নিজের কাছে প্রতিশ্রুতি
বলেছিলে, দেবেই দেবে।
আজ না হোক তো কাল, না হোক তো পরশু দেবে।
আলোর পাখি এনে দেবে!
তবে কেন এখন তোমার এই অবস্থা?
কথা রাখো, উঠে দাঁড়াও,
আবার দীর্ঘ বাহু বাড়াও আলোর দিকে।
আকন্দ ফুল মুখে রেখে ধুলোর মধ্যে শুয়ে আছ,
এই কি তোমার কথা রাখা?
আমি তোমার দুই জানুতে নতুন শক্তি ঢেলে দিলাম,
আবার তুমি উঠে দাঁড়াও।
আমি তোমার ওষ্ঠ থেকে শুষে নিলাম সমস্ত বিষ,
আবার তুমি বাহু বাড়াও আলোর দিকে।
রাখো তোমার প্রতিশ্রুতি।
যে-দিকে চাই, দৃশ্যগুলি এখন একটু ঝাপসা দেখায়;
জানলা তবু খোলা রাখি।
যে-দিকে যাই, নদীর রেখা একটু-একটু পিছিয়ে যায়।
বুঝতে পারি, অন্তরিক্ষে জলে-স্থলে
পাকিয়ে উঠছে একটা-কোনো ষড়যন্ত্র।
বুঝতে পারি, কেউ উচাটন-মন্ত্র পড়ছে কোনোখানে।
তাই আগুনের জিহ্বা এখন লাফ দিয়ে ছোঁয় আকাশটাকে।
একটা-কিছু ব্যাপার চলছে তলে-তলে,
তাই বাড়িঘর খাঁখাঁ শূন্য, শুকিয়ে যাচ্ছে তরুলতা।
বুঝতে পারি ক্রমেই এখন পায়ের তলায়
বসে যাচ্ছে আল্গা মাটি,
ধসে যাচ্ছে রাস্তা-জমি শহরে আর মফস্বলে।
তাই বলে কি ধুলোর মধ্যে শয্যা নেব?
বন্ধ করব চক্ষু আমার?
এখন আরও বেশিরকম টান্-বাঁধনে দাঁড়িয়ে থাকি।
দৃষ্টি ঝাপসা, তবুও জানি, চোখের সামনে
আজ না হোক তো কাল, না হোক তো পরশু আবার
ফুটে উঠবে আলোর পাখি।
বলেছিলে, দেবেই দেবে।
যেমন করেই পারো, তুমি আলোর পাখি এনে দেবে।
তবে কেন ধুলোর মধ্যে শুয়ে আছ?
আবার তুমি উঠে দাঁড়াও।
তবে কেন আনন্দ ফুল মুখে তোমার?
আবার দীর্ঘ বাহু বাড়াও আলোর দিকে।
আজ না হোক তো কাল, না হোক তো পরশু তুমি
পাখিটাকে ধরে আনবে, কথা ছিল।
এই কি তোমার কথা রাখা?
উঠে দাঁড়াও, রাখো তোমার প্রতিশ্রুতি।
নিজের কাছে স্বীকারোক্তি
আমি পাহাড় থেকে পড়তে পড়তে
তোমাকে ধরে বেঁচে রয়েছি, কবিতা।
আমি পাতালে ডুবে মরতে মরতে
তোমাকে ধরে আবার ভেসে উঠেছি।
আমি রাজ্যজয় করে এসেও
তোমার কাছে নত হয়েছি, কবিতা।
আমি হাজার দরজা ভালবেসেও
তোমার বন্ধ দুয়ারে মাথা কুটেছি।
কখনও এর, কখনও ওর দখলে
গিয়েও ফিরি তোমারই টানে, কবিতা।
আমাকে নাকি ভীষণ জানে সকলে,
তোমার থেকে বেশি কে জানে, কবিতা?
আমি ভিড়ের মধ্যে ঘুরে বেড়াই,
গোপন রাখি সকল শোক, কবিতা।
আমি শ্মশানে ফুল ঘটাব, তাই
তোমার বুকে চেয়েছি ঢেউ রটাতে।
আমি সকল সুখ মিথ্যে মানি,
তোমার সুখ পূর্ণ হোক, কবিতা।
আমি নিজের চোখ উপড়ে আনি,
তোমাকে দিই, তোমার চোখ ফোটাতে।
তুমি তৃপ্ত হও, পূর্ণ হও,
জ্বালো ভূলোক, জ্বালো দ্যুলোক, কবিতা।
পূর্ব গোলার্ধের ট্রেন
মাঝ-রাত্রে ঘুম ভেঙে যায়।
হঠাৎ ধড়মড় করে উঠে বসি।
মনে হয়,
ঘণ্টা পড়ে গেছে, ট্রেন আসতে আর দেরি নেই।
অথচ বিছানাপত্র, তোরঙ্গ, জলের কুঁজো–সব কিছু
ছত্রখান হয়ে আছে।
আমি দ্রুত হাতে ওয়েটিং রুমের সেই ছড়ানো সংসার
গুছিয়ে তুলতে থাকি।
বাইরে হুলুস্থুলু চলছে, ইনজিনের শানটিং, লোহার-
চাকাওয়ালা গাড়ি ছুটছে, হাজার পায়ের শব্দ,
আলো ছায়া আলো ছায়া
উন্মাদের মতন কে যেন
তারই মধ্যে
পরিত্রাহি ডেকে যাচ্ছে : কুলি, কুলি, এই দিকে, এ-দিকে।
মাঝ-রাত্রে ঘুম ভেঙে যায়।
হঠাৎ ধড়মড় করে উঠে বসি, চারদিকে তাকিয়ে
কিচ্ছুই বুঝি না।
আমি কেন ওয়েটিং রুমের মধ্যে, প্রাচ্যের সুন্দরী ভীরু বালিকার মতো,
সংসার গুছিয়ে তুলছি মধ্য-রাতে?
