Site icon BnBoi.Com

চোখের চাতক – কাজী নজরুল ইসলাম

Kazi Nazrul Islam

আঁধার রাতে কে গো একেলা

দেশ-পিলু – দাদরা

আঁধার রাতে কে গো একেলা
নয়ন-সলিলে ভাসালে ভেলা।
কাঁদিয়া কারে খোঁজো ওপারে
আজও যে তোমার প্রভাতবেলা॥
কী দুখে আজি যোগিনী সাজি
আপনারে লয়ে এ হেলাফেলা॥
সোনার কাঁকন ও দুটি করে
হেরো গো জড়ায়ে মিনতি করে।
খুলিয়া ধুলায় ফেলো না গো তায়
সাধিছে নূপুর চরণ ধরে।
হেরো গো তীরে কাঁদিয়া ফিরে
আজি ও রূপের রঙের মেলা॥

 আজি এ শ্রাবণ-নিশি কাটে কেমনে

মিঁয়া কী মল্লার – কাওয়ালি

আজি এ শ্রাবণ-নিশি কাটে কেমনে
গুর দেয়া-গরজন কাঁপে হিয়া ঘনঘন
শনশন কাঁদে বায়ু নীপ-কাননে॥
অন্ধ নিশীথ, মন খোঁজে কারে আঁধারে,
অন্ধ নয়ন ঝরে শাওন-বারিধারে।
ভাঙিয়া দুয়ার মম এসো এসো প্রিয়তম,
শ্বসিছে বাহির ঘর ভেজা পবনে॥
কার চোখে এত জল ঝরে দিক প্লাবিয়া,
সহিতে না পারি কাঁদে ‘চোখ গেল’ পাপিয়া।
কাহার কাজল-আঁখি চাহি মোর নয়নে
ঝুরেছিল একা রাতে কবে কোন্ শাওনে,
আজি এ বাদল ঝড়ে সেই আঁখি মনে পড়ে,
বিজলি খুঁজিছে তারে নভ-আঙনে॥

আজি বাদল ঝরে মোর একেলা ঘরে

ভৈরবী-আশাবরি – আদ্ধা কাওয়ালি

আজি বাদল ঝরে মোর একেলা ঘরে
হায় কী মনে পড়ে মন এমন করে॥
হায় এমন দিনে কে নীড়হারা পাখি
যাও কাঁদিয়া কোথায় কোন, সাথিরে ডাকি।
তোর ভেঙেছে পাখা কোন্‌ কুল ঝড়ে॥
আয় ঝড়ের পাখি আয়এ একা বুকে,
আয় দিব রে আশয় মোর গহন-দুখে,
আয় রচিব কুলায় আজ নূতন করে॥
এই ঝড়ের রাতি নাই সাথের সাথি,
মেঘ-মেদুর-গগন বায় নিবেছে বাতি,
মোরএ ভীরু প্রণয় হায় কাঁপিয়া মরে॥
এই বাদল-ঝড়ে হায় পথিক-কবি
ওই পথের পরে আর কতকাল রবি,
ফুল দলিবি কত হায় অভিমান-ভরে॥

আমার কোন কূলে আজ ভিড়ল তরি

খাম্বাজ-পিলু – দাদরা

আমার কোন কূলে আজ ভিড়ল তরি
এ কোন্ সোনার গাঁয়।
আমার ভাটির তরি আবার কেন
উজান যেতে চায়॥
আমার দুঃখের কাণ্ডারি করি
আমি ভাসিয়েছিলাম ভাঙা তরি,
তুমি ডাক দিলে কে স্বপনপরি
নয়ন-ইশারায়॥
আমার নিভিয়ে দিয়ে ঘরের বাতি
ডেকেছিল ঝড়ের রাতি,
তুমি কে এলে মোর সুরের সাথি
গানের কিনারায়॥
সোনার দেশের সোনার মেয়ে,
তুমি হবে কি মোর তরির নেয়ে,
এবার ভাঙা তরি চলো বেয়ে
রাঙা অলকায়॥

আমার গহিন জলের নদী

ভাটিয়ালি – কাহারবা

আমার গহিন জলের নদী।
আমি তোমার জলে রইলাম ভেসে জনম অবধি॥
তোমার বানে ভেসে গেল আমার বাঁধা ঘর
চরে এসে বসলাম রে ভাই ভাসালে সে চর।
এখনসব হারায়ে তোমার জলে রে
আমি ভাসি নিরবধি॥
আমার ঘর ভাঙিল ঘর পাব ভাই
ভাঙলে কেন মন,
হারালে আর পাওয়া না যায়
মনের রতন।
জোয়ার মন ফেরে না আর রে
ও সে ভাটিতে হারায় যদি॥
তুমি ভাঙো যখন কূল রে নদী
ভাঙো একই ধার,
আর মন যখন ভাঙো রে নদী
দুই কূল ভাঙো তার।
চর পড়ে না মনের কূলে রে
একবার সে ভাঙে যদি॥

আমার দুখের বন্ধু, তোমার কাছে

ছায়ানট-কেদারা – একতালা

আমার দুখের বন্ধু, তোমার কাছে
চাইনি তো এ সুখ।
আমিজানিনি তো বুকে পেয়েও
কাঁদবে এমন বুক॥
আমারশাখায় যবে ফোটেনি ফুল
আমি চেয়েছি পথ আশায় আকুল,
আজ ফোটা ফুলে কাঁদে কেন
কুসুম ঝরার দুখ॥
প্রিয়, মিলন-আশায় ছিনু সুখে
ছিলে যবে দূর।
আজ কাছে পেয়ে পরান কাঁদে
বিদায়-ভয়াতুর।
এ-যে অমৃতে গরল মিশা
প্রাণে কেবলই বাড়িছে তৃষা,
আমার স্বর্গে কেন মলিন ধরার
বেদন জাগরূক॥

