অথচ আমাদের কবিতায় কী-না থাকতে পারতো, বলো—
এত বড়ো মুক্তিযুদ্ধ গেল সারাদেশে
রক্তের স্রোত বইলো;
ভারতে এক কোটি উদ্বাস্তু
দশ লক্ষ গৃহহীন
মা বোন ধর্ষিতা
বুদ্ধিজীবী নিখোঁজ, হত্যা
ত্রিশ লক্ষ লোকের বিনিময়ে স্বাধীনতা
এবং ১৯৭৫-এ জাতির জনক
সপরিবারে নিহত
নিহত
নিহত
নিহত
নিহত
এবং নিহত—
–বলো, কোথায় লেখা হলো সেই কাহিনী
কোথায়ইবা সেই মহাকাব্য, বিষাদসিন্ধু?
হায়দার, তোমাদের কবিতা পড়লে মনে হয়
বিগত তিন দশক ধরে
আমরা বেশ সুখেই আছি;
মনে হয় :
বাংলাদেশে প্রেম ভালোবাসা ছাড়া আর কিচ্ছু নেই।
আমি কিন্তু দেখতে পাই
হাসান হোসেনের মুণ্ডের জন্যে
এজিদ আর সীমারের বংশধর, আজো
পথে পথে ঘুরছে।
দেখতে পাই
পেট্রোডলারের কাধে কাধ মিলিয়ে
সাম্রাজ্যবাদের তীব্র নখ
ছিন্নভিন্ন করছে
আমাদের প্রিয় জন্মভূমি, বাংলাদেশ।
২
আমি অবশ্য আদার ব্যাপারী, তাই
জাহাজের খবর রাখিনি কোনোদিন; কিন্তু,
স্পষ্টতই দেখতে পাচ্ছি
ধোঁয়ার ধোঁয়াকার হয়ে আসছে
আকাশ;–
শুনতে পাচ্ছি
বুটের আওয়াজ আর ট্যাঙ্কের গর্জন ছাপিয়ে
গণমানুষের ক্ষিপ্র পদধ্বনি—
আমার বিশ্বাস;
অচিরেই পৃথিবীর ভিত্তিভূমি নাড়িয়ে দেবে।
৩
না, এমন আর কথাটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নয়;–
প্রতিদিনের মৃত্যুর চেয়ে
একদিনের মৃত্যু অনেক শ্রেয়, তাই
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখতে হলে
আরো একটি মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজন।
–হায়দার, তুমি তোমার কবিতায়
সেই দিনের কথা লেখো।
২৪/১২/৮৩
তোমারই অস্থি ও চামড়ায়
একাত্তুরে তুমি ছিলে আমার ঈশ্বর
তোমার পদযুগলে তখন
ক্ষিপ্ত গতিবেগ, আর
বাহুতে,
তীব্র বিক্রম;
তুমি ছিলে আমার ঈশ্বর।
২
স্বাধীন স্বদেশে, হে আমার
নিভৃত প্রাণের দেবতা
তুমি আজ বন্দী এক
অক্ষম ধাতব-নির্ভরে।
বাঙ্কারে, যে হাতে গ্রেনেড ছুঁড়েছ
যে পায়ে, দুর্গমগিরিমরুকান্তার পেরিয়ে,
জয় করো স্বাধীনতা
সেই হা, সেই পা এখন
অচল,
নিঃসাড়।
তুমি প্রতিবন্দ্বী স্বাধীন স্বদেশে।
৩
একবার, শুধু একবারই
প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হও। জ্বলে ওঠো,
সার্বভৌম
মাটির গন্ধে,
তৃণজলে।
যে বেদনা ঝরেছে ভূগোলে,
স্বদেশে;
তুমি জানো :
আমাদের স্বাধীনতা, তোমারই
রক্তে, আহুইতে।
৪
মরজীবনের ভিতরে, গোটা
তোমারই মতো প্রতিবন্দ্বী;
হে ঈশ্বর, ঐশ্বরিক
অস্থি ও চামড়ায়, আমাদের
রাজসূয় অট্টালিকা,
সিংহাসন—
–ক্রাচে ভর দিয়ে কোথায় চলেছ, মুক্তিযোদ্ধা?
৩১/১০/৮৩
দীর্ঘায়ু, কপিল গুহায়
কে জানে, নদীর উৎসে
বিশ্বপটের ছায়া
পিঙ্গল আকাশে, পাখির
ওড়াউড়ি, হয়তোবা
মুক্তির পুণর আশা।
প্রকরণে, এও কি সম্ভব?
