১৭/৩/৮৩
আমাদের বাংলা কবিতা
যে কথা যে-ভাবে বলতে চাই,
আগের মতো আর কিছুতেই
ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে পারি না।
চুল এখন ক্রমশ শাদা হয়ে আসছে।
সামনের পাটির দু’টি দাঁত, এই দিনকয়েক হলো
নড়ে চড়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে
বয়স বসে নেই। মেঘে মেঘে অনেক বেলা হলো।
আমাদের আগামী শতকের দিকে এগুচ্ছি,
পৃথিবী ক্রমশ বুড়ো হয়ে আসছে।
কবিতা এখন আর আগের মতো সংঘবদ্ধ হচ্ছে না—
শব্দকে ভেঙে যে ভাবে তছনছ করছি,
পয়ারকে ভেঙে ফেলে অক্ষরে, অক্ষর ছিঁড়ে ফেলে
মাত্রায় ঢুকে পড়ছি; জাহিদ
তুমি দেখে নিও
আগামী শতকের মানুষেরা
কালবৈশাখীর ঝঞ্জার মতো সর্বত্র ঢুকে পড়ে
চুরমার করে দিচ্চে
আমাদের সুরক্ষিত লিরিক।
তুমি, নিরাপত্তার অভাবে এখনি মোহ্যমান?
ক্ষুধা তৃষ্ণার সংগ্রামে যারা
মৃত্যুকে তুচ্ছ করে
পথে-প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়ছে; দ্যাখো
সূর্যকে হাতের মুঠোর এনে
ছড়িয়ে দিচ্ছে রাত্রির গভীরে।
-দ্যাখো, গত এক শতাব্দী ধরে
আমাদের বাংলা কবিতা অভূক্ত, মৃতপ্রায়।
১৮/১০/৮২
আমার এই দেশ
এদেশ এখন সৈন্য কবলিত
এমাটি এখন রক্তকিংশুক
এই আমার দেশ। আমার স্বদেশে
নেমেছে সান্ত্রী। সান্ত্রীর বুটের আওয়াজে
তীক্ষ্ণ যাত্রী।
এই আমার দেশ। আমার স্বদেশ
মিছিলে-মৃত্যুতে উজ্জ্বল।
এই আমার আকাশ। আকাশ
বজ্রগর্ভে আলোকিত। বাতাস
বারুদগন্ধে ভরপুর।
এই আমার দেশ। আমার স্বদেশ
মিছিলে-মৃত্যুতে উজ্জ্বল।
২৮/৯/৭১
আমার কথা
আমি যে দেশের কথা বলি
সেই দেশ বিশ্ব স্বদেশ
আমি যে মানুষের কথা বলি
সেই মানুষ অমৃতস্যপুত্রাঃ
আমি যে ঘরের কথা বলি
সেই ঘর আসমুদ্রহিমাচল
আমি যে প্রেমের কথা বলি
সেই প্রেম বিশ্বপ্রকৃতি
আমি যে নারীর কথা বলি
সেই নারী বীরভোগ্যা বসুন্ধরা
আমি যে আমার কথা বলি
সেই আমি বিশ্ববাংলার।
৯/১২/৮৩
আমার কবিতা
আমার কবিতা দেশের জন্যে
আমার কবিতা দশের জন্যে
আমার কবিতা তোমার জন্যে
আমার কবিতা চৈত্র-দাওয়ায়
খররৌদ্রের কঠিন হাওয়ায়
ঝড়ঝঞ্চার মত্ত-খেলায়
যুদ্ধক্ষেত্রে, গোধূলি বেলায়
আমার কবিতা জলে-স্থলে
আমার কবিতা শীতে-অনলে
আমার কবিতা লাঙলে-ফসলে
আমার কবিতা তোমার জন্যে
আমার কবিতা দশের জন্যে
আমার কবিতা দেশের জন্যে
১৮/১২/৮৩
আমার চরাচরে
তোমার মুখের উপরে, এই শতাব্দীর
কালো ছায়া,
লেপ্টে আছে।
স্ফুলিঙ্গ ও ভষ্মে, যতবার
দেখেছি নিজেকে,
প্রজ্বলনে উন্মোচিত
আমি
নগ্ন-পাখসাটে।
আমার সমস্ত অহংকার, তুমি
নত করে দাও, তোমার
বীজে ও মন্ত্রে।
দিনের প্রখর রোদ্দুরে
যতবার আড়াল করেছি নিজেকে
তোমার শমীবৃক্ষ ঘিরেছে আমার
সমস্ত অঙ্কুর।
আমার চরাচরে তাই, ক্ষিপ্ত খাণ্ডবদাহন।