আমার সাম্পান যাত্রী না লয়

ভাটিয়ালি – কার্ফা

আমার সাম্পান যাত্রী না লয়
ভাঙা আমার তরি।
আমিআপনারে লয়ে রে ভাই
এপার ওপার করি॥
আমায় দেউলিয়া করেছে রে ভাই যে নদীর জল
আমি ডুবে দেখতে এসেছি ভাই সেই জলেরই তল।
আমি ভাসতে আসি, আসিনিকো কামাতে ভাই কড়ি॥
আমি এই জলেরই আয়নাতে ভাই দেখেছিলাম তায়
এখন আয়না আছে পড়ে রে ভাই
আয়নার মানুষ নাই।
চোখের জলে নদীর জলে রে
আমি তারেই খুঁজে মরি॥
আমি তারই-র আশায় সাম্পান লয়ে ঘটে বসে থাকি,
আমার তারই-র নাম ভাই জপমালা,
তারেই কেঁদে ডাকি।
আমার নয়ন-তারা লইয়া গেছে রে
নয়ন নদীর জলে ভরি॥
ওই নদীর জলও শুকায় রে ভাই, সে জল আসে ফিরে,
আর মানুষ গেলে ফিরে না কি দিলে মাথার কিরে।
আমি ভালোবেসে গেলাম ভেসে গো
আমি হলাম দেশান্তরী॥

আমি কী সুখে লো গৃহে রব

কীর্তন

আমি কী সুখে লো গৃহে রব।
আমার শ্যাম হল যদি যোগী ওলো সখী
আমিও যোগিনী হব॥
সেআমারই ধেয়ান করিত গো সদা
তার সে ধ্যান ভাঙিল যদি,
ওলো সে ভোলে ভুলুক, আমি ওই রূপ
ধেয়াইব নিরবধি।
আমিও যোগিনী হব।
শ্যামযে তরুর মূলে বসিবে লো ধ্যানে
সেথা আঁচল বিছায়ে রব।
আমি ধুলায় বসতে দেব না সই,
তার সোনার অঙ্গ মলিন হবে
ধুলায় বসতে দেব না সই।
কুয়াশায় চাঁদ পড়বে ঢাকা
সহিতে পারিব না সই।
সখী ধুলাই যদি সে মাগে,
আমি আপনি রাঙা পথ-ধূলি
বঁধুয়ার অনুরাগে।
শ্যাম যে পথ দিয়ে চলে যাবে
সেই পথের ধূলি হব।
সে চলে যেতে দলে যাবে
সেই সুখে গো ধূলি হব।
হব ভিক্ষার ঝুলি, শ্যাম লবে তুলি
বাহুতে আমারে জড়ায়ে,
সখী আমার বেদনা-গৈরিক-রাঙা
বাস দেব তারে পরায়ে।
নবীন যোগীরে সাজাইব আমি,
আমার প্রাণের গোধূলি-বেলায়
রঙে রঙে তারে সাজাইব আমি।
সখী তার অনাদর-আগুনে জ্বালায়ে
পোড়াব লাবণি মোর,
ওলো তারই-র হাতের আঘাতে আঘাতে
হবে এ দেহ কঠোর।
আমার এ তনু শুকাবে গভীর অভিমানের জ্বালা,
আমি তাই দিয়ে তার হব গলায় রুদ্রাক্ষেরই মালা।
আমি শ্যামের গলার মালা হব,
আমি জীবনে পেয়েছি জ্বালা শুধু সখী,
মরে এবার মালা হব।
আমার চোখের জলে বইবে নদী,
আমি নদী হয়ে কেঁদে যাব
চরণে তার নিরবধি।
আমি কী সুখে লো গৃহে রব,
আমার শ্যাম হল যদি যোগী ওলো সখী
আমিও যোগিনী হব॥

আসিলে কে অতিথি সাঁঝে

ভূপালি – আদ্ধা-কাওয়ালি

আসিলে কে অতিথি সাঁঝে
পূজার ফুল ঝরে বন-মাঝে॥
দেউল মুখরিত বন্দনা-গানে,
আকাশ-আঁখি চাহে তব পানে।
দোলে ধরাতল
দীপ-ঝলমল,
নৌবতে ভূপালি বাজে॥

এত কথা কি গো কহিতে জানে

খাম্বাজ-দেশ – দাদরা

এত কথা কি গো কহিতে জানে
চঞ্চল ওই আঁখি।
নীরব ভাষায় কী যে কহে যায়
মনের বনের পাখি –
চঞ্চল ওই আঁখি॥
মুদিত কমলে ভ্রমরেরই প্রায়
বন্দি হইয়া কাঁদিয়া বেড়ায়,
চাহিয়া চাহিয়া মিনতি জানায়
সুনীল আকাশে ডাকি –
চঞ্চল ওই আঁখি॥

বুঝিতে পারি না ও আঁখির ভাষা
জলে ডুবে তবু মিটে না পিয়াসা,
আদর সোহাগ প্রেম ভালোবাসা
অভিমান মাখামাখি।
মানস-সায়রে মরালেরই প্রায়
গহন সলিলে ভেসে ভেসে চায়।
আমার হিয়ার নিভৃত ব্যথায়
সাধ যায় ধরে রাখি।
চঞ্চল ওই আঁখি॥

এলে কী শ্যামল পিয়া কাজল মেঘে

কাজরি – কাহারবা

এলে কী শ্যামল পিয়া কাজল মেঘে
চাঁচর চিকুর ওড়ে পবন-বেগে॥
তোমার লাবণি ঝরে
পড়িছে অবনি পরে,
কদম শিহরে কর-পরশ লেগে॥
তড়িত ত্বরিত পায়ে
বিরহী-আঁখের ছায়ে তরাসে লুকায়।
ছুটিতে পথের মাঝে
ঝুমুর ঝুমুর বাজে ঘুঙুর দু-পায়।
অশনি হানার ছলে
প্রিয়ারে ধরাও গলে,
রাতের মুকুল কাঁদে কুসুমে জেগে॥

