মঙ্গলাচরণ
রঙনের রঙে রাঙা হয়ে এল শীতের কুহেলি-রাতি,
আমের বউলে বাউল হইয়া কোয়েলা খুঁজিছে সাথি।
সাথে বসন্ত-সেনা
আগে অজানার ঘেরা-টোপে তব চিরজনমের চেনা ।
পলাশ ফুলের পেয়ালা ভরিয়া পুরিয়া উঠেছে মধু,
তব অন্তরে সঞ্চরে আজ সৃজন-দিনের বধূ –
উঠিছে লক্ষ্মী ওই
তোমার ক্ষুধার ক্ষীরোদ-সাগর মন্থনে সুধাময়ী।
হারাবার ছলে চির-পুরাতনে নূতন করিয়া লভি,
প্রদোষে ডুবিয়া প্রভাতে উদিছে নিত্য একই রবি।
তাই সুন্দর সৃষ্টি
একই বরবধূ জনমে জনমে লভে নব শুভদৃষ্টি।
আদিম দিনের বধূ তব ওই আবার এসেছে ঘুরে
কত গিরিদরি নদী পার হয়ে তব অন্তর-পুরে।
কী দিব আশিস ভাই
তোমরা যে বাঁধা চির-জনমের – কোথাও বিরহ নাই।
না থাকিলে এই একটু বিরহ – এ জীবন হত কারা,
দুই তীরে তীরে বিচ্ছেদ তাই মাঝে বহে স্রোত-ধারা।
গত জনমের ছাড়াছাড়ি তাই এ মিলন এত মিঠে
সেই স্মৃতি লেখা শুভদৃষ্টির সুন্দর চাহনিতে।
ওগো আঙিনার সজিনা-সজনি,করো লাজ বরিষন
তব পুষ্পিত শাখা নেড়ে সখী, খইয়ে নাই প্রয়োজন।
আমের মুকুল আকুল হইয়া ঝরো গো দুকূলে লুটি,
বধূর আলতা চরণ-আঘাতে অশোক উঠো গো ফুটি।
বাজা শাঁক দে লো হুলু,
হারা সতী ফিরে এলে উমা হয়ে – উলু উলু উলু উলু!
মাধবী-প্রলাপ
আজ লালসা-আলস-মদে বিবশা রতি
শুয়ে অপরাজিতায় ধনি স্মরিছে পতি।
তার নিধুবন-উন্মন
ঠোঁটে কাঁপে চুম্বন,
বুকে পীন যৌবন
উঠিছে ফুঁড়ি,
মুখে কাম-কন্ঠক ব্রণ মহুয়া-কুঁড়ি!
করে বসন্ত বনভূমি সুরত কেলি,
পাশে কাম-যাতনায় কাঁপে মালতী বেলি!
ঝুরে আলু-থালু কামিনী
জেগে সারা যামিনী,
মল্লিকা ভামিনী
অভিমানে ভার,
কলি না ছুঁতেই ফেটে পড়ে কাঁটালি চাঁপার!
ছি ছি বেহায়া কী সাঁওতালি মহুয়া ছুঁড়ি,
লাজে আঁখি নিচু করে থাকে সোঁদাল-কুঁড়ি!
পাশে লাজ-বাস বিসরি
জামরুলি কিশোরী
শাখা-দোলে কি করি
খায় হিন্দোল।
হল ঘাম-ভাঙা লাজে কাম-রাঙার কপোল!
বাঁকা পলাশ-মুকুলে কার আনত আঁখি?
ওগো রাঙা-বউ বনবধূ রাগিল না কি?
তার আঁখে হানি কুঙ্কুম
ভাঙিল কি কাঁচা ঘুম?
চুমু খেয়ে বেমালুম
পালাল কি চোর?
রাগে অনুরাগে রাঙা হল আঁখি বন-বউর!
ওগো নার্গিসফুলি বনবালা-নয়নায়
ও কে সুরমা মাখায় নীল ভোমরা পাখায়!
কালো কোয়েলার রূপে ওকি
উড়িয়া বেড়ায় সখী
কামিনী-কাজল আঁখি
কেঁদে বিষাদে?
কার শীর্ণ কপোল কাঁদে অস্ত-চাঁদে!
সখী মদনের বাণ-হানা শব্দ শুনিস
ওই বিষ-মাখা মিশকালো দোয়েলের শিস!
দেখ দুই আঁখি ঝাঁপিয়া
কেঁদে ওঠে পাপিয়া—
‘চোখ গেল হা প্রিয়া’
চোখে খেয়ে শর।
কাঁদে ঘুঘুর পাখায় বন বিরহ-কাতর!
ঝরে ঝরঝর মরমর বিদায়-পাতা,
ওকি বিরহিণী বনানীর ছিন্ন খাতা?
ওকি বসন্তে স্মরি স্মরি
সারাটি বছর ধরি
শত অনুযোগ করি
লিখিয়া কত
আজ লজ্জায় ছিঁড়ে ফেলে লিপি সে যত!
