০৩. অভ্যুদয়
আঁধার কেন গো ঘনতম হয় উদয়-উষার আগে?
পাতা ঝরে যায় কাননে, যখন ফাগুন-আবেশ লাগে
তরু ও লতার তনুতে তনুতে, কেন কে বলিতে পারে?
সুর বাঁধিবার আগে কেন গুণী ব্যথা হানে বীণা-তারে?
টানিয়া টানিয়া না বাঁধিলে তারে ছিঁড়িয়া যাবার মতো
ফোটে না কি বাণী, না করিলে তারে সদা অঙ্গুলি ক্ষত?
সূর্য ওঠার যবে দেরি নাই, বিহগেরা প্রায় জাগে,
তখন কি চোখে অধিক করিয়া তন্দ্রার ঝিম লাগে?
কেন গো কে জানে, নতুন চন্দ্র উদয়ের আগে হেন
অমাবস্যার আঁধার ঘনায়, গ্রাসিবে বিশ্ব যেন!
পুণ্যের শুভ আলোক পড়িবে যবে শতধারে ফুটে
তার আগে কেন বসুমতী পাপ-পঙ্কিল হয়ে উঠে?
ফুল ফসলের মেলা বসাবার বর্ষা নামার আগে,
কালো হয়ে কেন আসে মেঘ, কেন বজ্রের ধাঁধা লাগে?
এই কি নিয়ম? এই কি নিয়তি? নিখিল-জননী জানে,
সৃষ্টির আগে এই সে অসহ প্রসব-ব্যথার মানে!
এমনই আঁধার ঘনতম হয়ে ঘিরিয়াছিল সেদিন,
উদয়-রবির পানে চেয়েছিল জগৎ তমসা-লীন।
পাপ অনাচার দ্বেষ হিংসার আশী-বিষ-ফণা তলে
ধরণির আশা যেন ক্ষীণজ্যোতি মানিকের মতো জ্বলে!
মানুষের মনে বেঁধেছিল বাসা বনের পশুরা যত,
বন্য বরাহে ভল্লুকে রণ; নখর-দন্ত-ক্ষত
কাঁপিতেছিল এ ধরা অসহায় ভীরু বালিকার সম!
শূন্য-অঙ্কে ক্লেদে ও পঙ্কে পাপে কুৎসিততম
ঘুরিতেছিল এ কুগ্রহ যেন অভিশাপ-ধূমকেতু,
সৃষ্টির মাঝে এ ছিল সকল অকল্যাণের হেতু!
অত্যাচারিত উৎপীড়িতের জমে উঠে আঁখিজল
সাগর হইয়া গ্রাসিল ধরার যেন তিন ভাগ থল!
ধরণি ভগ্ন তরণির প্রায় শূন্য-পাথরতলে
হাবুডুবু খায় বুঝি ডুবে যায়, যত চলে তত টলে।
এশিয়া য়ুরোপ আফ্রিকা – এই পৃথিবীর যত দেশ
যেন নেমেছিল প্রতিযোগিতায় দেখিতে পাপের শেষ!
এই অনাচার মিথ্যা পাপের নিপীড়ন-উৎসবে
মক্কা ছিল গো রাজধানী যেন ‘জজিরাতুল আরবে।’
পাপের বাজারে করিত বেসাতি সমান পুরুষ নারী,
পাপের ভাঁটিতে চলিত গো যেন পিপীলিকা সারি সারি।
বালক বালিকা যুবা ও বৃদ্ধে ছিল নাকো ভেদাভেদ,
চলিত ভীষণ ব্যাভিচার-লীলা নির্লাজ নির্বেদ!
নারী ছিল সেথা ভোগ-উৎসবে জ্বালিতে কামনা-বাতি,
ছিল না বিরাম সে বাতি জ্বলিত সমান দিবস-রাতি।
জন্মিলে মেয়ে পিতা তারে লয়ে ফেলিত অন্ধকূপে
হত্যা করিত, কিংবা মারিত আছাড়ি পাষাণস্তূপে!
হায় রে, যাহারা স্বর্গেমর্ত্যে বাঁধে মিলনের সেতু
বন্যা-ঢল সে কন্যারা ছিল যেন লজ্জারই সেতু!
সুন্দরে লয়ে অসুন্দরের এই লীলা তাণ্ডব
চলিতেছিল, এ দেহ ছিল শুধু শকুন-খাদ্য শব!
দেহ-সরসীর পাঁকের ঊর্ধ্বে সলিল সুনির্মল
ত্যজিয়া তাহারে মেতেছিল পাঁকে বন্য-বরাহ দল!
চরণে দলিত কর্দমে যারে গড়িয়া তুলিল নর
ভাবিত তাহারে সৃষ্টিকর্তা, সেই পরমেশ্বর!
আল্লার ঘর কাবায় করিত হল্লা পিশাচ ভূত,
শিরনি খাইত সেথা তিন শত ষাট সে প্রেতের পুত!