ওগো সুন্দর আমার

(ভজন) ভৈরবী – দাদরা

ওগো সুন্দর আমার!
সুন্দর আমার, এ কী দিলে উপহার॥
আমি দিনু পূজা-ফুল,
বর দিতে দিলে ভুল,
ভাঙিল আমার কূল,
তব স্রোতধার॥
গরল দিলে যে এই
অমৃত আমার সেই,
শুকাল নিশি-শেষেই
রাতের নীহার॥
তোমার সুখ-ছোঁয়ায়
ফুটেছে ফুল শাখায়,
তোমারই উতল বায়
ঝরিল আবার॥

ওরে মাঝি ভাই

ভাটিয়ালি – কাহারবা

ওরে মাঝি ভাই।
তুইকী দুখ পেয়ে কূল হারালি
অকূল দরিয়ায়॥
তোর ঘরের রশি ছিঁড়ে রে গেল –
ঘাটের কড়ি নাই,
তুই মাঝদরিয়ায় ভেসে চলিস
ভাসিয়ে তরি তাই।
ও ভাই দরিয়ায় আসে জোয়ার-ভাটি রে
তোর ওই চক্ষের পানি চাই॥
তোর চোখের জল ভাই ছাপাতে চাস
নদীর জলে এসে,
শেষে নদীই এল চক্ষে রে তোর
তুই চলিলি ভেসে।
তুই কলস দেখে নামলি জলে রে
এখন ডুবে দেখিস কলস নাই॥
তুই কূলে যাহার কূল না পেলি,
তারে অগাধ জলে
মিছে খুঁজে মরিস ওরে পাগল
তরি বাওয়ার ছলে।
ও ভাই দু-ধারে এর চোরা বালু রে
তোর হেথায় মনের মানুষ নাই॥

কাঁদিতে এসেছি আপনার লয়ে

জয়জয়ন্তী – একতালা

কাঁদিতে এসেছি আপনার লয়ে
কাঁদাতে আসিনি হে প্রিয় তোমারে।
এ মম আঁখি-জল আমারই নয়নের
ঝরিবে না এ জল তোমার দুয়ারে॥
ভালো যদি বাসি একাকী বাসিব,
বিরহ-পাথারে একাকী ভাসিব।
কভু যদি ভুলে আসি তব কূলে,
চমকি চলিয়া যাব দূর-পারে॥
কাঁটার বনে মোর ক্ষণিকের তরে
ফুটেছ রাঙা ফুল শুধু লীলাভরে।
মালা হয়ে কবে দুলিবে গলে কার
জাগিব একাকী লয়ে স্মৃতি কাঁটার।
কেহ জানিবে না শুকাল কে কোথা,
কার ফুলে কারে সাজালে দেবতা।
নিশীথ-অশ্রু মোর যাইবে শুকায়ে
তব সুখ-দিনে হাসির মাঝারে॥

কার বাঁশরি বাজে মুলতানি-সুরে

মুলতান – একতালা

কার বাঁশরি বাজে মুলতানি-সুরে
নদীকিনারে কে জানে।
সে জানে না কোথা সে সুরে ঝরে
ঝর-নির্ঝর পাষাণে॥
একে চৈতালি-সাঁঝ অলস
তাহে ঢলঢল কাঁচা বয়স
রহে চাহিয়া ভাসে কলস
ভাসে হৃদি বাঁশুরিয়া পানে॥
বেণি বাঁধিতে বসি অঙ্গনে
বধূ কাঁদে গো বাঁশরি-স্বনে।
যারে হারায়েছে হেলাভরে
তারে ও-সুরে মনে পড়ে,
বেদনা বুকে গুমরি মরে
নয়ন ঝুরে, বাধা না মানে॥

 কী হবে লাল পাল তুলে ভাই

ভাটিয়ালি – কার্ফা

কী হবে লাল পাল তুলে ভাই
সাম্পানের উপর।
তোর পালে যত লাগবে হাওয়া রে
ও ভাই ঘর হবে তোর ততই পর॥
তোর কী দুঃখ হায় ভুলতে চাস ভাই,
ছেঁড়া পাল রাঙিয়ে,
এবার পরান ভরে কেঁদে নে তুই
অগাধ জলে নেয়ে॥
তোর কাঁদনে উঠে আসুক রে
ওই নদীর থেকে বালুর চর॥
তুই কীসের আশায় দিবি রে ভাই
কূলের পানে পাড়ি,
তোর দিয়া সেথা না জ্বলে ভাই
আঁধার যে ঘরবাড়ি॥
তুই জীবনকূলে পেলিনে তায় রে
এবার মরণজলে তালাশ কর॥

কে এল ডাকে চোখ গেল

কালাংড়া – কাহারবা-দাদরা

কে এল।
ডাকে চোখ গেল, ডাকে চোখ গেল,
ডাকে চোখ গেল॥
ওলো ও ডাকে কী ও
ঘুমের সতিনি ও,
ও যে চোখের বালি।
ঘুম ভাঙায় খালি।
সখী আঁখি মেলো॥
মেলোআঁখি মেলো॥

কে ডাকিল আমারে আঁখি তুলে

ভৈরবী – কার্ফা

কে ডাকিল আমারে আঁখি তুলে,
এই প্রভাতে তটিনি-কূলে কূলে॥
ওই ঘুমায়ে সকলই, জাগেনি কেউ,
জল নিতে আসেনি এখনও বউ,
শুধু তব নদীতে জেগেছে ঢেউ,
মেলেছে নয়ন কানন-ফুলে॥
যে সুবাস ঝরে ও এলোকেশে
কমলে তা দিলে নাহিতে এসে,
তব তনুবাস দিঘিতে ভেসে
মাতাইছে, মধুপ পথ ভুলে॥
ও শিশির কপোল-স্বেদবারি
পড়িল ঝরি নয়নে আমারই
জাগিয়া হেরি রূপ মনোহারী
দাঁড়ায়ে উষসী তোরণ-মূলে॥