–প্রকৃতির দুয়ারে দুয়ারে, চেতনায়
তোমার ফিরে চাওয়া।
উত্তরণে, অমর তৃষ্ণায়
হয়তোবা, দগ্ধদিনে
গোধূলিতে, আমাদের মান্যজীবনে
দীর্ঘায়ু; কপিলগুহায়
১২/৭/৮৩
দ্রোণাচার্যও অক্ষম
তুমিও কি বাঁচবে, বাঁচাতে পারবে নিজেকে?
যে আগুন জ্বলেছে চিতায়, সারাদেশে; এঁকেবেঁকে
কুণ্ডলী পাকিয়ে আসছে ধেয়ে; পুড়িয়ে দেশ-ঘর
বনরাজি, খামার, প্রান্তর—
তুমিও কি বাঁচবে, একাই বাঁচবে, এই ভেবে
উঠেছো চূড়োয়?—তোমাকে, কে দেবে
আশ্রয়!—শূন্যেরও সীমা আছে! মারী ও মড়কে
হাহাকার, দেশব্যাপী; নরকে-সড়কে
দেখি দ্বিধাহীন শব, ছড়াছড়ি।
কে দেবে আশ্রয়, ভাবো : সময়ের ঘড়ি
দ্রুত গলে যায়! আছে পারিষদ, আছে সিংহাসন—
জানি; কিন্তু বলো, সব মন
যদি একাকার হয়, দ্রোণাচার্যও অক্ষম
বাঁচাতে তোমাকে। তোমার অনুপম
সার্কাস দেখে কিছুতেই ভুলি না, বাঘ
তুমি জনতায় মিশে ভুলে গেছ রক্তের স্বাদ!—আপাতত মাঘে
উত্তীর্ণ; আসন্ন ফাল্গুনে তাই, দর্শকই ভক্ষক।
কি করে বাঁচবে, বাঁচাতে পারবে কি; শুনি, কে তোমার রক্ষক!
২৬/২/৮৪
নিরন্ন মানুষের দেশে
[অত্যাচারের অমোঘ নিয়মে সুখী অসুখীর বিচ্ছেদ ভেঙে কবে যে সবাই বাঁচবে।
হেমন্ত/বিষ্ণুদে
–আমিও ভাবি তাই; দিনান্তে দিগন্তে বাজে
নরবলী মড়ক-সঙ্গীক। নিরন্ন মানুষের দেশে মাঝে মাঝে
তাই মৃত্যুঞ্জয়ী হতে চাই। যদিও, পিতৃকালের শানিত তরবারী নাই
তবুও পথে পথে ঘুরি; যদিও প্রাণের সীমানায় পাই
ঐশীর সীমা, অকাল বোধনে।
আমিও ভাই তাই, নিরন্ন মানুষের দেশে
অত্যাচারের অমোঘ নিয়মে সুখী, আমি-তুমি, নানা পরিবেশে
রাজণ্য অত্যাচারে, নানা ধর্মঘটে, কখনোবা
মারী ও বন্যাতে। দিনে দিনে শুধু জনসভা
এদেশের আনাচে কানাচে; অথচ অসুখী বিচ্ছেদ ভেঙে মনে-
প্রাণে বাঁচা যে কঠিন দায়; আমাদের নবজীবনের উজ্জীবনে।
৭/২/৮৩
প্রাণের পললে
সজল বৃষ্টিতে একবার, প্রকৃতির
নিয়মে স্বেচ্ছাবন্দী; তাই
দেশজ সমাজে, অনুষঙ্গে
তোমাকে আমার চাই।
মন জানে, প্রাণের পললে
আমিই মুক্তি, আশা
উত্তরণে।
অনুরক্তে, শিল্পে, দীক্ষায়
যে-জীবন পরাজিত
মানুষের;
সেখানে কী, বার বার ফিরে যাওয়া,
চেতনায়?
চেতনা কি, অকালবৈশাখ
ক্ষুধার্ত বাংলায়?
৮/১০/৮৩
বধিরের ভাষা
আমাদের সমস্যা নির্মাণ ধ্বংসের দিকে
আমাদের সমস্ত প্রেম মৃত্যুর দিকে
আমাদের জীবনের উজ্জীবনে, যতবার
মাধূর্য-বাসর গড়েছি, দেখেছি
রাজন্য অত্যাচারে
ভেঙে গেছে শ্রমের সংসার।
আমাদের ভাষা আছে বধিরের
আমাদের চোখ আছে অন্ধের
আমাদের পৌরুষ বৃদ্ধ যযাতির।