শয়তান ছিল বাদশাহ সেথা, অগণিত পাপ-সেনা,
বিনি সুদে সেথা হতে চলিত গো ব্যভিচার লেনা-দেনা!
সে পাপ-গন্ধে ছিঁড়িয়া যাইত যেন ধরণির স্নায়ু,
ভূমিকম্পে সে মোচড় খাইত যেন শেষ তার আয়ু!
এমনই আঁধার গ্রাসিয়াছে যবে পৃথ্বী নিবিড়তম–
ঊর্ধ্বে উঠিল সংগীত, ‘হল আসার সময় মম!’
ঘন তমসার সূতিকা-আগারে জনমিল নব শশী,
নব আলোকের আভাসে ধরণি উঠিল গো উচ্ছ্বসি।
ছুটিয়া আসিল গ্রহ-তারাদল আকাশ-আঙিনা মাঝে,
মেঘের আঁচলে জড়াইয়া শিশুচাঁদেরে পুলক লাজে
দাঁড়াল বিশ্ব-জননী যেন রে ; পাইয়া সুসংবাদ
চকোর-চকোরী ভিড় করে এল নিতে সুধার প্রসাদ!
ধরণির নীল আঁখি-যুগ যেন সায়রে শালুক সুঁদি
চাঁদেরে না হেরে ভাসিত গো জলে ছিল এতদিন মুদি,
ফুটিল রে তারা অরুণ-আভায় আজ এতদিন পরে,
দুটি চোখে যেন প্রাণের সকল ব্যথা নিবেদন করে!
পুলকে শ্রদ্ধা সম্ভ্রমে ওঠে দুলিয়া দুলিয়া কাবা,
বিশ্ব-বীণায় বাজে আগমনি, ‘মারহবা! মারহবা!!’
০৪. স্বপ্ন
প্রভাত-রবির স্বপ্ন হেরে গো যেমন নিশীথ একা
গর্ভে ধরিয়া নতুন দিনের নতুন অরুণ-লেখা।
তেমনই হেরিছে স্বপ্ন আমিনা – যেদিন নিশীথ শেষে
স্বর্গের রবি উদিবে জননী আমিনার কোলে এসে।
যেন গো তাহার নিরালা আঁধার সূতিকা-আগার হতে
বাহিরিল এক অপরূপ জ্যোতি, সে বিপুল জ্যোতি-স্রোতে
দেখা গেল দূর বোসরা নগরী দূর সিরিয়ার মাঝে।
ইরান-অধীপ নওশেরোয়াঁর প্রাসাদের চূড়া লাজে
গুঁড়া হয়ে গেল ভাঙিয়া পড়িয়া। অগ্নিপূজা দেউল
বিরাণ হইয়া গেল গো ইরান নিভে গিয়ে বিলকুল।
জগতের যত রাজার আসন উলটিয়া গেল পড়ি,
মূর্তিপূজার প্রতিমা ঠাকুর ভেঙে গেল গড়াগড়ি!
নব নব গ্রহ তারকায় যেন গগন ফেলিল ছেয়ে,
স্বর্গ হইতে দেবদূত সব মর্ত্যে আসিল ধেয়ে।
সেবিতে যেন গো আমিনায় তাঁর সূতিকা-আগার ভরি,
দলে দলে এল বেহেশ্ত হইতে বেহশ্তি হুরপরি।
যত পশু-পাখি মানুষের মতো কহিল গো যেন কথা,
রোম-সম্রাট-কর হতে ক্রস খসিয়া পড়িল হোথা,
হেঁটমুখ হয়ে ঝুলিতে লাগিল পূজার মূর্তি যত,
হেরিলেন জ্যোতি-মণ্ডিত দেহ অপরূপ রূপ কত!
টুটিতে স্বপ্ন হেরিলেন মাতা, ফুটিতে আলোর ফুল
আর দেরি নাই, আগমনি গায় গুলবাগে বুলবুল।
কী এক জ্যোতির্শিখার ঝলকে মাতা ভয়ে বিস্ময়ে
মুদিলেন আঁখি। জাগিলেন যবে পূর্ব-চেতনা লয়ে,
হেরিলেন চাঁদ পড়িয়াছে খসি যেন রে তাঁহার কোলে,
ললাটে শিশুর শত সূর্যের মিহির লহর তোলে!
শিশুর কন্ঠে অজানা ভাষায় কোন অপরূপ বাণী
ধ্বনিয়া উঠিল, সে স্বরে যেন রে কাঁপিল নিখিল প্রাণী।
ব্যথিত জগৎ শুনেছে ব্যথায় যার চরণের ধ্বনি,
এতদিনে আজ বাজাল রে তার বাঁশুরিয়া আগমনি!