 কে তুমি দূরের সাথি

পুরবি – একতালা

কে তুমি দূরের সাথি
এলে ফুল ঝরার বেলায়।
বিদায়ের বংশী বাজে
ভাঙা মোর প্রাণের মেলায়॥

গোধূলির মায়ায় ভুলে
এলে হায় সন্ধ্যা-কূলে,
দীপহীন মোর দেউলে
এলে কোন্‌ লোর খেলায়॥

সেদিনও প্রভাতে মোর
বেজেছে আশাবরি,
পুরবির কান্না শুনি
আজি মোর শূন্য ভরি।

অবেলায় কুঞ্জবীথি
এলে মোর শেষ অতিথি,
ঝরা ফুল শেষের গীতি
দিনু দান তোমার গলায়॥

কেউ ভোলে না কেউ ভোলে

মান্দ – কাহারবা

কেউ ভোলে না কেউ ভোলে
অতীত দিনের স্মৃতি।
কেউ দুখ লয়ে কাঁদে,
কেউ ভুলিতে গায় গীতি॥
কেউ শীতল জলদে
হেরে অশনির জ্বালা,
কেউ মঞ্জুরিয়া তোলে
তার শুষ্ক কুঞ্জ-বীথি॥
হেরে কমল-মৃণালে
কেউ কাঁটা কেহ কমল।
কেউ ফুল দলি চলে
কেউ মালা গাঁথে নিতি॥
কেউ জ্বালে না আর আলো
তার চির-দুখের রাতে,
কেউ দ্বার খুলি জাগে
চায় নব চাঁদের তিথি॥

কেন নিশি কাটালি অভিমানে

ভৈরবী – দাদরা-কাহরবা

কেন নিশি কাটালি অভিমানে।
ডুবে গেল চাঁদ দূর বিমানে॥
মান-ভরে চাতকী এ বাদলে
মিটালি না পিপাসা মেঘ-জলে।
কোথা রবে এ মেঘ কে বা জানে॥
রহে চাঁদ দূরে অমা নিশীথে,
তবু ফোটে কুমুদী সরসীতে।
রহে চাহি কলঙ্কী শশী পানে॥
যে ফাগুনে ফুল ফুটিল রাতে,
রবে না সে ফাগুন কালি প্রাতে,
যে ফুটিল না, সে শুকাবে বাগানে॥

কেন প্রাণ ওঠে কাঁদিয়া

কীর্তন

কেন প্রাণ ওঠে কাঁদিয়া
কাঁদিয়া কাঁদিয়া কাঁদিয়া গো॥
আমি যত ভুলি ভুলি করি
তত আঁকড়িয়া ধরি
তত মরি সাধিয়া
সাধিয়া সাধিয়া সাধিয়া গো।
শ্যামের সে রূপ ভোলা কি যায়
নিখিল শ্যামল যার শোভায়।
আকাশ সাগরে বনে কান্তারে
লতায় পাতায় সে রূপ ভায়।
আমারবঁধূর রূপের ছায়া বুকে ধরি
আকাশ-আরশি নীল গো,
বহে ভুবন প্লাবিয়া কালারে ভাবিয়া
কালো সাগর-সলিল গো।
আমার শ্যামেরে কাজল পরাইতে মেঘ
ঝুরে ঝুরে ঘুরে গগনে।
আমার শ্যামের মুকুট-চূড়া হয়ে শিখী
নেচে ফেরে বন-ভবনে
সখী গো –
সখী নিখিল তারে ধেয়ায় গো।
এই রাধিকার পারা কোটি শশী তারা
তার নীল বুকে লুটায় গো।
যদি ফুল হয়ে ফুটি তরু-শাখেসে
যে পল্লব হয়ে ঘিরে থাকে।
যদি একাকিনী চলি বনতলেসে
যে ছায়া হয়ে পিছে পিছে চলে।
যদি একা ঘরে মোর দীপ জ্বালি
আসে আঁধারের রূপে বনমালী। –
সখী গো –
আমার কলঙ্কী চাঁদ।
তার কলঙ্ক চেয়ে জ্যোৎস্না বেশি,
কলঙ্ক তার দেখে কে।
লোকে আমার চাঁদে কলঙ্কী কয়
জ্যোৎস্না তাহারই মেখে।
আমি তারই-র লাগি
অ কুমুদিনী হয়ে জলে ডুবে রই তারই-র লাগি
আমি চকোরিণী হয়ে নিশীথ জাগি তারই-র লাগি।
আমার প্রাণের সাগরে জোয়ার জাগে চাঁদের লাগি।
রাতে রবির কিরণ শরণ মাগে চাঁদের লাগি।
আমার কলঙ্কী চাঁদ।
আমি যেদিকে তাকাই হেরি ও-রূপ কেবল,
সে যে আমারই মাঝারে রহে করি নানা ছল।
সে যে বেণি হয়ে দুলে পিঠে চপল চতুর।
সে যে আঁখির তারায় হাসে কপট নিঠুর।
সখী গো –
সখী আঁখি মোর বিবাদী হল
সেও কালার রূপে গলে।
আমার বুকের কথা চোখে এল
চোখের জল সই সেও কালো।
সখী লো মোর মরণ ভালো!

