- বইয়ের নামঃ নীরক্ত করবী
- লেখকের নামঃ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অন্ধের সমাজে একা
রাস্তার দুইধারে আজ সারিবদ্ধ দাঁড়িয়েছে অন্ধ সেনাদল;
আমি চক্ষুষ্মান হেঁটে যাই
প্রধান সড়ক। দেখি, বল্লমের ধাতু
রোদ্দুরের প্রেম পায়, বন্দুকের কুঁদার উপরে
কেটে বসে কঠিন আঙুল।
যে-কোনো মুহূর্তে ঘোর মারামারি হতে পারে, তবু
অস্ত্রগুলি উল্টানো রয়েছে আপাতত।
পরস্পরের দিকে পিঠ দিয়ে সকলে এখন
সম্মান রচনা করে। আমি দেখি,
অযুত নিযুত অন্ধ সারিবদ্ধ দাঁড়িয়েছে রাস্তার উপরে।
আমি চক্ষুষ্মান হেঁটে যাই।
আমি সেনাপতি। আমি সৈন্য-পরিদর্শনে এসেছি।
কিন্তু তার সেনাপতি, কাহাকে সমরে নেব, কিছুই জানি না।
আমি শুধু দেখতে পাই, দশ লক্ষ যোদ্ধার সভায়
কাহারও কপালে অক্ষিতারকার শোভা নেই;
কপালে গভীর দুই গর্ত নিয়ে সবাই দাম্ভিক দাঁড়িয়েছে।
আমি একা দেখতে পাই, আমি একা দেখতে পাই, আমি
দশ লক্ষ যুযুধান অন্ধের সভায় আজ একা।
অথচ অন্ধের দেশে একা চক্ষুষ্মান হওয়া খুব ভয়াবহ।
প্রধান সড়কে তাই সৈন্য-পরিদর্শনের কালে
বারবার চমকে উঠি। মনে হয়,
অন্ধের সমাজে একা চক্ষুষ্মান হবার অধিক
বিড়ম্বনা কিছু নেই, কখনও ছিল না।
রাস্তার দুই ধারে আজ সারিবদ্ধ দাঁড়িয়েছে যুদ্ধে সমুৎসুক
অন্ধ সেনাদল।
আমি হেঁটে যাই। আমি হেঁটে যেতে-যেতে
গুরুবন্ধনার ছলে দেখে যাই, বল্লমের ধাতু
রোদ্দুরে হতেছে সেঁকা, বন্দুকের কুঁদার উপরে
কেটে বসে কঠিন আঙুল।
আপাতত রণাঙ্গন নিস্তব্ধ যদিও,
আমি তবু বুঝতে পারি, নিকুম্ভিলা যজ্ঞের আগুনে
সর্বত্র ভীষণ ধুমধাড়াক্কার উদ্যোগ চলেছে।
আমি সেনাপতি। আমি প্রধান সড়ড়ে হেঁটে যাই।
অথচ কখন যুদ্ধ শুরু হবে, কার যুদ্ধ, কিছুই জানি না।
কাহাকে সমরে নেব, কিছুই জানি না!
(আমি কার সেনাপতি, আমি কার সেনাপতি) আমি
অন্ধের সমাজে একা চক্ষুষ্মান হবার বিপদ
টের পেতে-পেতে আজ গুরুবন্দনার ছলে ভাবি,
এবার পালানো ভাল দৌড়িয়ে। নতুবা
যদি ভীমরবে সেই বিস্ফোরণ ঘটে যায়, তবে–
যেহেতু নিদানকালে চক্ষুলজ্জা ভয়াবহ, তাই–
নিজের চক্ষুকে হয়তো নিজেরই নখরাঘাতে উপড়ে ফেলে দিয়ে
অন্ধের সমাজে আজ মিশে যেতে হবে।
উপাসনার সায়াহ্নে
ভীষণ প্রাসাদ জ্বলে, যেন চিরকাল জ্বলে সায়াহ্নবেলায়।
অলিন্দ, ঝরোকা, শ্বেতমর্মরের সমস্ত নির্মাণ
জ্বলে ওঠে। আগুনের সুন্দর খেলায়
দাউদাউ জ্বলে হর্ম্য, প্রমোদ-নিকুঞ্জ। কিংবা সাধের তরণী
অনিচ্ছাসত্ত্বেও যেন অন্যপথে ধীরে আগুয়ান
হতে গিয়ে অগ্নিবয়লয়ের দিকে ঘুরে যায়।
মুহূর্তে মাস্তুলে, পালে, পাটাতনে প্রচণ্ড হলুদ
জ্বলে ওঠে।
সাধের তরণী জ্বলে, যেন চিরকাল জ্বলে সায়াহ্নবেলায়।
জানি না কখনও কেউ এমন জ্বলেছে কি না সায়াহ্নবেলায়।
যেমন প্রাসাদ জ্বলে, অলিন্দ, ঝরোকা কিংবা শ্বেতমর্মরের
বিবিধ নির্মাণ। যথা সহসা দাউদাউ
প্রমোদ-নিকুঞ্জ, ঝাউ-বীথিকা, হ্রদের জল, জলের উপরে
সাধের তরণীখানি জ্বলে ওঠে।
যেমন কুটির কিংবা অট্টালিকা কিছুকাল চিত্রের মতন স্থির থেকে তারপর
অগ্নিবলয়ের দিকে চলে যায়।
যেমন পর্বত পশু সহসা সুন্দর হয় বাহিরে ও ঘরে।
যেমন সমস্ত-কিছু জ্বলে, চিরকাল জ্বলে সায়াহ্নবেলায়।
একটাই মোমবাতি
একটাই মোমবাতি, তুমি তাকে কেন দু’দিকে জ্বেলেছ?
