দারিদ্র্য
হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান্।
তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীষ্টের সম্মান
কন্টক-মুকুট শোভা।-দিয়াছ, তাপস,
অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস;
উদ্ধত উলঙ্গ দৃষ্টি, বাণী ক্ষুরধার,
বীণা মোর শাপে তব হ’ল তরবার!
দুঃসহ দাহনে তব হে দর্পী তাপস,
অম্লান স্বর্ণেরে মোর করিলে বিরস,
অকালে শুকালে মোর রূপ রস প্রাণ!
শীর্ণ করপুট ভরি’ সুন্দরের দান
যতবার নিতে যাই-হে বুভুক্ষু তুমি
অগ্রে আসি’ কর পান! শূন্য মরুভূমি
হেরি মম কল্পলোক। আমার নয়ন
আমারি সুন্দরে করে অগ্নি বরিষণ!
বেদনা-হলুদ-বৃন্ত কামনা আমার
শেফালির মত শুভ্র সুরভি-বিথার
বিকশি’ উঠিতে চাহে, তুমি হে নির্মম,
দলবৃন্ত ভাঙ শাখা কাঠুরিয়া সম!
আশ্বিনের প্রভাতের মত ছলছল
ক’রে ওঠে সারা হিয়া, শিশির সজল
টলটল ধরণীর মত করুণায়!
তুমি রবি, তব তাপে শুকাইয়া যায়
করুণা-নীহার-বিন্দু! ম্লান হ’য়ে উঠি
ধরণীর ছায়াঞ্চলে! স্বপ্ন যায় টুটি’
সুন্দরের, কল্যাণের। তরল গরল
কন্ঠে ঢালি’ তুমি বল, ‘অমৃতে কি ফল?
জ্বালা নাই, নেশা নাই. নাই উন্মাদনা,-
রে দুর্বল, অমরার অমৃত-সাধনা
এ দুঃখের পৃথিবীতে তোর ব্রত নহে,
তুই নাগ, জন্ম তোর বেদনার দহে।
কাঁটা-কুঞ্জে বসি’ তুই গাঁথিবি মালিকা,
দিয়া গেনু ভালে তোর বেদনার টিকা!….
গাহি গান, গাঁথি মালা, কন্ঠ করে জ্বালা,
দংশিল সর্বাঙ্গে মোর নাগ-নাগবালা!….
ভিক্ষা-ঝুলি নিয়া ফের’ দ্বারে দ্বারে ঋষি
ক্ষমাহীন হে দুর্বাসা! যাপিতেছে নিশি
সুখে রব-বধূ যথা-সেখানে কখন,
হে কঠোর-কন্ঠ, গিয়া ডাক-‘মূঢ়, শোন্,
ধরণী বিলাস-কুঞ্জ নহে নহে কারো,
অভাব বিরহ আছে, আছে দুঃখ আরো,
আছে কাঁটা শয্যাতলে বাহুতে প্রিয়ার,
তাই এবে কর্ ভোগ!-পড়ে হাহাকার
নিমেষে সে সুখ-স্বর্গে, নিবে যায় বাতি,
কাটিতে চাহে না যেন আর কাল-রাতি!
চল-পথে অনশন-ক্লিষ্ট ক্ষীণ তনু,
কী দেখি’ বাঁকিয়া ওঠে সহসা ভ্রূ-ধনু,
দু’নয়ন ভরি’ রুদ্র হানো অগ্নি-বাণ,
আসে রাজ্যে মহামারী দুর্ভিক্ষ তুফান,
প্রমোদ-কানন পুড়ে, উড়ে অট্টালিকা,-
তোমার আইনে শুধু মৃত্যু-দন্ড লিখা!
বিনয়ের ব্যভিচার নাহি তব পাশ,
তুমি চান নগ্নতার উলঙ্গ প্রকাশ।
সঙ্কোচ শরম বলি’ জান না ক’ কিছু,
উন্নত করিছ শির যার মাথা নীচু।
মৃত্যু-পথ-যাত্রীদল তোমার ইঙ্গিতে
গলায় পরিছে ফাঁসি হাসিতে হাসিতে!