সে যে আঁখিপাতা হয়ে থাকে ঘিরিয়া আঁখি
বনে বনে ডাকে তারই আঁখি কোয়েলা পাখি।
কাঁদে ফাল্গুনে গুণ গুণ ফুল-ভোমরা,
বন-হরিণীর চোখে তারই কাজল পরা।
তারে কেমনে ভুলিব।
বলো সখী তারে কেমনে ভুলিব।
আমার অঙ্গ জড়ায়ে দুলে সে রঙ্গে
শাড়ি সে নীলাম্বরী গো।
আমি কুল ছাড়িয়াছি, আজ দেখি সখী
দুকুল লইয়া মরি গো,
আমি বসন-ভূষণ তারই-র সখা
কেমনে তায় ভুলিব।
থাকে কবরী-বন্ধে কালো ডোর হয়ে
কাল ফণী কালো কেশে গো।
থাকে কপালের টিপে, চোখের কাজলে,
কপোলের তিলে মিশে গো।
আমার একুল ওকুল দুকুল গেল।
আমার কুলে সই পড়িল কালি
সেও কালার রূপে এল।
আমার কপালের কলঙ্ক-তিলক
সেও কালার রূপে এল।
রাখি কী দিয়া মন বাঁধিয়া,
আমার সকলই ভাসিল সখী
কালো যমুনারই জলে
সকলই ভাসিল –
রাখিকী দিয়া মন বাঁধিয়া
বাঁধিয়া বাঁধিয়া বাঁধিয়া গো ॥

ঘেরিয়া গগন মেঘ আসে

মেঘ রাগ – ত্রিতাল (দ্রুতগতি)

ঘেরিয়া গগন মেঘ আসে।
বিহ্বল ধরণি,
দশ দিশি কাঁপে তরাসে॥
বিদ্যুৎ ঝলকে
ঝামর অলকে
ঝমঝম ঝাঁঝর
বাজে ঘন আকাশে॥
শিখী নাচে হরষে
বারিধারা বরষে,
চাতক চাতকী
পাগল পিয়াসে॥

ঘোর তিমির ছাইল

বাগেশ্রী – কাওয়ালি

ঘোর তিমির ছাইল
রবি শশী গ্রহ তারা।
কাঁপে তরাসে ভীতা ধরণি
অসীম আঁধারে হারা॥
প্রলয়েশ মহাকাল
এলায়েছে জটাজাল,
নাচিছে ঝড়ের বেগে
সুরধুনী-জলধারা॥
চমকি চমকি ওঠে
চপলা চপল-ফণা,
লুকাইল শিশুশশী,
মুরছিতা দিগঙ্গনা।
চাতকী চাতক-বুকে
বিভল কাঁদিয়া সারা॥

চলো সখী জল নিতে

পুরিয়া – ত্রিতাল

চলো সখী জল নিতে
চলো ত্বরিতে।
শ্রান্ত দিনের রবি
ডোবে সরিতে॥
ঘিরিছে আঁধার
তটিনি-কিনার,
গোধূলির ছায়া পড়ে
বন-হরিতে॥
ধেনু-ডাকা বেণু বাজে
বংশীবটে,
পাখি ওড়ে, আঁকা যেন
আকাশ পটে।
বধূ ঘাটে যায়
বঁধু পথে চায়,
চিনি চিনি বাজে চুড়ি
গাগরিতে॥

ছাড়িতে পরান নাহি চায়

খাম্বাজ – দাদরা

ছাড়িতে পরান নাহি চায়
তবু যেতে হবে, হায়!
মলয়া মিনতি করে
তবু কুসুম শুকায়॥
রবে না এ মধু-রাতি
জানি তবু মালা-গাঁথি,
মালাচলিতে দলিয়া যাবে
তবু চরণে জড়ায়॥
যে কাঁটার জ্বালা সয়ে
ফোটে ব্যথা ফুল হয়ে,
আমিকাঁদিব সে কাঁটা লয়ে
নিশীথ-বেলায়।
তুমিরবে যবে পরবাসে,
আমি দূর নীলাকাশে
জাগিব তোমারই আশে
নূতন তারায়॥

 জনম জনম গেল আশা-পথ চাহি

বাগেশ্রী – কাওয়ালি

জনম জনম গেল আশা-পথ চাহি।
মরু-মুসাফির চলি, পার নাহি নাহি॥
বরষ পরে বরষ আসে যায় ফিরে,
পিপাসা মিটায়ে চলি নয়নের নীরে।
জ্বালিয়া আলেয়া-শিখা
নিরাশার মরীচিকা
ডাকে মরু-কাননিকা শত গীত গাহি।
এ মরু ছিল গো কবে সাগরের বারি,
স্বপন হেরি গো তারই আজও মরুচারী।
সেই সে সাগর-তলে
যে তরি ডুবিল জলে
সে তরি-সাথিরে খুঁজি মরুপথ বাহি॥

 জাগো জাগো, পোহাল রাতি

ভৈরবী-ভূপালি – যৎ

জাগো জাগো, পোহাল রাতি।
গগন-আঙনে ম্লান চাঁদের বাতি।
পোহাল রাতি॥
মধুমাছি মধু বোলে,
ফুলমুখী ঘুম ভোলে,
শরমে নয়ন খোলে
শয়ন-সাথি।
পোহাল রাতি॥
সলিল লুটায় ঘটে
বধূর বুকের তটে,
বাজে বাঁশি ছায়াবটে
আবেশে মাতি।
পোহাল রাতি॥

জাগো, জাগো, খোলো গো আঁখি

টোড়ি – যৎ

জাগো, জাগো, খোলো গো আঁখি।
নিকুঞ্জ-ভবনে তব জাগিল পাখি।
খোলো গো আঁখি॥
তোমার রাতের ঘুমে
রবির কিরণ চুমে,
বাঁধিল কানন-ভূমে
ফুলের রাখি।
খোলো গো খোলো আঁখি॥
স্বপনে হেরিছ যারে
সে এল পূরব-দ্বারে,
বাতায়ন খুলি তারে
লহ গো ডাকি।
খোলো গো আঁখি॥

