Site icon BnBoi.Com

কলকাতার যীশু – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

কলকাতার যীশু - নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

ঈশ্বর! ঈশ্বর!

ঈশ্বরের সঙ্গে আমি বিবাদ করিনি।
তবুও ঈশ্বর
হঠাৎ আমাকে ছেড়ে কোথায় গেলেন?
অন্ধকার ঘর।
আমি সেই ঘরের জানলায়
মুখ রেখে
দেখতে পাই, সমস্তা আকাশে লাল আভা,
নিঃসঙ্গ পথিক দূর দিগন্তের দিকে চলেছেন।
অস্ফুট গলায় বলে উঠি :
ঈশ্বর! ঈশ্বর!

কলকাতার যিশু

লালবাতির নিষেধ ছিল না,
তবুও ঝড়ের বেগে ধাবমান কলকাতা শহর
অতর্কিতে থেমে গেল;
ভয়ঙ্করভাবে টাল সামলে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল
ট্যাক্সি ও প্রাইভেট, টেমপো, বাঘমার্কা ডবল-ডেকার।
‘গেল গেল’ আর্তনাদে রাস্তার দুদিক থেকে যারা
ছুটে এসেছিল—
ঝাঁকামুটে, ফিরিওয়ালা, দোকানি ও খরিদ্দার—
এখন তারাও যেন স্থির চিত্রটির মতো শিল্পীর ইজেলে
লগ্ন হয়ে আছে।
স্তব্ধ হয়ে সবাই দেখছে,
টালমাটাল পায়ে
রাস্তার এক-পার থেকে অন্য পারে হেঁটে চলে যায়
সম্পূর্ণ উলঙ্গ এক শিশু।

খানিক আগেই বৃষ্টি হয়ে গেছে চৌরঙ্গিপাড়ায়।
এখন রোদ্দুর ফের অতিদীর্ঘ বল্লমের মতো
মেঘের হৃৎপিণ্ড ফুঁড়ে
নেমে আসছে;
মায়াবী আলোয় ভাসছে কলকাতা শহর।

স্টেটবাসের জানালায় মুখ রেখে
একবার আকাশ দেখি, একবার তোমাকে।
ভিখারি-মায়ের শিশু,
কলকাতার যিশু,
সমস্ত ট্রাফিক তুমি মন্ত্রবলে থামিয়ে দিয়েছ।
জনতার আর্তনাদ, অসহিষ্ণু ড্রাইভারের দাঁতের ঘষটানি,
কিছুতে ভ্রুক্ষেপ নেই;
দু’দিকে উদ্যত মৃত্যু, তুমি তার মাঝখান দিয়ে
টলতে টলতে হেঁটে যাও।
যেন মূর্ত মানবতা, সদ্য হাঁটতে শেখার আনন্দে
সমগ্র বিশ্বকে তুমি পেয়ে চাও
হাতের মুঠোয়। যেন তাই
টাল্‌মাটাল পায়ে তুমি
পৃথিবীর এক-কিনার থেকে অন্য-কিনারে চলেছ।

কাঁচের বাসন ভাঙে

কাঁচের বাসন ভাঙে চতুর্দিকে–ঝন্‌ঝন্‌ ঝন্‌ঝন্‌!
মাথার ভিতরে সেই শব্দ শুনি,
রক্তের ভিতরে শব্দ বহে যায়।
আলো নেই ঘরে।
এইমাত্র কাছে ছিলে, অকস্মাৎ গিয়েছ কোথায়,
আমি কিছু বুঝতে পারি না।
শুধু শুনি,
চতুর্দিকে শব্দ বাজে ঝন্‌ঝন্‌ ঝন্‌ঝন্‌;
শুধু দেখি,
পেয়ালা পিরিচ
ভয়ার্ত পাখির মতো ছুটে যায় জ্যোৎস্নার ভিতরে।

 চতুর্থ সন্তান

দুটি কিংবা তিনটি বাচ্চা, ব্যস!
সভ্যতার সায়ংকালীন এই স্লোগানের অর্থ বুঝে নিয়ে,
চতুর্থ সন্তান, তুমি ঘরের ভিতরে
দেওয়ালের দিকে মুখ রেখে
গুম হয়ে বসে আছ।
ক্রোধে, নাকি দুঃখে, নাকি অবজ্ঞায়?
আয়ত চক্ষুর মধ্যে কখনও বিদ্যুত-জ্বালা খেলে যায়,
কখনও মেঘের ছায়া নেমে আসে।
তোমার বিরুদ্ধে আজ জোটবদ্ধ সমস্ত সংসার,
তবুও চেয়েছ তুমি তাকে,
যে তোমাকে চায়।

কে তোমাকে চায়?
পথে-পথে নিষেধাজ্ঞা, দিকে দিকে নিরুদ্ধ দুয়ার।
অবাঞ্ছিত ফল,
অসতর্ক মুহূর্তের ভ্রান্তির ফসল,
চতুর্থ সন্তান, তুমি কার?

