- বইয়ের নামঃ ঝড়
- লেখকের নামঃ কাজী নজরুল ইসলাম
- প্রকাশনাঃ নজরুল ইন্সটিটিউট
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অপরূপ সে দুরন্ত
ভাব-বিলাসী অপরূপ সে দুরন্ত,
বাঁধন-হারা মন সদা তার উড়ন্ত!
সে ঘুরে বেড়ায় নীল আকাশে।
চাঁদের সাথে মুচকি হাসে,
গুঞ্জরে সে মউ-মক্ষীর গুঞ্জনে,
সে ফুলের সাথে ফোটে, ঝরে পরাগ হয়ে অঙ্গনে।
তার চোখের পলক ভোরের তারায় ঝলে,
ধুমকেতু তার ফুলঝুরি, সে উল্কা হয়ে চলে।
অপরূপ সে দুরন্ত,
মন সদা তার উড়ন্ত।
সে প্রথম-ফোটা গোলাপ-কুঁড়ির সনে–
হিঙুল হয়ে ওঠে লাজে হঠাৎ অকারণে।
ধরা তারে ধরতে নারে ঘরের প্রদীপ দিয়ে,
সে শিশির হয়ে কাঁদে, খেলে পাখির পালক নিয়ে।
সে ঝড়ের সাথে হাসে
সে সাগর-স্রোতে ভাসে,
সে উদাস মনে বসে থাকে জংলা পথের পাশে
অপরূপ সে দুরন্ত,
মন সদা তার উড়ন্ত!
সে বৃষ্টিধারার সাথে পড়ে গলে,
অস্ত-রবির আড়াল টেনে লুকায় গগন-তলে।
দীপ্ত রবির মুকুরে সে আপন ছায়া দেখে,
সে পথে যেতে যায় যেন কি মায়ার মোহ এঁকে।
ঝরা তারার তির হানে সে নিশুত রাতের নভে,
ঘুমন্তরে জাগিয়ে সে দেয় বিপুল বজ্র-রবে।
অপরূপ সে দুরন্ত,
মন সদা তার উড়ন্ত!
সে রঙিন প্রজাপতি
কভু ফুলের দিকে মতি
কভু ভুলের দিকে গতি
তার রুধির-ধারা নদীর স্রোতের মতো
দেহের কূলে বদ্ধ তবু মুক্ত অবিরত।
রূপকে বলে সঙ্গিনী সে, প্রেমকে বলে প্রিয়া,
রূপ ঘুমালে ঊর্ধ্বে ওঠে আত্মাতে প্রেম নিয়া।
অপরূপ সে দুরন্ত,
মন সদা তার উড়ন্ত।
মরণকে সে ভয় করে না, জ্ঞানীর সভায় ভয়,–
ভাবের সাথে ভাব করে সে অভাব করে জয়।
তার তরল হাসি সরল ভাবে মুগ্ধ সবার মন,
মন ভরে না জ্ঞানীর, করে অর্থ অন্বেষণ।
চোখ আছে যার, তারই চোখের পাতা টিপে ধরে,
হাতিশালায় যায় না, যায় ফুল ফোটে যে-ঘরে।
তার পথের পথিক সাথি,
তার বন্ধু নীরব রাতি,
খ্যাতির খাতায় চায় না চাঁদা, চাঁদের সাথে খেলে,
সে কথা কহে, মুক্ত-পাখা পাখির দেখা পেলে।
অপরূপ সে দুরন্ত,
মন সদা তার উড়ন্ত!
তারে জ্ঞান-বিলাসী ডাকে না, তায় গাঁয়ের চাষি ডাকে,
তৃষার জলের পাত্র-সম জড়িয়ে ধরে তাকে।
সে রয় না আন্দোলনে,
যেথা আনন্দ হয় আন্দোলিত যায় সে গোপন বনে।
সে চাঁদের আলো, বর্ষা-মেঘের জল,
আপনার খুশিতে ঝরে আপনি সে চঞ্চল।
সে চায় না ফুলের মালা, সে ফুলের মধু চায়,
সে চায় না তাহার নাম,
দান দিয়ে সে পালিয়ে বেড়ায়
চায় না তাহার দাম।
অপরূপ সে দুরন্ত,
মন সদা তার উড়ন্ত!