২১/৮/৮৩
আমার সঞ্চয়ে
এই শূণ্যতা অন্ধকারে ভরে দাও। সারাদেশময়
কেবলি অশ্রুকণা, অথচ কোথাও ক্রন্দন নেই। পরাজয়
শুধু মানুষের। জায়মান দিনের গভীরে, আর
রাত্রির নিস্তব্ধতায় যে তরঙ্গ প্রবাহিত; আমার
স্ফুলিঙ্গ গর্ভে তারই প্রত্যাভিষেক; চেতনায়।
তোমাকে বলিনি, জীবনের গাঢ় অঙ্গীকারে-দিক্ষায়
আমার জীবন নির্ভার নয়। আকণ্ঠ তৃষ্ণায় যখন
পাথরও চৌচির, আমার দিগন্তে তখন
উদ্ধত বরাভয়। তোমাকে বলিনি, আমার সঞ্চয়ে শুধুই ব্যর্থতা
আর বিদায়ের হাতছানি;–এই আমার জীবন, এই আমার শিল্প, কবিতা।
২১/৮/৮৩
ইচ্ছে
দিগন্তে জাগুক তোমার প্রণয়
আশ্চর্য শরতে যে হাওয়া বয়
চতুর্দিকে, মনে হয় :
সর্ব দুঃখ জয় ক’রে নেব কার্তিকে।
জীবনের সকল ঐক্যে থেকে, মাতিকে
পুরুষ যদি ফিরে যায় রনে
দিও তাকে তিলক, মধুর সম্ভাষণে।
এই মহাকাশ তলে, আমার প্রণতি-প্রণয়
তোমাকে দিলাম; নারী, তুমি দাও যুগ্ম অভয় :
আমার ধমনী হোক চিরশস্যময়
আর, শান্তিসুধারসে ভরুক সকল আলয়।
৯/১২/৮৩
উত্তর চাই, জাহিদ
যত দিন যাচ্ছে, কেবলি
মুখোশ পাল্টে নিচ্ছি, ক্রমাগত
পাল্টে যাচ্ছে নামগুলো—
মনে হয়, আমি আর সেই আগের আমি নেই;
দ্রুত যাচ্ছি ধসে,
কোথায় যাচ্ছি; তাও অজানা।
জাহিদ, শুধু তোমার কিংবা আমার কথা নয়; আমি
গোটা দেশের কথাই বলতে চাই।
দেশের প্রসঙ্গেই আমার বারবার মনে হয়
কী করে একটি জাতি
মেরুদণ্ডহীন হয়ে গেল।
২
যারা গনতন্ত্রের কথা বলছেন,
আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না
দেশকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়ে,
মানুষের বাঁচবার অধিকার ও স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে
একনায়কতন্ত্রের মাধ্যমে
কী করে গণতন্ত্র সম্ভব?
–অবশ্য, প্লেটোর কথাটাও আমি ভুলছি না :
“মিথ্যা বলার অধিকার কেবল শাসকের, আর
সবই রাজকীয় মিথ্যা।”
জাহিদ, নিশ্চয় তোমার রিপাবলিকের
কথাগুলো মনে আছে :
“শাসিতের পক্ষে শাসকের মান্য করা কি ধর্ম”?
ভেবে দ্যাখো : “টেকোমাথা আর সচুল মাথার কাজ
সত্যিই কি ভিন্ন, কখনো হয়েছে?
তোমার দক্ষতার সাথে, আমার
বিনিময় চলে না বন্ধু; কিন্তু,
অভিভাবকদের বিবাহ উৎসবে আজ
পুত্রকন্যাই অতিথি!”
৩
জাহিদ, তোমার চারপাশে লক্ষ মানুষের
ভিড়; দ্যাখো
প্রত্যেকে তোমার দেশভাই, প্রত্যেকে
প্রতিকার চায়, প্রত্যেকে তোমার
মুখের দিকে চেয়ে আছে,–
কেননা, এদেশের মুক্তিযুদ্ধে তুমিই
অংশ নিয়েছিলে;–মনে পড়ে,
সেই একাত্তরে তোমাকে
‘অর্জুন’ বলে ডাকতুম।
জাহিদ, আমি তো ভাবতেই পারি না
সেই দৃশ্য :
ষাট হাজার যাদবরমণীকে
লুঠ করে নিচ্ছে দস্যুদল,
ধর্ষণ করছে উথালপাতাল; অথচ
অর্জুন চেয়ে দেখছেন,
হাতে তাঁর গাণ্ডীব;
তিনি অসহায়!