–তবে কি গোটা দেশ ক্লীবে পরিণত?
৪
–জাহিদ, আমি কিন্তু প্রশ্নগুলোর উত্তর চাইছি—
যে মুক্তিযোদ্ধার দল, রণাঙ্গনে রক্তকরবী ফুটিয়ে
দেশের স্বাধীনতা এনেছিল
তারা আজ কী করে দর্শক, বৃহন্নলা; বলো তো!
৩/১০/৮৩
এখনো প্রতীক্ষমান
আমার সমস্ত রক্তে, ধমনীতে
আর্ত হাহাকার;
তাই নিয়ে
হে হৃদয়
বাঁচি
ক্ষুধার্ত শহরে, ধোঁয়ায়।
মাঝে মাঝে হঠাৎ শিহরণ জাগে
সমস্ত রসনায়
বিশ্বতৃষ্ণা, আর
তিমিরবিদারী দংশন।
হে হৃদয়, খোলা আকাশের নিচে
তোমাকে নিয়ে আমার
দিনরাত্রি,
একাকার।
২
দিনের পরে দিন যে গেল
ভাবি
বিগত দিনগুলোর কথা;
ভাবি
হে জীবন, এখনো সময় আছে
তোমাকে একবার
গড়ের মাঠে, অন্ধকারে
জনতারাণীর সাথে
অমর্ত্য গানে,
ভাসিয়ে দেব।
হে জীবন, তুমি জানো
যুদ্ধ হিংসা আর বিপ্লবই
আমাদের জীবন, ইতিহাস।
আজকের জীবন আমার কাম্য ছিল না,–
সীমান্তের ওপারে আমার ঘর, গেরস্থালি;–
অথচ দ্যাখো,
যৌবনের অর্ধেককাল এই প্রবাসে, বিভুঁইয়ে কাটিয়ে
আমি আজ অনাথ, গৃহহীন।
হে জীবন, তোমাকে সুখের মুখ দ্যাখাবো ব’লে
সেই কথে থেকে প্রতীক্ষমান;–
এক যুগ কেটে গেল, এই কলকাতায়
এখনো আশায় বসে আছি;
যদি কেউ ফেরায় সস্নেহে, পিতৃদেশে।
১৮/১১/৮৩
এপিটাফ
যে দেশে আমার মৃত্যুর অধিকার ছিল
সেই দেশে আমি,
পরবাসী আজ।
অথচ এই দেশে, বিদেশ-বিভূঁইয়ে
অভুক্ত দেহমনে
বেঁচে আছি, ক্ষুধার্ত প্রাণ : কি আশ্চর্য বাঁচা।
২
আমার মৃত্যুর পরে, আমার এপিটাফে লিখে দিও :
জননীজন্মভূমি ছেড়ে, এই অচেনা নগরে তার
মৃত্যু হয়েছিল।
মূলত সে কবি : তারও আকাঙ্খা ছিল
স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সাম্য;–আর,
শুভ্র স্বপ্ন ছিল, বিজয়ী যোদ্ধারই মতো।
২৮/৯/১৯৮৩
কবিতার এলোমেলো ভেলা
রাধা নাচবে ঘি পুড়বে
বর্গী আসবে দেশে
রাজার সেনা ধান গিলিবে
খাজনা দেব কিসে।
খাজনা না হয় রক্তে দিলুম
প্রাণটা দেব কিসে—
প্রাণটা দেব কামান-গোলায়,
জন্মেছি এই দেশে।
২
কালোবজ্র স্টেশনে
তোমায় দেখি আপন মনে
হাঁটছো।
কী এক গভীর সংগোপনে
দেশের দশের আন্দোলনে
যাচ্ছো।
নগ্ন-নরক উন্মোচনে
পারবে?
ক্ষুধার তীব্র আক্রমণে
হারবে?
