অভিযান
নতুন পথের যাত্রা পথিক
চালাও অভিযান!
উচ্চকণ্ঠে উচ্চারো আজ –
‘মানুষ মহীয়ান!’
চারদিকে আজ ভীরুর মেলা,
খেলবি কে আয় নতুন খেলা?
জোয়ার জলে ভাসিয়ে ভেলা
বাইবি কে উজান?
পাতাল ফেড়ে চলবি মাতাল
স্বর্গে দিবি টান॥
সমর-সাজের নাই রে সময়
বেরিয়ে তোরা আয়,
আজ বিপদের পরশ নেব
নাঙ্গা আদুল গায়।
আসবে রণ-সজ্জা কবে,
সেই আশাতেই রইলি সবে!
রাত পোহাবে প্রভাত হবে
গাইবে পাখি গান।
আয় বেরিয়ে, সেই প্রভাতে
ধরবি যারা তান॥
আধাঁর ঘোরে আত্মঘাতী
যাত্রা পথিক সব
এ উহারে হানছে আঘাত
করছে কলরব।
অভিযানের বীর সেনাদল!
জ্বালাও মশাল, চল আগে চল!
কুচকাওয়াজের বাজাও মাদল,
গাও প্রভাতের গান!
ঊষার দ্বারে পৌঁছে গাবি
‘জয় নব উত্থান!’
উন্মনা
ওগো আজ কেন মন উদাস এমন কাঁদছে পুবের হাওয়ার পারা।
কে যেন মোর নেই গো কাছে কোন প্রিয়-মুখ আজকে হারা॥
দিকে দিকে বিবাগি মন
খুঁজে ফেরে কোন প্রিয়জন।
কোথায় সে মোর মনের মতন
বুকের রতন নয়নতারা॥
ঘর-দুয়ার আজ বাউল যেন শীতল উদাস মাঠের মতো,
ঝরছে গাছে সবুজ পাতা আমার মনের – বনের যত।
যেথাই থাক, জানি আমি, –
হে মোর সুদূর জীবন-স্বামি!–
সন্ধে হলে আসবে নামি
মুছিয়ে দেবে নয়ন-ধারা॥
গোপন-প্রিয়া
পাইনি ব’লে আজো তোমায় বাসছি ভালো, রাণি,
মধ্যে সাগর, এ-পার ও-পার করছি কানাকানি!
আমি এ-পার, তুমি ও-পার,
মধ্যে কাঁদে বাধার পাথার
ও-পার হ’তে ছায়া-তরু দাও তুমি হাত্ছানি,
আমি মরু, পাইনে তোমার ছায়ার ছোঁওয়াখানি।
নাম-শোনা দুই বন্ধু মোরা, হয়নি পরিচয়!
আমার বুকে কাঁদছে আশা, তোমার বুকে ভয়!
এই-পারী ঢেউ বাদল-বায়ে
আছড়ে পড়ে তোমার পায়ে,
আমার ঢেউ-এর দোলায় তোমার ক’রলো না কূল ক্ষয়,
কূল ভেঙেছে আমার ধারে-তোমার ধারে নয়!
চেনার বন্ধু, পেলাম না ক’ জানার অবসর।
গানের পাখী ব’সেছিলাম দু’দিন শাখার’ পর।
গান ফুরালো যাব যবে
গানের কথাই মনে রবে,
পাখী তখন থাকবো না ক’-থাকবে পাখীর ¯^i,
উড়ব আমি,-কাঁদবে তুমি ব্যথার বালুচর!
তোমার পারে বাজ্ল কখন আমার পারের ঢেউ,
অজানিতা! কেউ জানে না, জানবে না ক’ কেউ।
উড়তে গিয়ে পাখা হ’তে
একটি পালক প’ড়লে পথে
ভুলে’ প্রিয় তুলে যেন খোঁপায় গুঁজে নেও!
ভয় কি সখি? আপনি তুমি ফেলবে খুলে এ-ও!
বর্ষা-ঝরা এমনি প্রাতে আমার মত কি
ঝুরবে তুমি এক্লা মনে, বনের কেতকী?
মনের মনে নিশীথ্-রাতে
চুম্ দেবে কি কল্পনাতে?
স্বপ্ন দেখে উঠবে জেগে, ভাববে কত কি!
মেঘের সাথে কাঁদবে তুমি, আমার চাতকী!
দূরের প্রিয়া! পাইনি তোমায় তাই এ কাঁদন-রোল!
কূল মেলে না,-তাই দরিয়ায় উঠতেছে ঢেউ-দোল!
তোমায় পেলে থাম্ত বাঁশী,
আস্ত মরণ সর্বনাশী।
পাইনি ক’ তাই ভ’রে আছে আমার বুকের কোল।
বেণুর হিয়া শূন্য ব’লে উঠবে বাঁশীর বোল।
বন্ধু, তুমি হাতের-কাছের সাথের-সাথী নও,
দূরে যত রও এ হিয়ার তত নিকট হও।
থাকবে তুমি ছায়ার সাথে
মায়ার মত চাঁদনী রাতে!
যত গোপন তত মধুর-নাই বা কথা কও!
শয়ন-সাথে রও না তুমি নয়ন-পাতে রও!
ওগো আমার আড়াল-থাকা ওগো স্বপন-চোর!
