০৫. আলো-আঁধারি
বাদলের নিশি অবসানে মেঘ-আবরণ অপসারি
ওঠে যে সূর্য – প্রদীপ্ততর রূপ তার মনোহারী।
সিক্তশাখায় মেঘ-বাদলের ফাঁকে
‘বউ কথা কও’ পাপিয়া যখন ডাকে–
সে গান শোনায় মধুরতর গো সজল জলদচারী!
বর্ষায়-ধোয়া ফুলের সুষমা বর্ণিতে নাহি পারি!
কান্নার চোখ-ভরা জল নিয়ে আসে শিশু অভিমানী,
হাসির বিজলি চমকি লুকায় তার কাছে লাজ মানি।
কয়লার কালি মাখি যবে হিরা ওঠে,
সে রূপ যেন গো বেশি করে চোখে ফোটে!
নীল নভো ঠোঁটে এক ফালি হাসি দ্বিতীয়ার চাঁদখানি
পূর্ণশশীর চেয়ে ভালো লাগে – কেন কেহ নাহি জানি!
পথের সকল ধুলো কাদা মাখি যে শিশু ফেরে গো ঘরে,
সে কি গো পাইতে বেশি ভালোবাসা যত্ন জননী করে?
মুছাবেন মাতা অঞ্চল দিয়া বলে
শিশুর নয়নে অকারণে বারি ঝলে?
ধরার আঁচলে পাথরের সাথে সোনা বাঁধা এক থরে,
বিষে নীল হয়ে আসে মণি – সে কি অধিক মূল্য তরে?
ডুবে এক-গলা নয়নের জলে তবে কি কমল ফোটে?
মৃণাল-কাঁটার বেদনায় কি ও শতদল হয়ে ওঠে?
শত সুষমায় ফোটাবে বলিয়া কিরে
মেঘ এত জল ঢালে কুসুমের শিরে?
দগ্ধ লোহায় না বিঁধিলে সুর ফোটে না কি বেণু-ঠোঁটে?
তত সুগন্ধ ওঠে চন্দনে যত ঘষে শিলাতটে!
মুছাতে এল যে উৎপীড়িত এ নিখিলের আঁখিজল,
সে এল গো মাখি শুভ্র তনুতে বিষাদের পরিমল!
অথবা সে চির-সুখ-দুখ-বৈরাগী
আসিল হইয়া নিখিল-বেদনা-ভাগী!
জানে বনমাতা, গন্ধে ও রূপে মাতাবে যে বনতল
সে ফুল-শিশুর শয়ন কেন গো কণ্টক-অঞ্চল!
শুনে হাসি পায় এত শোকে হায়! বিশ্বের পিতা যার
‘হাবিব’ বন্ধু, হারায়ে পিতায় সে এল ধরা মাঝার!
খোদার লীলা সে চির-রহস্যময় –
বন্ধুর পথ এত বন্ধুর হয়!
আবির্ভাবের পূর্বে পিতৃহীন হয়ে – বার বার
ঘোষিল সে যেন, আমি ভাই সাথি পিতাহীন সবাকার!
আলোকের শিশু এল গো জড়ায়ে আঁধার-উত্তরীয়
জানাতে যেন গো ‘বিষ-জর্জর, এবার অমৃত পিয়ো!’
তৃষ্ণাতুরের পিপাসা করিতে দূর
হৃদয় নিঙাড়ি রক্ত দেয় আঙুর!
শোক-ছলছল ধরায় কেমনে হাসি অমিয়
আসিবে সবার সকল ব্যথার ব্যথী বন্ধু ও প্রিয়!
পূর্ণশশীরে হেরিয়া যখন সাগরে জোয়ার লাগে,
উথলায় জল তত কলকল যত আনন্দ জাগে!
তেমনই পূর্ণশশীরে বক্ষে ধরি
‘আমিনার’ চোখে শুধু জল ওঠে ভরি!
সুখের শোকের গঙ্গা-যমুনা বিষাদে ও অনুরাগে
বয়ে চলে, যেন ‘দজ্লা’ ‘ফোরাত’ বসরা-কুসুম-বাগে!
কাঁদিছে আমিনা, হাসিছেন খোদা,‘ওরে ও অবুঝ মেয়ে,
ডুবিয়াছে চাঁদ উঠিয়াছে রবি বক্ষে দেখনা চেয়ে,
ভবনের স্নেহ কাড়িয়া কঠোর করে
ভুবনের প্রীতি আনিয়া দিয়াছি ওরে!