কেউ যদি তায় ভালো বলে, আলোর বুকে হয় সে লয়,
বলে, ‘ওগো সুন্দর মোর, তোমায় বলে, আমায় নয়!’
ছন্দ তাহার স্বচ্ছন্দ, দ্বন্দ্ব মাঝে রয় না সে,
যে বড়ো তাঁর সুনাম নিয়ে ক্ষুদ্র কথা কয় না সে।
তার মন্দ শোনার নাইকো সময়,
রসের সাথে নিত্য প্রলয়,
তারে নিন্দা দিলে চন্দন দেয়
সে নন্দন-জাদুকর,
সুন্দর সে, তাই দেখে না কাহারেও সে অসুন্দর।
তারে লোভ দেখিয়ে যায় না ধরা,
আপনাকে যে দিতে চায়–
প্রেম-ভিক্ষু দুরন্ত সে লুটিয়ে পড়ে তাহার পায়।
পূর্ণের সে প্রতিচ্ছায়া, অপরূপ সে দুরন্ত,
মন কাঁদে মোর তারই তরে, মন সদা যার উড়ন্ত!
আঁধারে
অমানিশায় আসে আঁধার তেপান্তরের মাঠে;
স্তব্ধ ভয়ে পথিক ভাবে,– কেমনে রাত কাটে!
ওই যে ডাকে হুতোম-পেঁচা, বাতাস করে শাঁ শাঁ!
মেঘে ঢাকা অচিন মুলুক; কোথায় রে কার বাসা?
গা ছুঁয়ে যায় কালিয়ে শীতে শূন্য পথের জু জু–
আঁধার ঘোরে জীবন-খেলার নূতন পালা রুজু।
আগা মুরগি লে কে ভাগা
[সুর : ‘একদা তুমি প্রিয়ে আমারই এ তরুমূলে’]
একদা তুমি আগা দৌড়ে কে ভাগা মুরগি লেকে।
তোমারে ফেলনু চিনে ওই আননে জমকালো চাপ দাড়ি দেখে॥
কালো জাম খাচ্ছিলে যে সেইদিন সেই গাছে চড়ে
কালো জাম মনে করে ফেললে খেয়ে ভোমরা ধরে।
‘চুঁ করো আওর চাঁ করো ছোড়ে গা নেই,
সব কুছ কালা কালা খা জায়ে গা’ – বললে হেঁকে॥
ভুলো আর টেমি জিমি চেনে যে ওই ঝাঁকড় চুলে,
তোমারে দেখলে পরে তারস্বরে আসে তেড়ে ল্যাজুড় তুলে।
ও-পাড়ার হীরু তোমায় দেখেই পালায় পগার-পারে,
‘রুপিয়া লে আও,’ বলে ধরলে তাহার ছাগলটারে।
দেখিয়াই মটরু মিয়াঁর মুরগি লুকায় ঝোপের আড়ে,
তাই কি ছেলেমেয়ে মুরগি-চোরা বলে ডাকে॥
উঠিয়াছে ঝড়
উঠিয়াছে ঝড়, কড় কড় কড় ঈশানে নাকাড়া বাজিছে তার,
ওরে ভীরু, ওঠ, এখনই টুটিবে ধমকে তাহার রুদ্ধ দ্বার!
কৃষ্ণ মেঘের নিশান তাহার দোলে পশ্চিম-তোরণে ওই,
ভ্রুকুটি- ভঙ্গে কোটি তরঙ্গে নাচে নদনদী তাথই থই।
তরবারি তার হানিছে ঝিলিক সর্পিল বিদ্যুল্লেখায়,
হানিবে আঘাত তোর স্বপ্নের শিশমহলের দরোয়াজায় ;
কাঁদিবে পূর্ব পুবালি হাওয়ায়, ফোটাবে কদম জুঁই কুসুম ;
বৃষ্টিধারায় ঝরিবে অশ্রু, ঘনালে প্রলয় রবে নিঝুম?
যে দেশে সূর্য ডোবে – সেই দেশে হইল নবীন সূর্যোদয়,
উদয়-অচলে টলমল করে অস্ত-রবির আঁধার ভয়!
