- বইয়ের নামঃ নজরুল-গীতিকা
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
আমি তুরগ ভাবিয়া মোরগে চড়িনু
হিতে বিপরীত
কীর্তন
আমি তুরগ ভাবিয়া মোরগে চড়িনু
সে লইল মিয়াঁর ঘরে।
আমার কালি-মা ছাড়ায়ে কলেমা পড়ায়ে
বুঝি মুসলিম করে!
আঁখর : আমায় বুঝি মুসলিম করে গো!
শেষে আস্ত ধরিয়া গোস্ত খাওয়ায়ে –
মামদো করিবে গোরা গো!
আমার টিকি করি দূর রেখে দেবে নূর
জবাই করিবে পরে গো॥
আমি বাসব ভাবিয়া রাসভে পূজিনু
স্বর্গে যাইতে সোজা,
সে যে লয়ে এঁদো ঘাটে, ফেলে দিল পাটে
ভাবিয়া ধোবির বোঝা!
আঁখর : হল হিতে বিপরীত সবই গো!
আমি ভবানী ভাবিয়া করিতে প্রণাম
হেরি বাগদিনি ভবি গো
আমি শীতল হইতে চাহিনু, আনিল
শীতলা-বাহনে ধোবি গো॥
বাবা শিবের বাহন ভাবিয়া বৃষভ-
লাঙুল ঠেকানু ভালে,
হায় নিল না সে পূজা, শিং দিয়ে সোজা
গুঁতায়ে ফেলিল খালে!
আঁখর : আমার কপাল বেজায় ফুটো গো!
আমি জগন্নাথ হেরিতে হেরিনু
ধবল-কুষ্ঠী ঠুঁটো গো!
বাঁকা অঙ্গ হেরিয়া জড়ায়ে ধরিতে
হেরি ত্রিভঙ্গ খুঁটো গো॥
মোর মহিষী গৃহিণী খুশি হবে ভেবে
মহিষ কিনিয়া আনি!
বাবা মরি এবে ত্রাসে, শিং নেড়ে আসে
মহিষ, মহিষী রানি!
আঁখর : আমি কেমনে জীবন ধরি গো!
আমি ‘হরি বোল’বলে ডাকিতে হরি-রে!
হয়ে যায় ‘বলো হরি’গো॥
থাকিতে চরণ মরণে কী ভয়
কমিক গান
শ্রীচরণ ভরসা
সোহিনী – একতালা
কোরাস :
থাকিতে চরণ মরণে কী ভয়,
নিমেষে যোজন ফরসা।
মরণ-হরণ নিখিল-শরণ
জয় শ্রীচরণ ভরসা॥
গর্বের শির খর্ব মোদের?
চরণ তেমনই লম্বা!
শৈশব হতে আ-মরণ চলি
সবারে দেখায়ে রম্ভা।
সার্জেন্ট যবে আর্জেন্ট-মার
হাতে করে আসে তাড়ায়ে,
না হয়ে ক্রুব্ধ পদ প্রবুদ্ধ
সম্মুখে দিই বাড়ায়ে॥
কোরাস :
থাকিতে চরণ মরণ কী ভয়,
নিমেষে যোজন ফরসা।
মরণ-হরণ নিখিল-শরণ
জয় শ্রীচরণ ভরসা॥
বপু কোলা ব্যাং, রবারের ঠ্যাং,
প্রয়োজন মতো বাড়ে গো,
সমানে আঁদাড়ে বনে ও বাদাড়ে
পগারে পুকুরপাড়ে গো।
লখিতে চকিতে লঙ্ঘিয়া যায়
গিরি দরি বন সিন্ধু,
এই এক পথে মিলিয়াছি মোরা,
সম মুসলিম হিন্দু॥
কোরাস :
থাকিতে চরণ মরণে কী ভয়,
নিমেষে যোজন ফরসা!
মরণ-হরণ নিখিল-শরণ
জয় শ্রীচরণ ভরসা॥
কহিতেছে নাকি বিশ্ব, আমরা
রণে পশ্চাতে হেঁটে যাই?
পশ্চাৎ দিয়া ছুটে কেউ? হেসে
মরিব কি দম ফেটে, ছাই!
ছুটি যবে মোরা – সুমুখেই ছুটি,
পশ্চাতে পাশে হেরি না!
সামনে ছোটারে পিছু হাঁটা বল?
রাঁচি যাও, আর দেরি না॥
কোরাস :
থাকিতে চরণ মরণে কী ভয়,
নিমেষে যোজন ফরসা।
মরণ-হরণ নিখিল-শরণ
জয় শ্রীচরণ ভরসা॥
আমাদের পিছে ছুটিতে ছুটিতে
মৃত্যু পড়িবে হাঁপায়ে,
জিভ বার হয়ে পড়িবে যমের,
জীবন তখন বাঁ পায়ে!
মোরা দেব-জাতি ছিনু যে একদা,
আজ তার স্মৃতি চরণে,
ছুটি না তো, যেন উড়ে চলি নভে,
থাকে নাকো ধুতি পরনে॥
কোরাস :
থাকিতে চরণ মরণ কী ভয়,
নিমেষে যোজন ফরসা।
মরণ-হরণ নিখিল-শরণ
জয় শ্রীচরণ ভরসা॥
বাপ-পিতামোর প্রদর্শিত এ
পথ মহাজন-পিষ্ট,
গোস্বামী মতে পরাহেও বাবা
এ পথে মিলিবে ইষ্ট!
মরে যদি যাও তাহলে তো তুমি
একদম গেলে মরিয়াই!