ঘর সে কি ধরে বিশ্ব যাহার আলোকে উঠিবে ছেয়ে?
নিখিল যাহার আত্মীয় – ভুলে রবে সে স্বজন পেয়ে?
নীড় নহে তার – যে পাখি উদার অম্বরে গাবে গান,
কেবা তার পিতা কেবা তার মাতা, সকলই তার সমান!
নাহি দুখ সুখ আত্মীয়, নাই গেহ,
একের মাঝারে সে যে গো সর্বদেহ,
এ নহে তোমার কুটির-প্রদীপ ভোরে যার অবসান,
রবি এ – জনমি পূর্ব-অচলে ঘোরে সারা আশমান!’
সে বাণী যেন গো শুনিয়া আমিনা-জননী রহে অটল,
ক্ষণেক রাঙিয়া স্তব্ধ রহে গো যেমন পূর্বাচল!
কহিল জননী আপনার মনে মনে, –
‘আমার দুলালে দিলাম সর্বজনে!’
থির হয়ে গেল পড়িতে পড়িতে কপোলে অশ্রুজল।
উদিল চিত্তে রাঙা রামধনু, টুটিল শোক-বাদল!
০৬. দাদা
সব-কনিষ্ঠ পুত্র সে প্রিয় আবদুল্লার শোকে,
সেদিন নিশীথে ঘুম নাকো মুত্তালিবের চোখে!
পঁচিশ বছর ছিল যে পুত্র আঁখির পুতলা হয়ে,
বৃদ্ধ পিতারে রাখিয়া মৃত্যু তারেই গেল কি লয়ে!
হয়ে আঁখিজল ঝরে অবিরল পঁচিশ-বছরি স্মৃতি,
সে স্মৃতির ব্যথা যতদিন যায় তত বাড়ে হায় নিতি!
বাহিরে ও ঘরে বক্ষে নয়নে অশ্রুতে তারে খোঁজে
সহসা বিধবা আমিনারে হেরি সভয়ে চক্ষু বোজে!
ওরে ও অভাগি, কে দিল ও বুকে ছড়ায়ে সাহারা-মরু?
অসহায় লতা গড়াগড়ি যায় হারায়ে সহায়-তরু!
আঙনে বেড়ায় ও যেন রে হায় শোকের শুভ্রশিখা,
রজনিগন্ধা বিধবা মেয়েরে লয়ে কাঁদে কাননিকা!
মন্থরগতি বেদনা-ভারতী আমিনা আঙনে চলে,
হেরিতে সহসা মুত্তালিবের আঁধার চিত্ততলে
ঈষৎ আলোর জোনাকি চমকি যায় যেন ক্ষণে ক্ষণে,
আবদুল্লার স্মৃতি রহিয়াছে ওই আমিনার সনে।
আসিবে সুদিন আসিবে আবার, পুত্রে যে ছিল প্রাণ
পুত্র হইতে পৌত্রে আসিয়া হবে যে অধিষ্ঠান।
দিন গোনে মনে মনে আর কয়, ‘বাকি আর কত দিন,
লইয়া অ-দেখা পিতার স্মৃতিরে আসিবি পিতৃহীন!’
মুত্তালিবের আঁধার চিত্তে জ্বলেছে সহসা বাতি,
সেদিন আসিবে যেন শেষ হলে আজিকার এই রাতি!
চোখে ঘুম নাই শূন্যে বৃথাই নয়ন ঘুরিয়া মরে,–
নিশি-শেষে যেন অতন্দ্র চোখে তন্দ্রা আসিল ভরে!
কত জাগে আর লয়ে হাহাকার, আঁধারের গলা ধরি
আর কতদিন কাঁদিবে গো, চোখে অশ্রু গিয়াছে মরি!
আয় ঘুম হায়, হয়তো এবার স্বপনে হেরিব তারে,
বিরাম-বিহীন জাগি নিশিদিন খুঁজিয়া পাইনি যারে!
হেরিল মুত্তালিব অপরূপ স্বপ্ন তন্দ্রা-ঘোরে,–
অভূতপূর্ব আওয়াজ যেন গো বাজিছে আকাশ ভরে!