ঝরিছে অঝোরে বরষার বারি

মল্লার – কাওয়ালি

ঝরিছে অঝোরে বরষার বারি।
গগন সঘন ঘোর,
পবন বহিছে জোর,
একাকী কুটিরে মোর
রহিতে নারি॥
শিয়রে নিবেছে বাতি,
অন্ধ তমসা রাতি,
গরজে আওয়াজ বাজ
গগনচারী॥
চমকিছে চপলা,
জাগি ভয়-বিভলা
একা কুমারী॥

তোমায় কূলে তুলে বন্ধু আমি নামলাম জলে

ভাটিয়ালি – কার্ফা

তোমায় কূলে তুলে বন্ধু
আমি নামলাম জলে।
আমি কাঁটা হয়ে রই নাই বন্ধু
তোমার পথের তলে॥
আমি তোমায় ফুল দিয়েছি কন্যা
তোমার বন্ধুর লাগি
যদি আমার শ্বাসে শুকায় সে ফুল
তাই হলাম বিবাগি।
তুমি বুকের তলায় আছ আমার গো
পরে শুকাইনি কো গলে॥
যে দেশ তোমার ঘর রে বন্ধু
সে দেশ হতে এসে
আমার দুখের তরি দিছি ছেড়ে
চলতেছে সে ভেসে,
এখন যে পথে নাই তুমি বন্ধু গো
তরি সেই পথে মোর চলে॥

 দারুণ পিপাসায় মায়া-মরীচিকায়

জয়জয়ন্তী – একতালা

দারুণ পিপাসায় মায়া-মরীচিকায়
চাহিতে এলি জল বনের হরিণী।
দগ্ধ মরুতল কে তোরে দেবে জল
ঝরিবে আঁখি-নীর তোরই নিশিদিনই॥
নিবায়ে গৃহদীপ আপন নিশাসে
আলেয়ার পিছে এলি সুখ-আশে,
সে সুখ অবসান সমুখেতে শ্মশান
পিছনে অন্ধকার চির-নিশীথিনী॥
কেন তুই বনফুল বিলাস-কাননে
করিয়া পথ ভুল এলি অকারণে।
ছিঁড়ে সাঁঝে তোরে মালা গাঁথি ভোরে
দলিল বিলাসী পথ-ধূলি সনে॥
সন্ধ্যা-গোধূলির রাঙা রূপে ভুলে
আসিলি এ কোথায় তমসার কূলে।
শ্রাবণ-মেঘ হায় ভাবিয়া কুয়াশায়
হারালি পথ তোর রে হতভাগিনি॥

দুলে চরাচর হিন্দোল-দোলে

হিন্দোল – গীতাঙ্গী

দুলে চরাচর হিন্দোল-দোলে।
বিশ্বরমা দোলে বিশ্বপতি কোলে॥
গগনে রবি শশী গ্রহ তারা দুলে,
তড়িত-দোলনাতে মেঘ ঝুলন ঝুলে।
বরিষা শতনরি
দুলিছে মরি মরি,
দুলে বাদল-পরি
কেতকী-বেণি খোলে॥
নদী-মেখলা দোলে, দোলে নটিনী ধরা,
দুলে আলোক নভ-চন্দ্রতাপ ভরা।
করিয়া জড়াজড়ি দোলে দিবস নিশা,
দোলে বিরহবারি, দোলে মিলনতৃষা।
উমারে লয়ে বুকে
শিব দুলিছে সুখে,
দোলে অপরূপ
রূপলহর তোলে॥

 দেখা দাও দাও দেখা ওগো দেবতা

নাগধ্বনি কানাড়া – মধ্যমান

দেখা দাও, দাও দেখা, ওগো দেবতা।
মন্দিরে পূজারিনি আশাহতা॥
ধূপ পুড়িয়া গেছে, শুকায়েছে মালা,
বন্ধ হল বা দ্বার, একা কুলবালা।
প্রভাতে জাগিবে সবে, রটিবে বারতা॥
জাগো জাগো দেবতা শূন্য দেউলে,
আরতি উঠিছে মোর বেদনার ফুলে।
বাণীহীন মন্দির, কহো কহো কথা॥

না মিটিতে সাধ মোর নিশি পোহায়

ভৈরবী – কাওয়ালি

না মিটিতে সাধ মোর নিশি পোহায়।
গভীর আঁধার ছেয়ে আজও হিয়ায়॥
আমার নয়ন ভরে
এখনও শিশির ঝরে,
এখনও বাহুর পরে
বঁধু ঘুমায়॥
এখনও কবরী-মূলে
কুসুম পড়েনি ঢুলে,
এখনও পড়েনি খুলে
মালা খোঁপায়॥
নিবায়ে আমার রাতি;
পোহাল সবার রাতি
নিশি জেগে মালা গাঁথি,
প্রাতে শুকায়॥

 নাইয়া করো পার

ধবলশ্রী – মধ্যমান

নাইয়া, করো পার!
কূল নাহি, নদীজল সাঁতার॥
দু-কূল ছাপিয়া জোয়ার আসে,
নামিছে আঁধার, মরি তরাসে
দাও দাও কূল কুলবধূ ভাসে
নীর পাথার।
নাইয়া, করো পার॥

নিশীথ নিশীথ জাগি গোঁয়ানু রাতি

গৌড়সারং – যৎ

নিশীথ নিশীথ জাগি গোঁয়ানু রাতি।
জ্বলিয়া জ্বলিয়া নেভে শিয়রের বাতি॥
সারা দিন গাঁথি মালা তুলিয়া কুসুম,
পথ চাহি চাহি করে চোখে আসে ঘুম,
রহে পড়ি নব শেজ, কুসুমের পাঁতি॥
আমার কাননে আসি আলি যায় ফিরে,
গাহি গান ফেরে সাঁঝে পাখি সব নীড়ে॥
একেলা রহি গো শুধু আমি বিনা সাথি॥

