Site icon BnBoi.Com

জন্মই আমার আজন্ম পাপ – দাউদ হায়দার

জন্মই আমার আজন্ম পাপ - দাউদ হায়দার

অতন্দ্রিলা; তুই আমার কাছে থাক

(অতন্দ্রিলা, তুমি ঘমোওনি জানি/অমিয় চক্ৰব্রতী)

অতন্দ্রিলা; তুই এলি কেন, বরং চলে যা
দুঃখের নদীতে দ্যাখ গিয়ে পড়ে আছে আমার দুঃখপূর্ণ ভেলা

আমাকে আজ ঘুমোতে দে তুই
স্বচ্ছ আকাশে যন্ত্রণার ঝাপসা মায়া বাঁধলো কেনো ঘর
তুই জিজ্ঞেস কর বাতাস সাক্ষী হবে বকে রাধ কঠিন সাহস
তোর শরীরে আজ দেখি নিসর্গের আদি শোভা
আশ্চর্য হাওয়ায় তুই চুলগুলি উড়িয়ে এলি এতক্ষণ
হঠাৎ আনন্দ তোর বেজে ওঠে গুপ্ত সরোবরে
করোটি বিহীন শীতল অন্ধকার আসছে ওই
আলোটা জ্বালা
নিজস্ব সংসারে আমি ফিরে যাবো
তুই আজ যা অতন্দ্রিলা

তোর ছায়া ভীষণ ভয় লাগে; তবু তোর চোখ দুটো আমার চোখে
মারবেলের মতো জ্বলজ্বল করে
তোর হাঁটার শব্দে আমার ব্যাকুলতা বাড়ে—
বাসন্তী কাপড়ে তুই এসেছিস তব আমার চোখে ঘন্ত্রণা

আমার দুঃখের ভাগী হ’ এইবেলা
আমি কিছু স্বচ্ছ দেখি পৃথিবী তোকে
জননীর মতো হাতটা রাখ কপালে
দুঃখ আর দুশ্চিন্তায় মাথাটা ক্যামোন গরম দ্যাখ
জানালাটা বন্ধ কর সেই সাথে

অতীন্দ্রলা; তুই আজ আমার কাছে থাক

২৩/৯/৭০

অন্তর্গত উজ্জ্বল বিষাদ

(কবিরুল ইসলাম-কে)

যায় যায় সবই যায় নদীর কোঁকড়ানো ঢেউ ভাঙতে ভাঙতে যায়
হালকা হাওয়া নাচতে নাচতে যায় রমণীর নক্সী আঁচল উড়তে উড়তে যায়
পুরুষের দল হাঁটতে হাঁটতে যায় বহমান জনতার হাটে যায়; যায় যায়
যায় যায় সবই যায় খড়কুটো কবিতার শরীর ভেসে যায়

যায় যায় সবই যায় আমি এক পড়ে থাকি শুকনো শান্ত নদীর জলে পড়ে থাকি
অর্ধ-ডুবন্ত অৰ্ধ-জাগা পাশ ভাঙা খালি নৌকার মতো পড়ে থাকি
স্মৃতিরা ভীড় করে আসে আর সব যায় লালনীল নিশান উড়িয়ে যায়
মাছে শামুকের শুয়ে থাকে আমার পাঁজরায় আর সব যায়

আমি এক আর সব যায়; যায় ভালবাসার সরল হাত ধরে চলে যায়
নিপুণ সিম্ফনি বাজাতে বাজাতে যায়
উজ্জ্বল আলোর মেলায় যায় অন্তর্গত কান্নার ধ্বনি রেখে যায়
যায় যায় সবই যায়!

অলৌকিক বিকেল

কোঁকড়ানো চুলের মতো নদীর ঢেউ দেখে
তুমি বললে
সবুজ নিসর্গের দিকে তাকিয়ে দ্যাখো
একজন কামুক ক্যামোন উড়াচ্ছে কার
বেনারসী অঁচল।

আমার সুনীল মাংসে বাতাস খেলছে প্রবল
খোঁপার গোলাপ এই বিকেলে পড়ে যাবে অনায়াসে
হাত রাখো
বুকের নিবিড় গম্বুজে
ঢেউ তুলি শরীরে।

আমি বললুম—
তারপর স্নান করবো কোঁকড়ানো চুলের মতো
নদীর ঢেউ-এর জলে।

৪/৫/৭২

আন্দোলন; বারবার ফিরে আসে বাংলাদেশে যুদ্ধের বেশে

বাংলাদেশ কি আসলেই শোকের দুঃখের না যুদ্ধের?

তাহলে আমার মা কোথায়
কোথায় বর্ষিয়ান পিতা
আমার মেয়ে
গর্ভিণী স্ত্রী
ভিটে ঘর-বাড়ি
বলতে পারেন বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ?

হাঁ আমি জানি, আপনার পারবেন
পারবেন ভেজা-ভেজা কন্ঠে
চোখে জড়িয়ে রুমাল একজন যথার্থ প্রেমিকের মতো
মাটিতে পা ঠেকিয়ে
ঠায় রোদ্দুরে কিংবা প্রবল বর্ষণে

হাঁ, আপনারা পারবেন : পারবেন…

আমার মা; সেই মা
যে আমাকে না খেয়ে কোলে পিঠে মানুষ করেছেন
চোখের আড়াল হলেই তন্নতন্ন কোরে খুঁজেছেন
রোদ বৃষ্টিতে আঁচলে ঢেকেছেন
গেয়েছেন ঘুম পাড়ানিয়া
পরম আদরে চুমু দিয়েছেন সকাল বিকাল
পাঠিয়েছেন হাত পা ধুইয়ে
আঁচড়িয়ে চুল
আয়নায় দেখিয়ে মুখ
খেলার সাথীদের কাছে

সেই মা; যে আমার আবদারে বিরক্ত হয়নি কখনো
বরং কপালে মাথায় আশীর্বাদের হাত রেখে বুঝিয়েছেন ময়নার মতোন

সেই মা এখন কোথায়
যিনি রাত্রিকালে ঘুমিয়ে পড়ার আগে দেখে যেতেন পুনরায়?

পিতা, সেই বর্ষিয়ান পিতা?

যে আমাকে কাঁধে নিয়ে ঘুরতেন এমেলা ওমেলায়
কিনে দিতেন টিনের বাঁশি কাঠের ঘোড়া লাটাই সুতো
রঙীন ঘুড়ি
আমার ইচ্ছেমতো পোষাক-আশাক!

বোঝাতেন খেলাচ্ছলে সংসারের ঝামেলা
বিশাল জমিজমার টুকরো টুকরো নথিপত্র
চাইতেন একটা লাল টুকটুকে বৌ-মা
যে তাকে যখন তখন
জায়নামাজ তসবী আর পানের বাসন এগিয়ে দেবে
সহজেই ডাকবে ছেলের চেয়েও গভীর ভালবাসায়

সেই পিতা, যিনি আমাকে নিয়ে স্বপ্নে দেখতেন বিভিন্ন প্রহরে!

তিনি এখন কোথায়?

কোথাইবা আমার সেই পাঁচ বছরের মেয়ে?

যে গলা জড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকত
হঠাৎ কোরে ধরতে গেলে দৌড়ে যেত
ভেঁঙচি কাটত হেসে খেলে
দোলায় চেপে হারিয়ে যেত সাতসমুদ্দুর তেরনদী
অফিস গেলে বায়না ধরতো পতুল আনতে
বিয়ে দিতো যখন তখন ছেলে মেয়ের
বাইরে থেকে ফিরে এলেই হাত রাখত পকেট মাঝে
লজেঞ্চুষের থলি পেলেই চুমু দিতো ঠোঁটের উপর
মাদুর পেতে খেতে গেলেই ঠাঁই নিতে সে মধ্যিখানে

সেই মেয়েটি কোথায় গেল?

কোথায় গেল গর্ভিণী সেই স্ত্রী বা?

এক পা হাঁটতে গেলেই পেটের ব্যাথায় পড়ে যেত
খাটের উপর শুয়ে থাকত অতিকষ্টে
ঘর গোছাতে মন বসেনা
বাটনা বাটে পাড়ার লোকে

চেয়ে থাকত একটি সময়
কেমন করে জন্ম নেবে একটি ছেলে—
বাংলাদেশে!

সবতো আমার চলেই গেলো
কোথায় থাকি এখন আমি

ঘর-বাড়ি তো পুড়েই গেছে
পোড়া ভিটেয় গাছ হয়েছে হাজার রকম

হাঁটতে গেলেও ভয় লাগে যে
পায়ে বাধে মেয়ের শরীর পিতার হাত মায়ের চুল
ছিদ্র করা গর্ভিণী এক স্ত্রীর বুক

এদিকে আবার হঠাৎ কোরে কানের মধ্যে ঢুকেও পড়ে
“দাঁড়াও তুমি—
বাংলাদেশে যুদ্ধ আসে এমনি কোরেই
পরক্ষণেই জিতে যাবে অনায়াসে
আমরা জানি; তুমিও জানো!”

৮/১০/৭১

আমরা যেন খাঁচায় পোষা পাখী

আমরা যেন খাঁচায় পোষা পাখী
যা বলো তাই শুনি তোমার কথা
দ্বিরুক্তি নেই, হাতে বাধছো রাখী
বুকের মাঝে শুধু অনল ব্যথা

আকাশে আজ ঘন মেঘের খেলা
বাতাসে ওই হাহাকারের সুর
ক্ষুধা পেটেই খাঁচায় কাটে বেলা
চালের আড়ত বুঝি অনেক দূর!

একি খেলা খেলা খেলছো মহাজন—
খাঁচা থেকে উধাও হলে আমি
পেয়েই যাবো গভীর ঘন বন
তখন কি আর তোমার ডাকে থামি !

২৩/৮/৭৩

আমাদের সফলতা, মৃত্যু

আবার চিৎকার শোনা গেল, শূন্যমার্গে চাঁদ হাওয়ার রাত হাসপাতালের
করিডোর   নার্স    স্যালাইন    ছুরি
–তার মধ্যে আমি
উৎকন্ঠায় ইতঃস্তত ঘুরছি
তীক্ষ্ম আলোর ফোয়ারাগুলো আমার চোখের সামনে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধের
অবসানের মতো স্বপ্ন হয়ে দুলছিল

ব্যথা    অস্থির স্ত্রী    নতুন সময়ের কোলাহল    পৃথিবীর উন্মত্ততা
সন্তানের জন্ম—অর্থাৎ,
প্রবল আনন্দ ঘিরে ধরল আমাকে
—ভোর পাঁচটায়

আমি বিশাল আকাংক্ষা নিয়ে ক্লান্তি    কপালের ঘাম
সব মুছে ফেললাম—
ছিঁড়ে গেছে ঘুম,    মসজিদের মিনার থেকে মুয়াজ্জিনের গাঢ় বেদনার
মতে সঙ্গীত সমস্ত নিস্তব্ধতার ছুটি দিল—
রক্তের ভেতর থেকে, দ্বৈত প্রশ্রয়ে যাহার জন্ম হলো আজি—
নিবিড় পিপাসার মতো ঘ্রাণ এসে
নাকের উপর রয়ে গেল

তারপর;–তারপর
সন্দেহ   চিন্তা   ঘন অন্ধকার,    সভ্যতরে বিপুল গ্রন্থিতে দেখলাম
সমস্ত আয়োজন স্বপ্ন ও প্রতীক্ষা     সাধনা ও সৌরভ
করতলে এক বিষাদের দীঘ ছায়া ঘিরিতেছে তখন।
কান্নায় বুক ভেঙে আসে, নবজাতকের ওষুধ খাদ্য সব বাজার থেকে উধাও
আমাদের রক্তের সফলতা   প্রশ্রয়   আনন্দ ও প্রার্থনার সাথে
একটি জন্ম-মৃত্যুর ঘন্টাধ্বনি শোনা গেল!

এখন পৃথিবীর সব নগর বন্দরে এক বিমৰ্ষ আঁধার এসে বাঁধিতেছে ঘর
হায় বাঁধিতেছে ঘর!

১৮/১০/৭৪

আমার পিতাকে

মুমূর্ষু পিতার সংসারে আমি এক নির্বোধ বালক
যেন। আমাকে দিয়ে কিছুই হবেনা কোন কালেই; জানেন
তিনিই শুধু। যার কোলে-পিঠে মানুষ আজীবন; তিনি এই পৃথিবী-লোক
ছেড়ে এখন কোথায় যে ছিটকে পড়ে আছেন
তা বলতেও পারিনা সহসা ৷ অথচ বাড়িতে তাকে
নিয়ে আমাদের ভাবনার অন্ত নেই। এদিকে গতায়ু হবেন
যিনি আজকাল কিংবা মাসাধিকাল পরে; আপাততঃ তাকে
নিয়ে কেউ-ই ঘামায় না মাথা। বুড়োটে শরীর তার

ভীষণ উত্তেজিত হাতের তুড়িতে একদা নিমেষে উধাও হতো সব। তিনি
আজ বিছানায় একা একা শায়ে ভাবেন আল্লার
আরশ। মুমূর্ষু পিতার সংসারে আমিই বড় ছেলে। সব দায়িত্ব আমাকে
কাঁধে তুলে দিয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরে পালাতে চান যিনি
তাকেই বাঁচাতে চাই আপ্রাণ চেষ্টায়; আমার পিতাকে।

৮/৯/৭০

আমার ভালবাসা

বিষ্ণু দে; শ্রদ্ধাস্পদেষু)

আমার উজ্জ্বল ভালবাসায় অবশেষে আপনাকেই জড়িয়েছি।
চৈতন্যের নির্জন প্রকোষ্ঠে যখন নিহত মানুষের ঘণ্টাধ্বনি বাজে –
পুনর্বার ফিরে যাই আপনার কবিতায়। কি পেয়েছি
বলতে চান? গোল চাঁদের স্নিগ্ধতায় বৃক্ষের সজীবতায় নক্ষত্রের নিপুণ
কারুকাজে
আমার ব্যাকুল যৌবন বাধা পড়েছে; য্যানো মধ্যরাতে রাজার দুলালী তার
সমস্ত অন্তর্বাস খুলে দেয়–দাঁড়ায় শস্যহীন দগ্ধপ্রান্তরে!
কুয়াশার পাংশুপটে যে বালক মিশে গেছে; তাকে আমার
কুশল বলিনি কখনো। নষ্ট মৃত্তিকার সোণামণি; যার শরীরে
বারুদের প্রবল ঘ্ৰাণ পাওয়া যাবে; তাকেও ভালবাসা আশীর্বাদ
দেইনি। সম্পন্ন প্রেমিকের মতো সকল অস্থিরতা পলাতক। ভীষণ আঁধারে
নীলাভ বাহু, নেচেছে দিনরাত। কোথাও পারিনি যেতে। সম্রাটের নিখাদ
আত্মহত্যা অর্থাৎ আমাকে দিয়েছে প্রাণ। সন্ন্যাসীর মতো ঘরে বসে তারে
আমি খুঁজি; খুঁজি এখানে ওখানে; মানুষের সরলতা শান্তি প্রেম
মমতা অপার বিশ্বাসে
পাওয়া যাবে? আমিতো সঠিক পেয়েছি আমার আত্মীয়ের হৃদয়ে!

