- বইয়ের নামঃ নক্ষত্র জয়ের জন্য
- লেখকের নামঃ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অমানুষ
শিম্পাঞ্জি, তোমাকে আজ বড় বেশি বিমর্ষ দেখলুম
চিড়িয়াখানায়। তুমি ঝিলের কিনারে।
দারুণ দুঃখিতভাবে বসে ছিলে। তুমি
একবারও উঠলে না এসে লোহার দোলনায়;
চাঁপাকলা, বাদাম, কাবলি-ছোলা–সবকিছু
উপেক্ষিত ছড়ানো রইল। তুমি ফিরেও দেখলে না।
দুঃখী মানুষের মতো হাঁটুর ভিতরে মাথা গুঁজে
ঝিলের কিনারে শুধু বসে রইলে একা।
শিম্পাঞ্জি, তোমাকে কেন এত বেশি বিমর্ষ দেখলুম?
কী দুঃখ তোমার? তুমি মানুষের মতো
হতে গিয়ে লক্ষ-লক্ষ বছরের সিঁড়ি
ভেঙে এসেছিলে, তুমি মাত্রই কয়েকটা সিঁড়ি টপকাবার ভুলে
মানুষ হওনি। এই দুঃখে তুমি ঝিলের কিনারে
বসে ছিলে নাকি?
শিম্পাঞ্জি, তোমাকে আজ বড় বেশি দুঃখিত দেখলুম।
প্রায় হয়েছিলে, তবু সম্পূর্ণ মানুষ
হওনি, হয়তো সেই দুঃখে তুমি আজ
দোলনায় উঠলে না; তুমি ছেলেবুড়ো দর্শক মজিয়ে
অর্ধমানবের মতো নানাবিধ কায়দা দেখালে না।
হয়তো দেখনি তুমি, কিংবা দেখেছিলে,
দর্শকেরা পুরোপুরি বাঁদুরে কায়দায়
তোমাকে টিট্কিরি দিয়ে বাঘের খাঁচার দিকে চলে গেল।
কবিতা কল্পনালতা
ভালবাসলে শান্তি হয়, কিন্তু আমি কাকে আজ ভালবাসতে পারি?
কবিতাকে? কবিতার অর্থ কী? কবিতা
বলতে কি এখনও আমি কল্পনালতার ছবি দেখে যাব?
যে-ছবি সকলে দেখে, যে-ছবি দেখবার জন্যে অনেকে এখনও,
এখনও অর্থাৎ এই উনিশ শো পঁয়ষট্টি সনে
হরেক অদ্ভুত কর্মে সারা দিন আঙুল বাঁকিয়ে তবু বসে থাকে
অচিরে কুয়াশা কাটবে এই নাবালক প্রতীক্ষায়?
আমিও কি বসে থাকব? আমিও কি একবার বুঝব না
কুয়াশার অন্তরালে অন্য কোনো মূর্তি নেই?
এই অবয়বহীন ধবধবে দৃশ্যের আড়ালে
অন্য কোনো দৃশ্য নেই?
থাকলেও দ্বিতীয় এক কুয়াশার দৃশ্য পড়ে আছে,
জেনে কি একেই আমি কবিতার সম্মান দেব না?
কবিতা মানে কি আজও কল্পনালতায় কিছু কুসুম ফোটানো?
কবিতা মানে এই কুয়াশার ভিতরে একবার
বাঘ সিংহ হায়েনা ইত্যাদি
পশুর দাঁতের শক্তি বুঝে নেওয়া নয়?
স্পষ্ট কথাটাকে আজ অন্তত একবার খুব স্পষ্ট করে বলে দেওয়া ভাল।
অন্তত একবার আজ বলা ভাল,
যা-কিছু সামনে দেখছি, ধোঁয়া বা পাহাড় কিংবা পরস্পর-আলাপনিরত
ক্ষিপ্র পশু–
হয়তো এ ছাড়া কোন দৃশ্য নেই।
বলা ভাল,
কল্পনালতায় ফুল কুয়াশা কাটলেও কেউ দেখতে পাবে না
কেননা কুয়াশা আজ প্রত্যেকের মগজে ঢুকেছে। তাই
কবিতাকে ভালবেসে, ক্রমাগত ভালবেসে-বেসে
তোমাকে আমাকে আজ অন্তত একবার
ভিতরে-বাহিরে ব্যাপ্ত এই অন্তহীন কুয়াশায়
আলাপে-উৎসুক ধূর্ত বাঘের খাঁচার মধ্যে হেঁটে যেতে হবে।
কিচেন গারডেন
ফুটেছ গোলাপ তুমি কলকাতার কিচেন গারডেনে।
বিলক্ষণ অন্যায় করেছ। তুমি জানো,
এখন খাদ্যের খুব অনটন।
এখন চিচিঙ্গে, লাউ, ঢ্যাঁড়শের উদ্দেশে ধাবিত
জনতাকে ফেরানো যাবে না।
অন্য দিকে।
বাড়ির হাতায়, শীর্ষে, বারান্দায়, ঝুলন্ত কারনিসে
যেখানে যেটুকু ফালতু জায়গা ছিল–
ইনচি-সেণ্টিমিটারের চৌখুপি বিন্যাসে সব বুঝে নিয়ে
এখন সবাই
বাতিল কড়াই, গামলা, কাঠের বারকোষে
পালং, বরবটি, শিম, ধানিলঙ্কা
ইত্যাদি বসিয়ে যাচ্ছে।
তারই মধ্যে নিঃশব্দে দিয়েছ তুড়ি, ফুটেছ গোলাপ।
অন্যায় করেছ।
“আরেব্বাস, কত বড় গোলাপ ফুটেছে!”
