বাতাসি
“বাতাসি ! বাতাসি !”—লোকটা ভয়ংকর চেঁচাতে চেঁচাতে
গুমটির পিছন দিকে ছুটে গেল ।
ধাবিত ট্রেনের থেকে এই দৃশ্য চকিতে দেখলুম ।
কে বাতাসি ? জোয়ান লোকটা অত ভয়ংকরভাবে
তাকে ডাকে কেন ? কেন
হাওয়ার ভিতরে বাবরি-চুল উড়িয়ে
পাগলের মতো
“বাতাসি ! বাতাসি !” ব’লে ছুটে যায় ?
টুকরো টুকরো কথাগুলি ইদানিং যেন বড় বেশি—
গোঁয়ার মাছির মতো
জ্বালাচ্ছে । কে যেন কাকে বাসের ভিতরে
বলেছিল, “ভাবতে হবে না,
এবারে দুদ্দাড় করে হেমাঙ্গ ভীষণভাবে উঠে যাবে, দেখে নিস” ।
কে হেমাঙ্গ ? কে জানে, এখন
সত্যিই দুদ্দাড় ক’রে কোথাও উঠে যাচ্ছে কিনা ।
কিংবা সেই ছেলেটা, যে ট্রাম-স্টপে দাঁড়িয়ে পাশের
মেয়েটিকে অদ্ভুত কঠিন স্বরে বলেছিল,
“চুপ করো, না হলে আমি
সেই রকম শাস্তি দেব আবার—” কে জানে
“সেইরকম” মানে কি রকম । আমি ভেবে যাচ্ছি,
ক্রমাগত ভেবে যাচ্ছি, তবু—
গল্পের সবটা যেন নাগালে পাচ্ছি না ।
গল্পের সবটা আমি পাব না নাগালে ।
শুধু শুনে যাব । শুধু এখানে ওখানে,
জনারণ্যে, বাতাসের ভিতরে, হাটেমাঠে,
অথবা ফুটপাথে, কিংবা ট্রেনের জানলায়
টুকরো টুকরো কথা শুনবো, শুধু শুনে যাব । আর
হঠাত্ কখনো কোনো ভুতুড়ে দুপুরে
কানে বাজাবে “বাতাসি ! বাতাসি !”
রাজপথে কিছুক্ষণ
দেখুন মশায়,
অনেকক্ষণ ধরে আপনি ঘুরঘুর করছেন,
কিন্তু আর নয়, এখন আপনার সরে পড়াই ভাল।
এই আমি থেকে হলফ করে বলছি,
কলকাতা থেকে কৈম্বাটুর অব্দি একটা
প্যাসেঞ্জার বাস-সারভিস খুলবার সত্যিই খুব দরকার আছে কি না,
তা আমি জানি না।
আপনার যদি মনে হয়, আছে,
তা হলে বেশ তো, যান,
যেখানে-যেখানে সিন্নি দেবার, দিয়ে,
জায়গামতন ইনফ্লুয়েনস খাটিয়ে
লাইসেন্স পারমিট ইত্যাদি সব জোগাড় করুন,
যাঁকে যাঁকে ধরতে হয়, ধরুন,
আমাকে আর জ্বালাবেন না। আমি
নেহাতই একজন ছাপোষা লোক,
টাইমের ভাত খেয়ে আপিস যাই,
অবসর-টবসর পেলে ছোট মেয়েটাকে নামতা শেখাই,
কৈম্বাটুর যে কোথায়,
মাদ্রাজে না পাঞ্জাবে, তা-ই আমি জানি না।
আপাতত তাড়াতাড়ি
শ্যামবাজারে যাওয়া দরকার, ভাগ্যবলে যদি একটা
শাট্ল-বাস পাই,
তা হলেই আমি আজকের মতন ধন্য হতে পারি।
দেখুন মহাশয়,
সেই থেকে আপনি আমার সঙ্গে সেঁটে আছেন।
কিন্তু আর নয়, এখন আপনার সরে পড়াই ভাল। আপনি
বিশ্বাস করুন চাই না-করুন,
দুই হাতের পাতা উল্টে দিয়ে এই আমি
শেষবারের মতো জানালুম, কেন
কৃষ্ণমাচারী গেলেন এবং
শচীন চৌধুরী এলেন,
তার বিন্দুবিসর্গও আমি জানি না।
আমি একজন ধিনিকেষ্ট,
কলম পিষতে বড়বাজারে যাই,
পিষি,
সাবান কিংবা তরল আলতার শিশি
কিনে বাড়ি ফিরি, গিন্নি
কলঘরে ঢুকলে বাচ্চা সামলাই।
আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করা না-করা সমান,
ভোটারদের আল্জিভ না-দেখিয়ে যাঁরা বক্তৃতা দিতে পারেন না
আপনি বরং তাঁদের কাছে যান।
আমার এখন তাড়াতাড়ি
শ্যামবাজারে যেতে হবে। সঙ্গে যদি আসতে চান, আসুন,
লজ্জা-টজ্জা না-করে একটু শব্দ করে কাসুন,
তা হলেই আপনার বাসভাড়াটা চুকিয়ে দিতে পারি।
সভাকক্ষ থেকে কিছু দূরে
কী করলে হাততালি মেলে, বিলক্ষণ জানি;
কিন্তু আমি হাততালির জন্য কোনোদিন
প্রলুব্ধ হব না।
তোমার চারদিকে বহু কিঙ্কর জুটেছে, মহারানি।
ইঙ্গিত করলেই তারা ক্রিরিরিং
ঘড়িতে বাজিয়ে ঘণ্টি অদ্ভুত উল্লাসে গান গায়!