বিশাল বিষাদ নেই; য্যানো এক মহান প্রেমিক আমাদের আশেপাশে
ঘুরছেন অলৌকিক ক্রাচে-নিজস্ব ভঙ্গিতে। বিষণ্ণ প্রাঙ্গণ এখন হয়ে
যাচ্ছে সবুজ শ্যামল–শ্যামলতায় ঢাকছে গৃহাঙ্গন; হলদে তজনী খেলে
বুকের নিভাঁজ অঙ্গনে। আমার লোকালয় বহুদূরে; শহরতলীর শেষ
প্রান্তে। তব, আমি বৃষ্টির মতোন সঙ্গীহীন চলে আসি; ফেলে
আসি বিধ্বস্ত জনপদ। হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়; এইতো বেশ
চলেছেন আজীবন সঙ্গী আমার! মাঝে মাঝে বড় বেশী খেয়ালী;
বুঝি তাই
টেনে নেই বূকের গভীরে। আমার ভালবাসা
শুধুমাত্র স্মৃতি সত্তায় নয়; সমগ্র নিবিড়তায়। এখন যেখানেই যাই
সঙ্গে যায় মহান প্রেমিক–তাকে বলি “তুমিই আমার জীবন; তুমিই
আমার আশা”

২৫/৩/৭২

আমার স্ত্রীর প্রতি

রাগে আমার সর্বাঙ্গ জ্বলে নরকের আগুনের মতো
অথচ স্ত্রী আমার ভয় করে না বরং হেসেই কুটি কুটি
রাগে আমার শরীর কাঁপে কাঁপে পৃথিবী : ইচ্ছে হয় যতো
খুশী শাসিয়ে পাঠাঁই অনন্ত; চুলের ঝুটি

ধোরে। রাগে আমার কান্না আসে। চোখে দেখি শর্ষের ফুল—
যেন পা মাটিতেই চায়না পড়তে; মাথার সমস্ত চুল
যদি শূন্যেও ছুঁড়ে মারি; তবু আমার পড়েনা বিষণ্ণ
রাগ। সংসারে ছড়িয়ে বিষাদ কোন ফলই হয়না কখনো—
সে যতই দেইনা কেন মহাজনের প্রচন্ড হাঁক; জানি আদিকাল থেকে
যখনি মিছিলে সংগ্রামের ঢেউ; ঠিক তখনি আমি আদিগন্ত
সবুজ মাঠে লাউডস্পিকারে ফাটিয়ে গল ফিরেছি ঘরে;–সময় মতো!

রাগে আমার দাঁত কাঁপে; তব কাউকে পাইন ডেকে
স্ত্রী আমার শাড়ির আঁচলে মুখ রাখে। বোঝাই কতো
তবু বোঝেনা। অবশেষে দেখাই রাগ আসবাবপত্রে বাসন কোসনে
আমাকে দেখে কেউই ভয় করে না; শুধু বিড়ালগুলো পালায় গৃহকোণে।

৬/৬/৬৯

আমি তো প্রেমিক নই

 

 

আমিতো প্রেমিক নই, তবু, ক্যানো এ বসন্ত আমাকে পাগল করে!

ছায়া-ছায়া অন্ধকার সকালে নিসর্গ বাহু, মেলে

নিমেষে উধাও হয় আদিম শোভা
উজ্জ্বল প্রেমের মতো সমস্ত রঙীন দৃশ্যাবলী হঠাৎ দাঁড়ায় এসে
আমার সামনে!
এখন রাত্রিদিন বাতাস খেলা করে নিরিবিলি
নদীতে পালতোলা নৌকায় সর্বত্র অন্তরঙ্গ নর্তকীর মতোন গাছেরর
সবুজ পাতা
পায়ে পায়ে ছড়ার আশীর্বাদ মাঠে প্রান্তরে

ফাল্গুন আকাশের চাঁদ জলের নিকানো আঙিনায় পাতে নিবিড় সংসার
নিঃসঙ্গ গাছের ছায়া এলিয়ে সমস্ত শরীর শুয়ে থাকে একাকী;
এবং আমার তরুণ আঙুল
সরোদের আচ্ছন্ন হৃদয় ঘেঁষে যায়; কেঁপে ওঠে পুরোনো শহর
বস্তী গ্রাম
ঝেড়ে ফেলে নিজস্ব পোশাক মাটিতে ঘাসের ছিন্ন মেঝেয়

আমিতো প্রেমিক নই, তবু, ক্যানো আমার চোখোর নন্দন-কানন
মারবেলের বেঞ্চ, পাতা ঝরা, ফুল ফোটার অলৌকিক শব্দ?—কিছুরই
বুঝিনা—বুঝিনা হায় বিশেষত এবয়সে!

তবুও এখন আমার সর্বাঙ্গে বসন্তের জোৎসনা মাখা রমণীয় সন্ধ্যাগুলো
লেপটে আছে প্রত্যহ!

১৪/৫/৭০

আমি ভাল আছি, তোমরা?

আমি ভালো আছি,   তোমরা? –কি করছে।   এই অবেলায়?
—একটি বালক খেলছে দ্যাখো     বিমর্ষ ওই একল। হাওয়ায়!
চুলগুলো তার    কাটছে স্মৃতি        ভ্রান্তি ও ভুল দিবানিশি
মত্ত মেয়ে বুকের কাছে      তবু তাহার দুঃখ বেশী!

কি দুঃখ?–বলতে মানা    নানান কথাই হবে জানা     রৌদ্রে কিংবা অন্ধকারে
ছিলেম ভালো ঢাকার আলোয়    মেয়ের সাথে     পার্কে এবং অভিসারে
এখন আমার দুঃখ অনেক    কিন্তু আমি ভালো আছি     তোমরা কেমন?
—ভালো থাকলেই ভালো কথা, ভালো কথায় খুশি থাকে    প্রেমিক যেমন!

২৬/৬/৭৪

আমিও শহীদ হয়ে যাবো

পুনরায় কোন মহান গণ আন্দোলন শুরু হলে
আমিও আসাদের মতো
শহীদ হয়ে
তোমাদের স্মৃতির মণিকোঠায
জ্বেলে রাখবো অলৌকিক শহীদ উজ্জ্বল বাতি!

তুমি বাতি দেখে একদা ভীষণ ভয় করতে–
আলোয় তোমার মুখ দেখা যায় বলে
কেবলি আঁধারে মুখ রাখতে—
মুখ ঢাকতে ঢাকতে এখন
তোমার চেহারায় কালো দাগ

আমি বারবার তোমার মুখের কালো দাগ মুছে দিতে চেয়েছি
তুমি মুখ লুকিয়ে রাখো–
পাছে মুখের সঠিক কারুকাজ ধরা পড়ে যায়!

আমি আঁধার থেকে আলোয় আসতে চাই
তুমি তোমার বাহু দিয়ে শরীর জড়িয়ে রাখো
মিছিলে রক্তের খেলা হয় বলে!

আমি খেলতে খেলতে বাঁচতে চাই
বাঁচতে বাঁচতে মরতে চাই
মরতে মরতে তোমার বুকে
উজল করে লিখে যাবে।

এইতো আমি শহীদ হলাম
শহীদ হলাম
তোমার বকেই শহীদ হলাম!

৬/২/৭৩

আলোর গভীরে

আলোর গভীরে কেউ কেউ অনায়াসে যেতে পারে। যায়।
মিছিলে হঠাৎ শ্লোগান দিয়ে অনেকেই নেতা হবে। হোক।
আমাদের আঙিনায় ভালবাসা পলাতক আজীবন। জেনেছি।
ঘরে অলিন্দে বিভিন্ন সমস্যা চোখের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে। কিছুই
করার নেই।

এইসব লিখিত অলিখিত পব্দাবলী খেলেছে নিরবধি
দেখছি
এবং
শুনছি
শুনছি এবং দেখছি আমার শৈশব থেকে।

এ কথাগুলো শুনতে যেন কেমন লাগে। তাইনা? ঠিকই।

।২।
আমার একজন বন্ধু, ছিলেন। তিনি রাসেল।
এখন ঈশ্বরের রাজ্যে নতুন কোরে নথিপত্র দেখছেন।
সৃষ্টির প্রথমেই ঈশ্বর এক বিরাট ভুল কোরেছেন। অথাৎ মানুষ
এখন অনেক সময় নিয়ে তা আবার দেখতে হবে। দেখা উচিৎ।

এখন নদী হচ্ছে রক্তের
দেশ হচ্ছে যুদ্ধের
মানুষ হচ্ছে হিংস্র
পশু হচ্ছে ভদ্র

।৩।
বর্তমানে নতুন চালে সবাই খেলতে চায়। খেলে।
পকেট ভর্ত্তি কড়কড়ে নোট লুকিয়ে রেখে সৃষ্টি করে দুর্ভিক্ষ।
এদিকে তাই নিঃস্ব হচ্ছি রাত্রিদিন।
এখন তবে যাত্রা কোথায়? জানা নেই।

।৪।
মেয়েটা যাকে ভালবেসে বিয়ে করতে চেয়েছিল : করতে দিন
বাঁধা দেবেন না।
নইলে মনে একটা দুঃখ থেকে যাবে।
আমার চোখের দিকে যদি কেউ চেয়ে বলে—
তোমার চোখের মধ্যে কে?
আমি বলব—
তুমি|
এই উত্তরে যথার্থ কোন কাজ দেবে না। না দিক।
তবু, তার আনন্দেই আমার আনন্দ!

।৫।
আমরা সবাই আলোর গভীরে যেতে চাই
যেতে চাই উজিয়ে সকল বাধা
পেতে চাই কবিতা ও মানুষের ভালবাসা। তাই না? হাঁ!

২৫/৭/৭০

একটি নিষিদ্ধ কবিতা

গোল চাঁদের শেষ ঘণ্টাধ্বনি বেজে গেলে আমি পুনরায় বাড়ি থেকে
বেরুলাম

সকালের নিপুণ করতালিতে সুন্দর বনরাজি শিউরে উঠলো তুমুল
প্রেম-প্রেম খেলায় অন্ধকার নিবাসগুলো মেতেছিল বহুক্ষণ;-ভেঙে গেল
হঠাৎ

না আমাকে দেখে নয়; তাহলে কার অভিসম্পাতে? সঠিক জানিনা–
কিংবা এও হতে পারে আমারি বদৌলতে!

গোল চাঁদের শেষ ঘন্টাধ্বনি বেজে গেলে আমি দেখলুম; হৈহৈ করতে করতে
একদল রমণীও পুরুষ মিলিত রক্তের স্রোতের মধ্যে থেকে উঠে এল পরস্পর
বাতাস ছিলোনা তখন; সবেমাত্র আঁধার গিয়েছে ছিঁড়ে কিশোরীর
পাজামার গিঁটের মতোন

তারপর খুলে গেল সেই একল। কপাট!

যে রমণী ও পুরুষগুলো দেখলুম; আমাকে দেখেই তারা বলে উঠল—
‘তাহলে তুমিই সেই। প্রত্যহ ভোরে এসে দেখে যাও আমাদের লীলা-খেলা!
কেন সাথী হতে পারো না?
দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা; তোমার চৌদ্দপুরুষ উদ্ধার করবো এই প্রাতে
ফেরেশতা সেজে এই ভুবনে?

শালা শুয়োরের বাচ্চা; কোথায় যাও হে?
আমরাই পাপীরে হারামজাদা?
তাহলে তুমি কি হে?

যখন শালা তুমি হেঁটে যাও ওই বিভিন্ন লোকালয় ধরে: আমরা বলি–
“দ্যখি ওই যে যায়; যায়, যায় মহেন্দুনিদ্রিতকান্তি; শুভ্রবসন
মাথায় পাগড়ি; অলৌকিক পোশাক-আশাক; আননে কি রাপের মায়া
দেখলেই শ্রদ্ধা হয়

আর এখন তুমি ঈশ্বর নামক বদমাসের একান্ত অনুচর হয়ে আমাদের কাছে?
দেখাচ্ছি দাঁড়াও; একদিনে কয় বৎসর পাওনি তো টের—
হাজার জলপানি খেয়ে আমরাও হয়েছি মানুষ; ইকড়ি-মিকড়ি খেলায়
আমরাই এতদিন ছিলেম বলে লোকে দুর্নাম দিতো—
তুমি কি শৈশবে একবারও এক্কাদোক্কায় হেরে গিয়ে টাননি বাসন্তীর
সূক্ষ্ম অন্তর্বাস?
ওই সবদিনে ঘুমের ভান করে রাত্রিকালে কি করেছিস ঠিক কোরে বল্‌;
নইলে—
নইলে এক্ষুণি প্রস্রাবে ভরে দেব তোর মুখ; জুয়োচ্চোর ফেরেশতা সেজে
এই ভুবনে?—বলে

লোকগুলো নিয়ে গেল বিশ বছরের রমণীদের কাছে
দেখলাম; সেই রমণীবৃন্দ সমস্ত পোশাক খুলে; উন্নত বক্ষে দাঁড়িয়ে
হা হা করে হাসছে
আমি তখন মৃতপ্রায় মানুষের মতো আল্লাহ’র কাছে প্রার্থনা করলুম
“আল্লাহ; আমার প্রার্থনা কবলে করো; আমি যেন রোজ ভোর বেলা
এইভাবে আসি
আর এইভাবেই তোমার অপূর্ব হস্তের কারুকাজ দেখে যাই—
হে আমার দয়াময়
তোমার এমন শিল্পকর্ম এতো আমি দেখিনি আগে?”

২৮/৯/৭২

একটি বালক

আপন শিউলী বাগান নীলিমার মতো
লজ্জায় গ্রীবা রাখে সবুজ করতলে—
পরিশ্রান্ত প্রেমিক উদ্‌ভ্ৰান্ত সকল খেলায়; যতো
বার বলেছি তাকে মুখ রাখে কঠিন জলে!

তাহলে কোথায় যাবে এই অবেলায়?
হিরন্ময় কন্ঠের ভাঁজে বিষন্নতার ঘ্রাণ—
আষাঢ়ে মেঘের স্বর পলাতক বহুদিন; দিনরাত্রি হেঁকে যায়
একটি বালক, “এখানে কি পাওয়া যাবে জন্মের গান”?

২৫/৯/৭০

একটি ভালবাসার মুখ

বরং আরো কিছুক্ষণ এক বুক অন্ধকারে হাত দুটো রাখতে দাও
পেতে দাও ঈশ্বরের অনাবিল শান্তি
এসেছি যোজন পথ পাড়ি দিয়ে মাড়িয়ে খড়কুটে শক্ত পাথর
বড় অসহায় ক্লান্ত আমি
য্যানো অনেক অনেক দিন সুখের মুখ দেখিনি
দেখিনি আত্মীয় স্বজন, পাইনি নিবিড় সান্নিধ্য তাঁর
শুধু চোখের সামনে সারি সারি তৃষ্ণার্ত মুখের মিছিল—বলে

উন্মাদ লোকটি ম্রিয়মান ঘাসের উপর এলিয়ে সমস্ত শরীর তাকালো শূন্যে
পরম কৌতুহলী দৃষ্টিতে
নরম ফুরফুরে বাতাসে মাথার ঝাঁকড়া উস্কোখুস্কো চুলগুলো বড়বেশী
ব্যস্ত হলো বাতাসের অন্তরঙ্গ নর্তকীর মতোন

আমি সামনে দাঁড়িয়ে অবাক দটিতে গালে হাত দিয়ে
দেখছি তার নিপুণ কলা কৌশল; বলার ভঙ্গি–
সহসা সমস্ত বিস্ময় চুরমার হলো
প্রচণ্ড হাওয়ায় ট্রাউজারের পকেটে পয়সার মিউজিক বেজে গেল
অন্ধকার চারদিকে, বড় বেশী মেতেছে খেলায়; নিজেরাই খেলছেতো
খেলছেই—
লোকটি উঠে দাঁড়ালো আবার; বললে
আমার চোখ দুটো কেড়ে নিয়ে হাত দুটো সরিয়ে নাও
সহ্য হয়না এখন, সহ্য হয়না কোন কিছুই
এমন কি আজন্ম সাধের বাসন্তীকেও
ওই যে আমার রঙীন স্বপ্ন গলে এখন আর তীর্থ করেনা তার ত্রিসীমানা
কৈশোরের প্রেমগুলো ধুঁকে ধুঁকে মরছে, মরছে সবখানে
আমাকে এখন কেউ ভালবাসেনা, কাছে টানেনা, মাথায় চুলে হাত বুলোয় না
তুমি দয়া করে, দয়া করে সখা হে
যদি পারো এনে দাও একটি ভালবাসার মুখ
একটি ভালবাসার মুখ।

য্যানো বা তার কথাগুলো ঠিক তক্ষুণি শহরের বিষণ্ণ মনুমেন্ট ছুঁয়ে ছুঁয়ে
নিমেষে উধাও হলো দৃশ্যের গভীরে
বিহ্বল চেয়ে দেখি ওই অন্ধকারেই মারবেলের মতো
জ্বলজ্বল করছে তার উজ্জ্বল চোখ দুটো!