যুগ যুগ ধরি, তপস্যা দিয়ে করেছি মহিরে মহামহান,
ফুটায়েছি ফুল কর্ষিয়া মরু, ধূলির ঊর্ধ্বে গেয়েছি গান।
আজি সেই ফুলে-ফসল-মেলায় অধিকার নাই আমাদেরই,
আমাদের ধ্যান-সুন্দর ধরা আমাদের নয় আজি হেরি!
গীত-শেষে নীড়ে ফিরিবার বেলা হেরি নীড়ে বাসা বাঁধে শকুন,
মাংস-লোলুপ ফিরিতেছে ব্যাধ স্কন্ধে রক্ত-ধনুর্গুণ!
নীড়ে ফিরিবার পথ নাই তোর, নিম্নে নিষাদ, ঊর্ধ্বে বাজ,
তোর সে অতীত মহিমা আজিকে তোরে সব চেয়ে হানিছে লাজ!
উঠিয়াছে ঝড় – ঝড় উঠিয়াছে প্রলয়-রণের আমন্ত্রণ,
‘আদাওতি’র এ দাওতে কে যাবি মৃত্যুতে প্রাণ করিয়া পণ?
ঝড়ে যা উড়িবে, পুড়িবে আগুনে, উড়ুক পুড়ুক সে সম্বল,
মৃত্যু যেখানে ধ্রুব তোর সেথা মৃত্যুরে হেসে বরিবি চল!
অপরিমাণ এ জীবনে করিবি জীবিতের মতো ব্যয় যদি,
ঊর্ধ্বে থাকুক ঝড়ের আশিস, চরণে মরণ-অম্বুধি!
বিধাতার দান এই পবিত্র দেহের করিবি অসম্মান?
শকুন-শিবার খাদ্য হইবি, ফিরায়ে দিবি না খোদার দান?
এ-জীবন ফুল-অঞ্জলি সম নজরানা দিবি মৃত্যুরে, –
জীবিতের মতো ভুঞ্জি জীবন ব্যয় করে যা তা প্রাণ পুরে!
চরণে দলেছি বিপুলা পৃথ্বী কোটি গ্রহ তারা ধরি শিরে,
মোদের তীর্থ লাগি রবি শশী নিশিদিন আসে ফিরে ফিরে।
নিঃসীম নভ ছত্র ধরিয়া, বন্দনা-গান গাহে বিহগ,
বর্ষায় ঝরে রহমত-পানি-প্রতীক্ষমাণ সাত স্বরগ।
অপরিমাণ এ দানেরে কেমনে করিবি, রে ভীরু অস্বীকার?
মৃত্যুর মারফতে শোধ দিব বিধির এ মহাদানের ধার।
রোগ-পাণ্ডুর দেহ নয় – দিব সুন্দর তনু কোরবানি,
রোগ ও জরারে দিব না এ দেহ, জীবন-ফুলের ফুলদানি।
তাজা এ স্বাস্থ্য সুন্দর দেহ মৃত্যুরে দিবি অর্ঘ্যদান,
অতিথিরে দিবি কীটে-খাওয়া ফুল? লতা ছিঁড়ে তাজা কুসুম আন!
আসিয়াছে ঝড়, ঘরের ভিতর তাজিম করিয়া অতিথে ডাক,
বন্ধুর পথে এসেছে বন্ধু, হাসিয়া দস্তে দস্ত রাখ।
যৌবন-মদ পূর্ণ করিয়া জীবনের মৃৎপাত্র ভর,
তাই নিয়ে সব বেহুঁশ হইয়া ঝঞ্ঝার সাথে পাঞ্জা ধর।
ঝঞ্ঝার বেগ রুধিতে নারিবে পড়-পড় ওই গৃহ রে তোর,
খুঁটি ধরে তার কেন বৃথা আর থাকিস বসিয়া, ভাঙ এ দোর!
রবির চুল্লি নিভিয়া গিয়াছে, ধূম্রায়মান নীল গগন,
ঝঞ্ঝা এসেছে ঝাপটিয়া পাখা, ধেয়ে আয় তুই ক্ষীণ পবন!