নিশীথ-স্বপন তোর

ভৈরবী – দাদরা

নিশীথ-স্বপন তোর
ভুলে যা এ নিশি-শেষে
বাদল-অবসানে
আকাশ উঠেছে হেসে॥
চখার পাশে আসে
বিরহ-রাতের চখি।
আঁধার লুকাল ওই
দূর বনে এলোকেশে॥
শরম-রাঙা গালে
জাগিল কুমারী উষা,
তরুণ অরুণ ওই
এল রাঙা বর-বেশে॥

পরজনমে দেখা হবে প্রিয়

পরজ – একতালা

পরজনমে দেখা হবে প্রিয়।
ভুলিয়ো মোরে হেথা ভুলিয়ো॥
এ জনমে যাহা বলা হল না,
আমি বলিব না, তুমিও বোলো না।
জানাইলে প্রেম করিয়ো ছলনা,
যদি আসি ফিরে, বেদনা দিয়ো॥
হেথায় নিমেষে স্বপন ফুরায়,
রাতের কুসুম প্রাতে ঝরে যায়,
ভালো না বাসিতে হৃদয় শুকায়,
বিষ জ্বালা-ভরা হেথা অমিয়॥
হেথা হিয়া ওঠে বিরহে আকুলি,
মিলনে হারাই দু-দিনেতে ভুলি,
হৃদয় যথায় প্রেম না শুকায়,
সেই অমরায় মোরে স্মরিয়ো॥

 পরদেশি বঁধু! ঘুম ভাঙায়ো চুমি আঁখি

মাঢ় – কাওয়ালি

পরদেশি বঁধু! ঘুম ভাঙায়ো চুমি আঁখি।
যদি গো নিশীথ জেগে ঘুমাইয়া থাকি।
ঘুম ভাঙায়ো চুমি আঁখি॥
যদি দীপ নিভে গো কুটিরে,
বাতায়ন-পানে চাহি যেয়ো না গো ফিরে,
নিবেছে আঁখির শিখা প্রাণ আছে বাকি।
ঘুম ভাঙায়ো চুমি আঁখি॥
যদি গান থামে মোর মুখে,
ফিরিয়া যেয়ো না, বীণা রবে তবু বুকে
নাহি গান, কুলায়েতে আছে তবু পাখি।
ঘুম ভাঙায়ো চুমি আঁখি॥

পেয়ে কেন নাহি পাই হৃদয়ে মম

খাম্বাজ – ঠুংরি

পেয়ে কেন নাহি পাই হৃদয়ে মম
হে চির-সুদূর প্রিয়তম॥
তুমি আকাশের চাঁদ,
আমি পাতিয়া সরসী-ফাঁদ
জনম জনম কাঁদি
কুমুদীর সম।
হে চির-সুদূর প্রিয়তম॥
আমি ফুলের কুলের রাধা,
বৃন্তের কলে বাঁধা,
চপল গগন-চারী
তুমি নিরমম।
হে চির-সুদূর প্রিয়তম॥
নিখিলের রূপে রূপে
দেখা দাও চুপে চুপে,
এলে না মুরতি ধরি
ওগো নিরুপম!
হে চির-সুদূর প্রিয়তম॥

 ফাগুন-রাতের ফুলের নেশায়

পিলু – কাহারবা

ফাগুন-রাতের ফুলের নেশায়
আগুন-জ্বালায় জ্বলিতে আসে।
যে দীপশিখায় পুড়িয়া মরে
পতঙ্গ ঘোরে তাহারই পাশে॥
অথই দুখের পাথার-জলে
সুখের রাঙা কমল-দোলে,
কূলের পথিক হারায় দিশা
দিবস নিশা তাহারই বাসে॥
সুখের আশায় মেশায় ওরা
বুকের সুধায় চোখের সলিল।
মণির মোহে জীবন দহে
বিষের ফণীর গরল-শ্বাসে
বুকের পিয়ায় পেয়ে হিয়ায়
কাঁদে পথের পিয়ার লাগি,
নিতুই নতুন স্বরগ মাগি
নিতুই নয়ন- জলে ভাসে॥

ফুলকিশোরী! জাগো জাগো, নিশি ভোর

জৌনপুরি – দাদরা

ফুলকিশোরী! জাগো জাগো, নিশি ভোর।
দুয়ারে দখিন-হাওয়া
খোলো খোলো পল্লব-দোর॥
জাগাইয়া ধীরে ধীরে
যৌবন তনু-তীরে
যাব চলি উদাসী কিশোর॥
চিনি গো দেবতা চিনি
ও নূপুর-রিনিঝিনি,
ভেঙো না ভেঙো না ঘুম-ঘোর।
মধুমাসে আসো তুমি ফুলবাস-চোর।
প্রভাতে ফুটায়ে আঁখি
নিশীথে বহাবে আঁখি-লোর॥

বনে বনে দোলা লাগে

ছায়ানট – দাদরা

বনে বনে দোলা লাগে।
মনে মনে দোলা লাগে।
দখিনা-সমীর জাগে॥
এ কী এ বেদনা লয়ে
ফুটিল ফুল হৃদয়ে,
গোপনে মধুর ভয়ে
না-জানা পরশ মাগে॥
অশোক রঙিন ফুটে
কিশোর হৃদয় পুটে,
কপোল রাঙিয়া উঠে
অতনুর অনুরাগে॥

বাজায়ে জল-চুড়ি কিঙ্গিণি

আড়ানা – যৎ

বাজায়ে জল-চুড়ি কিঙ্গিণি,
কে চলো জলপথে উদাসিনী।
পথিক ডেকে বলো
ছল গো ছলছল
ছুঁতে উছলে জল
গরবিনি॥
তোমার কোল মাগি
কুলের হতভাগি
রহে ও কূলে জাগি
নিশীথিনী॥
বুকেতে বহে তরি,
চাহো না জলপরি
চলো সাগরে স্মরি
পূজারিনি॥