১৮/৯/৬৯

একটি যথার্থ ভালবাসা

এইভাবে তুমিও পরস্পর কথা রেখে উঠে যাবে আসল গন্তব্যে
চলে যাবে নিসর্গ বিলাসীর কাছে; পড়ে থাকবে ম্ৰিয়মান ঘাস
ঘাসের ছিন্ন মেঝেয় ইচ্ছাকৃত স্মৃতি;–
অতঃপর চেয়ে থাকবো আজীবন
ভাসবে অতীত দৃশ্যাবলী; একদা
যেমন মুখোমুখী চেয়েছিলে সুসময়ে

পুনরায় হয়তোবা পেয়ে যাবো সোনালী ভবিষ্যৎ; অভ্যাস মতো
পাঠাব ‘তারার গোলাপ’; তোমার খোঁপার জন্যে—তুমি দেবে
একটি যথার্থ ভালবাসা
ঠাঁই নেবে হৃদয়ের সূক্ষ্মতন্ত্রীতে—
এই আশায়

অনায়াসে চলে যাচ্ছো রান্ত্রির নির্জন ট্রেনে : একটি বর্ণনাহীন পাড়াগাঁয়ে
বাতাস তোমাকে আশ্রয় দেবে; ছায়া আমার ঘুরে বেড়াবে চতুর্পাশে
ক্যামোন অসহায়; য্যানো
দীঘকাল শুয়ে আছি নিরবধি অন্ধকারে
একটি যথার্থ ভালবাসা পাবো বলে!

৬/৩/৭২

একদিন আমারো প্রেমিকা ছিলো

একদিন আমারো প্রেমিকা ছিলো
একদিন আমিও খুশিনীল স্বপ্নের শূন্যতায় উচ্চারণ করেছিলাম
পৃথিবীর সব মানুষের আনন্দ-হাসির মত্ততা!

আজ আমি এই মধ্যরাতে বিপুল সিগ্রেট জ্বালিয়ে
হুলুস্থূল সফরী ধোঁয়ায় নিজেকে দেখলাম; বড় বেশী একা, একলা—
আত্মঅহংকার যার কবিত্বের মধ্যে বন্দী; অথাৎ দুই চোখের মাঝখানে
আরেকটি চোখ এসে হয়ে গেছে তৃতীয় নয়ন!

আমি এখন তাঁর নামে একটি কবিতা লিখে বিশ্ব বাজারে
রপ্তানী করে দেব
কেননা, বিমর্ষ হাওয়া জানে কোথায় লুকোবে অধিকার মানুষের ঘ্রাণ
ব্যবহৃত সবুজ রুমাল!

একদিন আমারো প্রেমিক ছিলো
একদিন আমিও খুশিনীল স্বপ্নের শূন্যতায় উচ্চারণ করেছিলাম
শিল্পসম্মত মানুষের আনন্দ-হাসির মত্ততা!

১৩/৮/৭৪

 একদিন কেউ কাউকে চিনবে না

(মেহবুবা শিরীন-কে)

সবই চলে যায় সবই চলে যাবে একদিন
তবু কেউ কারও মুখ দেখবোনা সঠিক
অস্পষ্ট ভালবাসা বরং থেকে যাবে ইতস্ততঃ
আজীবন ইচ্ছেগুলো ভেসে যাবে বাতাসে নীলিমায়

চোখে চোখে চোখ রাখলে কেউ কাউকে চিনবো না
ভুল কোরে পাশাপাশি হেঁটে গেলে কেউ কাউকে দেখবো না –
একদিন শরীরে শরীরে মিশে যাবো
একদিন জীবন সংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবো
একদিন মিছিল থেকে চলে যাবো মরণ ভবনে
একদিন ডেকে ডেকে চলে যাবে অলীক ঠিকানায়
একদিন নির্ভুল নিয়মে দাঁড়াবো মুখোমুখী
একদিন আমি তুমি চলে যাবো কালের আঙিনায়

একদিন তবু কেউ কাউকে চিনবো না!

৭/৩/৭০

 একলা হাতে

চাঁদ খসে পড়ল নষ্ট আকাশের বুক থেকে–
তারার মিউজিয়ম দুয়ার খুলে চকচক করে উঠল পুনরায়
আমি এক দাঁড়িয়ে; চাল উড়ে যাওয়া ভাঙা ঘরের মেঝেয়—
একল হাতে
পেছনে নটীর ছবিওলা আয়না

দেখলাম আয়নায় চাঁদের শরীর বিধ্বস্ত
নিসর্গের গাছপালা বেশ্যার মতো অদূরে দাঁড়িয়ে হাতছানি দিচ্ছে
আমায়
আমার শুদ্ধ প্রেম হঠাৎ তোমার হৃদয় থেকে ঝরে গেল।

আমি এখন সেই প্রেম এখানে ওখানে খুঁজি—
দেখি; আমার বুকের মধ্যে বসে কে যেন সেই প্রেমে
একাগ্রচিত্তে
সুন্দর করে আগুন লাগাচ্ছে ভীষণ; দ্রুত–
একলা হাতে!

২৯/২/৭৩

কবিতার এলোমেলো ভেলা

আমার বুকে অনেক ক্ষত
তব আমি বিক্ষত নই—
ভরদুপুরে একলা কত
খুঁজে বেড়াই হৃদয়টা কই!

কোথায় গেল এই বেলাতে—
দিন কেটে যায় অলস কাজে
বুকের মাঝে সন্ধ্যা রাতে
বীণার মতো দুঃখ বাজে
দুঃখ আমার ভালবাসা
তারে নিয়েই বেঁচে থাকা
বাঁচার মাঝে সকল আশা
সকাল দুপুর তারই দেখা!


চোখের সবুজ পৃথিবীটা নাচে হঠাৎ
রাত্রে
সুন্দরী এক লুকিয়ে থাকে রঙীন সাত
পাত্রে

অলীক প্রেমিক আরাম খোঁজে অন্ধকার
কক্ষে
কালো রঙের ইচ্ছে গুলো লাফায় তার
বক্ষে!


আমি বলি—
অঞ্জলি
সন্ধ্যে হলো
বাইরে চলো
একলা ঘরে
বুকের ‘পরে
কতটুকু পাবে মোরে!


হায়দার
এই দ্বার
আজ কেন রুদ্ধ?

তরুতলে কাছাকাছি
বসে আছি
গৌতম বুদ্ধ!
দিন নেই রাত নেই বসে শুধু ভাবছি
মমতায় ইশারায় চোখ দিয়ে ডাকছি—
কোথা সেই যুদ্ধ?

দেখলাম হায়দার
যুদ্ধই উদ্ধার
উদ্ধারে হয়ে যাবো সুন্দর শুদ্ধ।

[ কবিতাগুলো ‘৬৯ থেকে ৭৪-এ রচিত ]

কার জন্যে ভালবাসা

(রাশিদুল হাসান ও আনোয়ার পাশাকে)

এ বৈশাখে আমি কার জন্যে ভালবাসা রেখে যাবো?
সম্পূর্ণ ধ্বংসের ভিতর থেকে বিশাল ক্ষত এবং দুঃখ নিয়ে সবেমাত্র
বেরিয়ে এসেছি
আমার পেছনে আসছে বেলোয়ারী ঝড়; ভয়াবহ সোনালী বন্যার হাত ধরে

আমি কার জন্যে ভালবাসা রেখে যাবো?
আমার চৌদিকে একদা যে শিল্পসম্মত মানুষগুলো ঘুরতো সর্বদা
ঝলমলে আলোয় হাসি খুশি মুখ রাখতো পরম বিশ্বাসে
হাওয়ায় ফলে তোলা রুমাল উড়িয়ে চলে যেতো দূরে শহরে
গল্প করতো নিসর্গের সবুজ পার্কে; ডাকতো গভীর স্নেহে–
তাদের আমি আজ আর কাউকে দেখিনা

আমি কার জন্যে ভালবাসা রেখে যাবো?
ছিন্নমসুল পাখীর মতো অবিরাম ঘুরছি; নগ্ন পা রাখছি ক্লান্ত
মাটির শরীরে
সবদিকে দুর্ভিক্ষের দারুণ কন্ঠস্বর, দয়ারে অনাথ বালিকার কান্না—
আমি তার মধ্যে হেঁটে যাই; হেঁটে যাই গোপন ভালবাসা বুকে নিয়ে

আমি কার জন্যে এই গোপন ভালবাসা রেখে যাবো—আমার ভালবাসা?

২/১/৭২

খেলা

 

তবু দৃশ্যের কিছু, দৃশ্য থেকে যায় অবশেষে
টর্নেডো বন্যা মহামারী কিংবা ভয়াবহ যুদ্ধের শেষে
ধ্বংসের দারুণ ছবি খেলা করে হৃদয়ে চোখে
আকাশের সুনীল গম্বুজে প্রান্তরে নদীতে কল্পলোকে

শোক দুঃখ এবং কান্নার অবশিষ্ট অংশ
জমা হয় আমাদের পরিচিতি রাস্তা ঘাটে
লোকালয় বিধ্বস্ত হয়; পড়ে থাকে ঘরের ঝুল কবাট মাঠে–
উড়ে যায় সুদূরে কাকচিল চড়ুই হংস!

বিষাদ যন্ত্রণা ভালবাসা যাই বলো না কেন ধ’রে রাখে কিছু দৃশ্য
সময়ের ক্যামেরা
আদিগন্ত সবজ চিৎকারে ভাসে আমাদের শান্তির নীল ভেলা
বাতাসে জ্বলেনা মোমবাতি; অন্ধকারে জেগে থাকে বস্তি গ্রাম পাড়া—
এই সবই দেখা যায় বড় বেশী; প্রেম দুঃখের খেলা!

২৮/৭/৬৯

চলে এলুম

(চলে এলাম, তোমায় ছেড়ে চলে এলুম–
মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়)

চলে এলুম, তোমায় ছেড়ে চলে এলুম
রইলো পড়ে ছেঁড়া মাদুর, ভাঙ্গা সানকী
জীর্ণ কাঁথা মলিন বালিশ
মুলিবাঁশের ছিদ্রবেড়া, পচাঁ ডোবা
মাটির ঝাঁকি, পুরানো কোদাল

ফেলে রেখে চলে এলাম

চলে এলুম, তোমায় ছেড়ে চলে এলুম
দুঃখপূর্ণ মুখটি তোমার উঠলো ভেসে চোখের মধ্যে
ঘন্ট করা কচুর শাকে আমায় তুমি খেতে দিলে
মাটির ব্যকে পা ঠেকিয়ে অন্ন দিলুম মুখের ভেতর
হাতের খেলায় বিদায় নিলো ঘাসের যত মাছিগুলো
পাশে দেখলুম বুড়ো কুকুর শুয়ে আছে খালি পেটে
মাথার উপর কড়া রোদ্দুর কাকের শরীর
এবং তোমার
চোখের জলে ভিজে যাওয়া শাড়িটাকে

মনে ছিল, আসার বেলায় বলবো কিছু
খুচরো পয়সা দিয়ে যাবো
মুন্সী বাড়ি কাজের জন্যে বলেও যাবো
দিয়ে যাবো গামছাটাকে শাড়ি কোরে পরবে তুমি
কিন্তু আমার হয়নি বলা অত কিছু—
তবু আমায় আসতে হলো, আসতে হলো তোমায় ছেড়ে

গ্রামটা আমার ভেসে গেছে
চৈত্র এলে পুড়েও যাবে
কাজের জন্যে দুয়ার দুয়ার ঘুরেও কোন ফল হবেনা
এখন দেখি শহর আমায় রাখে কিনা!

বেঁচে থাকার ইচ্ছা নিয়ে গ্রামটি ছেড়ে চলে এলুম

চলে এলুম, তোমায় ছেড়ে চলে এলুম

৯/৫/৭০

চাঁদের ভেতরে একজন

চাঁদের ভেতরে একজন নগ্নপ্রায় ব্রোথেল রমণী বসে
আছে হাঁটুর ভেতরে মাথা গুঁজে; মার্কিনী নায়কের মতো হিংস্র
তার করতলে এক বিষাক্ত ছুরি
জ্যোৎস্নায় চকচকে করছে দীর্ঘকাল

আকাশের সুনীল কপালে একটা মারাত্মক টিপ
প্রেমের লন্ঠনের মতো উজ্জ্বল অথচ ভয়াবহ
উত্তরাধিকার সুত্রে বর্তমান দারুণ আগুন জ্বলে আমাদের হৃদয়ে
রক্তের সবুজ সঙ্গীত ঈশ্বরের একান্ত বন্ধ; স্কুলের মেয়েদের
মতো মিষ্টি
য্যানো মধ্যরাতে সমূহ চুম্বন। শরীরে নেচে বেড়ার অনুভূতির
পাগল জন্তুরা

সন্ধ্যায় রমণীর বিপণী থেকে পরিচিত আকৃতি বেরিয়ে আসে দ্রুত
ছিন্নভিন্ন রঙীন পথে; সোনালী আলোয়; কঠিন চোখে রাখি
ফেরেশতার নিত্য হরিণ
অতঃপর পরবর্তী বিশ্বাসের উপর নির্ভর করতে করতে চলে যায়
প্রতিবাদহীন ফ্ল্যাটে
এবং রাত্রি গাঢ় হলে যখন পরস্পর শরীরে শরীরে মিশতে থাকে—
দ্যাখে; জানলায়
আকাশের সুনীল কপালে মারাত্মক-অশ্লীল মহিলাটি ঠিক তখনে বসে
আছে নির্বিকার
য্যানো গিলে খাবে এই আমুণ্ড আমাকেই!

৬/৩/৭২

ছন্দে, ভুল ছন্দে গদ্যপদ্য খেলা

 

পাখির ভাষা কণ্ঠে নিয়ে     যেতে যেতে পোশাক আমার বদলে নেব
প্রেমিক পুরুষ পথ ভুলে যায়      উড়তে উড়তে পথটা আমি চিনিয়ে দেব–
বংশীধ্বনি পরাঙমুখ      ভুল ভ্রান্তি দুঃখ সুখ
নদীর স্রোত সোতস্বিনী,      আমি যাবো উল্টো দিকে—
দেখতে পাবো ঈশ্বরীকে      বসে আছে মা জননী!
বনান্তরে ঘন্টাধ্বনি;–      একলা হাওয়া হলদে ডাহুক
কোনদিকে যায়?      —ঘন আঁধার খেলা করে অনিমিখে!

