- বইয়ের নামঃ যে দেশে সবাই অন্ধ
- লেখকের নামঃ দাউদ হায়দার
- প্রকাশনাঃ নওরোজ সাহিত্য সম্ভার
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অক্ষয় গাণ্ডীব
আমাদেরই পাপের প্রায়শ্চিত্তে
মৃত্যুর কালো হিমছায়া
সারাদেশব্যাপী পড়েছে স্তব্ধ মিনার।
তুমি জানো, ভষ্মলীন আঁধার আর মন্বন্তরের বিবর্ণ সুপুর
প্রতিটা প্রাঙ্গণ ছেয়ে আছে, যেন বাংলার মাটিতে আবার
পাক সৈন্য নেমেছে সদর্পে, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র সম্ভারে।
তোমার মানস বলাকায় আমি তাই
বিশ্বভ্রমণে যেতে চাই—
কোন্ দেশ, কোন্ রাজ্যে এমন হাহাকার, আর
কে আমার প্রেমের বাক্যের এবং মৃত্যুর, দিনযাপনের
স্বাধীনতা কেড়ে নিতে চায়
আমি শুধু একবার দেখে নিতে চাই।
জানি, আমার একার পক্ষে এই প্রতিরোধ সম্ভব নয়,
সম্ভব নয় মারণাস্ত্রের বিরুদ্ধাচরণ; তবু
আমাকেই যেতে হবে; কেননা
আমার ভবিষ্যৎসন্তান যদি বলে :
“অতীতে তোমার কার্যকলাপ ছিল খুবই দুঃখজনক; যখন
সারাদেশব্যাপী হাহাকার, আর স্বাধীনতা হরণের পালা
তুমি তখন জীবনের প্রেমে স্বার্থপর, অথচ
এদেশ তোমার। বলো, তবে কি ক্রুর রাবণের ভয়ে
জটায়ু বিস্তার করবে না বাহু?”
তখন, কোন্ যুক্তির আশ্রয়ে বলবো :
‘হে আমার সন্তান-সন্ততি
তোমাদের পিতা ছিল অন্ধ, বধির’।
–আমি তাই, তাই আমি একবার বিশ্বভ্রমণে যেতে চাই; যদি
আমার দেখার চোখ দু’টো বন্ধ করে দাও, জেনে রেখো
কালো মৃত্যুর ভিতরেই আমি অক্ষয় গাণ্ডীব।
২/৮/৮৩
অনুজ জাহিদকে খোলা চিঠি
দ্যাখো জাহিদ, ঠিক এইভাবে আর চলতে পারে না—
নয়কে ছয় করে, ছয়কে তিনের ঘরে দাঁড় করিয়ে
যেমন ইচ্ছে তুমি ভাঙবে
সেই বয়স, সেই হঠাৎ ভুলে যাওয়ার দিনগুলো
না, এখন আর নেই।
তোমার চোখ-টোখ দেখে মনে হচ্ছে
গতরাত্রে তুমি
ভয়ংকর স্বপ্নের মধ্যে ডুবে গিয়েছিলে।
ঘুমের ভিতরে তুমি
সপ্তদ্বীপ পেরিয়ে, রবীন্দ্রনাথের সেই পদ্মার তীরে
এখন যেখানে অশ্বমেধ আর যজ্ঞের তুমুল হৈ চৈ; সেখানে
সত্যিই তোমাকে অসহায়,
বিপদগ্রস্ত মনে হচ্ছিল।
হা, যে কথা বলছিলাম—
তোমার জন্যে আমার শিরস্ত্রাণ
চেঙ্গিস যুগের বল্লম, আর
টিপু সুলতান আমলের অশ্ব, সব
সাজিয়ে রেখেছি। তুমি,
যুদ্ধে যাবার আগে
শেষবারের মত পরীক্ষা ক’রে নাও।
–মনে রেখো
তোমার প্রতিপক্ষ সারারাত
ঘুমিয়ে নেই। তুমি,
আসমুদ্রহিমালয় জয় করবার আগে
আমাদের চৈতন্যে হানো
বজ্রের আঘাত।
–মনে রেখো
তোমার পুত্র অর্জুন আর
আমার কন্যা জয়শ্রী
ঘরে ঘুরে উড়িয়েছে
অন্তঃশীল রৌদ্রের পতাকা।
১৮/১০/৮২
অপেক্ষা করো
মাঝে মাঝে মনে হয়
গোটা সমাজটার খোলনালচে পাল্টে দিই;
শুধু চুনকাম করে নয়,
ভিত সুদ্ধ উপড়ে ফেলা প্রয়োজন।
কিন্তু কিভাবে?
