রাজ-ভিখারি
কোন্ ঘর-ছাড়া বিবাগির বাঁশি শুনে উঠেছিলে জাগি
ওগো চির-বৈরাগী!
দাঁড়ালে ধূলায় তব কাঞ্চন-কমল-কানন ত্যাগি –
ওগো চির-বৈরাগী!
ছিলে ঘুম-ঘোরে রাজার দুলাল,
জানিতে না কে সে পথের কাঙাল
ফেরে পথে পথে ক্ষুধাতুর-সাথে ক্ষুধার অন্ন মাগি,
তুমি সুধার দেবতা ‘ক্ষুধা’ ‘ক্ষুধা’ বলে কাঁদিয়া উঠিলে জাগি –
ওগো চির-বৈরাগী।
আঙিয়া তোমার নিলে বেদনার গৈরিক-রঙে রেঙে,
মোহ-ঘুমপুরী উঠিল শিহরি চমকিয়া ঘুম ভেঙে,
জাগিয়া প্রভাতে হেরে পুরবাসী
রাজা দ্বারে দ্বারে ফেরে উপবাসী,
সোনার অঙ্গ পথের ধূলায় বেদনার দাগে দাগী!
কে গো নারায়ণ, নররূপে এলে নিখিল-বেদনা-ভাগী –
ওগো চির-বৈরাগী!
‘দেহি ভবতি ভিক্ষাম’ বলি দাঁড়ালে রাজ-ভিখারি,
খুলিল না দ্বার, পেলে না ভিক্ষা, দ্বারে দ্বারে ভয় দ্বারী।
বলিলে, ‘দেবে না? লহো তবে দান
ভিক্ষাপূর্ণ আমার এ প্রাণ!’ –
দিল না ভিক্ষা, নিল নাকো দান, ফিরিয়া চলিলে যোগী!
যে-জীবন কেহ লইল না তাহা মৃত্যু লইল মাগি॥
হুগলি
১৭ই আষাঢ় ১৩৩২
সান্ত্বনা
চিত্ত-কুঁড়ি-হাসনাহেনা মৃত্যু-সাঁঝে ফুটল গো!
জীবন-বেড়ার আড়াল ছাপি বুকের সুবাস টুটল গো!
এই তো কারার প্রাকার টুটে
বন্দি এল বাইরে ছুটে,
তাই তো নিখিল আকুল-হৃদয় শ্মশান-মাঝে জুটল গো!
ভবন-ভাঙা আলোর শিখায় ভুবন রেঙে উঠল গো।
২
স্ব-রাজ দলের চিত্তকমল লুটল বিশ্বরাজের পায়,
দলের চিত্ত উঠল ফুটে শতদলের শ্বেত আভায়।
রূপের কুমার আজকে দোলে
অপরূপের শিশ-মহলে,
মৃত্যু-বাসুদেবের কোলে কারার কেশব ওই গো যায়,
অনাগত বৃন্দাবনে মা যশোদা শাঁখ বাজায়!
৩
আজকে রাতে যে ঘুমুল, কালকে প্রাতে জাগবে সে।
এই বিদায়ের অস্ত-আঁধার উদয়-উষায় রাঙবে রে!
শোকের নিশির শিশির ঝরে,
ফলবে ফসল ঘরে-ঘরে,
আবার শীতের রিক্ত শাখায় লাগবে ফুলেল রাগ এসে।
যে মা সাঁঝে ঘুম পাড়াল, চুম দিয়ে ঘুম ভাঙবে সে।
৪
না ঝরলে তাঁর প্রাণ-সাগরে মৃত্যু-রাতের হিম-কণা
জীবন-শুক্তি ব্যর্থ হত, মুক্তি-মুক্তা ফলত না।
নিখিল-আঁখির ঝিনুক-মাঝে
অশ্রু-মানিক ঝলত না যে!
রোদের উনুন না নিবিলে চাঁদের সুধা গলত না।
গগন-লোকে আকাশ-বধূর সন্ধ্যা-প্রদীপ জ্বলত না।
৫
মরা বাঁশে বাজবে বাঁশি, কাটুক না আজ কুঠার তায়,
এই বেণুতেই ব্রজের বাঁশি হয়তো বাজবে এই হেথায়।
হয়তো এবার মিলন-রাসে
বংশীধারী আসবে পাশে
চিত্ত-চিতার ছাই মেখে শিব সৃষ্টি-বিষাণ ওই বাজায়।
জন্ম নেবে মেহেদি-ঈশা ধরার বিপুল এই ব্যথায়।
৬
কর্মে যদি বিরাম না রয়, শান্তি তবে আসত না!
ফলবে ফসল – নইলে নিখিল নয়ন-নীরে ভাসত না।
নেইকো দেহের খোসার মায়া,
বীজ আনে তাই তরুর ছায়া,
আবার যদি না জন্মাত, মৃত্যুতে সে হাসত না।
আসবে আবার – নইলে ধরায় এমন ভালো বাসত না!
হুগলি
১৬ই আষাঢ় ১৩৩২