চরণের জোরে মরণ এড়াও,
বাঁচিবে চরণ ধরিয়াই॥
কোরাস :
থাকিতে চরণ মরণ কী ভয়,
নিমেষে যোজন ফরসা।
মরণ-হরণ নিখিল-শরণ
জয় শ্রীচরণ ভরসা॥
বদনা-গাড়ুতে গলাগলি করে (প্যাক্ট)
প্যাক্ট
কোরাস :
বদনা-গাড়ুতে গলাগলি করে,
নব-প্যাক্টের আসনাই,
মুসলমানের হাতে নাই ছুরি,
হিন্দুর হাতে বাঁশ নাই॥
আঁটসাঁট করে গাঁট-ছড়া বাঁধা
হল টিকি আর দাড়িতে,
‘বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো’? তা
হয় হোক তাড়াতাড়িতে!
একজন যেতে চাহিবে সুমুখে,
অন্যে টানিবে পিছনে,
ফসকা সে গাঁট হয়ে যাবে আঁট
সেই টানাটানি ভীষণে!
বুকে বুকে মিল হল নাকো, মিল
হল পিঠে পিঠে? তাই সই।
মিয়াঁ কন, ‘কোথা দাদা মোর?’আর
বাবু কন ‘মিয়াঁ ভাই কই’?
বাবু দেন মেখে দাড়িতে ‘খেজাব’,
মিয়াঁ চৈতনে তৈল,
চার চোখে করে আড়া-চোখাচোখি
কী মধু-মিলন হইল!
বাবু কন, ‘খাই তোমারে তুষিতে
ওই নিষিদ্ধ কুঁকড়ো!’
মিয়াঁ কন, ‘মিল আরও জমে দাদা,
যদি দাও দুটো টুকরো!
মোদের মুরগি হল রামপাখি, দাদা,
তাও হল শুদ্ধি?
বাদশাহি গেছে, মুরগিও গেল,
আর কার লোভে যুদ্ধি॥’
বাবু কন, ‘পরি লুঙি বি-কচ্ছ
তোমাদের দিল্ তুষিতে!’
মিয়াঁ কন, রাখি ফেজে চৈতনি-
ঝান্ডা সেই সে খুশিতে!
আমাদের কত মিয়াঁ ভাই করে
বাস তব বারাণসীতে,
(আর) বাত হলে ভাই ভাত খাই নাকো
আজও তাই একাদশীতে!’
বাবু কন, ‘দ্যাখো চটিকা ছাড়িয়া
সেলিমি নাগরা ধরেছি!’
মিয়াঁ কন, গোরু জবাই-এর পাপ
হতে তাই দাদা তরেছি!’
বাবু কন, ‘এত ছাড়িলেই যদি,
ছেড়ে দাও খাওয়া বড়োটা!’
মিয়াঁ কন, ‘দাদা মুরগি তো নাই,
কী দিয়া খাইব পরটা!’
বাবু কন, ‘গোরু কোরবানি করা
ছেড়ে দাও যদি মিয়াঁ ভাই,
তোরে সিনান করায়ে সিঁন্দুর পরায়ে
মার মন্দিরে নিয়া যাই।‘
মিয়াঁ কন, ‘যদি আল্লা মিয়াঁর
ঘরে নাহি লও হরিনাম,
বলদের সাথে ছাড়িব তোমারে,
যা হয় হবে সে পরিণাম!’
‘সারা-রারা-রারা’সহসা অদূরে
উঠিল হোরির হররা!
শম্ভু ছুটিল বম্বু তুলিয়া,
ছকু মিয়াঁ নিল ছোররা!
লাগিল হেঁচকা হেঁইয়ো হাঁইয়ো,
টিকি দাড়ি ওড়ে শূন্যে–
ধর্মে ধর্মে করে কোলাকুলি
নব-প্যাক্টেরই পুণ্যে।
বদনা-গাড়ুতে পুন ঠোকাঠুকি,
রোল উঠিল ‘হা হন্ত!’
ঊর্ধ্বে থাকিয়া সিংগি-মাতুল
হাসে ছিরকুটি দন্ত!
মসজিদ পানে ছুটিলেন মিয়াঁ,
মন্দির পানে হিন্দু;
আকাশে উঠিল চির-জিজ্ঞাসা –
করুণ চন্দ্রবিন্দু!
যদি শালের বন হত শালার বোন
যদি
কীর্তন
যদি শালের বন হত শালার বোন
আর কনে বউ হত ওই গৃহেরই কোণ।
ছেড়ে যেতাম না গো,
আমি থাকিতাম পড়ে শুধু, খেতাম না গো!
যদি শালের বন হত শালার বোন –
আমি ওই বনে যে হারিয়ে যেতাম!
ওই বৃন্দাবনে চারিয়ে যেতাম!
ওই মাকুন্দ হত যদি কুন্দ-বালা
হত দাড়িম্ব-সুন্দরী দাড়িওয়ালা!
আমি ঝুলে যে পড়িতাম
তার দাড়ি ধরে –
ওগো দুর্গা বলে –
আমি ঝুলে যে পাড়িতাম!
হত চিমটি শালির যদি বাবলা কাঁটা,
আর শর-বন হত তার খ্যাংরা ঝাঁটা!
দোয়ার্কি :
বিষ ঝেড়ে যে দিত তোর খ্যাংরা মেরে
বিষ ঝেড়ে যে দিত তোর!
যদি একই শালি
দিলে গো মা কালী,
সে যে শালি নয় বিশালী (মা গো)
মাগো বিশাল বপু তার
বিশালী সে – শালি নয়, শালি নয়!