নিজের বাড়ি
ভাবতে ভাল লেগেছিল, এই ঘর, ওই শান্ত উঠোন,
এই খেত, ওই মস্ত খামার–
সবই আমার।
এবং আমি ইচ্ছে হলেই পারি
ইচ্ছেমতন জানলা-দরজা খুলতে।
ইচ্ছেমতন সাজিয়ে তুলতে
শান্ত সুখী একান্ত এই বাড়ি।
ভাবতে ভাল লেগেছিল, চেয়ার টেবিল,
আলমারিতে সাজানো বই, ঘোমটা-টানা নরম আলো,
ফুলদানে ফুল, রঙের বাটি,
আলনা জুড়ে কাপড়-জামার
সুবিন্যস্ত সমারোহ, সবই আমার।
এবং আমি ইচ্ছে হলেই পারি
দেয়ালে লাল হলুদ রঙের কাড়াকাড়ি
মুছে ফেলতে সাদার শান্ত টানে।
এই যে বাড়ি, এই তো আমার বাড়ি।
ভাবতে ভাল লেগেছিল, এই ঘর, ওই ঠাণ্ডা উঠোন,
এই খেত, ওই মস্ত খামার,
আলমারিতে সাজানো বই,
ফুলদানে ফুল, রঙের বাটি,
টবের গোলাপ, নরম আলো,
আলনা জুড়ে কাপড়-জামার
শৃঙ্খলিত সমারোহ, সবই আমার, সব-ই আমার।
ভাবতে ভাল লেগেছিল, কাউকে কিছু না জানিয়ে
হঠাৎ কোথাও চলে যাব।
ফিরে এসে আবার যেন দেখতে পারি,
যে-নদী বয় অন্ধকারে, তারই বুকের কাছে
বাড়িটা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।
ওই যে বাড়ি, ওই তো আমার বাড়ি।
নিতান্ত কাঙাল
নিতান্তই ক্লান্ত লোকটা শুধু
ছোট্ট একটা ঘরের কাঙাল।
দক্ষিণের জানলা দিয়ে ধুধু
অফুরন্ত মাঠ দেখবে। আর
পশ্চিমের জানলা দিয়ে লাল
সূর্য-ডোবা সন্ধ্যার বাহার।
নিতান্তই ক্লান্ত লোকটা। শুধু
ছোট্ট একটা ঘরের কাঙাল!
নিতান্তই ক্লান্ত লোকটা। তাই
মিষ্টি একটা মেয়ের কাঙ্গাল।
যে তাকে খুনসুটি করে প্রায়ই
রাত জাগাবে। বলবে, ‘কোন দিশি
লোক তুমি তা বোঝা শক্ত। কাল
আনতে হবে আলতা এক শিশি।’
নিতান্তই শান্ত লোকটা। তাই
মিষ্টি একটা মেয়ের কাঙ্গাল।
নিতান্তই ভ্রান্ত লোকটা। হায়,
অল্প-একটু সুখের কাঙাল।
রৌদ্রে, জলে, উদ্দাম হাওয়ায়
ঢের ঘুরেছে। বুঝল না এখনও
ইচ্ছার আগুনে খেয়ে জ্বাল
একটু-সুখে তৃপ্তি নেই কোনো!
নিতান্তই ভ্রান্ত লোকটা। হায়,
অল্প-একটু সুখের কাঙাল।
প্রিয়তমাসু
তুমি বলেছিলে ক্ষমা নেই, ক্ষমা নেই।
অথচ ক্ষমাই আছে।
প্রসন্ন হাতে কে ঢালে জীবন শীতের শীর্ণ গাছে।
অন্তরে তার কোনো ক্ষোভ জমা নেই।
তুমি বলেছিলে, তমিস্রা জয়ী হবে।
তমিস্রা জয়ী হলো না।
দিনের দেবতা ছিন্ন করেছে অমারাত্রির ছলনা;
ভরেছে হৃদয় শিশিরের সৌরভে।
তুমি বলেছিলে, বিচ্ছেদই শেষ কথা।
শেষ কথা কেউ জানে?
