- বইয়ের নামঃ অন্ধকার বারান্দা
- লেখকের নামঃ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অমলকান্তি
অমলকান্তি আমার বন্ধু,
ইস্কুলে আমরা একসঙ্গে পড়তাম।
রোজ দেরি করে ক্লাসে আসতো, পড়া পারত না,
শব্দরূপ জিজ্ঞেস করলে
এমন অবাক হয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকতো যে,
দেখে ভারী কষ্ট হত আমাদের।
আমরা কেউ মাষ্টার হতে চেয়েছিলাম, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি সে-সব কিছু হতে চায়নি।
সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল!
ক্ষান্তবর্ষণ কাক-ডাকা বিকেলের সেই লাজুক রোদ্দুর,
জাম আর জামরুলের পাতায়
যা নাকি অল্প-একটু হাসির মতন লেগে থাকে।
আমরা কেউ মাষ্টার হয়েছি, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।
সে এখন অন্ধকার একটা ছাপাখানায় কাজ করে।
মাঝে মধ্যে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে;
চা খায়, এটা-ওটা গল্প করে, তারপর বলে, “উঠি তাহলে।”
আমি ওকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।
আমাদের মধ্যে যে এখন মাষ্টারি করে,
অনায়াসে সে ডাক্তার হতে পারত,
যে ডাক্তার হতে চেয়েছিল,
উকিল হলে তার এমন কিছু ক্ষতি হত না।
অথচ, সকলেরই ইচ্ছেপূরণ হল, এক অমলকান্তি ছাড়া।
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।
সেই অমলকান্তি–রোদ্দুরের কথা ভাবতে-ভাবতে
ভাবতে-ভাবতে
যে একদিন রোদ্দুর হতে চেয়েছিল।
১৮ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৯৫
অল্প-একটু আকাশ
অতঃপর সে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল।
জুঁইয়ের গন্ধে বাতাস যেখানে মন্থর হয়ে আছে;
এবং রেলিংয়ে ভর দিয়ে,
সেখান থেকে অল্প-একটু আকাশ দেখা যায়।
আকাশ!
এতক্ষণে তার মনে পড়ল,
সারাটা সকাল, সারাটা বিকেল আর সন্ধ্যা
কাজের পাথরে মাথা ঠুকতে-ঠুকতে, মাথা ঠুকতে-ঠুকতে
মাথা ঠোকাই তার সার হয়েছে।
কোনো-কিছুই সে শুনতে পায়নি;
না একটা গান, না একটু হাসি।
এখন শুনবে।
কোনো-কিছুই সে দেখতে পায়নি;
আন একটা ফুল, না একটু আকাশ।
এখন দেখবে।
রুগ্ণ স্ত্রীকে মেজার-গ্লাসো-মাপা ওষুধ খাইয়ে,
কুঁচকে-যাওয়া বালিশটাকে গুছিয়ে রেখে,
ঘুমন্ত ছেলের ইজেরের দড়িটাকে আর-একটু আলগা করে দিয়ে,
সে তাই বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল।
আংটিটা
আংটিটা ফিরিয়ে দিও ভানুমতী, সমস্ত সকাল
দুপুর বিকেল তুমি হাতে পেয়েছিলে।
যদি মনে হয়ে থাকে, আকাশের বৃষ্টিধোয়া নীলে
দুঃখের শুশ্রূষা নেই, যদি
উন্মত্ত হাওয়ার মাঠে কিংশুকের লাল
পাপড়িও না পেরে থাকে রুগ্ণ বুকে সাহস জাগাতে,
অথবা সান্ত্বনা দিতে বৈকালের নদী,–
আংটিটা ফিরিয়ে দিও সন্ধ্যার সহিষ্ণু শান্ত হাতে।
আংটিটা ফিরিয়ে দিও, এ-আংটি যেহেতু তারই হাতে
মানায়, যে পায় খুঁজে পত্রালির ভিড়ে
ফুলের সুন্দর মুঘ, ঘনকৃষ্ণ মেঘের শরীরে
রৌদ্রের আলপনা। কোনো ক্ষতি
ফেরাতে পারে না তাকে তীব্রতম দুঃখের আঘাতে।
আংটিটা ফিরিয়ে দিও, তাতে দুঃখ নেই, ভানুমতী।
আবহমান
যা গিয়ে ওই উঠানে তোর দাঁড়া,
লাউমাচাটার পাশে।
ছোট্ট একটা ফুল দুলছে, ফুল দুলছে, ফুল
সন্ধ্যার বাতাসে।
কে এইখানে এসেছিল অনেক বছর আগে,
কেউ এইখানে ঘর বেঁধেছে নিবিড় অনুরাগে।
কে এইখানে হারিয়ে গিয়েও আবার ফিরে আসে,
এই মাটিকে এই হাওয়াকে আবার ভালবাসে।
ফুরয় না্ তার কিছুই ফুরয় না,
নটেগাছটা বুড়িয়ে ওঠে, কিন্তু মুড়য় না!