দুটি কিংবা তিনটি বাচ্চা, ব্যস!
অপমানে বিকৃত মুখের রেখা, সভ্যতার চতুর্থ সন্তান,
হঠাৎ কখন তুমি ঘর থেকে উন্মাদের মতো
রাজপথে
বেরিয়ে এসেছ,
বন্দুক তুলেছ ওই বিদ্রুপের দিকে
জনতা ও যানবাহন থেমে যায়, প্রতিষ্ঠানগুলি
আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে।
হয়তো বুঝেছে তারা,
আসন্ন দিনের যুদ্ধে তুমিই তাদের
সব থেকে ক্ষমাহীন প্রতিদ্বন্দ্বী;
হয়তো জেনেছে,
যে-পৃথিবী তোমাকে চায়নি,
তুমিও অক্লেশে তাকে ঘাড়ে ধরে জাহান্নমে ঠেলে দিতে পারো।

তখনও দূরে

রাস্তা পেরোলেই বাড়ি
কিন্তু বাড়ি তখনও অনেক দূর।
বাবা তাঁর কাজের টেবিলে মগ্ন, এ-ঘরের থেকে অন্য ঘরে
দিদির চঞ্চল ছায়া সরে যায়,
রেলিঙে মায়ের নীল শাড়ি।
দৃশ্যগুলি একে-একে ভেসে উঠছে চোখের উপরে।
যেন সব হাতের মুঠোয়। চতুর্দিকে
শব্দ, গন্ধ, রঙের ফোয়ারা,
ফুল, লতা, অগ্নিবর্ণ পাখির পালক,
ফুটপাথের ঝক্‌ঝকে রোদ্দুর,
অর্থাৎ যা-কিছু এই ভুবনের বৃন্তে ফুটে আছে,
যা দিয়ে কবি ও শিল্পী বানিয়ে তোলেন গান, ভালবাসা,
তাকেই ব্যাকুল হাতে তুলে নিয়ে
কে তুই, নিতান্ত শিশু, বাড়িতে ফিরবার তীব্র তাড়নায়
ছুটে যাস?

রাস্তা বেরোলেই বাড়ি,
কিন্তু বাড়ি তখনও অনেক দূর।

দেশ দেখাচ্ছ অন্ধকারে

দেশ দেখাচ্ছ অন্ধকারে :
এই যে নদী, ওই অরণ্য, ওইটে পাহাড়,
এবং ওইটে মরুভূমি।
দেশ দেখাচ্ছ অন্ধকারের মধ্যে তুমি,
বার করেছ নতুন খেলা।
শহর-গঞ্জ-খেত-খামারে
ঘুমিয়ে আছে দেশটা যখন, রাত্রিবেলা
খুলেছ মানচিত্রখানি।
এইখানে ধান, চায়ের বাগান, এবং দূরে ওইখানেতে
কাপাস-তুলো, কফি, তামাক।
দম-লাগানো কলের মতন হাজার কথা শুনিয়ে যাচ্ছ।
গুরুমশাই,
অন্ধকারের মধ্যে তুমি দেশ দেখাচ্ছ।

কিন্তু আমরা দেশ দেখি না অন্ধকারে।
নৈশ বিদ্যালয়ের থেকে চুপি চুপি
পালিয়ে আসি জলের ধারে।
ঘাসের পরে চিত হয়ে শুই, আকাশে নক্ষত্র শুনি,
ছলাত-ছলাত ঢেউয়ের টানা শব্দ শুনি।
মাথার মধ্যে পাক খেয়ে যায় টুকরো-টুকরো হাজার ছবি;
উঠোন জুড়ে আলপনা, আল-পথের পাশে
হিজল গাছে সবুজ গোটা,
পুণ্যি-পুকুর, মাঘমণ্ডল, টিনের চলে হিমের ফোঁটা।
একটু-একটু বাতাস দিচ্ছে, বাতাস আনছে ফুলের গন্ধ;
তার মানে তো আর-কিছু নয়,
ছেলেবেলার শিউলি গাছে
এই আঁধারেও ফুলের দারুন সমারোহ।
গুরুমশাই,
অন্ধকারে কে দেখাবে মানচিত্রখানা?
মাথার মধ্যে দৃশ্য নানা,
স্মৃতির মধ্যে অজস্র ফুল,
তার সুবাসেই দেশকে পাচ্ছি বুকের কাছে।

মধ্যরাতে, ঘুমন্ত শহরে

একবার…দু’বার…আমি তিনবার ভীষণ জোরে
তোমাকে ডেকেছি :
ইন্দিরা…ইন্দিরা…ইরা!
বৃদ্ধের শ্লেষ্মার বেগ সামলে নিয়ে উৎকর্ণ হলেন।
শিশুরা ঘুমের মধ্যে কেঁদে উঠল।
একতলায় দোতলায় তিনতলায়
অন্ধকারে তৎক্ষণাৎ খুলে গেল অসংখ্য জানাল।

কী ঘুম তোমার, তুমি বাড়িতে ডাকাত পড়লে তবু
ঘুমে অচেতন থাকতে পারো।
মধ্যরাতে পৃথিবীর তীব্রতম ডাক তাই দেওয়ালে-দেওয়ালে
প্রতিহত হতে-হতে
অর্থহীন হয়ে যায়।
যাকে ডাকা, সে আসে না,
অনর্থক অন্যেরা ঘরের থেকে ছুটে এসে বারান্দায়
ঝুঁকে পড়ে!