নিত্য অভাবের কুন্ড জ্বালাইয়া বুকে
সাধিতেছ মৃত্যু-যজ্ঞ পৈশাচিক সুখে!
লক্ষ্মীর কিরীটি ধরি, ফেলিতেছ টানি’
ধূলিতলে। বীণা-তারে করাঘাত হানি’
সারদার, কী সুর বাজাতে চাহ গুণী?
যত সুর আর্তনাদ হ’য়ে ওঠে শুনি!
প্রভাতে উঠিয়া কালি শুনিনু, সানাই
বাজিছে করুণ সুরে! যেন আসে নাই
আজো কা’রা ঘরে ফিরে! কাঁদিয়া কাঁদিয়া
ডাকিছে তাদেরে যেন ঘরে ‘সানাইয়া’!
বধূদের প্রাণ আজ সানা’য়ের সুরে
ভেসে যায় যথা আজ প্রিয়তম দূরে
আসি আসি করিতেছে! সখী বলে, ‘বল্
মুছিলি কেন লা আঁখি, মুছিলি কাজল?….
শুনিতেছি আজো আমি প্রাতে উঠিয়াই
‘ আয় আয়’ কাঁদিতেছে তেমনি সানাই।
ম্লানমুখী শেফালিকা পড়িতেছে ঝরি’
বিধবার হাসি সম-স্নিগ্ধ গন্ধে ভরি’!
নেচে ফেরে প্রজাপতি চঞ্চল পাখায়
দুরন্ত নেশায় আজি, পুষ্প-প্রগল্ভায়
চুম্বনে বিবশ করি’! ভোমোরার পাখা
পরাগে হলুদ আজি, অঙ্গে মধু মাখা।
উছলি’ উঠিছে যেন দিকে দিকে প্রাণ!
আপনার অগোচরে গেয়ে উঠি গান
আগমনী আনন্দের! অকারণে আঁখি
পু’রে আসে অশ্রু-জলে! মিলনের রাখী
কে যেন বাঁধিয়া দেয় ধরণীর সাথে!
পুষ্পঞ্জলি ভরি’ দু’টি মাটি মাখা হাতে
ধরণী এগিয়ে আসে, দেয় উপহার।
ও যেন কনিষ্ঠা মেয়ে দুলালী আমার!-
সহসা চমকি’ উঠি! হায় মোর শিশু
জাগিয়া কাঁদিছ ঘরে, খাওনি ক’ কিছু
কালি হ’তে সারাদিন তাপস নিষ্ঠুর,
কাঁদ’ মোর ঘরে নিত্য তুমি ক্ষুধাতুর!
পারি নাই বাছা মোর, হে প্রিয় আমার,
দুই বিন্দু দুগ্ধ দিতে!-মোর অধিকার
আনন্দের নাহি নাহি! দারিদ্র্য অসহ
পুত্র হ’য়ে জায়া হয়ে কাঁদে অহরহ
আমার দুয়ার ধরি! কে বাজাবে বাঁশি?
কোথা পাব আনন্দিত সুন্দরের হাসি?
কোথা পাব পুষ্পাসব?-ধুতুরা-গেলাস
ভরিয়া করেছি পান নয়ন-নির্যাস!….
আজো শুনি আগমনী গাহিছে সানাই,
ও যেন কাঁদিছে শুধু-নাই কিছু নাই!
দ্বারে বাজে ঝঞ্ঝার জিঞ্জির
দ্বারে বাজে ঝঞ্ঝার জিঞ্জির,
খোলো দ্বার ওঠো ওঠো বীর!
