মাটির হাতে
এ কোন্ যন্ত্রণা দিবসে, আর
এ কোন্ যন্ত্রণা রাতে;
আকাশী স্বপ্ন সে ছুঁয়েছে তার
মাটিতে গড়া দুই হাতে।
বোঝেনি, রাত্রির ঝোড়ো হাওয়ায়
যখন চলে মাতামাতি,
জ্বলতে নেই কোনো আকাঙ্ক্ষায়
জ্বালাতে নেই মোমবাতি।
ভেবেছে, সবখানে খোলা দুয়ার
দ্যাখেনি দেয়ালের লেখা;
এবং বোঝেনি যে বারান্দার
ধারেই তার সীমারেখা।
তবু সে গিয়েছিল বারান্দায়,
কাঁপেনি তবু তার বুক;
তবু সে মোমবাতি জ্বেলেছে, হায়,
দেখেছে আকাশের মুখ।
এখন যন্ত্রণা দিবসে, আর
এখন যন্ত্রণা রাতে।
আকাশী স্বপ্ন সে ছুঁয়েছে তার
মাটিতে গড়া দুই হাতে।
মাঠের সন্ধ্যা
অন্যমনে যেতে যেতে হঠাৎ যদি
মাঠের মধ্যে দাঁড়াই,
হঠাৎ যদি তাকাই পিছন দিকে,
হয়তো দেখতে পাওয়া যাবে বিকেলবেলার নদীটিকে।
ও নদী, ও রহস্যময় নদী,
অন্ধকারে হারিয়ে যাসনে, একটু দাঁড়া;
এই যে একটু-একটু আলো, এই যে ছায়া ফিকে-ফিকে,
এরই মধ্যে দেখে নেব সন্ধ্যাবেলার প্রথম তারাটিকে।
ও তারা, ও রহস্যময় তারা,
একটু আলো জ্বালিয়ে ধর, দেখে রাখি
আকাশী কোন্ বিষণ্ণতা ছড়িয়ে যায় দিকে-দিকে,
দেখে রাখি অন্ধকারে উড়ন্ত ওই ক্লান্ত পাখিটিকে।
ও পাখি, ও রহস্যময় পাখি।
হারিয়ে গেল আকাশ-মাটি, কান্না পাওয়া
এ কী করুণ সন্ধ্যা! এ কোন্ হাওয়া লেগে
অন্ধকারে অদৃশ্য ওই নদীর দুঃখ হঠাৎ উঠল জেগে।
ও হাওয়া, ও রহস্যময় হাওয়া!
মৃত্যুর পরে
দু’ দণ্ড দাঁড়াই ঘাটে। এই স্থির শান্ত জলে তার
আয়াত দৃষ্টির মৌন রহস্য বিম্বিত হয় যদি।
দু’ দণ্ড দাঁড়াই এই আদি অন্ধকারে। বলি, ‘নদী,
কে তার ব্যর্থতাগুলি ক্ষিপ্ত হাতে নিয়েছে কুড়িয়ে
সন্ধ্যার আকাশ, অস্ত-সূর্য আর নিঃসঙ্গ হাওয়ার
বিষণ্ণ মর্মর থেকে, শীতের সন্ন্যাসী বনভূমি
থেকে? তুমি নাকি? তার আকাঙ্ক্ষার ক্লান্ত পথ দিয়ে
কে ফিরে এসেছে এই অপরূপ অন্ধকারে,–তুমি?’
দু’ দণ্ড দাঁড়াই ঘাটে। তরঙ্গের অস্ফুট কল্লোলে
কান পাতি। যদি তার কণ্ঠের আভাস পাওয়া যায়।
যদি এই মধ্যরাতে শীত-শীত সুন্দর হাওয়ায়
নদীর গভীরে তার কান্না জেগে ওঠে। হাত রাখি
জলের শরীরে। বলি, ‘নদী, তোর নয়নের কোলে
এত অন্ধকার কেন, তুই তার অশ্রুজল নাকি?’
