মধ্যরাতে, ঘুমন্ত শহরে
একবার…দু’বার…আমি তিনবার ভীষণ জোরে
তোমাকে ডেকেছি :
ইন্দিরা…ইন্দিরা…ইরা!
বৃদ্ধের শ্লেষ্মার বেগ সামলে নিয়ে উৎকর্ণ হলেন।
শিশুরা ঘুমের মধ্যে কেঁদে উঠল।
একতলায় দোতলায় তিনতলায়
অন্ধকারে তৎক্ষণাৎ খুলে গেল অসংখ্য জানাল।
কী ঘুম তোমার, তুমি বাড়িতে ডাকাত পড়লে তবু
ঘুমে অচেতন থাকতে পারো।
মধ্যরাতে পৃথিবীর তীব্রতম ডাক তাই দেওয়ালে-দেওয়ালে
প্রতিহত হতে-হতে
অর্থহীন হয়ে যায়।
যাকে ডাকা, সে আসে না,
অনর্থক অন্যেরা ঘরের থেকে ছুটে এসে বারান্দায়
ঝুঁকে পড়ে!
একবার…দু’বার…আমি তিনবার ভীষণ জোরে
তোমাকে ডেকেছি।
কিন্তু তার পরে আর প্রতীক্ষা করিনি।
মধ্যরাতে, ঘুমন্ত শহরে
সবাইকে চমকে দিয়ে ফিরে -যেতে-যেতে আমি
দেখতে পাই,
সারি-সারি
বাতিস্তম্ভ দাঁড়িয়ে রয়েছে, কিন্তু পৌর ধর্মঘটের কারণে
তাতে আলো নেই।
রাস্তার দু’ধারে ছিটকে সরে যাচ্ছে আলিঙ্গনে বদ্ধ নরনারী।
যুদ্ধক্ষেত্রে, এখনও সহজে
রাত্রিগুলি
এখনও বাঘের মতো পিছু নেয়।
স্বপ্নগুলি
এখনও নিদ্রার পিঠে
ছুরি মেরে হেসে ওঠে।
সতর্ক ছিলাম, তবু কিছু চিহ্ন এখানে-ওখানে
থেকে গিয়েছিল।
পেট্রোলে-ভিজোনো ন্যাকড়া, দেশলাই-কাঠির টুকরো, এইসব।
স্মৃতিগুলি
তারই সূত্র ধ’রে হাওয়া শুঁকতে শুঁকতে, পা টিপে পা টিপে
হেঁটে আসে; জানালার ধারে
নিঃশব্দে দাঁড়ায়।
অতর্কিতে
হো-হো শব্দ ছুটে যায় অন্ধকার থেকে অন্ধকারে।
অর্থাৎ এখনও মরে যাইনি। এখনও
বাতাসে পুরনো যুদ্ধ
হানা দেয়।
রাত্রিগুলো স্বপ্নগুলি স্মৃতিগুলি
চতুর্দিকে
কখনও জন্তুর মতো, কখনও দস্যুর মতো, কখনও-বা
ধূর্ত জেদি গোয়েন্দার মতো
ঘোরাফেরা করে।
অন্ধকারে
চোরাগোপ্তা আক্রমণ চলতে থাকে সারাক্ষণ।
অর্থাৎ এখনও আমি বেঁচে আছি। চৌমাথায়
যে-লোকটা দাঁড়িয়ে আছে, বস্তুত আমাকে
সে-ও চোখে-চোখে রাখছে, আমি তার
হিংসার ভিতরে বেঁচে আছি।
এবং তুমিও আছ, নারী।
আছ, তাই অসংখ্য শত্রুর সঙ্গে এই যুদ্ধ
কিছুটা তাৎপর্য পায়,
তাই যুদ্ধক্ষেত্রে আমি এখনও সহজে
বিদ্রুপের ভঙ্গিতে হাওয়ায়
শব্দ করে চুম্বন রটিয়ে দিতে পারি।
সন্ধ্যাসংগীত, প্রভাতসংগীত
বায়বীয় চাঁদকে নিয়ে
এই আমাদের
শেষ কবিতা, আমরা লিখে দিলাম।
সময়ের জল-বিভাজিকায় দাঁড়িয়ে
মানবীয় চাঁদকে নিয়ে
এই আমাকের প্রথম কবিতা।
দূর থেকে চাঁদকে যাঁরা ভালবেসেছিলেন,
সেই প্রাচীন কবি ও প্রেমিকদের আমরা
শেষ বংশধর।
কাছে গিয়ে তার মৃত ওষ্ঠে যাঁরা
প্রেমে-প্রত্যয়ে-সংশয়ে-দ্বিধায় আলোড়িত
জীবনের
তপ্ত চুম্বন স্থাপনা করবেন,
সেই নবীন কবি ও প্রেমিকদের আমরা
জনক।
আমরাই সমাপ্তি, এবং
আমরাই সূচনা।
একটা কল্প শেষ হয়ে গেল
(কল্প, ন কল্পনা?),
আজ
আর-এক কল্পের আরম্ভ।
একটা ভাবনা শেষ হয়ে গেল,
আজ
আর-এক ভাবনার শুরু।
দুই কল্পের, দুই ভাবনার, একই জন্মে দুই জীবনের
মিলন-লগ্নে আমরা দাঁড়িয়ে আছি।
দেখতে পাচ্ছি–
আমাদের একদিকে আজ পূর্ণগ্রাস,
অন্যদিকে পূর্ণিমা