নিদাঘের রৌদ্র খর কন্ঠে শোনে প্রদীপ্ত আহ্বান—
জয় অভিনব যৌবন-অভিযান!…
শ্রান্ত গত বরষের বিশীর্ণ শর্বরী
স্থলিত মন্থর পদে দূরে যায় সরি
বিরাটের চক্রনেমিতলে।
চম্পমালা দোলাইয়া গলে
আলোক-তাঞ্জামে আসে অভিযান-রথী,
ঘুম-জাগা বিহগের কন্ঠে কন্ঠে আনন্দ-আরতি
ভেসে চলে খেয়া-সম দিকে দিকে আজি।
বজ্রাঘাতে ঘন ঘন আকাশ-কাঁসর ওঠে বাজি।
মরমর-মঞ্জীর-পায়ে মাতে ঘূর্ণি-নটী
বিশুষ্ক পল্লব-নৃত্যে, ডগমগ পড়িছে উছটি
অসহ আনন্দ-মদে!
সুন্দর আসিছে পিছে অবগাহি বেদনার জবা-রক্ত হ্রদে।
ওড়ে তার ধূলি-রাঙা গৈরিক পতাকা
বৈশাখের বাম করে! ক্ষত-চিহ্ন আঁকা
নিখিল পীড়িত মুখে মুখচ্ছবি তার।
একী রূপ হেরি তব বেদনার মুকুরে আমার
অপরূপ! ওগো অভিনব!
কত অশ্রু জমাইয়া কত দিনে গড়েছ এ তরবারি তব?
সাঁতরিয়া কত অশ্রুজল,
হে রক্ত-দেবতা মোর, পেলে আজি স্থল?
কোন সে বেদনা-পানি বাণী অশ্রুমতী
করিতেছে তোমার আরতি?
মন্দির-বেদির শ্বেত প্রস্তরের আস্তরণ তলে
এলায়িত কুন্তলা কে স্খলিত অঞ্চলে
ছিন্নপর্ণা স্থলপদ্ম-প্রায়
প্রাণহীন দেবতার চরণে লুটায়?
জানি, তারই স-বেদন আবেদনখানি
খড়্গ হয়ে ঝলে তব করে, শস্ত্রপাণি!
মরণ-উৎসবে রণে ক্রন্দন-বাসরে
নিখিল-ক্রন্দসী, বীর, তব স্তব করে!
বধূ তব নিখিলের প্রাণ
বিদায়-গোধূলি-লগ্নে মৃত্যু-মঞ্চে করে মাল্য দান! …
হে সুন্দর, মোরা তব দূর যাত্রাপথ
করিতেছি সহজ সরল, রচিতেছি তব ভবিষ্যৎ!
সতেজ তরুণ কন্ঠে তব আগমনি
গাহিতেছি রাত্রিদিন, দৃপ্ত জয়ধ্বনি
ঘোষিতেছে আমাদের বাণী বজ্র-ঘোষ!
বুকে বুকে জ্বালিতেছি বহ্নি-অসন্তোষ।
আশার মশাল জ্বালি আলোকিয়া চলেছি আঁধার
অগ্রদূত নিশান-বরদার!
অতন্দ্রিত নিশীথ-প্রহরী—হাঁকিতেছি প্রহরে প্রহরে,
যৌবনের অভিযান-সেনাদল, ওরে,
ওঠ তোরা করি ত্বরা!
তিমিরাবরণ খোলো, ছুঁড়ে ফেলো স্বপন-পসরা!
ওঠো ওঠো বীর,
দ্বারে বাজে ঝঞ্ঝার জিঞ্জির!
বিপ্লব-দেবতা ওই শিয়রে তোমার
দাঁড়ায়েছ আসিয়া আবার!