ফেরেশতা সব যেন গগনের নীল শামিয়ানা-তলে
জমায়েত হয়ে তকবীর হাঁকে, সে আওয়াজ জলে থলে
উঠিল রণিয়া। ‘সাফা’ ‘মারওয়ান’ গিরি-যুগ সে আওয়াজে
কাঁপিতে লাগিল, উঠিল আরাব, ‘আসিল সে ধরা মাঝে!’
কে আসিল ? সে কী আমিনার ঘরে? ছুটিতে ছুটিতে যেন
আসিল যে ঘরে আমিনা! ওকি ও, গৃহের ঊর্ধ্বে কেন
এত সাদা মেঘ ছায়া করে আছে? শত স্বর্গের পাখি
বসিতেছে ওই গেহ-পরি যেন চাঁদের জোছনা মাখি!
ঝুঁকিয়া ঝুঁকিয়া দেখিছে কী যেন গ্রহ তারাদল আসি
আকাশ জুড়িয়া নৌবত বাজে ভুবন ভরিয়া বাঁশি!…
টুটিল তন্দ্রা মুত্তালিবের অপরূপ বিস্ময়ে –
ছুটিল যথায় আমিনা – হেরিল নিশি আসে শেষ হয়ে।
আমিনার শ্বেত ললাটে ঝলিত যে দিব্য জ্যোতি-শিখা,
কোলে সে এসেছে – হাতে চাঁদ তার ভালে সূর্যের টিকা!
সে রূপ হেরিয়া মুর্ছিত হয়ে পড়ল মুত্তালিব,
একী রূপ ওরে একী আনন্দ একী এ খোশনসিব!
চেতনা লভিয়া পাগলের প্রায় কভু হাসে কভু কাঁদে,
যত মনে পড়ে পুত্রে, পৌত্রে তত বুকে লয়ে বাঁধে!
পৌত্রে ধরিয়া বক্ষে তখনই আসিলেন কাবা-ঘরে,
বেদি পরে রাখি শিশুরে করেন প্রার্থনা শিশু তরে।
‘আরশে’ থাকিয়া হাসিলেন খোদা – নিখিলের শুভ মাগি
আসিল যে মহামানব – যাচিছে কল্যাণ তারই লাগি!
ছিল কোরেশের সর্দার যত সে প্রাতে কাবায় বসি
যোগ দিল সেই ‘মুনাজাতে’ সবে আনন্দে উচ্ছ্বসি।
সাতদিন যবে বয়স শিশুর – আরবের প্রথামতো
আসিল ‘আকিকা’ উৎসবে প্রিয় বন্ধু স্বজন যত!
উৎসব শেষে শুধাল সকলে শিশুর কী নাম হবে,
কোন সে নামের কাঁকন পরায়ে পলাতকে বাঁচি লবে।
কহিল মুত্তালিব বুকে চাপি নিখিলের সম্পদ,–
“নয়নাভিরাম! এ শিশুর নাম রাখিনু ‘মোহাম্মদ’!”
চমকে উঠিল কোরেশির দল শুনি অভিনব নাম,
কহিল, ‘এ নাম আরবে আমরা প্রথম এ শুনিলাম।
বনি-হাশেমের গোষ্ঠীতে হেন নাম কভু শুনি নাই,
গোষ্ঠী-ছাড়া এ নাম কেন তুমি রাখিলে, শুনিতে চাই!’
আঁখিজল মুছি চুমিয়া শিশুরে কহিলেন পিতামহ –
“এর প্রশংসা রণিয়া উঠুক এ বিশ্বে অহরহ,
তাই এরে কহি ‘মোহাম্মদ’ যে চির-প্রশংসমান,
জানি না এ নাম কেন এল মুখে সহসা মথিয়া প্রাণ।”
নাম শুনি কহে আমিনা –‘স্বপ্নে হেরিয়াছি কাল রাতে
‘আহ্মদ’ নাম রাখি যেন ওর!’ ‘জননী, ক্ষতি কি তাতে’
হাসিয়া কহিল পিতামহ, ‘এই যুগল নামের ফাঁদে,
বাঁধিয়া রাখিনু কুটিরে মোদের তোমার সোনার চাঁদে!’
একটি বোঁটায় ফুটিল গো যেন দুটি সে নামের ফুল,
একটি সে নদী মাঝে বয়ে যায়, দুইধারে দুই কূল!
অসাধারণ ।নজরুলের প্রকৃত মুল্যায়ন আমরা করতে পারছিনা ।