আসে ঋতুরাজ, ওড়ে পাতা জয়ধ্বজা;
হল অশোক শিমুলে বন-পুষ্প রজা।
তার পাংশু চীনাংশুক
হল রাঙা কিংশুক,
উৎসুক উন্মুখ
যৌবন তার
যাচে লুন্ঠন-নির্মম দস্যু তাতার!
ওড়ে পিয়াল-কুসুম-ঝরা পরাগ কোমল
ওকি বসন্ত বনভূমি-রতি-পরিমল?
ওকি কপোলে কপোল ঘষা
ওড়ে চন্দন খসা?
বনানী কি করে গোঁসা
ছোঁড়ে ফুল-ধুল?
ওকি এলায়েছে এলো-খোঁপা সোঁদা-মাখা চুল?
নাচে দুলে দুলে তরুতলে ছায়া-শবরী,
দোলে নিতম্ব-তটে লটপট কবরী!
দেয় করতালি তালীবন,
গাহে বায়ু শন শন,
বনবধূ উচাটন
মদন-পীড়ায়,
তার কামনার হরষণে ডালিম ডাঁশায়!
নভ অলিন্দে বালেন্দু উদিল কি সই?
ও যে পলাশ-মুকুল, নব শশিকলা কই?
ও যে চির বালা ত্রয়োদশী
বিবস্ত্রা উর্বশী,
নখ-ক্ষত ওই শশী
নভ-উরসে।
ওকি তারকা না চুমো-চিন আছে মুরছে?
দূরে সাদা মেঘ ভেসে যায়— শ্বেত সারসী,
ওকি পরিদের তরি অপ্সরি-আরশি
ওকি পাইয়া পীড়ন-জ্বালা
তপ্ত উরসে বালা
শ্বেতচন্দন লালা
করিছে লেপন?
ওকি পবন খসায় কার নীবি-বন্ধন?
হেথা পুষ্পধনু লেখে লিপি রতিরে
হল লেখনি তাহার লিচু-মুকুল চিরে!
লেখে চম্পা কলির পাতে,
ভোমরা আখর তাতে,
দখিনা হাওয়ার হাতে
দিল সে লেখা।
হেথা ‘ইউসোফ’ কাঁদে, হোথা কাঁদে ‘জুলেখা’!
রাখিবন্ধন
সই পাতাল কি শরতে আজিকে স্নিগ্ধ আকাশ ধরণি?
নীলিমা বাহিয়া সওগাত নিয়া নামিছে মেঘের তরণি!
অলকার পানে বলাকা ছুটিছে মেঘ-দূত-মন মোহিয়া
চঞ্চুতে রাঙা কলমির কুঁড়ি – মরতের ভেট বহিয়া।
সখীর গাঁয়ের সেঁউতি-বোঁটার ফিরোজায় রেঙে পেশোয়াজ
আশমানি আর মৃন্ময়ী সখী মিশিয়াছে মেঠো পথ-মাঝ।
আকাশ এনেছে কুয়াশা-উড়ুনি, আশমানি-নীল কাঁচুলি,
তারকার টিপ, বিজুলির হার, দ্বিতীয়া-চাঁদের হাঁসুলি।
ঝরা-বৃষ্টির ঝর ঝর আর পাপিয়া শ্যামার কূজনে
বাজে নহবত আকাশ ভুবনে – সই পাতিয়েছে দুজনে!
আকাশের দাসী সমীরণ আনে শ্বেত পেঁজা মেঘ ফেনা ফুল,
হেথা জলে-থলে কুমুদে-কমলে আলুথালু ধরা বেয়াকুল।
আকাশ-গাঙে কি বান ডেকেছে গো, গান গেয়ে চলে বরষা,
বিজুরির গুন টেনে টেনে চলে মেঘ-কুমারীরা হরষা।
হেথা মেঘ-পানে কালো চোখ হানে মাটির কুমার মাঝিরা,
জল ছুঁড়ে মারে মেঘ-বালাদল, বলে, ‘চাহে দেখ পাজিরা!’
কহিছে আকাশ, “ওলো সই, তোর চকোরে পাঠাস নিশিতে,
চাঁদ ছেনে দেব জোছনা-অমৃত তোর ছেলে যত তৃষিতে।
আমারে পাঠাস সোঁদা-সোঁদা-বাস তোর ও-মাটির সুরভি
প্রভাত-ফুলের পরিমল মধু, সন্ধ্যাবেলার পুরবি।”
হাসিয়া উঠিল আলোকে আকাশ নত হয়ে এলো পুলকে
লতা-পাতা-ফুলে বাঁধিয়া আকাশে ধরা কয়, “সই, ভূলোকে
বাঁধা পলে আজ”, চেপে ধরে বুকে লজ্জায় ওঠে কাঁপিয়া,
চুমিল আকাশ নত হয়ে মুখে ধরণির বুকে ঝাঁপিয়া।