।দুই।

পোশাক আমার হরিৎপোশাক,      হরিৎ নয়,      হতেও পারে—
দোকলা স্বভাব মনের ভেতর,      টানাপোড়েন –
আমার তেমন ভাল্লাগেনা      নারী আছে সংসারে—
যৌথ খামার দোকানপাট      তাহার মাঝে আমার বাস
বানের জলে ডুবল ঘাট      কবির দুঃখ বারোমাস

বারে মাসেই যেতে যেতে      পোশাক আমার বদলে নেব
মদবিহ্বল জ্যোৎস্না রাতে সকাল সাঁঝে নদীর মতো স্রোতস্বিনী নদী হবো।

১৫/১০/৭৪

জন্মই আমার আজন্ম পাপ

জন্মই আমার আজন্ম পাপ, মাতৃজরায়ু থেকে নেমেই জেনেছি আমি
সন্ত্রাসের ঝাঁঝালো দিনে বিবর্ণ পত্রের মত হঠাৎ ফুৎকারে উড়ে যাই
পালাই পালাই সুদূরে

চৌদিকে রৌদ্রের ঝলক
বাসের দোতলায় ফুটপাতে রুটির দোকানে দ্রুতগামী নতুন মডেলের
চকচকে বনেটে রাত্রির জমকালো আলো ভাংগাচোরা চেহারার হদিস

ক্লান্ত নিঃশব্দে আমি হেঁটে যাই
পিছনে ঝাঁকড়া চুলওয়ালা যুবক। অষ্টাদশ বর্ষিয়ার নিপুণ ভঙ্গি
দম্পতির অলৌকিক হাসি প্রগাঢ় চুম্বন
কাঁথায় জড়ানো শিশুর অসতর্ক চিৎকার
এবং
আমি দেখে যাই হেঁটে যাই কোথায় সামান্য বাতাসে উড়ে যাওয়া চাল–
অর্থাৎ আমার নিবাস।

ঘরের স্যাঁতসেতে মেঝেয় চাঁদের আলো এসে খেলা করে
আমি তখন সঙ্গমে ব্যর্থ, স্ত্রীর দুঃখ অভিমান কান্না
সন্তান সন্তুতি পঙ্গু
পেটে জ্বালা, পাজরায় তেল মালিশের বাসন উধাও–

আমি কোথা যাই? পান্তায় নুনের অভাব।

নিঃসঙ্গতাও দেখেছি আমি, উৎকন্ঠার দিনমান জ্বলজ্বলে বাল্বের মতোন
আমারি চোখের মতো স্বজনের চোখ–
য্যানো আমুন্ড গ্রাস করবে এই আমাকেই
আমিই সমস্ত আহার নষ্ট করেছি নিমেষে!

শত্রুর দেখা নেই, অথচ আমারি শত্রু আমি–
জ্বলন্ত যৌবনে ছুটি ফ্যামিলি প্ল্যানিং কোথায়
কোথায় ডাক্তার কম্পাউন্ডার?
যারা আমাকে অপারেশন করবে?
পুরুষত্ব বিলিয়ে ভাবি, কুড়িটাকায় একসের চাল ও একদিনের অন্যান্য
সামান্য দ্রব্যাদী মিলবে তো?

আমার চৌদিকে উৎসুক নয়ন আহ্লাদী হাসি ঘৃণা আমি পাপী

এরা কেন জন্ম নেয়? এরাই তো আমাদের সুখের বাধা অভিশাপ
মরণ এসে নিয়ে যাক; নিয়ে যাক
লোকালয়ের কিসের ঠাঁই এই শত্রুর?–বলে
প্রাসাদ প্রেমিকেরা

আমিও ভাবি তাই; ভাবি নতুন মডেলের চাকায় পিষ্ট হবো।
আমার জন্যই যখন তোমাদের এত দুঃখ
আহা দুঃখ
দুঃখরে!

আমিই পাপী; বুঝি তাই এ জন্মই আমার আজন্ম পাপ।

 জর্ণাল : স্মৃতিচিত্র

কাল সারারাত বৃষ্টি হয়েছিল

মেঘের প্রবল খেলার ভঙ্গিতে আমি এক নিবিড় শুয়েছিলাম
কোমল শয্যার শরীরে
আমার চৌদিকে বৃষ্টির নিপুণ করতালি
ডাকছিল আমাকে।
“আয় আয় ভিজে উঠি গুরুজনের দারুণ চোখ ফাঁকি দিয়ে”—
যেন পেয়ে গেছে বালকবেলার সাথী!

কাল সারারাত একা একা বৃষ্টি হয়েছিল
টিনের ছাদে খেলছিল তুমুল
যৌবনের ব্যস্ত প্রেমিকের মতো ছুটেছিল পার্কে বাগানে—
নদী কি এখনো বসে আছে ভীষণ উৎকন্ঠায় ?
আমিতো মেঘের অনুচর বিষে নীল গোলাপ
শহরময় হেঁটে গেলে ঘেমে যায় ক্ষয়িত পাথর
আমিতো জোৎস্নার শত্রু, ঘন কুয়াশা বক্ষের বন্ধু!

আমার খেলার ভঙ্গিতে বর্ষাতি চাপিয়ে গায় ছুটে যায় মহাজন
রাজাধিরাজ
ব্যাকুল চেয়ে থাকে সম্রাজ্ঞীর করুণ হৃদয় কিশোরীর বুক
আমিতো খেলছি এই মধ্যরাতে ; টিনের ছাদে খেলছি একা একা
সখী নেই
আমিতো এক্ষুণি চলে যাবো বিষন্ন মেঘের ইশারায় –
হয়তো বা
সেই মেঘ ভেবেছিল বহুবার?

আমি একা শুয়ে আছি; নিবিড় শুয়ে আছি
কোমল শয্যার শরীরে
সেই বৃষ্টি এখনো কি সখীবিনা ঘরে বেড়ায় আকাশের একলা পথে
আমি যেমন শুয়ে আছি এই বিজন ঘরে?

১২/৭/৭২

জেব্রা ক্রসিং-এ

এই চাঁদ খসে পড়ল জেরা
ক্রসিং-এ। তাঁর শরীরে আলোর
যে বন্যা; কে যেন মাড়িয়ে
গেল নিমিশে। জ্যোৎস্নার ব্লাউজ ব্রা
রক্তে ভেজা। ছুরির তীক্ষ্মতা যেন মোর
বুকের উপর তখনো দাঁড়িয়ে।

কোন্‌ ঈশ্বর এই জ্যোৎস্নময়ী
চাঁদের স্তনে আঘাত করেছিল? — জানিনা!
তবু মনে হলো বেশ্যার অপরাধ
কতটুকু? ঈশ্বরতো সবারই জয়ী।
মুদ্রার কাছে শুধু বেশ্য পরাজিতা বৈশ্যাকে ঘরে রাখতে পারিনা
বলেই ঘর থেকে বের কোরে দেয়া–কি স্বাদ
আমি তো বুঝিনা। সেই চাঁদের কলঙ্ক আমি জানি। যেমন সবাই বেশ্যার
কলঙ্ক জেনেও তাঁর কাছে বারবার
যাওয়া আসা; দু’পায়ের গোপন ফাঁদের নিবিড়ে ধরা দেয়া। কি আশার
কথা তুমি শোনাবে এখানে?—জানা আছে আমার!

পড়ে থাকা চাঁদের রাউজ ব্রা
সব কুড়িয়ে যখন ঘরে ফিরছি; দেখি
ভীষণ রক্তে ভিজে গেছে জেব্রা
ক্রসিং। মনে মনে বলি, “তাহলে ঈশ্বরই মেকী!”

২৮/৫/৭৩

তুমি আমার কবিতা পড়োনা

আমি কখনো প্রেমিক ছিলুম না
প্রেম কি বুঝতে চাইতুম না—তুমি শেখালে
আমি হয়ে উঠলুম প্রেমিক

সকল বাঁধা বিপত্তি অমান্য কোরে তোমার কাছে যাই
অনিচ্ছায় বলি “কি সন্দের তোমার চুল চিবুক চোখের ইশারা
শরীরের রঙ

চন্দ্রের সাথে তোমাকে তুলনা করা ভুল হবে!
এমনি হাসি কখনো দেখিনি;–ঠিক যেন মুক্তো ঝরে—

আমি আসলে ঠিকই তোমাকে আবিস্কার করেছি
তোমাকে দেখলেই কবিতার কথা মনে পড়ে যায়
তুমি যেন সাক্ষাৎ কবিতা হয়ে ওঠো
কবিতার সমস্ত উপমা তোমাতেই
আমি তাই কবি হয়ে গেছি!

তোমার জন্যেই আমি আজ কবিতা লিখি–
মিথ্যে বলতে বলতে কবিরা যেমন সৎ হয়ে যায়
সবকিছুই ইচ্ছাকৃত ভুল কোরে চিৎকার কোরে ওঠে এইটেই ঠিক
আমিও তেমনি অলীকে আশ্রয় নিয়ে বলি
“তুমিই আমার জীবন যেন নদীর জলধারা আমাতে স্বয়ং
যৌবনের প্রাচুর্যে আমি এক গ্রীসীয় রাজা–হৃদয়ে আমার
খেলছো সর্বদা!

আমি তোমাকে পাবার জন্যে মিথ্যে উপমা দিয়ে কবিতা লিখি
কবিতার বদৌলতে আমি কবি হয়ে গেলাম—
কিন্তু তুমি আমার কবিতা পড়োনা!

২/৪/৭৩

তুমিই আমার প্রেমিকা

তুমিই আমার প্রেমিকা। যেহেতু
তুমিই আমাকে প্রথম ভালবাসা শেখালে
কি কোরে ভালবাসতে হয়।

একদিন দেখলাম; একজন বিদেশী যুবা
তোমাকে ক্যামোন জোর করে টেনে নিচ্ছে—-
তুমি নিরুপায়!

হয়তো তোমার বিশ্বাস ছিল
তোমার ভালবাসার প্রতিদানে
আমি তোমাকে উদ্ধার করবো। আমি তাই করেছি

আমি তোমার জন্যে মুক্তিযুদ্ধে গেছি
মর্টার ধরেছি, দাঁত দিয়ে গ্রেনেডের ক্লিপ ছিঁড়েছি—
দ্যাখো, তার সঠিক ফলাফল পাওয়া গেছে
একটি চরম যুদ্ধে।

অতএব এসো, এখন জ্বলজ্বলে দিনের আলোয় পুনমিলন হোক্‌
আমাদের–
যেহেতু আমি তোমার আশৈশব প্রেমিক—
তোমার ভালবাসা আমার শরীরে!

১৫/২/৭২

তৃতীয় বিশ্বের শিশুদের

তৃতীয় বিশ্বের শিশুদের । নবারুণ ভট্টাচার্য

অন্ধকারে জন্ম তোর
দেখেও যাবি অন্ধকার
অন্ধকারে মৃত্যু হবে
অন্ধকারে জন্ম যার।

অনন্তকাল থাকবে ক্ষুধা
দারিদ্র ও মৃত্যু শাপ
মশাল হাতে নাচবে প্রেত
বন্যা, খরা, দুর্বিপাক।

অনাথ শিশু, চক্ষু বসা
চলছে চলবে গুরুর দশা
চলছে চলবে গুরুর দশা
মরণ, মারণ—চলবে তাই।

জুলবে কুমির, বাঘের চোখ
আমিষ গাছের বিষম ফল
লতাবে সাপ কাটায় কাটায়
পচা নদীর বদ্ধ জল।

অন্ধকারে জন্ম তোর
দেখেও যাবি অন্ধকার
অন্ধকারে মৃত্যু হবে
অন্ধকারে জন্ম যার।

 তোমার ছায়া

তোমার ছায়া ঘিরে রাখে
সকাল থেকে সন্ধ্যাবেলা
যখন কিনা কাজের ফাঁকে মনে পড়ে
ছায়ায় তখন তোমাকে দেখি
ইচ্ছে করে শুধাই কিছু
এখন কেমন চলছে তবে
আমার মতোন সঙ্গীহীন বুঝি
এখন আমি যেমন আছি!

তোমার ছায়া ধরতে গেলেই
দাঁড়ায় সে যে অনেক দূরে
বলতে গেলে মুখটা তুমি ফিরিয়ে রাখো
হয়না বলা তখন কিছু

পার্কে কিংবা নদীর ঘাটে
বাড়ায় শুধু ব্যাকুলতা
হাতের মুঠোয় ফুলটা তাই
লুকিয়ে থাকে অনেক আগেই
কেমন করে দুঃখটাকে
থামাই বলে এখন তবে!

তোমার ছায়া ভাল লাগে
যখন কিনা একলা ঘরে
তোমায় নিয়ে থাকি মেতে
কিংবা যখন তাকাই আমি সুদূর পানে।

তোমার ছায়া ভাল লাগে সকাল থেকে সন্ধ্যেবেলা।

১৭/৭/৬৯

নগ্নতাই আমার সৌন্দৰ্য

পুনর্বার ফিরে যাবো মধ্যরজনীতে আমি ও আমার সকল সুন্দরতম শত্রু
ফিরে যাবো সেই রমণীর কাছে; যার নিবাসে নিরপরাধ প্রেম
লুকিয়ে থাকে
সগৌরবে তুলে ধরে বাহু
ভাবনার একান্ত নক্সী ভায়োলীন

সিম্ফনির মতো বাজতে থাকে একলা বাতাসে–
আমরা তাকে ডেকে এনে
জ্যোৎস্নাহীন জ্যোৎস্নায় হত্যা করবো
খুলে নেব সমস্ত ভূষণ প্রেমের মাদুলী
শুধু রক্ষা করবো তাঁর একমাত্র প্রিয় গাঁথা!

পুনর্বার ফিরে যাবো; ফিরে যাবে সুশোভনাকে সঙ্গে নিয়েই
ফিরে যাবো
ফেলে যাবো রজনীগন্ধার বনে শাড়ি ব্লাউজ ও গোপন অন্তর্বাস
নতজানু হয়ে অবলোকন করব হৃদয়; হৃদয়ের সমস্ত ভালবাসা
সৌন্দয় এবং নগ্নতা

তোমরা সবাই চলে গেলে; চলে গেলে হে আমার সুন্দর শত্রুরা
আমি সুশোভনাকে তুলে নিয়ে ফুলের মতে সাজিয়ে রাখবো–
সাজাবো আমার গোলাপ-টেবিলে!

৮/১/৭৩

 না পারলেও পুনর্বার ভেবে দ্যাখো তুমি

না পারলেও পুনর্বার ভেবে দ্যাখো তুমি
ইন্দ্রিয়ের কাছে জেনে নাও কি কোরে পূনর্মিলন হবে আমাদের–বলে
সে নিজেই মধ্যাহ্নের খরতাপে ছুঁড়ে দিল প্রিয় রমণীর মতো একটি
গোলাপ ও সিগ্রেট
অশ্রু নির্মিত সরোবরে
আরেকটি পদ্মের ঠিক হৃদয়ের মাঝখানে

তুমুল অগ্নিপ্রপাতের দিনে পাশাপাশি যেতে যেতে
একজন মায়াবী মহিলার কাছে শব্দের তোরণ খুলে দিয়ে
আভুমি নতজানু হয়ে
তাকালে নয়নে সখা তাকালে নীলিমায়

।। দুই।।
এই ভাবেই হোকনা শুরু এই ভাবেই হোকনা শেষ —
জীবনের সজল পল্লব জয় করবার ইচ্ছায় চকিতে উড়াও
কামিনী ডালের পাখিদের, আঙিনার পায়রা, ভোরের পবন,
শ্রাবণের মেঘ মেলা, আমাদের প্রিয়তম সুন্দরীতমারে!

না পারলেও পুনর্বার ভেবে দাখো তুমি; ভেবে দ্যাখো
সরোবরের পদ্মপাতার ফাঁকে অমল জ্যোৎস্নার লকোচুরি
নর্তকী অমরাবতীর সোনালী যৌবন
সুবর্ণ পদাবলীর কোমল হৃদয়
পার্কের বিকেল বেলায় খুনসুটি
চুলের নিবাসে রজনীগন্ধার বসবাস—এইসব দেখা ও পাওয়া
বুঝি সব ব্যথা যাবে
বৃথা যাবে অন্ধকারে দুজনে মুখোমুখী বসিবার?