আমি কেন ছিটকিয়ে-ছড়িয়ে-যাওয়া পুঁতিগুলি
খুঁটে তুলছি।
আমি কি কোথাও যাব? কোনোখানে যাব?
আমি কি ট্রেনের জন্য প্রতীক্ষায় থাকতে থাকতে
ঘুমিয়ে পড়েছি?
ইদানীং এই রকম ঘটছে। ইদানীং
শব্দে-শব্দে তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। মধ্যরাতে
টুপটাপ শিশির ঝরলে চমলে উঠি; মনে হয়,
দেড় কাঠা উঠোন, তার স্বত্ব নিয়ে
স্বর্গে-মর্তে ঘোরতর সংঘাত চলেছে।
অন্ধকারে
বৃষ্টির ঝর্ঝর শুনলে মনে হয়,
দুদিকে পাহাড়, তার হৃৎপ্রদেশে
আচম্বিতে ট্রেনের চাকার শব্দ বেজে উঠল।
অথচ কোথায় ট্রেন, উদ্ধারের-সম্ভাবনাহীন
যাত্রীদের বুকে নিয়ে কোনখানে চলেছে, আমি
কিচ্ছুই বুঝি না–
সূর্যকে পিছনে রেখে
পূর্ব গোলার্ধের থেকে পশ্চিম গোলার্ধে কোন্ নরকের দিকে।
প্রতীকী সংলাপ
দিনমান তো বৃথাই গেল, এখন আমার যুদ্ধ;
এখন আমার অস্ত্রসজ্জা সব কিছুর বিরুদ্ধে।”
বলেই তিনি হাত বাড়িয়ে নিলেন পদ্মফুল।
এটা কেমন যুদ্ধ? সাদা পদ্মফুলের কান্তি
যে-বস্তুটার প্রতীক, সেটা নিতান্তই যে শান্তি!”
দ্বিতীয় জন তন্মুহূর্তে ধরিয়ে দিলেন ভুল।
“তবে বৃথাই বর্ম আঁটো, সাজাও চতুরঙ্গ,
এখন আমি সন্ধি করব ঈশ্বরের সঙ্গে।”
বলেই তিনি পদ্ম ফেলে গোপাল তুলে নিলেন।
“এটা কেমন সন্ধি? জানে সবাই জগৎ সুদ্ধ
গোলাপ ঝরায় রক্তধারা, গোলাপ মানেই যুদ্ধ।”
দ্বিতীয় জন পুনশ্চ তাঁর ভুল ধরিয়ে দিলেন।
আমরা দেখছি খেলায় মত্ত প্রতীকী উদ্ভ্রান্তি।
রৌদ্রে ভাসে চবুতরা, ছায়ায় ভাসে খিলেন।
ভুল ঠিকানায় ঘুরে বেড়ায় যুদ্ধ এবং শান্তি।
প্রবাস-চিত্র
যেখানে পা ফেলবি, তোর মনে হবে, বিদেশে আছিস।
এই তোর ভাগ্যলিপি।
গাছপালা অচেনা লাগবে, রাস্তাঘাট
অন্যতর বিন্যাসে ছড়ানো,
সদরে সমস্ত রাত কড়া নাড়বি, তবু
বাড়িগুলি নিদ্রার গভীর থেকে বেরিয়ে আসবে না।
এই তোর ভাগ্যলিপি।
সকলে বলবে না কথা; যারা বলবে,
তারা পর্যটন বিভাগের কর্মী মাত্র,
যে-কোনো টুরিস্ট্কে তারা দুটি-চারটি ধোপদুরস্ত কথা
উপহার দিয়ে থাকে,
তার জন্যে মাসান্তে মাইনে পায়।
এই তোর ভাগ্যলিপি।
যেখানি যাবি, তোর মনে হবে, এইমাত্র উড়োজাহাজের
পেটের ভিতর থেকে ভিন্ন-কোনো ভূমির উপরে
নেমে এসেছিস।
এই তোর ভাগ্যলিপি।
কাপড় সরিয়ে কেউ বুকের রহস্য দেখবে না।