–এই প্রশ্নে আমিও বিব্রত; তবে,
উপায় যে নেই, তাও নয়।
সমস্যা থাকলে সমাধানও আছে; অতএব
শাসক ও সংবিধান পাল্টাও।
গণভোটে নির্বাচিত হোক
কে যথার্থ শাসক, কে এবং কারা
রচনা করবেন সংবিধান।
জনতার প্রতি যদি আস্থা না থাকে
গণ-সংবিধান যদি অমান্য মনে হয়,
তথাপি একনায়কতন্ত্রের হাতে রাজত্ব নয়—
যদি মনে হয় শস্যের ভিতরেই ভূত;
তবে গোটা শস্যটাই পুড়িয়ে দাও
অপেক্ষা করো নতুন প্রজন্মের জন্যে।
৩/৬/৮৩
আমরা সবাই নেতা
দর্পনে ও-কার মুখ, তোমার আমার নাকি প্রত্যেকের
নাকি, মানব নামধারী কংসের?
হয়তোবা তাই। হয়তোবা সবাই শাসকের
ভূমিকায় অবতীর্ণ; ধরবে দণ্ড রাজবংশের।
দ্যাখো, কী অবস্থা দেশের, দশের ভাগ্যে আজ
মৃত্যু ছাড়া কিছু নেই। প্রতিবাদী কেউ নয়; অথচ সবাই
ভুলেছি বাহান্ন, একাত্তর;–বিস্মৃত জাতির সাজ
সত্যিই পিপীকিকা-তুল্য; বোঝাবে কে, তেমন বুদ্ধিজীবী
রাজনীতিবিদ কই! “শুধু চাই
সিংহাসব;” ব’লে আমি-তুমি প্রত্যেকে নেমেছি পথে,
কেউবা ভিখিরীর সাজে, কেউবা সৈনিক বস্ত্রে—
যে যেমন সাজে, সজ্জিত হতে চাও মারণ-অস্ত্রে।
–আমরা সবাই নেতা, আমাদের এই নেতার রাজত্বে।
১৩/৩/৮৩
আমাদের গোপন আস্তানা
দেখুন মশায়, সময়ে অসময়ে আমার সঙ্গে
ইয়ার্কি মস্করা করবেন আ।
আপনি যা ভালো বোঝেন, করুণ
তাতে আমার কিসসু যায় আসে না।
আপনারও বয়স হচ্ছে, আমিও ছেলেপুলের বাপ; তাছাড়া
ইয়ার্কি-ফাজলামোরও তো একটা সীমা আছে; দেখুন
বেশি বাড়াবাড়ি করলে বিপদে পড়বেন; বলে দিচ্ছি।
যেদিকে যাচ্ছিলেন, যান;
যদি না যেতে চান; টু শব্দ করবেন না,
আমার সঙ্গে আসুন। আমি যা করি
শুধু দেখবেন। কোনো বাদ-প্রতবাদ কিংবা
জানতে চাইবেন না, কোনটি ভালো, কোনটি মন্দ : না,
সে হিসেব আপনার নয়।
এখন, আপনাকে একটি গোপন আস্তানায় নিয়ে যাচ্ছি—
এখানে বন্দুক কিংবা বুলেট
কিসসু তৈরী হয় না।
এখানে বোমা-টোমার কোনো কারখানা নেই
এখানে পোস্টার কিংবা ইস্তাহার বিলি হয় না,
এখানে নারী ও মদের কোনো ব্যবসা নেই;
এখানে আপনাকে দু’দণ্ড দাঁড়াতে হবে; এই যা।
আমাদের এই গোপন আস্তানা বুভুক্ষা ভূগোল নামে পরিচিত—
এখানকার জনগণ কিংবা বাসিন্দা, যাই বলুন
গনগনে আগুনের মধ্যে
রক্তকরবীর বীজ বুনে
নিশ্চিন্ত বসে আছে।
মশায়, আপনি দেখুন; দেখে
যেখানে যা খুশি বলবার বলুন :
“বুভুক্ষা ভূগোলের মানুষেরা
আমাদের সুরক্ষিত রাজভবনের দিকে
বিধ্বংসী ঝড়ের মতো সংঘবদ্ধ,
ক্রমশ ধাবমান”।