[কবিতার দুটো লাইন এলিয়ট এবং জীবনানন্দের কাছ থেকে ধার নেয়া]

নিজস্ব মানুষ

তাতে কি, পুনর্বার জলে নেমে শুদ্ধ কর গা
যে গন্ধময় পাপ করেছ ধারণ
না হয় নামলেই এই শীতে
সমস্তই ধুয়ে যাবে জলের তরলতায়-বলে

আমার সুজন মিশে গেল হাওয়ার গভীরে
চারদিকে সকালের নিবিড় কুয়াশা
পাখিও জাগেনি তখন
অন্ধকার কেবল ছায়া-ছায়া

আমি সেই জলের উদরে পা রাখতেই
কনকনে ঠাণ্ডা এক ঘিরে ধরল শরীর
তাড়াতাড়ি উঠে পড়লাম তীরে

তারপর হাঁটতে হাঁটতে আমিও চললাম শহরে
শহরের এক প্রান্তে এসে যখন দাঁড়িয়েছি
দেখলাম, আমার সুজন মিশে গেল মানুষের ভীড়ে

প্রাণপণে ডাকলাম যেন না-শোনার ভানে হাঁটতে থাকলো দ্রুত
আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেটে শেষ টান দিচ্ছি
দেখি, একটি বাস এসে দাঁড়াল আমার কাছে—
আমি তাঁর হাতল ধরে উঠতে চাইলাম—
মানুষগুলো ঠেলে দিল মাটিতে

পুনরায় আমি হাঁটতে লাগলাম
হাঁটতে হাঁটতে একটি রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছি
সবাই নাকে আঙুল চেপে চলে গেল –
আমি বুঝতে চেষ্টা করলাম
মানুষের কিসে এই অনীহা!

মনে পড়ল সুজনের কথা—
“যে গন্ধময় পাপ করেছ ধারণ–
না হয় নামিলেই এই শীতে
সমস্তই ধুয়ে যাবে জলের তরলতায়!”

আমি আবার হাঁটতে হাঁটতে নিজের ঘরে ফিরে এলাম
দরজায় টোকা দিতেই ভেতর থেকে শব্দ এলো
‘কে’?
বললাম
‘খোলো’
খুলে গেল বন্ধ কপাট
ভিতরে ঢুকতেই নির্দ্ধিধায় কাছে এলে বাসন্তী
শরীরে হাত রেখেই বলে উঠলো
‘ঘেমে দেখছি অস্থির হয়ে গেছ”

বাসন্তী তখন জামার বোতাম খুলে, সামনে বসে, মাথায় হাত
বুলাতে বুলাতে
বাতাস দিতে থাকলো—
আমিই সেই বাতাসে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছি

তারপর এক সময় জেগে দেখি
বাসন্তীর মুখখানি পড়ে আছে আমার বুকের উপর।

৩/১০/৭২

নিরপরাধ বৃক্ষমূল

কখনো যাবোনা আর-

যেহেতু তার
হিংস্রতার
কঠিন কুঠার
হানা দেয় অনিবার।

একদা যখন টাকার
ছড়াছড়ি আমার
রাজার
দুলালী এসে ছিঁড়ে দিত গিঁট পাজামার।

এখন গিয়েছে সব; ঘরেতে আঁধার–
বিধাতার
অদৃশ্য খেলার
হাত; মমতা যার
কবিতার
মতো অপার—
বোঝা ভার।

নিরপরাধ বৃক্ষমূল ভেঙেছে সে; যাবো না আর

২/১১/৭২

প্রতিদিন দুঃখ আসে আমার নিবাসে

রাস্তায় গাঢ় দিন হেঁটে যায়। মধ্যরাত
তোমার নিবাসে; সমুদ্র উধাও; দুই হাত
বিজয়িনীর স্বর্ণ মাখা। ভালবাসার নাম
কোথায়? বিভিন্ন সবর আমার মধ্যে। দাম
সব জিনিসের। পলাতক প্রত্যেকে। বাজারে আগুন।
আমি নিঃস্ব। চৌদিকে ঝড়; ঝড়ের খেলায় খুন
হয় ঘরবাড়ি। কোথায় যাবো প্রাক্তন বন্ধুরা?

হাঁটুজল ভাঙতে অভ্যস্ত; বাসে বাদুড় হই; যারা
ভেঁঙচি কাটে; রক্ত তাদের ভিন্নমুখী। এখানে বাঁচার
অর্থ কি? সঠিক সংজ্ঞাটা দিতে পারেন থিবির রাজার
স্ত্রী। এখনো বালক; উপলদ্ধি যদিও প্রখর নয়—

লোকে বলে। তব, আমি অন্ধকার করিনা ব্যবসা। সময়
উর্ধ্বমুখী। পত্র আজ ছিন্ন; ছেলে মেয়ে উপোস যায়।
মাঝে মাঝে ভরসা পাই; হকার হাঁকে রাস্তায়
দৈনিকের হেডলাইন। ঘরে শুয়ে দেখি রোজ
আকাশে নক্ষত্র; ডালপালাহীন তরুরাজি। খোঁজ
নেই আমার হপ্তাখানেক। যুদ্ধ চলে পেটের নিবাসে।

দিন সব বাঘের মতো। রাত্রি; দুঃখ নিয়ে আসে
ঈশ্বর প্রচন্ড ক্ষমতাবান জানি; তব, আমাদের এই পাপ
হয়না কেন স্খলন? এসবের মালিক কে? কে করেন মাফ?

বুঝি দরিদ্র? মধ্যরাতে সজাগ হয় চিন্তা; দুঃখ হানা দেয় আমার নিবাসে
বস্ত্রহীন ছেলে মেয়ে; দ্রব্যমুল্যের বৃদ্ধির খবর আসে
আমার কাছে; তাহলে কিসের স্বাধীন?
মৃত্যু অনিবার্য; এমনিই কাছে আমাদের দিন।

২৭/৪/৭২

প্রেম

 

প্রেম দ্যাখো বয়স মানেনা কোনদিন
ছোটবড় তালার মতো সব বয়সের কপাটে ঝুলে পড়ে হঠাৎ

প্রেম, সবুজ নিসর্গ থেকে পলাতক কয়েদীর মতোন নিঃশবেদ বেরিয়ে
আসে দ্রুত
ঠাঁই নেয় বিভিন্ন লোকালয়ে; খেলা করে সকাল বিকাল
তোলপাড়ে ভেঙে যায় নীলিমার আজীবন আশীর্বাদ-গড়ে তোলে
সুখ-দুঃখ
পড়ে থাকে বয়স্কদের দারুণ চোখ

প্রেম, সেতো বয়স মানে নি কোনদিন-বুঝি তাই
তীক্ষ্ম চকচকে সোনার ছুরি এনে বসিয়ে দেয় সকল প্রহরে
মেতে ওঠে ভয়াবহ বন্যার জলের মতো বাদশাহী হৃদয়ে–এবং
ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় পারিবারিক স্নেহ-মমতা
অথচ শুধু, বেঁচে থাকে পরস্পর হৃদয়ের সদর দৃশ্যাবলী!

।২।
প্রেম, একটা ক্ষুধার্ত হিংস্র বাঘ : নিমেষে গ্রাস করে দীর্ঘকায় শরীর
প্রচন্ড থাবায় কখনো আবার ছিঁড়ে নেয় লালিত মাংস–ছিঁটিয়ে দেয়
বিষাক্ত লবণ
জ্বলতে থাকে আজীবন!
প্রেম; য্যানো গোলাপ-নীলিমা-নিসর্গ-নক্ষত্রে মোড়া আদুরে পুতুল—
নির্জনে থাকেনা পড়ে; অথচ একবার উপযুক্ত হৃদয়ে ঠাঁই পেলে কেউই
রুখতে পারেনা সহজে এবং
সৃষ্টি করে রিশাল বাগান
যা কখনো ফেলে রেখে কোথাও যাওয়া যায় না; শুধু ঈশ্বরের মতো
ক্ষমতা সম্পন্ন হয়ে যায় মুহূর্তে!

৬/৬/৬৯

বাংলাদেশ

লক্ষ মানুষ বিলিয়ে দিয়ে
তোমায় পেলুম একটি নামে—
স্বাধীনতা
তোমার শরীর রক্তে মাখা –

চোখের জলে সিনান কোরে উঠে এলে রণপায়ে; দীপ্ত চোখে
স্টেন্‌গান ফেলে দিয়ে বুকের ভেতর জড়িয়ে নিয়ে
চুম দিলাম আদর কোরে
পাড়ার লোকে দেখতে এলো মালা হাতে
ভুলে গেল দুঃখাবলী, কঠিন শোক, অত্যাচারী রাজার কথা—-
এখন আমি তোমায় নিয়ে নেচে বেড়াই প্রাণের সুখে
সামনে আমার দাঁড়িয়ে তুমি হাসতে থাকো ভীষণ জোরে

আমার মেয়ে মাটির ব্যকে পা ঠেকিয়ে
কাঁদতে থাকে কেমন কোরে–
দ্যাখো তুমি
মায়ের প্রেম হারিয়ে এখোন তাকিয়ে আছে বোনের দিকে–
আসবে ফিরে
ভায়ের কথা স্মরণ কোরে শুধায় শুধু এই পিতাকে
“আসবে কখোন যুদ্ধ থেকে–বাংলাদেশে”?

লক্ষ মানুষ হারিয়ে আমি তোমায় পেলুম তোমায় পেলুম
তোমার বুকে মাথা রেখে ঘুমাই আমি পরম সুখে—
তুমি এলে রণপায়ে, দীপ্ত চোখে; স্বাধীনতা!

১/২/৭২

ভালোবাসার বাগান থেকে

ভালবাসার বাগান থেকে একটি গোলাপ তুমি চেয়েছিলে
তোমার গম্বুজের মতোন অলীক খোঁপার জন্যে—
আমি তোমাকে দিতে পারিনি
তুমি তাই চোখের জলে প্রতিশোধ নিলে
মুখ রাখলে শাড়ির কাছে

আমি বারবার তোমাকে ডাকলাম; তুমি সাড়া দিলে না
বরং ভাসালে নিকানো আঙিনা কুয়োতলা
বিজন ধোঁয়ার মতো উড়ে গেল আমাদের দীর্ঘদিনের পরিচয়
বৃদ্ধি করলে বুকের হিংসার নদী

আমি পেছনে ফিরে তাকালাম একবার; দেখি—
নিজস্ব দুঃখের ঘরের দরজা তখন হাট কোরে খোলা!

১৪/৪/৬৯

মধ্যরাতে রূপোলী চাঁদ

(সিলভিয়া ইসলাম-কে)

মধ্যরাতে রূপোলী চাঁদের মতো বিশাল দুঃখ নিয়ে পড়ে আছি
তোমার করতলে হে আমার মাধবী
সবুজ নিসর্গ থেকে উঠে এলে একাকী
মুখে কালো কাপড় জড়িয়ে; ফেলে রেখে ভাবনার ভায়োলীন

আমি এই মধ্যরাতে তোমার সম্পতি কুড়াবো
বিজন প্রেমে উল্লসিত হবোনা আর—
ভেবেছি বহুদিন
আমার সুনীল মাংসে ভয়াবহ ক্ষতের চিহ্নাবলী—
যেন আদিগন্ত চিৎকারে ভেসে যায় নিবিড় যামিনী!

মধ্যরাতে এখনো পড়ে আছি; রাপোলী চাঁদের মতো পড়ে আছি
চতুর্দিকে ছেঁড়া ট্রাউজার উড়ছে শুন্যে নীলিমায়
হয়তোবা আজন্ম দুঃখগুলো এখানেই পাওয়া যাবে–
কিছুমাত্র লুকোবার নেই
আমি আমার দুঃখের কাছে যাবো হে মাধবী
তুমি তোমার করতল উর্দ্ধে তোলো

মধ্যরাতে রূপোলী চাঁদের মতো পড়ে আছি
থাকতে দাও!

৪/৪/৭২

মনের রংধনু ক্যানভাসে

মনের রংধনু ক্যানভাসে
সৈয়দ গোলাম দস্তগীর

সিম্ফনি বিশ্বের সব কলার মা সম্ভবত সংগীত। এই মাধ্যমের অঙ্গসমূহের তুলনা শিল্পের যেকোনো মাধ্যমে পাওয়া সম্ভব। অভিব্যক্তি, ভূমিবিন্যাস, দৃশ্য বর্ণনা, আকার এবং এদের বস্তুক-নির্বস্তুক অবস্থান শিল্পের যেকোনো মাধ্যমে দেখা যায়। তাই সংগীতবিহীন কোনো শিল্পের কল্পনা বেশ কঠিন।
আর শিল্পী নিজে যদি হন সংগীতের মানুষ, তাহলে তো কথাই নেই। শিল্পী সুমনা হক একাধারে সংগীতশিল্পী এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত চিত্রকর। দীর্ঘ নয় বছর পর প্রদর্শনী করছেন ৬৭টি বাছাই করা চিত্রকর্ম নিয়ে; যার সবগুলোই তেলরঙে করা। কারণ কৌশলে প্রথার বাইরে এসে এমনভাবে উপকরণ ব্যবহার করেছেন, যাতে উপকরণ ও করণ কৌশলের বিবেচনায় তার এক প্রকার নিজস্ব স্বাক্ষর তৈরি হয়েছে। সুমনার এ রচনাসমূহকে দেখলে একপ্রকার ব্যক্তিগত কাব্যের সামনাসামনি হই আমরা। শিল্পীর একান্ত নিজস্ব ভালো লাগা, সুখ, দুঃখ অথবা খেলার ছলে দাগ কেটে যাওয়া বা কোনো কিছু আঁকা এসব চেতন-অবচেতন প্রয়াসের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এক দৃশ্যকাব্য। যার হয়তো নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তিগত অর্থ আছে অথবা নেই। তবে প্রত্যেক স্বতন্ত্র ব্যক্তির কাছে তা ভিন্ন। কাজ হিসেবে এরা দৃষ্টিনন্দন। তার প্রয়াসের সরল একটি লক্ষ্য হলো এমন কিছু উপস্থাপন করা, যা চোখকে আরাম দেয়। আর এ রকম কাজ স্বভাবতই ঘরের শোভা বাড়াতে বা দৃষ্টিকে পুলকিত করতে পারঙ্গম।
কাজগুলোতে আবেগ আছে, আছে ভূমিবিন্যাসের সেই কারুকাজ, যা সংগীতের শব্দ, নৈঃশব্দ্য এবং শব্দ থেকে নৈঃশব্দ্যের যাত্রাপথের মধ্যবর্তী স্বরের মধ্যে ঘটে থাকে এবং এ বিষয়টিকে বস্তু ও শূন্যতা পরিপ্রেক্ষিত দিয়ে বিচার করলে যেমন ফল পায় তেমন। তবে নিবিষ্ট মনে পরপর তাঁর কাজগুলো দেখতে থাকলে মাঝেমধ্যে ঈষৎ সংশয় জাগতে পারে দর্শকদের এবং সংশয়টা ভাষাগত। দৃশ্য ভাষার নির্মাণে একটু যেন অস্থিরই তিনি মনে হয়। বিশুদ্ধ বিমূর্ত রীতির ছবির পরই কখনো কখনো সম্পূর্ণ চেনা অবয়ব বা অপরিচিত আকার বা চেনা অবয়বের আদলে আবার নির্মাণ—এভাবে লাফিয়ে চলেছে। আবার বিমূর্ত ছবিগুলো যখন চেনা নামের ব্রাকেটে আবদ্ধ হয় এবং সে নামগুলো যদি পরিচিত কোনো বস্তুর কথা বিবৃত করে, তখন সংশয়টা আরও বেড়ে যায়। এ প্রসঙ্গে রংধনু শিরোনামের কাজগুলোর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। রংধনুর বর্ণচ্ছটা এবং পরিচিত আকৃতি থেকে এরা স্বতন্ত্র। যদিও এর মধ্যে তার রংগুলো উপস্থিত, তথাপি এরা পরিচিত আকারে বা অবয়বে বর্তমান নয়। এ রকম উপস্থাপনা দোষণীয় নয়; বরং একটি সফল প্রকাশরীতি। তথাপি বিপত্তি শুরু হয় তখন, যখন পাশাপাশি একই শিল্পীর অপর একটি কাজ সরাসরি চেনা বস্তুকে তার চেনা অবয়বেই প্রকাশ করে।
তার পরও যে কথাটা বলতে হয় তা হলো, তার সব কটি কাজ মিলিয়ে একটা ঐক্যতান আছে। যেগুলো একসঙ্গে দেখলে আমরা হয়তো সুমনার কাজ বলে আংশিকভাবে হলেও চিহ্নিত করতে পারব।
প্রথমে ভেবেছিলাম যেহেতু দীর্ঘ নয় বছরের কাজের সমাবেশ এই প্রদর্শনী, তাই সময় পরিক্রমায় শিল্পী নিরন্তর একটি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। বাস্তবে রচনাগুলোর তারিখ দেখতে গিয়ে আমরা দেখি, ২০১১ সালের রচনা বিমূর্ত মূর্ছনা-১, যা পুরোপুরি নিবস্তুক। আবার একই বছরের রচিত ‘ডিজায়ার’ শিরোনামের চিত্রটিতে আমরা দেখি ফুল-পাখি এবং কিছু লাইনের সমাহারে রচিত। একইভাবে ২০১১ সালের রচিত নেচার অ্যান্ড লাভ-১ বা ফিশের মতো কাজের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে মিডনাইট মিস্ট্রি। এসব বৈপরীত্য ছাপিয়ে বহু কাজ আছে যারা আলাদাভাবে দর্শকদের আনন্দ দেয়। তাদের কেউ কেউ একক চিত্র হিসেবে বেশ মন কাড়ে। এদের একটি সিম্ফোনি-৩ মজবুত জ্যামিতিক গঠনে স্নিগ্ধ কিন্তু উচ্ছল বর্ণবিন্যাসে বেশ ভালো লাগে কাজটি। এ ছাড়া আরও কয়েকটি কাজের কথা উল্লেখ না করলেই নয়; যারা রচনা নৈপুণ্যে নান্দনিকভাবে দৃষ্টি কেড়েছে। যেমন—বিমূর্ত মূর্ছনা-৩, অ্যাবসট্র্যাক্ট-৪, সম্পর্ক-২, স্বাধীনতা, এনব্লোজড, নস্টালজিয়া প্রভৃতি। সবশেষে যে বিষয়টি উল্লেখ করা প্রয়োজন তা হলো তার উপাদান ব্যবহারে ও করণ কৌশলগত দক্ষতা। যেখানে বুনটের চমৎকারিত্বে সৃষ্টি করেছেন ভিন্ন মায়াজাল। আর বর্ণ প্রয়োগে পরিমিত এবং ঝুঁকি না নেওয়ার প্রবণতা তার ছবিকে আকর্ষণের কেন্দ্রে নিয়ে যায়।

