২
আমাদের জীবনের উজ্জীবনে আশা নেই ভাষা নেই, তাই
জীবনে-মরনে ব্রতী
ইতিহাসে-উল্লাসে, নাকি
এক জীবনেই নানা জীবনের জীবন যাপনে
অসুস্থ প্রবাসী?
আমাদের কালের অসুখে
নানা জীবনের দ্বন্দ্ব
প্রহরে-প্রহরে, নাকি
অসুস্থ মারী ও মড়কে, অন্ধ?
আমাদের কালের সভ্যতা, ইতিহাসে
চতুর্দিকে, ঘরে ঘরে সন্দেহ, ভয়
কী ভাবে বাঁচি মরি; কোথায়!
৩
মৃত্যুর দেশে মর্তের অধিবাসী যারা
জীবনের স্কেড়নাট্যে রচেছিল সংহতি
মানবিক-বোধে নাগরিক তারা
বাসুকীর সাথে বন্ধুতা সম্প্রতি?
৪
আমাদের জীবনের কাল যুদ্ধে
মহামারী আর মন্বন্তর, জানি
জীবনে জীবন বেঁধে, জীবনের বিরুদ্ধে
রচি জীবনেরই গ্লানি।
–বিহঙ্গ তাই এনেছে সন্ধ্যা দুরন্ত ঘুর্ণিতে
বন্ধ পাখায় অন্ধ আঁধার নেমেছে কালের চুর্ণিতে।
৫
আমাদের ভাষা আজ বধিরের
আমাদের চোখ আজ অন্ধের
আমাদের পৌরুষ বৃদ্ধ যযাতির
আমাদের চলা শুধু খঞ্জের
আমাদের গান শুধু মৃত্যুর,
আমাদের নির্মান ধ্বংসের।
৬
যেদিকে তাকাই শুধু অন্ধ, পঙ্গুর সমাহার—
যেদিকে তাকাই দেখি, কালো-ছায়া আবিশ্ব পাষানে
যেদিকে ফেরাই কান, শুনি
পদধ্বনি; কার পদধ্বনি?
১/১০/৮৩
বৈজয়ন্তী ওড়াও বিশ্ববাংলায়
যে বিশ্বাস নিয়ে একদিন
বৈজয়ন্তী উড়িয়েছে, সেই
একাগ্রতায়
এখনো আমি প্রতীক্ষমান।
আমাদের অবয়বে এখন, আপাতত
কোন দৃশ্য নেই; ভিতরে
বহ্নিমান শিখা, আর
রক্তফেন আক্রোশ
জেগে আছে।
২
তোমার দেখার চোখ দু’টোয়
আরো একটি চোখ
বসিয়ে দিতে চাই;
শিবনেত্র নয়, তৃতীয় চক্ষু দিয়ে
দেখে নাও, তোমার স্বদেশে
সহস্র রাবণ ও দুর্যোধন; এখনো
ছদ্মবেশে,
স্থির।
তোমার পায়ের তলা থেকে, মাটি
ধীরে ধীরে
সরে যাচ্ছে; তুমি
দিগন্তে তাকিয়ে
তারা-ছাওয়া সৌর-আকাশ
দেখছ।
যে অরিত্র নিয়ে, ঝঞ্চসাগর
পাড়ি দেবে, বলেছিলে; দ্যাখো
মাস্তুল ভেঙে আছে ডাঙায়।
দ্যাখো, দিকচত্রে আজ
ঊর্মির জোয়ার; অথচ তুমি
ক্ষিপ্ত ঈগলের মতো
আকাশ, শুন্যতা ঠোকরাও।
তবে কি সব আহুতি
বৃথা গেল, তোমাদের?
তোমার ভিতরে এক
শুদ্ধির সন্তান জেগে আছে, শুধু
একবার প্রজ্বলনে
উন্মোচিত হও।
আমি, মাটির মানুষ; তাই
আশাবাদী;–
স্ফুলিঙ্গ ও ভস্মে
অনাদি প্রেমিক্ল আমার স্বদেশের।
এসো, আমাদের বৈজয়ন্তী ওড়াও
ত্রিলোকে, আসমুদ্রহিমাচলে, আর
বিশ্ববাংলায়।
১৮/১০/৮৩
ভাতের গন্ধে
মনে করো
একদল ক্ষুধার্ত মানুষ
ঝড় বৃষ্টি মাথায় নিয়ে,
বহু পথ অতিক্রম ক’রে
শুধুমাত্র ভাতের গন্ধে
তোমার দোরগোড়ায় ছুটে এসেছেন।
মনে করো
তাদের শরীর থেকে যে ক্ষুধা-তৃষ্ণার ঘ্রাণ,
বারুদের গন্ধের চাইতেও তীব্র আর ঝাঁঝালো;
বাতাসকে মথিত ক’রে
হাওয়ায় আসছে ভেসে।
মনে করো
ক্ষুধার্ত মানুষের দলে
আমিই সবচেয়ে বুভুক্ষু, আর
পুরোভাগে দণ্ডায়মান।
মনে করো
এক টুকরো ছেঁড়া কাপড়ে
লজ্জাকে ঢাকবার ব্যর্থ প্রয়াসে যখন অতিশয় ক্লান্ত,
হাওয়ায় কিছুতেই অবরুটুকু মানছে না;
তুমি তখন অনায়াসে দেখে নিচ্ছ
আমার পাঁজরে ফুটে উঠছে বিশাল মানচিত্র, আর
সেই মানচিত্রের ভিতরে
অসহায় আর্তনাদে আমি
একমুঠো ভাতের জন্যে
মাটিতে মুখ থুবরে পড়ে যাচ্ছি।
–ঠিক তখনি, তখনি তোমার উনুনের গনগনে আগুনের আঁচে
আমাদের হাড়-মাংস টগবগ, টগবগ করছে।
১১/৩/৮৩
যে দেশে সবাই অন্ধ
যে দেশে সবাই অন্ধ,
সূর্যের প্রচণ্ড আলোকেও
চক্ষুষ্মান নয়; সেই দেশে
পিতৃলোকের ছায়া
পড়েছে মাটিতে, দর্পণে।
দর্পণে, তোমারই মুখের রেখা
চেনা কী অচেনা
দ্বিখণ্ডিত, স্বরূপে
আলোয়।
আমাদের দেশজ সমাজে, তাই
দিবানিশি অন্ধকার। যেদিকে তাকাই
দৃশ্যত কিছু নেই; আগমন শ্মশান-নরক
আমাদেরই দেশজ সমাজে, ঘরে ঘরে বাংলায়।
১/১০/৮৩