কেউ ভোলে না কেউ ভোলে
মান্দ – কাহারবা
কেউ ভোলে না কেউ ভোলে
অতীত দিনের স্মৃতি।
কেউ দুখ লয়ে কাঁদে,
কেউ ভুলিতে গায় গীতি॥
কেউ শীতল জলদে
হেরে অশনির জ্বালা,
কেউ মঞ্জুরিয়া তোলে
তার শুষ্ক কুঞ্জ-বীথি॥
হেরে কমল-মৃণালে
কেউ কাঁটা কেহ কমল।
কেউ ফুল দলি চলে
কেউ মালা গাঁথে নিতি॥
কেউ জ্বালে না আর আলো
তার চির-দুখের রাতে,
কেউ দ্বার খুলি জাগে
চায় নব চাঁদের তিথি॥
কেন নিশি কাটালি অভিমানে
ভৈরবী – দাদরা-কাহরবা
কেন নিশি কাটালি অভিমানে।
ডুবে গেল চাঁদ দূর বিমানে॥
মান-ভরে চাতকী এ বাদলে
মিটালি না পিপাসা মেঘ-জলে।
কোথা রবে এ মেঘ কে বা জানে॥
রহে চাঁদ দূরে অমা নিশীথে,
তবু ফোটে কুমুদী সরসীতে।
রহে চাহি কলঙ্কী শশী পানে॥
যে ফাগুনে ফুল ফুটিল রাতে,
রবে না সে ফাগুন কালি প্রাতে,
যে ফুটিল না, সে শুকাবে বাগানে॥
কেন প্রাণ ওঠে কাঁদিয়া
কীর্তন
কেন প্রাণ ওঠে কাঁদিয়া
কাঁদিয়া কাঁদিয়া কাঁদিয়া গো॥
আমি যত ভুলি ভুলি করি
তত আঁকড়িয়া ধরি
তত মরি সাধিয়া
সাধিয়া সাধিয়া সাধিয়া গো।
শ্যামের সে রূপ ভোলা কি যায়
নিখিল শ্যামল যার শোভায়।
আকাশ সাগরে বনে কান্তারে
লতায় পাতায় সে রূপ ভায়।
আমারবঁধূর রূপের ছায়া বুকে ধরি
আকাশ-আরশি নীল গো,
বহে ভুবন প্লাবিয়া কালারে ভাবিয়া
কালো সাগর-সলিল গো।
আমার শ্যামেরে কাজল পরাইতে মেঘ
ঝুরে ঝুরে ঘুরে গগনে।
আমার শ্যামের মুকুট-চূড়া হয়ে শিখী
নেচে ফেরে বন-ভবনে
সখী গো –
সখী নিখিল তারে ধেয়ায় গো।
এই রাধিকার পারা কোটি শশী তারা
তার নীল বুকে লুটায় গো।
যদি ফুল হয়ে ফুটি তরু-শাখেসে
যে পল্লব হয়ে ঘিরে থাকে।
যদি একাকিনী চলি বনতলেসে
যে ছায়া হয়ে পিছে পিছে চলে।
যদি একা ঘরে মোর দীপ জ্বালি
আসে আঁধারের রূপে বনমালী। –
সখী গো –
আমার কলঙ্কী চাঁদ।
তার কলঙ্ক চেয়ে জ্যোৎস্না বেশি,
কলঙ্ক তার দেখে কে।
লোকে আমার চাঁদে কলঙ্কী কয়
জ্যোৎস্না তাহারই মেখে।
আমি তারই-র লাগি
অ কুমুদিনী হয়ে জলে ডুবে রই তারই-র লাগি
আমি চকোরিণী হয়ে নিশীথ জাগি তারই-র লাগি।
আমার প্রাণের সাগরে জোয়ার জাগে চাঁদের লাগি।
রাতে রবির কিরণ শরণ মাগে চাঁদের লাগি।
আমার কলঙ্কী চাঁদ।
আমি যেদিকে তাকাই হেরি ও-রূপ কেবল,
সে যে আমারই মাঝারে রহে করি নানা ছল।
সে যে বেণি হয়ে দুলে পিঠে চপল চতুর।
সে যে আঁখির তারায় হাসে কপট নিঠুর।
সখী গো –
সখী আঁখি মোর বিবাদী হল
সেও কালার রূপে গলে।
আমার বুকের কথা চোখে এল
চোখের জল সই সেও কালো।
সখী লো মোর মরণ ভালো!