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ০৭, ২০১১

মায়ের চোখে

আমার মায়ের চোখে আমি ছাড়া য্যানো পৃথিবীর কোন সুন্দর-ই
সহজে লাগে না আর তার কাছে
দিনের আলোর মতো উজ্জ্বল ভালবাসা সমস্ত শরীরে রেখে
বেঁচে থাকেন পরম তৃপ্তিতে—
কখন তার সোনালী প্রহর গড়িয়ে যায়; দৃষ্টি নেই সে দিকে
অথচ ভীষণ মায়াবী চোখে আমাকে নিয়ে খেলা করে সারাদিন
এবং
মেলে রাখেন আত্মীয় পাড়াপড়শীর কাছে!

আমার মায়ের চোখে কোন দুরন্তপনাই ধরা পড়েন। কখনো; য্যানো
বিরাট গণের অধিকারী
সুবোধ বালক আমি
ঠোঁটস্থ সকাল বিকাল তার আমার সমস্ত কাজ-বুঝি তাই
পরম স্নেহে চোখে মুখে ছুঁয়ে যায় আশীর্বাদের নরম হাত!

আমার মায়ের চোখে আজীবন দুধের শিশুই রয়ে গেছি আমি—
এখনো রাত্রিকালে তিনি সেই শিয়রে বসে দেখে যান; গেয়ে যান
ঘুমপাড়ানিয়া গান!

৮/৮/৬৮

মিছিলে তোমার মুখ

মিছিলে তোমার মুখ ছিলো সেদিনের রক্তগঙ্গা রাজপথে
গ্রামকে গ্রাম উজাড় কোরে অবশেষে এইখানে এসে কোন মতে
বাঁধলে কঠিন বুক পরম সাহসে; হৃদয়ে আশা দোলে; যেন সব
সম্রাজ্ঞী স্বপন
অথবা বিধাতার স্বর্গীয় শান্তি খোঁজো রাত্রিদিন এই দারুণ মিছিলে। কখন
যে পাপময় বাতাস বয়ে গেল গাছের ডালে; একটু চোখ তুলে দেখলেও
না তুমি–
বরং বললে; “এখানে নিবিড় ভালবাসা আছে অথচ কি যেন নেই—
হায় আমার বাংলা আমার জন্মভুমি!”

—বলে সেই যে হারিয়ে গেলে ফিরে তাকালেও না আর–
জানিনা একি অপার মমতা যে হৃদয়ে তোমার!

৩/৭/৬৮

রামায়ণের উৎস কৃষি

“যে মহাকাব্য ট্রাডিশানের অংশীভূত তার সম্বন্ধে নতুন আলোকে বিচার করায় কিছু ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ থেকে যায়। যে কোনও রচনা বা সৃষ্টি কোনও এক কালে, কোনও এক সমাজে সৃষ্ট হয়েছিল-সে যে ইতিহাসের বাইরে নয়, কালাতীত নয় এ সহজ সত্যটা গতানুগতিকায় আবদ্ধ মন সহজে মেনে নিতে পারে না। না পারলেও কিন্তু ঘটনাট সত্য। মানুষের ইতিহাসের বাইরে, সমাজবদ্ধ মানুষের সমাজের গণ্ডীমুক্ত অবস্থায় মানুষের কোনও সৃষ্টিই হতে পারে না। তাই রামায়ণ বা মহাভারত আমাদের ঐতিহ্যের একান্ত এবং আত্মস্থ হলেও, তাদের কালিক এবং সামাজিক পটভূমিকা আছে। এ সব মহাকাব্যের মধ্য দিয়ে, তাদের রূপকগুলোর অন্তরালে তৎকালীন সমাজের সমাজবদ্ধ মানুষের সম্বন্ধে যে সব তথ্য লুকিয়ে আছে তাদের ধরতে পারা যায় বিশ্লেষণী মননশীল দৃষ্টি দিয়ে। তাতে মিথ্যা সংস্কারে আঘাত লাগলেও সত্যের হানি হয় না। তবে ট্রাডিশান যে গ্রন্থকে এক বিশেষ কালাতীত আসনে বসিয়ে পুস্তকের অন্তস্থ চরিত্রগুলিকে কালের বাইরে নিয়ে গেছে—তাতে কালিক সত্য নির্ধারণ করতে গেলে দরকার সাহসের দরকার সুস্থ মুক্ত মনের।…রূপক আশ্রিত রামায়ণের মধ্যে বিশ্লেষণের মাধ্যমে লেখক যে ঐতিহাসিক তথ্যের সন্ধান এবং পরিবেশন করেছেন তা আমাদের ঐতিহাসিক ভাবনা চিন্তাকে নতুন ধারায় বাহিত করবে।”

রামায়ণের উৎস কৃষি‘ বইটির ভূমিকায় লিখেছিলেন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শংকরী প্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়। বইটি আমাদের ইবুক সেকশনে পিডিএফ আকারে আগেই দেয়া হয়েছিল। এবার পুরো ইউনিকোড বাংলায় দেয়া হলো আমাদের লাইব্রেরি সেকশনে

স্বগত কবিতাগুচ্ছ/১

 

তাহলে এবার চৈতন্যের নির্জন প্রকোষ্ঠে সহজ সরল বাহ, রাখো—
সমবেত প্রেমিকবৃন্দের উন্নত বক্ষে ঝুলিয়ে দাও লম্বিত মাদুল
দ্রিমিদ্রিমি
বাজুক সমস্বরে; নীলিমায় চোখ রেখে উলঙ্গ করো
নাভীমূল স্তন ও অন্যান্য যৌনাঙ্গ

আমরা এই রঙ্গমঞ্চের অভিজ্ঞ নট পশ্চাতেই নটী
ঘোমটায় কেউ আর পর্দার আড়াল ভেদ কোরে উন্মুক্ত আলোয় আসিনা
যেহেতু অন্ধকারে আমরাই অনেক বালক জন্ম দেই—এইসব
বালকইতো যত সব নটের মূল; পকেটে বিষাক্ত ছুরি
চকচকে সর্টগান
ধারে কাছেও যাওয়া যাবেনা!

ন। যাবোনা; কোথাও যাবোনা; সমস্ত যাত্রা বাতিল
তোমার চিৎকার জুড়ে দাও এই ব্রোথেলে; তুমুল হৈ চৈ বাধাও
ব্যাকুল হও নিজস্ব ভঙ্গিতে —
সমুদ্রের নিঃস্বনে কিবা লাজ; অরণ্যে আমাদের বাস
রোধ করি মহামারী
সহবাসে সন্তান কই? কেবল উঠোন ছেড়ে অলিন্দে ঠাঁই?

এসো সমবেত প্রেমিক প্রেমিকা; নাচো এই রঙ্গমঞ্চেই নাচো—
দেখাও ভালো খেল্‌ অথাৎ সার্কাসী ভঙ্গিমা
আমরাই শ্রোতা ও দর্শক
তোমাদের নিপুণ ভঙ্গির তালে তালে আমরাও করতালি দেব–
শুধু উলঙ্গ করো নাভীমূল স্তন ও অন্যান্য যৌনাঙ্গ!

২/১২/৭২

স্বদেশ, তোমার মুখ

স্বদেশ, তোমার মুখ, আমার আশৈশব প্রার্থনার একান্ত সঙ্গীত
বেঁচে থাকার পরম ইচ্ছায় তোমার বুকের উপর মাথা রেখে শুয়ে আছি
ক্যামোন নিবিড়
য্যানো সপ্রেমে টেনে নেই তোমার দীর্ঘকায় শরীর, আমার শরীরে

স্বদেশ, তোমার সূক্ষ্ম ভালবাসার শিল্পসম্মত ছাপ
হৃদয়ের উজ্জ্বল প্রকোষ্টে অন্তরঙ্গ সখার মতো নিশ্চল নিঃশব্দ
ঝুলে আছে প্রগাঢ় বিশ্বাস নিয়ে!
তোমার আদিগন্ত সবুজ চিৎকারে ছুটে যাই, তুলে ধরি
স্ফিংসের মতোন শক্তসবল বাহু
রক্ষা করি প্রতিটি রোম; ছুঁড়ে ফেলি গন্ধযুক্ত আৰ্বজনা
গভীরতম ড্রেনে, গর্তে

স্বদেশ, তোমার কল্যাণী মুখের রেখা আমার আনন্দে কিংবা প্রেমে
উধাও হয়নি কোন জটিল অন্ধকারে
অথবা এক ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের গহ্বরে!

স্বদেশ, দ্যাখো, তোমার সমস্ত ভালবাসায় আমার ভালবাসা
একাকার হয়ে মিশে আছে
ক্যামোন নিবিড় অন্তরঙ্গতায়!

৮/৮/৭০

হিমু সিরিজের “দরজার ওপাশে”

হুমায়ূন আহমেদের হিমু সিরিজের দ্বিতীয় উপন্যাস “দরজার ওপাশে” আপলোড করা হয়েছে। এখানে ক্লিক করে দেখুন- দরজার ওপাশে

হেলেনের মতো চুম্বন

আমিতো বলিনি হেলেনের মতো একটি চুম্বন অমর করো আমাকে!

অথচ তুমিই একদা প্রতিবিম্বহীন মেঘমেলায় কুসমগন্ধ রেখে
কি গান শুনিয়েছিলে!
আমার সত্তায় সেই শ্লোক গভীর মমতায় এখনে৷ বেজে ওঠে কিন্নরী!

আমিতো অগ্নির কাছে নতজানু হয়ে বলিনি
—রক্তের অশুদ্ধতা প্রজ্জ্বলিত হোক তোমার বিশ্বাসে
অতলান্ত প্রেমে মুছে যাক সুবর্ণ পদাবলী
প্রত্যাখ্যাত ভালবাসায় ফিরে যেতে বড় ভালবাসি।
সকল সম্ভার থেকে মুক্ত করো দুচোখের সজল সরোবর।

বুঝিনি সানন্দে পুষ্পবীজ নক্ষত্র বাগানে—
প্রেমিক হবো বলে গ্রন্হিতে প্রতিজ্ঞার কোন চিহ্ন নেই আমার–
অথচ তুমিই একদা হেলেনের মতো একটি চুম্বনে
অমর করেছো কিন্নরী!

এ অমরতার জন্যে তুমিই দোষী হে আমার প্রিয়তম সুন্দরী।

২৫/৫/৭৩

যেদিক দিয়া আসিয়াছিলাম

যেদিক দিয়া আসিয়াছিলাম সেই দিক দিয়াই ফিরিয়া চলিলাম। মোড় পর্যন্ত পৌঁছিবার আগেই দেখা গেল সম্মুখের রাস্তা দিয়া একটি যুবতী এক ঝাঁক পাতিহাস তাড়াইয়া লইয়া যাইতেছে।

যুবতী আমাদের দেখিতে পায় নাই। তাহার মাথার কাপড় খোলা‌, পরনে মোটা তাঁতের লুঙ্গি-ডুরে শাড়ি‌, দেহে ভরা যৌবন। অন্যমনস্কভাবে যাইতে যাইতে আমাদের দিকে চোখ ফিরাইয়া যুবতী লজ্জায় যেন শিহরিয়া উঠিল। ক্ষিপ্ৰহস্তে মাথার উপর ঘোমটা টানিয়া দিয়া সে তাড়াতাড়ি হাঁসগুলিকে পিছনে ফেলিয়া চলিয়া গেল। কলোনীর পিছন দিকে প্ৰকাণ্ড ইন্দারার পাশে কয়েকটা ঘর রহিয়াছে‌, সেইখানে অদৃশ্য হইয়া গেল।

নিশানাথ বলিলেন,–’মুস্কিলের বৌ। কলোনীর হাঁস-মুরগীর ইন-চার্জ।’

মনে আবার একটা বিস্ময়ের ধাক্কা লাগিল। এখানে কি প্রভু-ভৃত্য সকলেরই দ্বিতীয় পক্ষ? ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল,–’ওদিকে কোথায় গেল?’

নিশানাথ বলিলেন,–’ওদিকটা আস্তাবল। মুস্কিলও ওখানেই থাকে।’

ব্যোমকেশ বলিল,–’ভদ্রঘরের মেয়ে বলে মনে হয়।’

‘ওদের মধ্যে কে ভদ্র‌, কে অভদ্র বলা শক্ত। জাতের কড়াকড়ি নেই। কিনা।’

‘কিন্তু পর্দার কড়াকড়ি আছে।’

‘আছে‌, তবে খুব বেশি নয়। আমাদের দেখে নজর বিবি এখন আর লজ্জা করে না। আপনারা নতুন লোক‌, তাই বোধহয় লজ্জা পেয়েছে।’

নজর বিবি! নামটা যেন সুনয়নার কাছ ঘেঁষিয়া যায়! চকিতে মাথায় আসিল‌, যে স্ত্রীলোক খুন করিয়া আত্মগোপন করিতে চায়‌, মুসলমান অন্তঃপুরের চেয়ে আত্মগোপনের প্রকৃষ্টতর স্থান সে কোথায় পাইবে? আমি রমেনবাবুর দিকে সরিয়া গিয়া চুপিচুপি জিজ্ঞাসা করিলাম,–’কেমন দেখলেন?’

রমেনবাবু দ্বিধাভরে মাথা চুলকাইয়া বলিলেন,–’উই‌, নেত্যকালী নয়–কিন্তু–কিছু বলা যায় না—‘

বুঝিলাম‌, রমেনবাবু নেত্যকালীর মেক-আপ করিবার অসামান্য ক্ষমতার কথা ভাবিতেছেন। কিন্তু মুস্কিল মিঞার বৌ দিবারাত্ৰ মেক-আপ করিয়া থাকে ইহাই বা কি করিয়া সম্ভব?