যা গিয়ে ওই উঠানে তোর দাঁড়া,
লাউমাচাটার পাশে।
ছোট্ট একটা ফুল দুলছে, ফুল দুলছে, ফুল,
সন্ধ্যার বাতাসে।
ফুরয় না তার যাওয়া এবং ফুরয় না তার আসা,
ফুরয় না সেই একগুঁয়েটার দুরন্ত পিপাসা।
সারাটা দিন আপনে মনে ঘাসের গন্ধ মাখে,
সারাটা রাত তারায়-তারায় স্বপ্ন এঁকে রাখে।
ফুরয় না, তার কিছুই ফুরয় না,
নাটেগাছটা বুড়িয়ে ওঠে, কিন্তু মুড়য় না।
যা গিয়ে ওই উঠানে তোর দাঁড়া,
লাউমাচাটার পাশে।
ছোট্ট একটা ফুল দুলছে, ফুল দুলছে, ফুল,
সন্ধ্যার বাতাসে।
নেভে না তার যন্ত্রণা যে, দুঃখ হয় না বাসী,
হারায় না তার বাগান থেকে কুন্দফুলের হাসি
তেমনি করেই সূর্য ওঠে, তেমনি করেই ছায়া
নামলে আবার ছুটে আসে সান্ধ্য নদীর হাওয়া
ফুরয় না, তার কিছুই ফুরয় না,
নাটেগাছটা বুড়িয়ে ওঠে, কিন্তু মুড়য় না।
যা গিয়ে ওই উঠানে তোর দাঁড়া,
লাউমাচাটার পাশে।
ছোট্ট একটা ফুল দুলছে, ফুল দুলছে, ফুল,
সন্ধ্যার বাতাসে।
উপলচারণ
না, আমাকে তুমি শুধু আনন্দ দিয়ো না,
বরং দুঃখ দাও।
না, আমাকে সুখশয্যায় টেনে নিয়ো না,
পথের রুক্ষতাও
সইতে পারব, যদি আশা দাও দু-হাতে।
ভেবেছিল, এই দুঃখ আমার ভোলাবে
আনন্দ দিয়ে; হায়,
প্রেম শত জ্বালা, সহস্র কাঁটা গোলাপে,
কে তাতে দুঃখ পায়,
যদি আশা জ্বলে মনের গোপন গুহাতে।
যে আমাকে চায় তন্দ্রার থেকে জাগাতে,
মোহ যে ভাঙাতে চায়
প্রবল পুরুষ আশার বিপুল আঘাতে,
কঠিন যন্ত্রণায়,
আমি তারই, তুমি দিয়ো না মমতা, গৃহ না!
হয়তো বুঝিনি, হয়তো বোঝাতে পারিনি,
তবে শুধু মনে হয়,
প্রেমের প্রকৃতি হয়তো উপচারিণী,
যদিচ অসংশয়।
না, আমাকে তুমি করুণা দিয়ো না, দিয়ো না।
চলন্ত ট্রেনের থেকে
চলন্ত ট্রেনের থেকে ধুধু মাঠ, ঘরবাড়ি এবং
গাছপালা, পুকুর, পাখি, করবীর ফুলন্ত শাখায়
প্রাণের উচ্ছ্বাস দেখে যতটুকু তৃপ্তি পাওয়া যায়,
সেইটুকুই পাওয়া। তার অতিরিক্ত কে দেবে তোমাকে।
দুই চক্ষু ভরে তবে দ্যাখো ওই সূর্যাস্তের রঙ
পশ্চিম আকাশে; দ্যাখো পুঞ্জিত মেঘের গাঢ় লাল
রক্ত-সমারোহ; দ্যাখো উম্মত্ত উল্লাসে ঝাঁকে-ঝাঁকে
সবুজ ভুট্টার খেতে উড্ডীন অসংখ্য হরিয়াল।
চলন্ত ট্রেনের থেকে ধুধু মাঠ, ঘরবাড়ি অথবা
ঘরোয়া স্টেশনে আঁকা চিত্রপটে করবীর ঝাড়,
গাছপালা, পুকুর, পাখি, গৃহস্থের সচ্ছল সংসার,
কর্মের আনন্দ দুঃখ দেখে নাও; আকাশের গায়ে
লগ্ন হয়ে আছে দ্যাখো প্রাণের প্রকাণ্ড লাল জবা।
সমস্ত পৃথিবী এসে দাঁড়িয়েছে ট্রেনের জানলায়।