জলের কল্লোলে
জলের কল্লোলে যেন কারও কান্না শোনা গেল,
অরণ্যের মর্মরে কারও দীর্ঘনিশ্বাস।
চকিত হয়ে ফিরে তাকাতেই দেখা গেল
নির্বান্ধব সেই বাবলা গাছটাকে।
আর আর তাকে গাছ বলে মনে হল না;
মনে হল,
সংসারের সমস্ত রহস্য জেনে নিয়ে
কেউ যেন জলের ধারে এসে দাঁড়িয়েছে।
ফলত, যা হয়,
অত্যন্ত বিব্রত বোধ করল সেই মানুষটি।
কেননা, জীবনের কাছে মার খেয়ে
প্রকৃতির কাছে সে তার দুঃখ জানাতে এসেছিল।
প্রকৃতি নিজেরই এত দুঃখ
সে তা জানত না।
জলের কল্লোলে যে কারও কান্না ধ্বনিত হতে পারে,
অরণ্যের মর্মরে কারও নিশ্বাস,
সে তা বোঝেনি।
এবং ভাবেনি যে নদীর ধারের বাবলা গাছটাকে আজ
বিষণ্ণ একটা মানুষের মত দেখাবে।
নদীকে সে তার দুঃখ জানাতে এসেছিল;
জানাল না।
সন্ধ্যার আগেই সে তার ঘরে ফিরে এল।
জুনের দুপুর
উপর থেকে নীচে তাকাও, দ্যাখো,
ছায়াছবির মতোই হঠাৎ
চোখের সামনে থেকে
এরোড্রমটা দৌড়ে পালায়
পৃথিবী যায় বেঁকে।
রইল পড়ে দশটা-পাঁচটা,
ঝাঁকড়া-মাথা মেপ্ল গাছটা,
চওড়া-ফিতে রাস্তাটা আর
নদীর নীলচে শাড়ি,
ফুলের বাগান, গির্জে, খামার,
ছক-কাটা ঘরবাড়ি।
উপর থেকে নীচে তাকাও, দ্যাখো,
লক্ষ লক্ষ টুকরো দৃশ্য
নতুন করে ভেঁজে
একটি অসীম রিক্ততাকে
তৈরি করল কে যে।
নোত্রদামের গির্জেটা আর
হোটেল, কাফে, মস্ত টাওয়ার
মিলিয়ে দিচ্ছে মেঘের শান্ত
হাল্কা নীলের তুলি।
মিলায় মিলায় পারির প্রান্ত-
রেখার দৃশ্যগুলি।
উপর থেকে নীচে তাকাও, দ্যাখো,
দৃশ্যহারা দীর্ঘ দুপুর
সমস্ত দিক ধুধু,
জুনের আকাশ আপন মনে
রৌদ্র পোহায় শুধু।
কোথায় ফাটছে আগুন-বোমা,
কোথায় কাইরো, কোথায় রোমা!
শূন্য মোছায় দেখার ভ্রান্তি
নিত্যদিনের চোখে।
বিশ্ববিহীনতার শান্তি অসীম ঊর্ধ্বলোকে।
তোমাকে বলেছিলাম
তোমাকে বলেছিলাম, যত দেরীই হোক,
আবার আমি ফিরে আসব।
ফিরে আসব তল-আঁধারি অশথগাছটাকে বাঁয়ে রেখে,
ঝালোডাঙার বিল পেরিয়ে,
হলুদ-ফুলের মাঠের উপর দিয়ে
আবার আমি ফিরে আসব।
আমি তোমাকে বলেছিলাম।
আমি তোমাকে বলেছিলাম, এই যাওয়াটা কিছু নয়,
আবার আমি ফিরে আসব।
ডগডগে লালের নেশায় আকাশটাকে মাতিয়ে দিয়ে
সূর্য যখন ডুবে যাবে,
নৌকার গলুইয়ে মাথা রেখে
নদীর ছল্ছল্ জলের শব্দ শুনতে-শুনতে
আবার আমি ফিরে আসব।
আমি তোমাকে বলেছিলাম।
আজও আমার ফেরা হয়নি।
রক্তের সেই আবেগ এখন স্তিমিত হয়ে এসেছে।
তবু যেন আবছা-আবছা মনে পড়ে,
আমি তোমাকে বলেছিলাম।
দৃশ্যের বাহিরে
সিতাংশু, আমাকে তুই যতো কিছু বলতে চাস, বল।
যতো কথা বলতে চাস, বল।
অথবা একটাও কথা বলিসনে, তুই
বলতে দে আমাকে তোর কথা।
সিতাংশু, আমি যে তোর সমস্ত কথাই জেনে গেছি।
আমি জেনে গেছি।
কী বলবি আমাকে তুই, সিতাংশু ? বলবি যে,