কে যেন উদ্ভ্রান্ত স্বরে বলেছিল; কিন্তু তার ভোটার জোটেনি।
জনতা হুড়মুড় করে প্রাইভেট বাসের
বাম্পারে দাঁড়িয়ে গিয়ে হুলুধ্বনি দিয়ে উঠল : গোলদিঘি চলো হে।
শুধুই গোলদিঘি বলে কথা নেই। উত্তরে দক্ষিণে
সমস্ত কলকাতা
জুড়ে আজ চমৎকার সবজির বাগান
জমে উঠছে।
শুধুই গোলাপ বলে কথা নেই। সমস্ত ফুলের
বোঁটাসুদ্ধ খেয়ে ফেলছে চ্যাপলিনি তামাসা।
সবাই টোমাটো, উচ্ছে, ধুঁদুলের মধ্যে ডুবে গিয়ে
মনে মনে
অঙ্ক কষছে, কোথায় কতটা জমি এক লপ্তে চষে ফেলা যায়–
গঙ্গার জেটিতে, ডকে, নির্বাচনী মিটিঙে, সন্ধ্যার
ময়দানে অথবা শতবার্ষিকী ভবনে।
কেন যাওয়া, কেন আসা
অন্ধকারের মধ্যে জ্বলে ভালবাসা,
পাখিটা সব বুঝতে পারে।
কেন যাওয়া, গিয়েও কেন ফিরে আসা,
নিষেধ কেন চার দুয়ারে।
এবং কেন ফোটাও আলোর পরিভাষা
খাঁচার মধ্যে, অন্ধকারে।
পাখি জানে, ঘরের বাইরে নদী পাহাড়
লুঠ করে নেয় সকল সোনা,
দূরের দর্জি মেঘে বসায় রূপালি পাড়;
দূরে তোমার সায় ছিল না।
কিন্তু এই যে চাবির গোছা, এও তো তোমার
মস্ত বড় বিড়ম্বনা।
পাখিটা সব বুঝতে পারে, চালাক পাখি
তাই আসে ফের খাঁচার ধারে।
আমিও তেমনি রঙ্গমঞ্চে ঘুরতে থাকি
স্বর্গেমর্তে বারে-বারে।
দূরে গিয়েও সেইমতো হাত বাড়িয়ে রাখি
বুকের মধ্যে, অন্ধকারে।
তার চেয়ে
সকলকে জ্বালিয়ে কোনো লাভ নেই।
তার চেয়ে বরং
আজন্ম যেমন জ্বলছ ধিকিধিকি, একা
দিনরাত্রি
তেমনি করে জ্বলতে থাকো,
জ্বলতে-জ্বলতে ক্ষয়ে যেতে থাকো,
দিনরাত্রি
অর্থাৎ মুখের
কশ বেয়ে যতদিন রক্ত না গড়ায়।
একদিন মুখের কশ বেয়ে
রক্ত ঠিক গড়িয়ে পড়বে।
ততদিন তুমি কী করবে?
পালিয়ে-পালিয়ে ফিরবে নাকি?
পালিয়ে-পালিয়ে কোনো লাভ নেই।
তার চেয়ে বরং
আজন্ম যেমন আছ, একা
পৃথিবীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে
দিনরাত্রি
তেমনি করে জ্বলতে থাকো,
জ্বলতে-জ্বলতে ক্ষয়ে যেতে থাকো,
দিনরাত্রি
অর্থাৎ নিয়তি
যতদিন ঘোমটা না সরায়।
নিয়তির ঘোমটা একদিন
হঠাৎ সরবে।
সরে গেলে তুমি কী করবে?
মুখে রক্ত, চোখে অন্ধকার
নিয়ে তাকে বলবে নাকি “আর যে না-জ্বলি”?
না না, তা বোলো না।
তার চেয়ে বরং
বোলো, “আমি দ্বিতীয় কাউকে
না-জ্বালিয়ে একা-একা জ্বলতে পেরেছি,
সে-ই ভাল;
আগুনে হাত রেখে তবু বলতে চেয়েছি,
‘সবকিছু সুন্দর’–
সে-ই ভাল।”
বোলো যে, এ ছাড়া কিছু বলবার ছিল না।