মৌলিক নিষাদ
পিতামহ, আমি এক নিষ্ঠুর নদীর ঠিক পাশে
দাঁড়িয়ে রয়েছি। পিতামহ,
দাঁড়িয়ে রয়েছি, আর চেয়ে দেখছি রাত্রির আকাশে
ওঠেনি একটিও তারা আজ।
পিতামহ, আমি এক নিষ্ঠুর মৃত্যুর কাছাকাছি
নিয়েছি আশ্রয়। আমি ভিতরে বাহিরে
যেদিকে তাকাই, আমি স্বদেশে বিদেশে
যেখানে তাকাই–শুধু অন্ধকার, শুধু অন্ধকার।
পিতামহ, আমি এক নিষ্ঠুর সময়ে বেঁচে আছি।
এই এক আশ্চর্য সময়।
যখন আশ্চর্য বলে কোনো কিছু নেই।
যখন নদীতে জল আছে কি না-আছে
কেউ তা জানে না।
যখন পাহাড়ে মেঘ আছে কি না-আছে
কেউ তা জানে না।
পিতামহ, আমি এক আশ্চর্য সময়ে বেঁচে আছি।
যখন আকাশে আলো নেই,
যখন মাটিতে আলো নেই,
যখন সন্দেহ জাগে, যাবতীয় আলোকিত ইচ্ছার উপরে
রেখেছে নিষ্ঠুর হাত পৃথিবীর মৌলিক নিষাদ–ভয়।
পিতামহ, তোমার আকাশ
নীল–কতখানি নীল ছিল?
আমার আকাশ নীল নয়।
পিতামহ, তোমার হৃদয়
নীল–করখানি নীল ছিল?
আমার হৃদয় নীল নয়।
আকাশের, হৃদয়ের যাবতীয় বিখ্যাত নীলিমা
আপাতত কোনো-এক স্থির অন্ধকারে শুয়ে আছে।
পিতামহ, আমি সেই ভয়ের দরুণ অন্ধকারে
দাঁড়িয়ে রয়েছি! পিতামহ,
দাঁড়িয়ে রয়েছি, আর চেয়ে দেখেছি, রাত্রির আকাশে
ওঠেনি একটাও তারা আজ।
মনে হয়, আমি এক অমোঘ মৃত্যুর কাছাকাছি
নিয়েছি আশ্রয়। আমি ভিতরে বাহিরে
যেদিকে তাকাই, আমি স্বদেশে বিদেশে
যেখানে তাকাই–শুধু অন্ধকার, শুধু অন্ধকার
অন্ধকারে জেগে আছে মৌলিক নিষাদ–এই ভয়।
যেহেতু
আশা ছিল শান্তিতে থাকার,
আহা, ব্যর্থ হল সেই আশা,
যেহেতু মস্তিষ্কে ছিল তার
মস্ত একটা ভিমরুলের বাসা।
এবং সাদা যে কালো নয়,
কালো নয় নীল কিংবা লাল,
যেহেতু সে তাতেও সংশয়
লালন করেছে চিরকাল…
বন্ধুদের পরামর্শ শুনে
মীমাংসার বারিবিন্দুগুলি
অবিলম্বে চিন্তার আগুনে
ছিটোটে পারলেই তার খুলি
ঠাণ্ডা হয়ে আসত। সে যেহেতু
সাধ্য আর সাধনার সেতু
বেঁধে নিতে চায়নি, বারবার
পরাস্ত হয়েও প্রাণপণে
নৌকা খুলে দিয়েছিল তার
অনির্দিষ্ট লক্ষ্যের পিছনে…
এবং যেহেতু তার মনে
ইথে কোনো সন্দেহ ছিল না,
যা-কিছু ঝলসায় ক্ষণে-ক্ষণে,
সমস্তই নয় তার সোনা…
সুতরাং শান্তিতে থাকার,
আহা, ব্যর্থ হল সব আশা
মস্তিষ্কে অবশ্য ছিল তার
মস্ত একটা ভিমরুলের বাসা।
শিল্পীর ভূমিকা
আপনি তো জানেন, শুধু আপনিই জানেন, কী আনন্দে
এখনও মূর্খের শূন্য অট্টহাসি, নিন্দুকের ক্ষিপ্র
জিহ্বাকে সে তুচ্ছ করে নিতান্তই অনায়াসে; তীব্র
দুঃখের মুহূর্তে আজও কী পরম প্রত্যয়ের শান্তি
শিল্পীকে বাঁচিয়ে রাখে; সন্ধ্যামালতীর মৃদু গন্ধে
কেন তার স্বপ্ন হয়ে সমুদ্রের মতো নীলকান্তি;
উপরে যন্ত্রণা যার, অন্তরালে সুধা অতলান্ত।
আপনি তো জানেন, শুধু আপনিই জানেন, মায়ামঞ্চে
কেউ বা সম্রাট হয়, কেউ মন্ত্রী, কেউ মহামাত্য;
শিল্পীর ভূমিকা তার, সাময়িক সমস্ত দৌরাত্ম্য
দেখার ভূমিকা। তাতে দুঃখ নেই। কেননা, অনন্ত
কালের মৃদঙ্গ ওই বাজে তার মনের মালঞ্চে।
ত্রিকালী আনন্দ তার; নেই তার আদি, নেই অন্ত।