ঘরের ভিতরে তোর শান্তি নেই, তোর
শান্তি নেই, তোর
ঘরের ভিতরে বড়ো অন্ধকার, বড়ো
অন্ধকার, বড়ো
বেশি অন্ধকার তোর ঘরের ভিতরে।
(সিতাংশু, আমি যে তোর সমস্ত কথাই জেনে গেছি।
আমি জেনে গেছি।)
কী বলবি আমাকে তুই, সিতাংশু ? বলবি যে,
দৃশ্যের সংসার থেকে তুই
(সংসারের যাবতীয় অস্থির দৃশ্যের থেকে তুই)
স্থিরতর কোনো-এক দৃশ্যে যেতে গিয়ে
গিয়েছিস স্থির এক দৃশ্যহীনতায়।
অনন্ত রাত্রির ঠাণ্ডা নিদারুণ দৃশ্যহীনতায়।
দৃশ্যের বাহিরে তোর ঘরে।
জানিরে, সিতাংশু, তোর ঘরের চরিত্র আমি জানি।
ওখানে অনেক কষ্টে শোয়া চলে, কোনোক্রমে দাঁড়ানো চলে না।
ও-ঘরে জানালা নেই, আর
ও-ঘরে জানালা নেই, আর
মাথার দু’ইঞ্চি মাত্র উর্ধ্বে ছাত। মেঝে
স্যাঁতস্যাঁতে। দরোজা নেই। একটাও দরোজা নেই। তোর
চারদিকে কাঠের দেয়াল।
এবং দেয়ালে নেই ঈশ্বরের ছবি।
এবং দেয়ালে নেই শয়তানের ছবি।
(তা যদি থাকত, তবে ঈশ্বরের ছবির অভাব
ভুলে যাওয়া যেত।) নেই, তা-ও নেই তোর
নির্বিকার ঘরের ভিতরে।
না, আমি যাব না তোর ঘরের ভিতরে।
যাব না, সিতাংশু, আমি কিছুতে যাব না।
যেখানে ঈশ্বর নেই, যেখানে শয়তান নেই, কোনো-কিছু নেই,
প্রেম নেই, ঘৃণা নেই, সেখানে যাবো না।
যাব না, যেহেতু আমি মূর্তিহীন ঈশ্বরের থেকে
দৃশ্যমান শয়তানের মুখশ্রী এখনো ভালোবাসি।
না, আমি যাব না তোর ঘরের ভিতরে।
সিতাংশু, তুই-ই বা কেন গেলি ?
অস্থির দৃশ্যের থেকে কেন গেলি তুই
স্থির নির্বিকার ওই দৃশ্যহীনতায় ?
সিতাংশু, আমি যে তোর সমস্ত কথাই জেনে গেছি।
আমি জেনে গেছি।
দৃশ্যের ভিতর থেকে দৃশ্যের বাহিরে
প্রেম-ঘৃণা-রক্ত থেকে প্রেম-ঘৃণা-রক্তের বাহিরে
গিয়ে তোর শান্তি নেই, তোর
শান্তি নেই, তোর
ঘরের ভিতরে বড়ো অন্ধকার, বড়ো
অন্ধকার, বড়ো
বেশি অন্ধকার তোর ঘরের ভিতরে।
দেয়াল
চেনা আলোর বিন্দুগুলি
হারিয়ে গেল হঠাৎ–
এখন আমি অন্ধকারে, একা।
যতই রাত্রি দীর্ণ করি দারুণ আর্তরবে,
এই নীরন্ধ্র নিকষ কালোর কঠিন অবয়বে
যতই করি আঘাত,
মিলবে না আর, মিলবে না আর,
মিলবে না তার দেখা।
হারিয়ে গেল হঠাৎ আমার
আলোকলতা-মন,–
নেই, এখানে নেই;
হারিয়ে গেল প্রথম আলোর হঠাৎ-শিহরণ,–
নেই।
চার-দেয়ালে বন্ধ হয়ে চার দেয়ালের গাতে
যতই হানি আঘাত, আমার আর্ত আকাঙ্ক্ষায়
যতই মুক্তিলাভের চেষ্টা করি,
ততই কঠিন পরিহাসের রাত্রি নামে, আর
ততই ভয়ের উজান ঠেলে মরি।
চেনা আলোর বিন্দুগুলি
হারিয়ে গেল হঠাৎ–
এখন আমি অন্ধকারে, একা।
চারদিকে চার-দেয়াল, চোখের দৃষ্টি নিবে আসে,
শিউরে উঠি অন্ধকারের কঠিন পরিহাসে;
এই নীরন্ধ্র অন্ধকারে যতই হানি আঘাত,
আসবে না আর, আসবে না কেউ,
মিলবে না তার দেখা।
ভাঙো আমার দেয়াল, আমার দেয়াল।