ইতিমধ্যে আমরা আর একটি বাড়ির সম্মুখীন হইতেছিলাম। ভোজনালয় যে রাস্তার উপর তাহার পিছনে সমান্তরাল একটি রাস্তা গিয়াছে‌, এই রাস্তার মাঝামাঝি স্থানে একটি কুঠি। ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল,–’এখানে কে থাকে?’

নিশানাথ বলিলেন,–’এখানে থাকেন প্রফেসার নেপাল গুপ্ত আর তাঁর মেয়ে মুকুল।’

ব্যোমকেশ বলিল,–’নেপাল গুপ্ত-নামটা চেনা-চেনা ঠেকছে। বছর তিন-চার আগে এর নাম ‘কাগজে দেখেছি মনে হচ্ছে।’

নিশানাথ বলিলেন,–’অসম্ভব নয়। নেপালবাবু এক কলেজে কেমিস্ট্রির অধ্যাপক ছিলেন। তিনি রাত্রে গিয়ে ল্যাবরেটরিতে কাজ করতেন। একদিন ল্যাবরেটরিতে বিরাট বিস্ফোরণ হল‌, নেপালবাবু গুরুতর আহত হলেন। কর্তৃপক্ষ সন্দেহ করলেন নেপালীবাবু লুকিয়ে লুকিয়ে বোমা তৈরি করছিলেন। চাকরি তো গেলই‌, পুলিসের নজরবন্দী হয়ে রইলেন। যুদ্ধের পর পুলিসের শুভদৃষ্টি থেকে মুক্তি পেলেন বটে। কিন্তু চাকরি আর জুটল না। বিস্ফোরণের ফলে তাঁর চেহারা এবং চরিত্র দুই-ই দাগী হয়ে গিয়েছে।’

‘সত্যিই কি উনি বোমা তৈরি করছিলেন? উনি নিজে কি বলেন?’

নিশানাথ মুখ টিপিয়া হাসিলেন, —’উনি বলেন গাছের সার তৈরি করছিলেন।’

আমরা হাসিয়া উঠিলাম। নিশানাথ বলিয়া চলিলেন,–’এখানে এসেও সার তৈরি করা ছাড়েননি। বাড়িতে ল্যাবরেটরি করেছেন‌, অর্থাৎ গ্যাস-সিলিন্ডার‌, বুনসেন বানার‌, টেস্ট-টিউব‌, রেটর্ট ইত্যাদি যোগাড় করেছেন। একবার খানিকটা সার তৈরি করে আমাকে দিলেন‌, বললেন‌, পেঁপে গাছের গোড়ায় দিলে ইয়া ইয়া পেঁপে। ফলবে। আমার ইচ্ছে ছিল না‌, কিন্তু উনি শুনলেন না—‘

‘শেষ পর্যন্ত কি হল?’

‘পেঁপে গাছগুলি সব মরে গেল।’

 

নেপালবাবুর কুঠিতে প্ৰবেশ করিলাম। বাহিরের ঘরে তক্তপোশের উপর একটি অর্ধ উলঙ্গ বৃদ্ধ থাবা গাড়িয়া বসিয়া আছেন‌, তাঁহার সম্মুখে দাবার ছক। ছকের উপর কয়েকটি ঘুটি সাজানো রহিয়াছে‌, বৃদ্ধ একাগ্র দৃষ্টিতে সেইদিকে চাহিয়া আছেন। সেই যে ইংরেজি খবরের কাগজে দাবা খেলার ধাঁধা বাহির হয়‌, সাদা ঘুটি প্রথমে চাল দিবে এবং তিন চালে মাত করিবে‌, বোধহয় সেই জাতীয় ধাঁধার সমাধান করিতেছেন। আমরা দ্বারের বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইলাম; কিন্তু তিনি জানিতে পারিলেন না।

নিশানাথবাবু আমাদের দিকে চাহিয়া একটু হাসিলেন। বুঝিলাম ইনিই বোমারু অধ্যাপক নেপাল গুপ্ত।

নেপালবাবু বয়সে নিশানাথের সমসাময়িক‌, কিন্তু গুণ্ডার মত চেহারা। গায়ের রঙ তামাটে কালো‌, মুখের একটা পাশ পুড়িয়া ঝামার মত কৰ্কশ ও সচ্ছিদ্র হইয়া গিয়াছে‌, বোধকরি বোমা বিস্ফোরণের চিহ্ন। তাঁহার মুখখানা স্বাভাবিক অবস্থায় হয়তো এতটা ভয়াবহ ছিল না‌, কিন্তু এখন দেখিলে বুক গুরগুর করিয়া ওঠে।

নিশানাথ ডাকিলেন,–’কি হচ্ছে প্রফেসর?’

নেপালবাবু দাবার ছক হইতে চোখ তুলিলেন‌, তখন তাঁহার চোখ দেখিয়া আরও ভয় পাইয়া গেলাম। চোখ দুটো আকারে হাঁসের ডিমের মত এবং মণির চারিপাশে রক্ত যেন জমাট হইয়া আছে। দৃষ্টি বাঘের মত উগ্ৰ।

তিনি হেঁড়ে গলায় বলিলেন,–’নিশানাথ! এস। সঙ্গে কারা?’

দেখিলাম নেপালবাবু আশ্রয়দাতার সঙ্গে সমকক্ষের মত কথা বলেন‌, এমন কি কণ্ঠস্বরে একটু মুরুবিয়ানাও প্রকাশ পায়।

আমরা ঘরে প্রবেশ করিলাম। নেপালবাবু শিষ্টতার নিদর্শন স্বরূপ হাঁটু দু’টির উপর কেবল একটু কাপড় টানিয়া দিলেন। নিশানাথ বলিলেন,–’এঁরা কলকাতা থেকে বাগান দেখতে এসেছেন।’

নেপালবাবুর গলায় অবজ্ঞাসূচক একটি শব্দ হইল‌, তিনি বলিলেন,–’বাগানে দেখবার কি আছে তোমার? আমার সার যদি লাগাতে তাহলে বটে দেখবার মত হত।’

নিশানাথ বলিলেন,–’তোমার সার লাগালে আমার বাগান মরুভূমি হয়ে যেত।’

নেপালবাবু গরম স্বরে বলিলেন,–’দেখ নিশানাথ‌, তুমি যা বোঝা না তা নিয়ে তর্ক কোরো না। সয়েল কেমিষ্ট্রর কী জানো তুমি? পেঁপেগাছগুলো মরে গেল তার কারণ সারের মাত্রা বেশি হয়েছিল–তোমার মালীগুলো সব উলুক।’ বলিয়া একটা আধাপোড়া বিমাচুরুট তক্তপোশ হইতে তুলিয়া লইয়া বজ্র-দন্তে কামড়াইয়া ধরিলেন।

নিশানাথ বলিলেন,–’সে যাক‌, এখন নতুন গবেষণা কি হচ্ছে?’

নেপালবাবু চুরুট ধরাইতে ধরাইতে বলিলেন,–’তামাক নিয়ে experiment আরম্ভ করেছি।’

‘এবার কি মানুষ মারবে?’ নেপালবাবু চোখ পাকাইয়া তাকাইলেন,–’মানুষ মারব! নিশানাথ‌, তোমার বুদ্ধিটা একেবারে সেকেলে‌, জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধার দিয়ে যায় না। বিজ্ঞানের কৌশলে বিষও অমৃত হয়‌, বুঝেছ?’

ঠোঁটের কোণে গোপন হাসি লইয়া নিশানাথ বলিলেন,–’তামাক থেকে যখন অমৃত বেরুবে তখন তোমাকে কিন্তু প্ৰথম চেখে দেখতে হবে।–এখন যাই‌, বেলা বাড়ছে‌, এদের বাকী বাগানটা দেখিয়ে বাড়ি ফিরব। হ্যাঁ‌, ভাল কথা‌, মুকুলের নাকি ভারি মাথা ধরেছে?’

নেপালবাবু উত্তর দিবার পূর্বে ঘনঘন চুরুট টানিয়া ঘরের বাতসা কটু করিয়া তুলিলেন, শেষে বলিলেন,–’মুকুলের মাথা! কি জানি‌, ধরেছে বোধহয়।’ অবহেলাভরে এই তুচ্ছ প্রসঙ্গ শেষ করিয়া বলিলেন,–’অবৈজ্ঞানিক লো-ম্যান হলেও তোমাদের জানা উচিত যে‌, নতুন ওষুধ প্ৰথমে ইত্যর প্রাণীর ওপর পরীক্ষা করে দেখতে হয়‌, যেমন ইঁদুর‌, গিনিপিগ। তাদের ওপর যখন ফল ভাল হয় তখন মানুষের ওপর পরীক্ষা করতে হয়।’

‘কিন্তু মানুষের ওপর ফল যদি মারাত্মক হয়?’

‘এমন মানুষের ওপর পরীক্ষা করতে হয় যারা মরলেও ক্ষতি নেই। অনেক অপদার্থ লোক আছে যারা ম’লেই পৃথিবীর মঙ্গল।’

‘তা আছে।’ অর্থপূর্ণভাবে এই কথা বলিয়া নিশানাথ দ্বারের দিকে চলিলেন। কিন্তু ব্যোমকেশের বোধহয় এত শীঘ্ৰ যাইবার ইচ্ছা ছিল না‌, সে নেপালবাবুকে জিজ্ঞাসা করিল,–’আপনি বুঝি ভাল দাবা খেলেন?’

এতক্ষণে নেপালবাবু ব্যোমকেশকে ভাল করিয়া লক্ষ্য করিলেন‌, ব্যাঘ্রচক্ষে চাহিয়া বলিলেন,–’আপনি জানেন দাবা খেলতে?’

ব্যোমকেশ সবিনয়ে বলিল,–’সামান্য জানি।’

নেপালবাবু ছকের উপর খুঁটি সাজাইতে সাজাইতে বলিলেন,–’আসুন‌, তাহলে এক দান খেলা যাক।’

নিশানাথ বলিলেন,–’আরে না না‌, এখন দাবায় বসলে দুঘন্টাতেও খেলা শেষ হবে না।’

নেপালবাবু বলিলেন,–’দশ মিনিটেও শেষ হয়ে যেতে পারে। —আসুন।’

ব্যোমকেশ আমাদের দিকে একবার চোখের ইশারা করিয়া খেলায় বসিয়া গেল। মুহূৰ্তমধ্যে দু’জনের আর বাহ্যজ্ঞান রহিল না। নিশানাথ খাটো গলায় বলিলেন,–’নেপাল খেলার লোক পায় না‌, আজ একজনকে পাকড়েছে‌, সহজে ছাড়বে না‌,–চলুন‌, আমরাই ঘুরে আসি।’

বাহির হইলাম। আমরা যে-উদ্দেশ্যে ঘুরিয়া বেড়াইতেছি। তাহাতে ব্যোমকেশের উপস্থিতি অত্যাবশ্যক নয়‌, রমেনবাবুর উপস্থিতিই আসল।

বাড়ির বাহিরে আসিয়া পিছন দিকে জানালা খোলার শব্দে আম্রয়া তিনজনেই পিছু ফিরিয়া চাহিলাম। বাড়ির পাশের দিকে একটা জানালা খুলিয়া গিয়াছে এবং একটি উনিশ-কুড়ি বছরের মেয়ে রুক্ষ উৎকণ্ঠগভরা চক্ষে আমাদের দিকে চাহিয়া আছে। আমরা ফিরিতেই সে দ্রুত জানালা বন্ধ করিয়া দিল।

এক নজর দেখিয়া মনে হইল মেয়েটি দেখিতে ভাল; রঙ ফরসা‌, কোঁকড়া চুল‌, মুখের গড়ন একটু কঠিন গোছের। রমেনবাবু স্থাণুর মত দাঁড়াইয়া একদৃষ্টি বন্ধ জানালার দিকে তাকাইয়া ছিলেন‌, বলিলেন,–’ও কে?’

নিশানাথ বলিলেন,–’মুকুল-নেপালবাবুর মেয়ে।’

রমেনবাবু গভীর নিশ্বাস টানিয়া আবার সশব্দে ত্যাগ করিলেন,–’ওকে আগে দেখেছি–সিনেমার স্টুডিওতে দেখেছি—‘

নিশানাথ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিয়া শেষে মৃদুস্বরে বলিলেন,–’কিন্তু ও সুনয়না নয়?’

রমেনবাবু ধীরে ধীরে মাথা নাড়িলেন,–’ন-বোধ হয়—সুনয়না নয়।’

বিকেলের দিকে ইকবাল

বিকেলের দিকে ইকবাল মোটা দড়ি দিয়ে বাঁধা চারপাই-এর ওপর নিজেকে এলিয়ে দিয়ে ঘুমাবার চেষ্টা করলেন। গতরাতে তিনি ট্রেনের একটি তৃতীয় শ্রেণীর কামরায় নিজের মোড়ানো বিছানার ওপর বসে কাটিয়েছেন। কামরাটি ছিল যাত্রীতে ভরা। যখনই তিনি একটু ঘুমাবার চেষ্টা করেছেন তখনই ট্রেনটা হঠাৎ ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেছে। কামরার দরজা জোর করে খুলে যাত্রীভরা কামরায় আরও যাত্রী উঠেছে। সাথে রয়েছে পরিবারের অন্যান্য সদস্য আর বিছানাপত্র। অনেক মহিলা যাত্রীর কোলে শিশুরা ঘুমিয়েছিল। কিন্তু যাত্রীদের ওঠানামা, ঠেলাঠেলি ও চিৎকারে তাদের ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় তারা চিৎকার শুরু করে দেয়।

নিরুপায় মায়েরা সেই ভিড়ের মধ্যেই অবুঝ শিশুর মুখে স্তন দিলে তাদের কান্না থেমে যায়। কিন্তু ক্টেশন ছাড়ার পর বহুক্ষণ ধরে সেই চিৎকারের রেশ থাকে। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে বার বার। কারণ পঞ্চাশ জন যাত্রীর এই কামরায় উঠেছিল। প্রায় দুশ জন যাত্রী। কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে। সাথে তো বিছানাপত্র ছিলই। দরজার পাদানিতে দাঁড়িয়ে ছিল প্রায় ডজন দুই যাত্রী। হ্যান্ডেল ধরে তারা দাঁড়িয়ে ছিল। ছাদের ওপর ছিল বহু লোক। গরম ও বিকট গন্ধ ছিল অসহনীয়। ঝগড়া করার জন্য তাদের মেজাজ যেন তৈরিই ছিল। কয়েক মিনিট পরপরই যাত্রীদের মধ্যে কথা কাটাকাটি এবং উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়। কারণ অতি সামান্য। কেউ হয়ত অন্যের জায়গা সামান্য একটু দখল করে নিয়েছে অথবা টয়লেটে যাওয়ার সময় কারও পায়ে পাড়া লেগেছে। দুজনের কথা কাটাকাটিতে অন্যেরা দুই পক্ষ নিয়ে যোগ দিয়েছে। আবার শেষে অনেকে বিরোধ মিটিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। সব মিলিয়ে একটা অসহনীয় পরিবেশ। এর মধ্যে ইকবাল স্বল্প আলোয় কিছু পড়ার চেষ্টা করছিলেন। বাঘের চারপাশে পতঙ্গ উড়ছিল। তিনি একটা প্যারা পড়া শেষ না করতেই পাশ থেকে একজন বলে উঠলেন:

আপনি পড়ছেন?

হা, আমি পড়ছি।

আপনি কি পড়ছেন?

একটা বই।

এ উত্তরে তিনি সন্তুষ্ট হলেন না। ইকবালের হাত থেকে বইখানা নিয়ে তিনি বইয়ের পাতা উল্টে-পাল্টে দেখলেন।

ইংরেজী?

হ্যাঁ, ইংরেজী।

আপনি নিশ্চয়ই শিক্ষিত লোক।

ইকবাল এ কথার জবাব দিলেন না।

বইখানার হাত বদল হলো। কামরার অনেক যাত্রীই তা পরখ করে দেখলেন। তাদের ধারণা হলো, তিনি শিক্ষিত, ফলে অন্য শ্রেণীর লোক। তিনি বাবু শ্রেণীর লোক।

আপনার নাম কি?

