সহোদরা
না, সে নয়, অন্য কেউ এসেছিল; ঘুমো, তুই ঘুমো।
এখনো রয়েছে রাত্রি, রোদ্দুরে চুমো
লাগেনি শিশিরে। ওরে বোকা,
আকাশে ফোটেনি আলো, দরজায় এখনো তার টোকা
পড়েনি! টগর-বেল-গন্ধরাজ-জুঁই
সবাই ঘুমিয়ে আছে, তুই
জাগিসনে আর! তোর বরণডালার মালাগাছি
দে আমাকে, আমি জেগে আছি।
না রে মেয়ে, নারে বোকা মেয়ে,
আমি ঘুমোবো না। আমি নির্জন পথের দিকে চেয়ে
এমন জেগেছি কত রাত।
এমন অনেক ব্যথা-আকাঙ্ক্ষার দাঁত
ছিঁড়েছে আমাকে! তুই ঘুমো দেখি, শান্ত হ’য়ে ঘুমো।
শিশিরে লাগেনি তার চুমো,
বাতাসে ওঠেনি তার গান। ওরে বোকা,
এখনও রয়েছে রাত্রি, দরজায় পড়েনি তার টোকা ।
সান্ধ্য তামাশা
হা-রে হা-রে হা-রে, দ্যাখো, হা-রে,
কী জমাট সান্ধ্য তামাশায়
আকাশের পশ্চিম দুয়ারে
সূর্য তার ডুগডুগি বাজায়।
টকটকে আগুনে জ্বেলে দিয়ে
আকাশের শান্ত রাজধানী
শূন্যে ও কে দিয়েছে উড়িয়ে
রক্তরং সতরঞ্জখানি।
দ্যাখো রে পুঞ্জিত মেঘে-মেঘে
চিত্রিত অলিন্দে ঝরোকায়
রঙের সংহত ছোঁয়া লেগে
সারি বেঁধে ও কারা দাঁড়ায়।
হা-রে হা-রে হা-রে, দ্যাখো, হা-রে,
কী জমাট সান্ধ্য তামাশায়…
ও কারা কৌতুকে ঠোঁট চেওএ
সায়াহ্নের সংবৃত আবাগে
দ্যাখে ভেল্কিবাজের চাতুরি;
কী করে সে শূন্যে জাল বেয়ে
নিখিল সন্ধ্যায় করে চুরি
নানাবর্ণ মাছের সম্ভার।
দর্শকেরা রয়েছে তাকিয়ে,
তবু কিছু লজ্জা নেই তার।
অন্তিম তামাশা ছিল বাকি।
অকস্মাৎ চক্ষের নিমেষে
নিঃসঙ্গ বিহ্বল এক পাখি
বিদ্যুত-গতিতে ছুটে এসে
যেন মায়ামন্ত্রবলে প্রায়
ডুবেছে অথই লাল জলে।
গেল, গেল!–মেঘেরা দৌড়ায়
নিঃশব্দ ভীষণ কোলাহলে।
হা-রে হা-রে হা-রে, দ্যাখো, হা-রে,
কী জমাট সান্ধ্য তামাশায়
আকাশের পশ্চিম দুয়ারে
সূর্য তার ডুগডুগি বাজায়।
সোনালি বৃত্তে
একটুখানি কাছে এসেই দূরে যায়
নোয়ানো এই ডালের ‘পরে
একটু বসেই উড়ে যায়।
এই তো আমার বিকেলবেলার পাখি।
সোনালি এই আলোর বৃত্তে
থেমে থাকি,
অশথ গাছের কচি পাতায় হাওয়ার নৃত্যে
দৃষ্টি রাখি।
একটু থামি, একটু দাঁড়াই,
একটু ঘুরে আসি আবার।
কখন যে সেই দূরে যাবার
সময় হবে, জানি না তা।
রৌদ্রে ওড়ে পাখি, কাঁপে অশথগাছের কচি পাতা।
দুপুরবেলার দৃশ্য নদী হারিয়ে যায় বারে বারে
সন্ধ্যাবেলার অন্ধকারে।
তবু আবার
সময় আসে নদীর স্বপ্নে ফিরে যাবার।
নদীও যে পাখির মতোই, কাছের থেকে দূরে যায়,
মনের কাছে বাঁক নিয়ে সে ঘুরে যায়।
একটুখানি এগিয়ে তাই আলোর বৃত্তে
থেমে থাকি,
অশথখানি কচি পাতায় হাওয়ার নৃত্যে
দৃষ্টি রাখি।
হঠাৎ হাওয়া
হঠাৎ হাওয়া উঠেছে এই দুপুরে