সে যে আঁখিপাতা হয়ে থাকে ঘিরিয়া আঁখি
বনে বনে ডাকে তারই আঁখি কোয়েলা পাখি।
কাঁদে ফাল্গুনে গুণ গুণ ফুল-ভোমরা,
বন-হরিণীর চোখে তারই কাজল পরা।
তারে কেমনে ভুলিব।
বলো সখী তারে কেমনে ভুলিব।
আমার অঙ্গ জড়ায়ে দুলে সে রঙ্গে
শাড়ি সে নীলাম্বরী গো।
আমি কুল ছাড়িয়াছি, আজ দেখি সখী
দুকুল লইয়া মরি গো,
আমি বসন-ভূষণ তারই-র সখা
কেমনে তায় ভুলিব।
থাকে কবরী-বন্ধে কালো ডোর হয়ে
কাল ফণী কালো কেশে গো।
থাকে কপালের টিপে, চোখের কাজলে,
কপোলের তিলে মিশে গো।
আমার একুল ওকুল দুকুল গেল।
আমার কুলে সই পড়িল কালি
সেও কালার রূপে এল।
আমার কপালের কলঙ্ক-তিলক
সেও কালার রূপে এল।
রাখি কী দিয়া মন বাঁধিয়া,
আমার সকলই ভাসিল সখী
কালো যমুনারই জলে
সকলই ভাসিল –
রাখিকী দিয়া মন বাঁধিয়া
বাঁধিয়া বাঁধিয়া বাঁধিয়া গো ॥
ঘেরিয়া গগন মেঘ আসে
মেঘ রাগ – ত্রিতাল (দ্রুতগতি)
ঘেরিয়া গগন মেঘ আসে।
বিহ্বল ধরণি,
দশ দিশি কাঁপে তরাসে॥
বিদ্যুৎ ঝলকে
ঝামর অলকে
ঝমঝম ঝাঁঝর
বাজে ঘন আকাশে॥
শিখী নাচে হরষে
বারিধারা বরষে,
চাতক চাতকী
পাগল পিয়াসে॥
ঘোর তিমির ছাইল
বাগেশ্রী – কাওয়ালি
ঘোর তিমির ছাইল
রবি শশী গ্রহ তারা।
কাঁপে তরাসে ভীতা ধরণি
অসীম আঁধারে হারা॥
প্রলয়েশ মহাকাল
এলায়েছে জটাজাল,
নাচিছে ঝড়ের বেগে
সুরধুনী-জলধারা॥
চমকি চমকি ওঠে
চপলা চপল-ফণা,
লুকাইল শিশুশশী,
মুরছিতা দিগঙ্গনা।
চাতকী চাতক-বুকে
বিভল কাঁদিয়া সারা॥
চলো সখী জল নিতে
পুরিয়া – ত্রিতাল
চলো সখী জল নিতে
চলো ত্বরিতে।
শ্রান্ত দিনের রবি
ডোবে সরিতে॥
ঘিরিছে আঁধার
তটিনি-কিনার,
গোধূলির ছায়া পড়ে
বন-হরিতে॥
ধেনু-ডাকা বেণু বাজে
বংশীবটে,
পাখি ওড়ে, আঁকা যেন
আকাশ পটে।
বধূ ঘাটে যায়
বঁধু পথে চায়,
চিনি চিনি বাজে চুড়ি
গাগরিতে॥
ছাড়িতে পরান নাহি চায়
খাম্বাজ – দাদরা
ছাড়িতে পরান নাহি চায়
তবু যেতে হবে, হায়!
মলয়া মিনতি করে
তবু কুসুম শুকায়॥
রবে না এ মধু-রাতি
জানি তবু মালা-গাঁথি,
মালাচলিতে দলিয়া যাবে
তবু চরণে জড়ায়॥
যে কাঁটার জ্বালা সয়ে
ফোটে ব্যথা ফুল হয়ে,
আমিকাঁদিব সে কাঁটা লয়ে
নিশীথ-বেলায়।
তুমিরবে যবে পরবাসে,
আমি দূর নীলাকাশে
জাগিব তোমারই আশে
নূতন তারায়॥
জনম জনম গেল আশা-পথ চাহি
বাগেশ্রী – কাওয়ালি
জনম জনম গেল আশা-পথ চাহি।
মরু-মুসাফির চলি, পার নাহি নাহি॥
বরষ পরে বরষ আসে যায় ফিরে,
পিপাসা মিটায়ে চলি নয়নের নীরে।
জ্বালিয়া আলেয়া-শিখা
নিরাশার মরীচিকা
ডাকে মরু-কাননিকা শত গীত গাহি।
এ মরু ছিল গো কবে সাগরের বারি,
স্বপন হেরি গো তারই আজও মরুচারী।
সেই সে সাগর-তলে
যে তরি ডুবিল জলে
সে তরি-সাথিরে খুঁজি মরুপথ বাহি॥