খুব অহঙ্কারী হলে তবেই এমন কাণ্ড করা যায়।
তুমি এত অহঙ্কারী কেন?
চোখে চোখ রাখতে গেলে অন্য দিকে চেয়ে থাকো,
হাতে হাত রাখলে গেলে ঠেলে দাও,
হাতের আমলকী-মালা হঠাৎ টান মেরে তুমি ফেলে দাও,
অথচ তারপরে এত শান্ত স্বরে কথা বলো, যেন
কিছুই হয়নি, যেন
যা কিছু যেমন ছিল, ঠিক তেমনি আছে।
খুব অহঙ্কারী হলে তবেই এমন কাণ্ড করা যায়।
অথচ এমন কাণ্ড করবার এখনই কোনো দরকার ছিল না।
অন্য কিছু না থাক, তোমার
স্মৃতি ছিল; স্মৃতির ভিতরে
ভুবন-ভাসানো একটা নদী ছিল; তুমি
নদীর ভিতরে ফের ডুবে গিয়ে কয়েকটা বছর
অনায়াসে কাটাতে পারতে। কিন্তু কাটালে না;
এখনই দপ করে তুমি জ্বলে উঠলে ব্রাউজের হলুদে।
খুব অহঙ্কারী হলে তবেই এমন কাণ্ড করা যায়।
তুমি এত অহঙ্কারী কেন?
একটি মোমবাতি, তবু অহঙ্কারে তাকে তুমি দু’দিকে জ্বেলেছ।
জলে নামবার আগে
সকলে মিলিত হয়ে যেতে চাই আজ
পৃথিবীর মিশকালো ঘরে।
গিয়ে স্থিত হতে চাই, কাঠের জাহাজ
যেমন সুস্থির হয় জলের জঠরে।
কেননা আলোয় যারা করে চলাচল,
ডাঙায় তাদের কাছে বিশ বাঁও জল।
যেন সব ভুলে যাই, কোন্খান থেকে
কত দূরে কোথায় এলাম।
আলোকিত দেবতার মুখ যায় বেঁকে,
প্রেমিক জানে না তার প্রেমিকার নাম।
জীবনে কোথাও ছিল এত বড় দহ,
জানত না মানুষের বাপ-পিতামহ।
অথচ আকাশ নীল। ফুলের প্রণয়
হাওয়ায় সলিলে ওই ভাসে।
ছোঁবার সাহস নেই, যেন খুব ভয়
শিরদাঁড়া বেয়ে উঠে আসে।
যদিও সবাই জানে, খুঁজতে গেলেই
দেখা যাবে, কারও আজ শিরদাঁড়া নেই।
ফলত সবাই যেন যেতে চাই আজ
পৃথিবীর মিশকালো ঘরে।
সবাই লুকোতে চাই; কাঁকড়া কি মাছ
যেমন লুকিয়ে থাকে জলের জঠরে।
এদিকে ডাঙায় যারা করে চলাচল,
ডাঙাই তাদের কাছে বিশ বাঁও জল।
জিম করবেটের চব্বিশ ঘণ্টা
সারাটা দিন ছায়া পড়ে।
যত দূরে যেখানে যাই,
পাহাড় ভাঙি, তাঁবু ওঠাই–
ছায়া পড়ে।
দৃশ্য অনেক, নেবার পাত্র
পৃথিবীতে একটা মাত্র–
ছায়া পড়ে।
সারা সকাল, সারা দুপুর,
সারা বিকেল, সারাটা রাত
মনের মধ্যে হলুদ-কালো চতুর একটা ছায়া পড়ে।
সারাটা দিন ছায়া পড়ে।
এই যে বসি, এই যে উঠি,
থেকে-থেকে বাইরে ছুটি–
ছায় পড়ে।
পিছন-পিছন ঘুরেছি যার,
সেই নিয়েছে পিছু আমার–
ছায়া পড়ে।
সারা সকাল, সারা দুপুর,
সারা বিকেল, সারাটা রাত
মনের মধ্যে হলুদ-কালো চতুর একটা ছায়া পড়ে।
সারাটা দিন ছায়া পড়ে।
সকল কাজে, সকল কথায়,
জলেস্থলে তরুলতায়–
ছায়া পড়ে।
এখন আমি বুঝব কিসে
শিকার কিংবা শিকারি সে–
ছায়া পড়ে।
সারা সকাল, সারা দুপুর,
সারা বিকেল, সারাটা রাত
মনের মধ্যে হলুদ-কালো চতুর একটা ছায়া পড়ে।