আকাশী নীল শান্তি বুঝি ছিনিয়ে নিতে চায়।
মালোঠিগাঁও বিমূঢ়, হতবাক্।
মেঘের ক্রোধ গর্জে ওঠে ঝড়ের ডঙ্কায়।
এখনই এল ডাক।
মন্দাকিনী মিলায় তাল তরঙ্গের নূপুরে।
এ যেন হরধনুর টান ছিলাতে
হেনেছে কেউ প্রবল টংকার।
চিনের চোখ মীলিত। কার ভীষণ জটাজাল
আকাশে পড়ে ছড়িয়ে, শোনো বাতাসে বাজে তার
সঘন করতাল।
ত্রিলোক কোটিকণ্ঠে চায় গানের গলা মিলাতে।
এ যেন কোন্ শিল্পী তার খেয়ালে
উপুড় করে দিয়েছে কালো রঙ
আকাশময়। পাখিরা ত্রাসে কুলায়ে ফিরে যায়।
কে যেন তার ক্রোধের কশা দারুণ নির্মম
হানে হাওয়ার গায়ে।
অট্টহাসি ধ্বনিত তার গিরিগুহার দেয়ালে।
এবং, দ্যাখো, নিমেষে যেন কী করে
মিলিয়ে যায় খামার-ঘরবাড়ি,
মিলিয়ে যায় নিকট-দূর পর্বতের চূড়া।
খেতের কাজ গুছিয়ে মাঠ-চটিতে দেয় পাড়ি
ত্রস্ত গাঁওবুড়া।
বিদ্যুতের নাগিনী ধায় মেঘের কালো শিখরে।
হঠাৎ হাওয়া উঠেছে এই দুপুরে,
আকাশী নীল শান্তি যেন ছিনিয়ে নিয়ে যায়।
মালোঠিগাঁও বিমূঢ়, হতবাক্।
মেঘের ক্রোধ গর্জে ওঠে ঝড়ের ডঙ্কায়।
এসেছে তার ডাক।
মন্দাকিনী মিলায় তাল তরঙ্গের নূপুরে।
হলুদ আলোর কবিতা
দুয়ারে হলুদ পর্দা। পর্দার বাহিরে ধুধু মাঠ
আকাশে গৈরিক আলো জ্বলে।
পৃথিবী কাঞ্চনপ্রভ রৌদ্রের অনলে
শুদ্ধ হয়।
কারা যেন সংসারের মায়াবী কপাট
খুলে দিয়ে ঘাস, লতা, পাখির স্বভাবে
সানন্দ সুস্থির চিত্তে মিশে গেছে। শান্ত দশ দিক।
দুয়ারে হলুদ পর্দা। আকাশে গৈরিক
আলো কাঁপে। সারাদিন কাঁপে।
আকাশে গৈরিক আলো। হেমন্ত-দিনের মৃদু হাওয়া
কৌতুকে আঙুল রাখে ঘরের কপাটে,
জানালায়। পশ্চিমের মাঠে
মানুষের স্নিগ্ধ কণ্ঠ। কে জানে মানুষ আজও মেঘ
হতে গিয়ে স্বর্ণাভ মেঘের স্থির ছায়া
হয়ে যায় কি না। তার সমস্ত আবেগ
হয়তো সংহত হয় রোদ্দুরের হলুদ উত্তাপে।
আলো কাঁপে। সারাদিন কাঁপে।
হাতে ভীরু দীপ
হাতে ভীরু দীপ, পথে উন্মাদ হাওয়া,
ভ্রুকুটিকুটিল সহস্র ভয় মনে।
কেন ভয়? কেন এমন সঙ্গোপনে
পথে নেমে তোর বারে-বারে ফিরে চাওয়া?
এ কী ভয় তোর সকল সত্তা কাঁপায়?
আমি যে এসেছি, সে যেন জানতে না পায়।
দূরে হেলঙের পাহাড়, পাহাড়তলি
ছাড়িয়ে পিপলকোঠির চড়াই, আর
তারপর সাঁকো। বাঁয়ে গেলে গঙ্গার
ধারে সেই গ্রাম, অমৌঠি রঙ্কোলি।
সেইখানে যাব। সামনের শীতে যদি
পাওয়া যায় জমি ঢালু সিয়াসাঙে, তাই
চলেছি। এ ছাড়া, জানেন গঙ্গামাঈ,
কোনো আশা নেই। বরফের তাড়া খেয়ে
নির্জন পাকদণ্ডির পথ বেয়ে
নীচে নেমে যাই। কী ভয়ে আমাকে কাঁপায়–
জানে মানাগাঁও, জানে পাহাড়িয়া নদী।
আমি যে এসেছি, সে যেন জানতে না পায়।