বারে বারে এসেছে দেবতা
যুগান্তের এনেছে বারতা।
বারে বারে করাঘাত করি
দ্বারে দ্বারে হেঁকেছি প্রহরী
নিদ্রাহীন রাত্রিদিন,
আঘাতে ছিঁড়েছে তন্ত্রী, ভাঙিয়াছে বীণ;
জাগিসনি তোরা,
ফিরে গেছে দেবতা সুন্দর, এসেছে কুৎসিত মৃত্যু জরা।
এবার দুয়ার ভাঙি শিয়রে দেবতা যদি
আসিয়াছে পারাইয়া গিরি দরি সিন্ধু নদ নদী,
ওরে চির-সুন্দরের পূজারির দল,
এবার এ লগ্ন যেন না হয় বিফল!
বারে বারে করিয়াছি যারে অপমান,
মন্দির-প্রদীপ যারে বারে বারে করেছি নির্বাণ,
বরণ করিতে হবে তারে।
পলে পলে বিলাইয়া মোরা আপনারে
যে আত্মদানের ডালা রেখেছি সাজায়ে
তাই দান দিব রক্ত-দেবতার পায়ে!
এবার পরান খুলে এ দর্প করিতে যেন পারি,
জিতি আর হারি,
ধরিয়াছি তোমার পতাকা—শুনিয়াছি তোমার আদেশ,
আত্মবলি দিয়া দিয়া আপনারে করেছি নিঃশেষ!
দাঁড়ায়েছি আসি তব পাশ
শিরে ধরি অনির্বাণ জ্যোতিষ্কের উলঙ্গ আকাশ!
বাহিরের রাজপথ বাহি,
হে সারথি, চলিয়াছি তব রথ চাহি!
আলোক-কিরণ
করিয়াছি পান মোরা পুরিয়া নয়ন! —
সুপ্তরাতে গুপ্তপথ বাহি,
আসিয়াছে অসুন্দর শত্রুর সিপাহি,
অকস্মাৎ
পিছে হতে করেছে আঘাত।
মসিময় করিয়াছে তব রশ্মিপথ,
নিন্দার প্রস্তর হানি রচেছে পর্বত,
পথে পথে খুঁড়িয়াছে মিথ্যার পরিখা,
চোখে-মুখে লিখিয়াছের ভন্ডামির নীতিবাণী লিখা,
দলে দলে করিয়াছে রিরংসার উলঙ্গ চিৎকার,
ফুঁ দিয়া নিবাতে গেছে, হে ভাস্কর, প্রদীপ তোমার!
হে সুন্দর, মোরা শুধু তব অনুরাগে
কোনো দিকে দেখি নাই, চলিয়াছি আগে
লঙ্ঘি বাধা, লঙ্ঘিয়া নিষেধ,
মানিনিকো কোরান পুরাণ শাস্ত্র, মানিনিকো বেদ!
নির্বেদ তোমার ডাকে শুধু চলিয়াছি,
যখনই ডেকেছ তুমি, হাঁকিয়াছি : ‘আছি, মোরা আছি!’
ভরি তব শুভ্র শুচি ললাট-অঙ্গন
কলঙ্ক-তিলক-পঙ্ক করেছে লেপন,
বারে বারে মুছিয়াছিল, প্রিয় ওগো প্রিয়,
তোমার ললাট-পঙ্কে ম্লান হল আমাদের রক্ত-উত্তরীয়!
জাদুকর মিথ্যুকের সপ্তসিন্ধুনীর
কত দিনে হব পার, পাব শভ্র আনন্দের তীর?
হে বিপ্লব-সেনাধিপ, হে রক্ত-দেবতা,
কহো, কহো কথা!
শ্মশানের শিবা-মাঝে হে শিব সুন্দর
এসো এসো, দাও তব চরম নির্ভর!
দাও বল, দাও আশা, দাও তব পরম আশ্বাস,
হিংসুকের বদ্ধদ্বার জতুগৃহে আনো অবকাশ!
অপগত হোক এ-সংশয়,
দশদিকে দিগঙ্গনা গেয়ে যাক যৌবনের জয়!
অসুন্দর মিথ্যুকের হোক পরাজয়,
এসো এসো আনন্দ-সুন্দর, জাগো জ্যোতির্ময়!
১৩ চৈত্র, ১৩৩৩