বৃন্দাবনে এ কী বাঁশরি বাজে

বৃন্দাবনি সারং – কাওয়ালি

বৃন্দাবনে এ কী বাঁশরি বাজে।
গোপিনী উন্মনা, মন নাহি কাজে॥
কুলবধূ-ঘটে ঘটে সে বাঁশি স্বনে
উছলি উছলি ওঠে নীর ক্ষণে ক্ষণে।
নয়ন-সলিল ঝরে গাগরি-মাঝে॥

ভাঙা মন আর জোড়া নাহি যায়

সিন্ধু-ভৈরবী – পাঞ্জাবি ঠেকা

ভাঙা মন আর জোড়া নাহি যায়।
ঝরা ফুল আর ফেরে না শাখায়॥
শীতের হাওয়ায় তুষার হয়ে
গলি খরতাপে বারি যায় বয়ে,
গলে নাকো আর হৃদয়-তুষার
উষ্ণ ছোঁয়ায়॥
গাঁথি ফুলমালা নাহি দিয়া গলে
শুকালে নিঠুর তব মুঠিতলে,
হাসিবে না সে ফুল শত আঁখিজলে
আর সে শোভায়॥
স্রোতের সলিলে
যে বাঁধ বাঁধিলে
ভাঙিয়া সে বাঁধ
তোমারে ভাসায়॥

মন কেন উদাসে এই ফাগুন-বাতাসে

(শুদ্ধ) সারং – একতালা

মন কেন উদাসে।
এই ফাগুন-বাতাসে॥
যাহারে না পাইনু কভু এ জীবনে,
সে কেন গো কাঁদাতে আসে নিতি স্মরণে।
কুসুমের গন্ধে গো
তারই সুবাস ভাসে॥
কেন এ সমীরে
সে আসে ফিরে ফিরে,
নয়ন-নদীতীরে
কেন জল উছাসে॥

 মাধবী-তলে চলো মাধবিকা দল

মধুমাদ সারং – কাওয়ালি

মাধবী-তলে চলো মাধবিকা দল
আইল সুখ-মধুমাস।
বহিছে খরতর থর থর মরমর
উদাস চৈতি-বাতাস॥
পিককুল কলকল অবিরল ভাষে,
মদালস মধুপ পুষ্পল বাসে।
বেণু-বনে উঠিছে নিশাস॥
তরুণ নয়ন সম আকাশ আনীল,
তটতরু ছায়া ধরে নীর নিরাবিল,
বুকে বুকে স্বপন-বিলাস॥

মোর ঘুমঘোরে এলে মনোহর

ভৈরবী-গজল – দাদরা

মোর ঘুমঘোরে এলে মনোহর
নমো নম, নমো নম, নমো নম।
শ্রাবণ-মেঘে নাচে নটবর
ঝমঝম ঝমঝম ঝমঝম॥
শিয়রে বসি চুপি চুপি চুমিলে নয়ন
মোর বিকশিল আবেশে তনু
নীপসম নিরুপম মনোরম॥
মোর ফুলবনে ছিল যত ফুল
ভরি ডালি দিনু ঢালি দেবতা মোর!
হায় নিলে না সে ফুল ছি ছি বেভুল
নিলে তুলি খোঁপা খুলি কুসুম-ডোর।
স্বপনে কী যে কয়েছি তাই গিয়াছ চলি
জাগিয়া কেঁদে ডাকি দেবতায় –
প্রিয়তম প্রিয়তম প্রিয়তম॥

মোর ধেয়ানে মোর স্বপনে

পাহাড়ি মিশ্র – কাহারবা

মোর ধেয়ানে মোর স্বপনে
পরান-প্রিয়, দিয়ো হে দেখা।
মোর শয়নে মোর নয়নে
লিখিয়া যেয়ো সলিল-লেখা॥
পথ চলিতে আসিলে ভুলে
নিয়ো না তুলে তব দেউলে,
হবে না পূজা এ বনফুলে
দেবতা মম, ঝরিব একা॥

যাও যাও তুমি ফিরে

ভৈরবী – দাদরা

যাও যাও তুমি ফিরে
এই মুছিনু আঁখি।
কে বাঁধিবে তোমারে
হায় বনের পাখি॥
মোর এত প্রেম আশা
মোর এত ভালোবাসা
আজ সকলই দুরাশা
আর কী দিয়ে রাখি॥
এই অভিমান-জ্বালা
মোর একেলারই কালা,
ম্লান মিলনেরই মালা
দাও ধুলাতে ঢাকি॥
তোমারবেঁধেছিল নয়ন
শুধু এ রূপের জালে,
তাইদু-দিন কাঁদিয়া
হায় সে বাঁধন ছাড়ালে।
মোর বাঁধিয়াছে হিয়া
তায় ছাড়াব কী দিয়া,
সখা হিয়া তো নয়ন নহে
সে ছাড়ে না কাঁদিয়া
দু-দিন কাঁদিয়া।
আজ যে ফুল প্রভাতে
হায় ফুটিল শাখাতে,
তায় দেখিল না রাতে
সে ঝরিল না কি॥
হায় রে কবি প্রবাসী
নাই হেথা সুখ-হাসি
ফুল ঝরে হলে বাসি
রয় কাঁটার ফাঁকি॥

হিন্দোলি হিন্দোলি ওঠে নীল সিন্ধু

হিন্দোল – সাদ্রা

হিন্দোলি হিন্দোলি
ওঠে নীল সিন্ধু।
গগনে উঠিল তার
কোন্ পূর্ণ ইন্দু॥
শত শুক্তি-আঁখি দিয়া
পিইছে চাঁদ অমিয়া,
শিশির রূপে ঝরিয়া
পড়ে জ্যোৎস্না-বিন্দু॥

Exit mobile version