কথা যে ছড়িয়ে আছে হৃদয়ের সব গানে, সবখানে;
তারও পরে আছে বাঙময় নীরবতা।
এবং তুষার মৌলি পাহাড়ে কুয়াশা গিয়েছে টুটে,
এবং নীলাভ রৌদ্রকিরণে ঝরে প্রশান্ত ক্ষমা,
এবং পৃথিবী রৌদ্রকে ধরে প্রসন্ন করপুটে।
দ্যাখো, কোনোখানে কো্নো বিচ্ছেদ নেই।
আছে অনন্ত মিলনে অমেয় আনন্দ, প্রিয়তমা।
ফলতায় রবিবার
কেউ কি শহরে যাবে? কেউ যাবে? কেউই যাব না।
বরং ঘনিষ্ঠ এই সন্ধ্যার সুন্দর হাওয়া খাব,
বরং লুণ্ঠিত এই ঘাসে-ঘাসে আকণ্ঠ বেড়াব
আমি, অমিতাভ আর সিতাংশু।
সিতাংশু, এই ভাল,
শহরে ফিরব না। দ্যাখো, অমিতাভ, কতখানি সোনা
ডুবে গেল নদীর শরীরে। দ্যাখো, তরঙ্গের গায়ে
নৌকার লণ্ঠন থেকে আলো পড়ে, আলো কাঁপে, আলো
ভেঙে-ভেঙে যায়।
কেউ কি শহরে যাবে? কেউ যাবে? কেউই যাব না।
শহরে প্রচণ্ড ভিড়, অকারণ তুমিল চিৎকার,
লগ্ন নিয়নের বাতি। শহরে ফিরব না কেউ আর।
বরং চুপ করে দেখি, অন্ধকারে নদী কত কালো
হতে পারে, অপচয়ী সূর্য তার সবটুকু সোনা
কী করে ওড়ায়; দেখি মৃদুকণ্ঠ তরঙ্গমালায়
নৌকার লণ্ঠন থেকে আলো পড়ে, আলো কাঁপে, আলো
ভেঙে-ভেঙে যায়।
বারান্দা
‘এ-কন্যা উচ্ছিষ্ট, কোনো লোলচর্ম বৃদ্ধ লালসার
দ্বাবিংশ সন্ধ্যার প্রণয়িনী।
ধিক্, এরে ধিক্!’
বলে সেই সত্যসন্ধ নিষ্পাপ প্রেমিক
বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন।
সেখানে টগর জুঁই হাস্নুহানা রজনীগন্ধার
সহৃদয় সান্নিধ্যে এবং
সন্ধ্যার হাওয়ায় তাঁর ক্লিষ্ট স্নায়ুমন
শান্ত হয়ে এলে ফের অরিন্দম সেন
দু-দণ্ড তন্ময় বসে থেকে
পুনরায় নেই একই চিন্তার হাঁটুতে মাথা রেখে
নবতর সিদ্ধান্তে এলেন :
তা বলে কি প্রেম নেই? প্রেমে শান্তি নেই? আছে, আছে।
বিবৃতজঘনা এই কন্যাদের কাছে
সে-প্রেম যাবে না পাওয়া। কিংবা পাওয়া গেলেও বিস্তর
মূল্য দিতে হবে। আমি ততটা শাঁসালো
প্রেমিক যখন নেই, অনিবার্য এই পরাজয়ে
শোকার্ত হব না। অতঃপর
আমার আশ্রয় নেওয়া ভাল
মেঘ-নদী-বৃক্ষলতাপাতার প্রণয়ে।’
অপিচ পরম রঙ্গে টবের গোলাপে
মগ্ন হয়ে দেখা যায়, সে এক আশ্চর্য প্রণয়িনী!
ঘনিষ্ট, তবুও শান্ত। এবং পাপড়িতে তার কাঁপে
সেই একই অপার্থিব অমর্ত্য পিপাসা,
যাকে বলি প্রেম।
তাই সমস্ত প্রগল্ভ ছিনিমিনি
শেষ হয়ে গেলে সেই প্রেমিক আবারও বুঝি পারে
হৃদয়ে জ্বালিয়ে নিতে আর-এক প্রসন্ন ভালবাসা
বারান্দার এই মৌন বসন্তবাহারে।
বৃদ্ধের স্বভাবে
“এককালে আমিও খুব মাংস খেতে পারতুম, জানো হে;
দাঁত ছিল, মাংসে তাই আনন্দ পেতুম।
তোমার ঠানদিদি রোজ কব্জি-ডোবা বাটিতে, জানো হে,
না না, শুধু মাংস নয়, মাংস মাছ ইত্যাদি আমায়
(রান্নাঘর নিরামিষ, তাই রান্নাঘরের দাওয়ায়)
সাজিয়ে দিতেন। আমি চেটেপুটে নিত্যই খেতুম।
সে-সব দিনকাল ছিল আলাদা, জানো হে,
হজমের শক্তি ছিল, রাত্তিরে সুন্দর হত ঘুম।”
মুখ তুলে তাকিয়ে দেখি, রোগা ঢ্যাঙা বৃদ্ধ এক তার
পাতের উপরে দিব্য জমিয়েছে মাংসের পাহাড়।
যদিও খাচ্ছে না। শুধু মাংসল স্মৃতির তীব্র মোহে
ক্রমাগত বলে যাচ্ছে–‘জানো হে, জানো হে’!