হারার চেয়ে বড়ো কথা, ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন
আন্দোলনে দেখবে তুমি, উল্টে গেছে রাজভবন।
১৯৮৩
কে শত্রু, কে মিত্র
কোথায়ও কোনো নিশ্চয়তা নেই, এখন সর্বত্রই অনিশ্চিত
আর, সন্দেহের ছায়াগুলো দীর্ঘ থেকে গাঢ় হয়ে উঠছে।
জলপ্রপাতের শব্দে একদিন বুঝতাম, ধস আসন্ন। দেয়ালে
সারি সারি পিঁপড়ের দাগ দেখে বলতাম : ঝড়ের তাণ্ডবে
সংসার, ঘরবাড়ি, সবকিছু তছনছ হয়ে যাবে।
–এখন বুঝতে পারি না, বন্ধুর মুখোশ কোনদিকে ফেরানো।
বুঝতে পারি না, কে শত্রু কে মিত্র, এই দেশে।
২২/১০/৮৩
কোরাস
রাজার পাপে রাজ্য নষ্ট, তাই সমস্ত থিবি আজ
আক্রান্ত দুর্ভিক্ষে, মহামারী আর বন্যায়—
যে কোনো মুহুর্তে সবকিছু, এমন কী রাজ
-বাড়ি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। ন্যায় অন্যায়
মানুষের করতলে। থিবির অধিবাসী যারা,
মৃত্যু-ভয়ে লীণ নয়, জানি; কিন্তু, সৈন্য-
-সামন্ত রাজার আজ্ঞাবহ; সজ্জিত তারা
বর্মে ও অস্ত্রে; উপরন্তু, স্বভাবে বণ্য।
কার বিরুদ্ধে এই অস্ত্র ও বর্ম?—নাকি,
স্বদেশেই ব্যবহৃত?—হয়তোবা।
মূলত জারজ এরা : তাই, লজ্জায় নাক ঢাকি,
ঘৃণা করি; কারণ, খচ্চরের অধিক রাত্রির শিবা।
২
একদিন সবই ছিল এইদেশে, ধনধান্যেপুষ্পেভরা;
অথচ উধাও আজ। আমাদের সুন্দরী বসুন্ধরা
ভিক্ষা মাগে : ‘কোথায় তাইরেসিয়াস, কে শোনায়
আশার বাণী, দুর্দিনে; তবে কি থিবি আজ, সত্যিই অসহায়’।
৭/১০/৮৩
জল দাও
চৈত্রে ফেটেছে মাঠ; জৈষ্ঠ-আষাঢ়ও খরতাপে উজ্জ্বল,
দগ্ধ করেছে দেশ; এদিকে, শ্রাবণও নির্জলা; কোলাহল
শুনি মানুষের ‘জল দাও’।–শস্যের ভূমি আজ
কবরের মত উন্মুক্ত; যেন সবই মাটির কারুকাজ।
কে-বা দেবে জল; যতটুকু ছিল চোখের কোণায়
তাও যেন ধুয়ে গেছে বিগত বর্ষায়।
–ঘরে ঘরে তাই হাহাকার; পিপাসিত বিশ্বে আমি
ছুটি দিনান্তে-ঊষায়; ক্লান্তিহীন চলা শুধু পথে, পথে-পথে—
সূর্যের প্রচণ্ড দাবদাহে নদীও চৌচির; নামি
অবগাহনে, অতল হেডিসে। বেগার্ত জীবনের রথে
দগ্ধ জীবনের গান, শুনি প্রহরে প্রহরে;
অথচ দেখা নেই বৃষ্টির। এদিকে আকাশ,
হানে বাণ অগ্নির। আমাদের ধনধান্যেপুষ্পেভরা বাংলার ঘরে ঘরে
রোদনের ধ্বনি আর মাঠে মাঠে শ্বাপদের নিশ্বাস!
জল চাই, জল দাও আমাদের প্রত্যাহিক জীবনে, দীর্ঘযাত্রায়
জল দাও আমাদের ঘরে ঘরে, তৃষিত বাংলায়।
১৪/৩/৮৩
তোমার কথা
মাঝে মাঝে তোমার কথা ভাবি
আকাশে জমেছে মেঘ, বাতাসে বৃষ্টির গান
রাত্তির বড়ো দীর্ঘ; কিছুতেই
ঘুম আর আসছে না। একবার এপাশ, একবার ওপাশ, আর
বিশ্বচরাচর জুড়ে নিথর স্তব্ধতা।
মাঝে মাঝে মনে হয়
অসীম শূন্যের ভিতরে উড়ে যাই।
মেঘের মতন ভেসে ভেসে, একবার
বাংলাদেশ ঘুরে আসি।
মনে হয়, মনুমেণ্টের চূড়োয় উঠে
চিৎকার করে
আকাশ ফাটিয়ে বলি :
দ্যাখো, সীমান্তের ওইপারে আমার ঘর
এইখানে আমি একা, ভিনদেশী।
২৫/১০/৮৩
তোমার কবিতায়
বুঝলে হায়দার, আজকালকার পদ্য আর পড়া যায় না;
কী যে ছাইভস্ম লেখো
আগা নেই মাথা নেই, যা খুশি তাই লিখছো
কী যে বলতে চাও, কাকেইবা বলতে চাও
একমাত্র তোমরাই বোঝো।