একবার…দু’বার…আমি তিনবার ভীষণ জোরে
তোমাকে ডেকেছি।
কিন্তু তার পরে আর প্রতীক্ষা করিনি।
মধ্যরাতে, ঘুমন্ত শহরে
সবাইকে চমকে দিয়ে ফিরে -যেতে-যেতে আমি
দেখতে পাই,
সারি-সারি
বাতিস্তম্ভ দাঁড়িয়ে রয়েছে, কিন্তু পৌর ধর্মঘটের কারণে
তাতে আলো নেই।
রাস্তার দু’ধারে ছিটকে সরে যাচ্ছে আলিঙ্গনে বদ্ধ নরনারী।

যুদ্ধক্ষেত্রে, এখনও সহজে

রাত্রিগুলি
এখনও বাঘের মতো পিছু নেয়।
স্বপ্নগুলি
এখনও নিদ্রার পিঠে
ছুরি মেরে হেসে ওঠে।
সতর্ক ছিলাম, তবু কিছু চিহ্ন এখানে-ওখানে
থেকে গিয়েছিল।
পেট্রোলে-ভিজোনো ন্যাকড়া, দেশলাই-কাঠির টুকরো, এইসব।
স্মৃতিগুলি
তারই সূত্র ধ’রে হাওয়া শুঁকতে শুঁকতে, পা টিপে পা টিপে
হেঁটে আসে; জানালার ধারে
নিঃশব্দে দাঁড়ায়।
অতর্কিতে
হো-হো শব্দ ছুটে যায় অন্ধকার থেকে অন্ধকারে।

অর্থাৎ এখনও মরে যাইনি। এখনও
বাতাসে পুরনো যুদ্ধ
হানা দেয়।
রাত্রিগুলো স্বপ্নগুলি স্মৃতিগুলি
চতুর্দিকে
কখনও জন্তুর মতো, কখনও দস্যুর মতো, কখনও-বা
ধূর্ত জেদি গোয়েন্দার মতো
ঘোরাফেরা করে।
অন্ধকারে
চোরাগোপ্তা আক্রমণ চলতে থাকে সারাক্ষণ।

অর্থাৎ এখনও আমি বেঁচে আছি। চৌমাথায়
যে-লোকটা দাঁড়িয়ে আছে, বস্তুত আমাকে
সে-ও চোখে-চোখে রাখছে, আমি তার
হিংসার ভিতরে বেঁচে আছি।
এবং তুমিও আছ, নারী।
আছ, তাই অসংখ্য শত্রুর সঙ্গে এই যুদ্ধ
কিছুটা তাৎপর্য পায়,
তাই যুদ্ধক্ষেত্রে আমি এখনও সহজে
বিদ্রুপের ভঙ্গিতে হাওয়ায়
শব্দ করে চুম্বন রটিয়ে দিতে পারি।

সন্ধ্যাসংগীত, প্রভাতসংগীত

বায়বীয় চাঁদকে নিয়ে
এই আমাদের
শেষ কবিতা, আমরা লিখে দিলাম।
সময়ের জল-বিভাজিকায় দাঁড়িয়ে
মানবীয় চাঁদকে নিয়ে
এই আমাকের প্রথম কবিতা।

দূর থেকে চাঁদকে যাঁরা ভালবেসেছিলেন,
সেই প্রাচীন কবি ও প্রেমিকদের আমরা
শেষ বংশধর।
কাছে গিয়ে তার মৃত ওষ্ঠে যাঁরা
প্রেমে-প্রত্যয়ে-সংশয়ে-দ্বিধায় আলোড়িত
জীবনের
তপ্ত চুম্বন স্থাপনা করবেন,
সেই নবীন কবি ও প্রেমিকদের আমরা
জনক।
আমরাই সমাপ্তি, এবং
আমরাই সূচনা।

একটা কল্প শেষ হয়ে গেল
(কল্প, ন কল্পনা?),
আজ
আর-এক কল্পের আরম্ভ।
একটা ভাবনা শেষ হয়ে গেল,
আজ
আর-এক ভাবনার শুরু।

দুই কল্পের, দুই ভাবনার, একই জন্মে দুই জীবনের
মিলন-লগ্নে আমরা দাঁড়িয়ে আছি।
দেখতে পাচ্ছি–
আমাদের একদিকে আজ পূর্ণগ্রাস,
অন্যদিকে পূর্ণিমা

Exit mobile version