আমিও দু-একটা গান জানি,
কিন্তু আমি কোরাসের ভিতরে যাব না।
মহারানি,
যেমন জেনেছি, ঠিক সেইরকম উচ্চারণে বাজাব তোমাকে।
তুমি সিংহাসনে খুব চমৎকার ভঙ্গিতে বসেছ।
দেখাচ্ছ ধবল গ্রীবা, বুকের খানিক;
ধরেছ সুমিষ্ট ইচ্ছা চক্ষুর তারায়,
বাঁ হাতে রেখেছ থুতনি, ডান হাতে
খোঁপা থেকে দু-একটা নির্মল জুঁই খুঁটে নিচ্ছ,
ছুড়ে দিচ্ছ সভার ভিতরে।
কিন্তু, মহারানি, আমি তোমাকে আর-একটু বেশি জানি।
ইঙ্গিত করলেই তার ক্রিরিরিং
ঘড়িতে ঘণ্টির তাল বাজাতে পারি না।
বাজিয়ে দেখেছি, তবু বুকের ভিতরে বহু জমিজমা
অন্ধকার থাকে।
সভাকক্ষ থেকে তাই কিছু দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছি।
মহারানি,
অন্তত একদিন তুমি অনুমতি দাও,
যেমন জেনেছি, ঠিক সেইরকম উচ্চারণে বাজাব তোমাকে।
সাংকেতিক তারবার্তা
সারাদিন আলোর তরঙ্গ থেকে ধ্বনি জাগে :
দূরে যাও।
সারারাত্রি অন্ধকার কানে-কানে মন্ত্র দেয় :
দূরে যাও!
বাল্যবয়সের বন্ধু, পরবর্তী জীবনে তোমরা
কে কোথায়
কর্মসূত্রে জড়িয়ে রয়েছ, আমি খবর রাখি না।
কেউ কি অনেক দূরে রয়ে গেলে?
কৈশোর-দিন্র সঙ্গী, তোমরা কেউ কি
দূর-ভুবনের মৃত্তিকায়
সংসার পেতেছ, তবু
কৈশোর-দিনের কথা ভুলতে পারোনি?
কিংবা যারা প্রথম-যৌবনে কাছে এসেছিলে,
তারাই কেউ কি
অজ্ঞাত বিদেশে আজ অবেলায়
পর্বতচূড়ায় উঠে অকস্মাৎ পূর্বাস্য হয়েছ?
তোমরা কেউ কি
উন্মাদের মতো ঢিল ছুঁড়ে যাচ্ছ স্মৃতির অতলে?
আলোর অক্লান্ত ধ্বনি প্রাণে বাজে : দূরে যাও।
কেন বাজে?
অন্ধকার কানে-কানে মন্ত্র দেয় : দূরে যাও।
কেন দেয়?
অন্য জীবনের মধ্যে ডুব দিয়ে তবুও কেউ কি
পরিপূর্ণ ডুবতে পারোনি?
কেউ কি নিঃসঙ্গ দূর দ্বীপ থেকে উদ্ধার চাইছ?
বুঝতে পারি, স্মরণ করছ কেউ রাত্রিদিন।
বুঝতে পারি, নিরুপায় সংকেত পাঠাচ্ছ কেউ
আলোর তরঙ্গে, অন্ধকারে।