নিখিল ব্যথিত অন্তরে এর আসার খবর রটে
ইহারই স্বপন জাগেরে নিখিল-চিত্ত-আকাশপটে।
সারা বিশ্বের উৎপীড়িতের রোদনের ধ্বনি ধরি
ধরণির পথে অভিসার এল ছিল দিবা শর্বরী।
সাগর শুকায়ে হল মরুভূমি এরই তপস্যা লাগি,
মরু-যোগী হল খর্জুরতরু ইহারই আশায় জাগি।
লুকায়ে ছিল যে ফল্গুর ধারা মরু-বালুকার তলে
মরু-উদ্যানে বাহিরিয়া এল আজি ঝরনার ছলে।
খর্জুর-বনে এলাইয়া কেশ সিনানি সিন্ধুজলে
রিক্তাভরণা আরব বিশ্ব-দুলালে ধরিল কোলে!
‘ফারাণের’ পর্বত-চূড়াপানে ভাববাদী বিশ্বের
কর-সংকেতে দিল ইঙ্গিত ইহাই আগমনের।
সেদিন শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির সুখে হসিল বিশ্বত্রাতা,
‘সুয়োরানি’ হল আজিকে যেন রে বসুমতী ‘দুয়ো’ মাতা
‘মারহাবা সৈয়দে মক্কি মদনি আল-আরবি!’
গাহিতে নান্দী গো যাঁর নিঃস্ব হল বিশ্বকবি।
আসিল বন্ধ-ছেদন শঙ্কা-নাশন শ্রেষ্ঠ মানব,
পশিল অন্ধ গুহায় ওই পুনরায় রক্ষ দানব।
ভাসিল বন্যাধারায় ‘দজলা’ ‘ফোরাত’ কন্যা মরুর,
সাহারায় নৌবতেরই বাজনা বাজে মেঘ-ডমরুর।
বেদুইন তাম্বু ছিঁড়ে বর্শা ছুঁড়ে অশ্ব ছেড়ে
খেলিছে গেণ্ডুয়া-খেল, রক্ত ছিটায় বক্ষ ফেড়ে!
আরবের কুব্জা বঁধু উট ছেড়ে পথ সব্জা-খেতি
খুঁজিছে আজকে ঈদে খোর্মা আঙুর খেজুর-মেতি।
খর্জুর কন্টকে আজ বন্ধ খুলি যুক্ত বেণির
ঢালিছে মুক্ত-কেশী আরবি-নিঝর কলসি পানির!
জরিদার নাগরা পায়ে গাগরা কাঁখে ঘাগরা ঘিরা
বেদুইন বউরা নাচে মৌ-টুসকির মৌমাছিরা।
শরমে নৌজোয়ানীরা নুইয়ে ছিল ডালিম-শাখা,
আজি তার রস ধরে না, তাম্বুলী ঠোঁট হিঙ্গুল মাখা
করে আজ খুনসুড়ি ওই শুকনো কাঁটার খেজুর-তরু,
খেজুরের গুলতি খেয়ে ‘উঃ’ ডাকে ‘লু’ হাওয়ায় মরু!
আখরোট বাদাম যত আরবি-বউ-এর পড়ছে পায়ে,
বলে, ‘এই নীরস খোসা ছাড়াও কোমল হাতের ঘায়ে!’
আরবের উঠতি বয়েস ফুল-কিশোরী ডালিম-ভাঙা
বিলিয়ে রং কপোলের আপেল-কানন করছে রাঙা।
ছুটিতে দুম্বাসম স্থূল শ্রোণিভার হয় গো বাধা,
দশনে পেস্তা কাটি পথ-বঁধুরে দেয় সে আধা!
অধরের কামরাঙা-ফল নিঙড়ে মরুর তপ্ত মুখে,
উড়ুনি দেয় জড়ায়ে পাগলা হাওয়ার উতল বুকে।
না-জানা আনন্দে গো ‘আরাস্তা’ আজ আরব-ভূমি,
অ-চেনা বিহগ গাহে ফোটে কুসুম বে-মরশুমি,
আরবের তীর্থ লাগি ভিড় করে সব বেহেশ্ত বুঝি,
এসেছে ধরার ধুলায় বিলিয়ে দিতে সুখের পুঁজি।
‘রবিউল আউওল’ চাঁদ শুক্লা নবমীর তিথিতে
ধেয়ানের অতিথ্ এল সেই প্রভাতে এই ক্ষিতিতে।
মসীহের পঞ্চশত সপ্ততি এক বর্ষ পরে
সোমবার জ্যেষ্ঠ প্রথম – ধরার মানব-ত্রাণের তরে
আসিলেন বন্ধু খোদার মহান উদার শ্রেষ্ঠ নবি,
‘মারহাবা সৈয়দ মক্কি মদনি আল-আরবি।’
অসাধারণ ।নজরুলের প্রকৃত মুল্যায়ন আমরা করতে পারছিনা ।