তুমি আছ আমি আছি এই তো খুশি মোর।
কোথায় আছ কেম্নে রাণি
কাজ কি খোঁজে, নাই বা জানি!
ভালোবাসি এই আনন্দে আপনি আছি ভোর!
চাই না জাগা, থাকুক চোখে এমনি ঘুমের ঘোর!
রাত্রে যখন এক্লা শোব-চাইবে তোমার বুক,
নিবিড়-ঘন হবে যখন একলা থাকার দুখ,
দুখের সুরায় মস্ত্ হ’য়ে
থাকবে এ-প্রাণ তোমায় ল’য়ে,
কল্পনাতে আঁক্ব তোমার চাঁদ-চুয়ানো মুখ!
ঘুমে জাগায় জড়িয়ে র’বে, সেই তো চরম সুখ!
গাইব আমি, দূরের থেকে শুনবে তুমি গান।
থাম্বে আমি-গান গাওয়াবে তোমার অভিমান!
শিল্পী আমি, আমি কবি,
তুমি আমার আঁকা ছবি,
আমার লেখা কাব্য তুমি, আমার রচা গান।
চাইব না ক’, পরান ভ’রে ক’রে যাব দান।
তোমার বুকে স্থান কোথা গো এ দূর-বিরহীর,
কাজ কি জেনে?- তল কেবা পায় অতল জলধির।
গোপন তুমি আস্লে নেমে
কাব্যে আমার, আমার প্রেমে,
এই-সে সুখে থাক্বে বেঁচে, কাজ কি দেখে তীর?
দূরের পাখী-গান গেয়ে যাই, না-ই বাঁধিলাম নীড়!
বিদায় যেদিন নেবো সেদিন নাই-বা পেলাম দান,
মনে আমায় ক’রবে না ক’-সেই তো মনে স্থান!
যে-দিন আমায় ভুলতে গিয়ে
কর্বে মনে, সে-দিন প্রিয়ে
ভোলার মাঝে উঠবে বেঁচে, সেই তো আমার প্রাণ!
নাই বা পেলাম, চেয়ে গেলাম, গেলে গেলাম গান!
চাঁদনিরাতে
কোদালে মেঘের মউজ উঠেছে গগনের নীল গাঙে,
হাবুডুবু খায় তারা-বুদ্বুদ, জোছনা সোনায় রাঙে।
তৃতীয় চাঁদের ‘শাম্পানে’চড়ি চলিছে আকাশ-প্রিয়া,
আকাশ দরিয়া উতলা হল গো পুতলায় বুকে নিয়া।
তৃতীয়া চাঁদের বাকি ‘তেরো কলা’আবছা কালোতে আঁকা,
নীলিম প্রিয়ার নীলা ‘গুল রুখ’ অবগুণ্ঠনে ঢাকা।
সপ্তর্ষির তারা-পালঙ্কে ঘুমায় আকাশ-রানি,
সেহেলি ‘লায়লি’ দিয়ে গেছে চুপে কুহেলি-মশারি টানি।
দিকচক্রের ছায়া-ঘন ওই সবুজ তরুর সারি,
নীহার নেটের কুয়াশা-মশারি – ও কি বর্ডার তারই?
সাতাশ তারার ফুল-তোড়া হাতে আকাশ নিশুতি রাতে
গোপনে আসিয়া তারা-পালঙ্কে শুইল প্রিয়ার সাথে।
উহু উহু করি কাঁচা ঘুম ভেঙে জেগে ওঠে নীলা হুরি,
লুকিয়ে দেখে তা ‘চোখ গেল’বলে চেঁচায় পাপিয়া ছুঁড়ি!
‘মঙ্গল’তারা মঙ্গল-দীপ জ্বালিয়া প্রহর জাগে,
ঝিকিমিকি করে মাঝে মাঝে – বুঝি বঁধুর নিশাস লাগে।
উল্কা-জ্বালার সন্ধানী-আলো লইয়া আকাশ-দ্বারী
‘কাল-পুরুষ’ সে জাগি বিনিদ্র করিতেছে পায়চারি।
সেহেলিরা রাতে পলায়ে এসেছে উপবনে কোন আশে,
হেথা হোথা ছোটে পিকের কণ্ঠে ফিক ফিক করে হাসে।
আবেগে সোহাগে আকাশ-প্রিয়ার চিবুক বাহিয়া ও কি
শিশিরের রূপে ঘর্মবিন্দু ঝরে ঝরে পড়ে সখী,
নবমী চাঁদের সসারে ও কে গো চাঁদিনি-শিরাজি ঢালি
বধূর অধরে ধরিয়া কহিছে – ‘তহুরা পিয়ো লো আলি!’
কার কথা ভেবে তারা-মজলিশে দূরে একাকিনী সাকি
চাঁদের সসারে কলঙ্ক-ফুল আনমনে যায় আঁকি!…
ফরহাদ-শিরী লায়লি-মজনুঁ মগজে করেছে ভিড়,
মস্তানা শ্যামা দধিয়াল টানে বায়ু-বেয়ালার মিড়!
আনমনা সাকি! অমনি আমরাও হৃদয়-পেয়ালা-কোণে
কলঙ্ক-ফুল আনমনে সখী লিখো মুছো ক্ষণে ক্ষণে!