আমার নাম ইকবাল।

স্ত্ৰষ্টা আপনার ইকবাল (সুনাম) বৃদ্ধি করুক।

লোকটা মুসলমান বলে সবাই ধরে নিল। ভাল হলেই ভাল। যাত্রীদের প্রায় সবাই ছিল মুসলমান। তারা যাচ্ছিল পাকিস্তানে।

আপনার বাড়ী কোথায় বাবু সাহেব?

আমার পর্ণকুঠির ঝিলাম জেলায়। ইকবাল বললেন অতি সহজভাবে। তাঁর উত্তরে সবাই নিশ্চিত হলেন যে, লোকটি মুসলমান। কারণ বিলাম জেলা পাকিস্তানে।

ফলে অন্য যাত্রীরাও ইকবালকে নানা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে তুলল। ইকবালকে তাদের বলতে হলো: সে কি করে, তাঁর আয়ের উৎস কি, সমাজে তাঁর মর্যাদা কতটুকু, কোথায় সে লেখাপড়া শিখেছে, সে বিয়ে করেনি কেন, এ যাবত সে কি কি রোগে আক্রান্ত হয়েছে। তারা তাদের পারিবারিক সমস্যা ও অসুখের কথা তুলে ইকবালের পরামর্শ চাইল। যৌন শক্তিহ্রাস পেলে ইংরেজ লোকেরা যা করে এমন কোন ওষুধ বা আয়ুৰ্বেদীয় ওষুধ ইকবাল কি জানে? ইত্যাকার প্রশ্নে জর্জরিত ইকবালকে পড়া বা ঘুমানোর চেষ্টা থেকে বিরত থাকতে হলো। সারা রাত এবং পরদিন সকাল পর্যন্ত তারা এ ধরনের আলোচনা চালিয়ে গেল। ইকবাল এই সফরকে দুঃসহ বলে বর্ণনা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি জানেন ভারতে মানুষের সহোর সীমা কত বিস্তৃত। তাই তিনি সফরের বর্ণনা দেয়াকে অর্থহীন বলে মনে করলেন। মানো মাজরা স্টেশনে তিনি ট্রেন থেকে নেমে পরিতৃপ্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন। তিনি সেবন করলেন নির্মল বায়ু। অপেক্ষা করতে লাগলেন একটা দীর্ঘ নিদ্রার।

কিন্তু ঘুম ইকবালের চোখে এলো না। কামরায় বাতাস চলাচলের কোন ব্যবস্থা ছিল না। ছাতা-পড়া মাটির দুৰ্গন্ধ। কামরার এক কোণায় এক স্তুপ ময়লা পুরাতন কাপড়। হয়ত ধোয়ার জন্য রাখা আছে। তার চারপাশে মাছি ভন্‌ ভিন্ন করছে। ইকবাল তাঁর মুখের ওপর একটা রুমাল ছড়িয়ে দিলেন। তাঁর শ্বাস নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। এমন পরিবেশেও তিনি নিদ্রায় ঢলে পড়লেন। কিন্তু মিত সিং-এর দার্শনিক কথায় তার সে নিদ্ৰা ভেঙ্গে গেল।

নিজ গ্রামের লোকের বাড়িতে ডাকাতি করা আর মায়ের জিনিস চুরি করা একই ব্যাপার। ইকবাল সিংজি এটা হলো কলিযুগ, অন্ধকার যুগ। প্রতিবেশীর বাড়িতে ডাকাতি করার কথা। আপনি কখনও শুনেছেন? এখন দুনিয়ায় নৈতিকতা বলতে আর কিছু নেই।

ইকবাল তাঁর মুখ থেকে রুমালটা সরিয়ে নিলেন।

কি ঘটেছে?

কি ঘটেছে? একই কথার পুনরাবৃত্তি করে মিত সিং বিস্ময়ের ভান করে বললেন, কি হয়নি। তাই বলুন! জুগ্‌গার জন্য পুলিশ এসেছে। জুগ্‌গা হলো দশ নম্বর বদমায়েশা। (পুলিশের খাতায় লিপিবদ্ধ অসৎ লোকদের তালিকার নম্বর মোতাবেক)। কিন্তু জুগ্‌গা পালিয়েছে, ফেরার। কিন্তু জুগ্‌গার ঘরের আঙ্গিনায় লুঠ করা এক জোড়া চুড়ি পাওয়া গেছে। সুতরাং এ কাজ কে করেছে তা আমরা বুঝতে পেরেছি। এবারই প্রথম সে হত্যা করল না। হত্যার নেশা তার রক্তের সাথে মিশে আছে। তার পিতা ও পিতামহ ডাকাত ছিল এবং খুন করার জন্য তাদের ফাঁসি হয়। কিন্তু তারা নিজের গ্রামের কারও বাড়িতে কোনদিন ডাকাতি করেনি। সত্যি কথা বলতে কি, তারা বাড়িতে থাকলে মানো মাজরায় কোন ডাকাত আসতে সাহস করত না। জুগ্‌গাত্‌ সিং তার পরিবারকেই অসম্মান করল।

ইকবাল উঠে বসে দু’হাত দিয়ে চোখ রূপড়াতে লাগলেন। তুরি ইউরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে এমন অনেক কিছুই ধরা পড়ে যা তাঁর দেশীয় ভাইদের কাছে কিছুই নয়। তাদের নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে মাঝে মাঝে হতবাক করে দেয়। পাঞ্জাবীদের নীতিবোধ আরও বেশি বিভ্রান্তিকর। তাদের কাছে সত্য, সম্মান, অর্থনৈতিক সাধুতা—এসবই ভাল। কিন্তু এর মূল্য বন্ধুর কাছে বন্ধুর উপকারী এবং নিজ গ্রামবাসীর চেয়ে কম। বন্ধুর জন্য তুমি আদালতে মিথ্যা বলতে পার বা কাউকে ঠকাতে পোর। এজন্য তোমাকে কেউ দোষ দেবে না। একইভাবে তুমি যদি পুলিশ বা ম্যাজিস্ট্রেটকে অগ্রাহ্য করতে পোর, ধর্মকে অস্বীকার করতে পোর, অথচ বন্ধুর প্রতি অবিচল থাক, তাহলে লোকে তোমাকে বীরের মর্যাদা দেবে। গ্রামীণ সমাজের চিত্ৰ এটাই। এখানে গ্রামের সবাই সবার আস্ত্রীয় কিনা এবং সবাই সবার প্রতি অনুগত কিনা সেটাই বিবেচ্য বিষয়। জুগ্‌গা হত্যা করেছে, এটা কিছু ধর্মগুরু মিত সিং-এর কাছে বড় কিছু নয়। তার কাছে বিবেচ্য বিষয় হলো, জুগ্‌গা নিজ গ্রামের এক লোকের রক্তে নিজের হাত রঞ্জিত করেছে। জুল্পী যদি এমন অপরাধ পাশের গ্রামে করত তাহলে হয়ত মিত সিং তার পক্ষ সমর্থন করে এবং পবিত্র গ্রন্থের নামে শপথ করে বলতেন খুন হওয়ার সময় জুগ্‌গা গুরুদুয়ারায় প্রার্থনারত ছিল! মিত সিং-এর মতো লোকের সাথে কথা বলতে ইকবালের ক্লান্তিবোধ হয়। তারা কিছু বুঝতে পারে না। ইকবাল শেষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, তিনি ঐ ধরনের লোকের সমপর্যায়ের নন।

ইকবাল কোন আগ্রহ দেখাল না বলে মিত সিং হতাশ হলেন।

আপনি দুনিয়া দেখেছেন, অনেক বই পড়েছেন। কিন্তু শুনে রাখুন, সাপ তার খোলস ছাড়লেও বিষ ছাড়তে পারে না। একথা হাজার টাকার চেয়েও দামী।

এই মূল্যবান কথারও গুণগান করল না ইকবাল। মিত সিং ব্যাখ্যা করে বললেন, জুগ্‌গা কিছু দিন বেশ সৎভাবেই দিন কাটাচ্ছিল। সে জমি চাষ করত, গৃহপালিত পশু দেখাশোনা করত। গ্রাম থেকে বাইরে যেত না, সরদারের কাছে প্রতিদিন রিপোর্ট করত। কিন্তু কতদিন একটা সাপ না কামড়িয়ে থাকতে পারে? তার রক্তের সাথে পাপ মিশে আছে।

কারও রক্তে যদি পুণ্য মিশে থাকে তাহলে তার চেয়ে বেশি কারও রক্তে পাপ মিশে থাকে না, কিছুটা উত্তেজিত হয়েই বললেন ইকবাল। অনেক মতবাদের মধ্যে এটাও তাঁর একটা মন্ত্ৰ। কেউ কি কখনও জানার চেষ্টা করেছে মানুষ কেন চুরি, ডাকাতি, হত্যা করে? না। তারা তাদের জেলে ঢোকায় আর না হয় ফাঁসিতে ঝোলায়। এটা খুব সহজ কাজ। ফাঁসি কাষ্ঠ বা জেলের সেল যদি মানুষকে খুন বা চুরি থেকে বিরত রাখতে পারত। তাহলে কোন খুন, বা চুরি হত না। এটা হতে পারে না। এ প্রদেশে তারা প্রতিদিন একজন লোককে ফাঁসিতে ঝোলাচ্ছে। কিন্তু প্রতি চব্বিশ ঘণ্টায় দশ জন লোক খুন হচ্ছে। না, ভাইজি, কেউ পাপী হয়ে জন্মায় না। ক্ষুধা, চাহিদা ও অবিচার তাদেরকে পাপী করে তোলে।

এমন নিরস বক্তব্য দেয়ায় ইকবাল নিজেকে অবিবেচক বলেই মনে করল। আলোচনার সময় এ ধরনের বক্তৃতা দেয়ার অভ্যাস তাঁর পরিত্যাগ করাই বাঞ্ছনীয়। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তিনি আগ্রহ প্রকাশ করলেন।

জুগ্‌গা যেহেতু সবার অতি পরিচিত, সেহেতু আমার মনে হয়, তারা সহজেই তাকে ধরতে পারবে।

জুগ্‌গা বেশি দূর যেতে পারবে না। এলাকার সবাই তাকে চেনে। সাধারণ লোকের চেয়ে সে বেশ লম্বা। ডেপুটি সাহেব সবস্থিানায় নির্দেশ পাঠিয়েছেন জুগ্‌গার ওপর কড়া নজর রাখতে।

ডেপুটি সাহেব কে? ইকবাল জিজ্ঞাসা করলেন।

আপনি ডেপুটি সাহেবকে চেনেন না? মিত সিং বিস্ময় প্রকাশ করলেন। তাঁর নাম হুকুম চাঁদ। তিনি এখন আছেন পুলের উত্তর পাশে ডাকবাংলোয়। এখন হুকুম চাঁদই সত্যিকারের বীর। তিনি ছিলেন একজন কনস্টেবল। আর এখন তিনি কোথায়! তিনি সব সময় সাহেবদের খুশি রাখেন এবং তারা তাঁকে একটার পর একটা পদোন্নতি দেন। শেষের জন্য তাঁকে ডেপুটি করে দেন। সত্যি ইকবাল সিংজি, হুকুম চাঁদ একজন বীর এবং তিনি চালোকও বটে। তিনি বন্ধুদের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং তাদের সব কাজ তিনি করিয়ে দেন। তিনি তাঁর বহু আত্মীয়স্বজনকে ভাল চাকরি জুটিয়ে দিয়েছেন। তাঁর মতো লোক এক শ জনে একজন পাওয়া ভার।

তিনি কি আপনার বন্ধু?

বন্ধু? না, না। প্রতিবাদের সুরে বললেন মিত সিং। আমি এই গুরুদুয়ারার একজন সাধারণ ভাই। আর তিনি একজন সম্রাট। তিনি সরকার আর আমরা তাঁর প্ৰজা। তিনি মানো মাজরায় আসলে আপনি তাঁকে দেখতে পাবেন।

আলোচনায় কিছুটা বিরতি ঘটল। ইকবাল তাঁর স্যান্ডেলে পাঢুকিয়ে দাঁড়ালেন। আমার কিছুটা হাঁটা দরকার। কোন দিকে যাওয়া ঠিক বলে আপনি মনে করেন?

আপনার যেদিকে ইচ্ছা সেদিকে যান। সব দিকই উন্মুক্ত। নদীর ধারে যান। দেখবেন ট্রেন আসছে আর যাচ্ছে। রেল রাস্তা পার হয়ে গেলে আপনি ডাকবাংলো দেখতে পাবেন। কিন্তু দেরি করবেন না। এখন সময় ভাল নয়। সন্ধ্যার আগে ঘরে ফেরাই ভাল। তাছাড়া আমি মসজিদের ইমাম বখশ ও সরদারকে বলেছি আপনার কথা। তারা আপনার সাথে দেখা করার জন্য আসতে পারে।

না, আমার দেরি হবে না।

 

 

 

 

 

গুরুদুয়ারা থেকে বেরিয়ে পড়লেন ইকবাল। এ সময় কারও কোন কর্মব্যস্ততা তার নজরে পড়ল না। বাহ্যত পুলিশ তদন্ত কাজ শেষ করেছে।

পিপুল গাছের নিচে ছয়জন কনস্টেবল খাটিয়ার ওপর অলসভাবে শুয়ে-বসে আছে। রামলালের ঘরের দরজা খোলা। ঐ ঘরের আঙ্গিনায় কিছু গ্রামবাসী তখনও বসে ছিল। একজন মহিলা কাঁদছিলেন। হৃদয়ফাটা চিৎকার। তাঁর সাথে কান্নায় যোগ দিলেন আরও কয়েকজন মহিলা। বাইরে বেশ গরম। বাতাস নেই। সূর্যের প্রখর রশ্মি ঘরের মাটির দেয়ালে এসে যেন আছড়ে পড়ছিল।

ইকবাল গুরুদুয়ারার মাটির দেয়ালের ওপর দেয়া চালের নিচ দিয়ে হাঁটছিলেন। পথটিতে মলমূত্রের ছাপ স্পষ্টভাবে বিদ্যমান। পুরুষ লোকেরা এ পথটিকে তাদের প্রস্রাবের স্থান হিসাবে ব্যবহার করে। একটা মেয়ে কুকুর পাশ ফিরে শুয়েছিল। তার আটটি ছোট বাচ্চা উী:উ: শব্দে দুধ খাচ্ছিল।

গলি পথটি হঠাৎ শেষ হয়ে গেল গ্রামের প্রান্তসীমায় এসে। সামনেই একটা ছোট পুকুর, পানি কম, কাদা বেশি। ঐ পুকুরে দেখা গেল কাদা পানির মধ্যে মহিষ শুয়ে আছে। শুধু মুখটা পানির ওপরে।

ছোট পুকুরটার পাশ দিয়ে একটা পায়ে হাঁটা পথ। গম খেতের মধ্য দিয়ে ঐ পথটা মিশে গেছে নদীর কিনারায়। পায়ে হাঁটা পথের পাশ দিয়ে আছে একটা দীর্ঘ নালা, সেটাও শেষ হয়েছে নদীর কিনারায়। ঐ নালায় এখন পানি নেই, শুকনো। নালার পাশ দিয়ে ইকবাল সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। পা ফেললেন অতি সাবধানে। পথের শেষ প্রান্তে অর্থাৎ নদীর তীরে এসেই তিনি দেখলেন লাহোর থেকে আসা এক্সপ্রেস ট্রেনটি ব্রিজ পার হচ্ছে। ইস্পাতের তৈরি ব্রিজ কিভাবে ট্রেনটি অতিক্রম করছে তা তিনি আপলক নেত্ৰে তাকিয়ে দেখলেন। অন্যান্য ট্রেনের মতো এ ট্রেনটিতেও ছিল যাত্রী ঠাসা। ট্রেনের ছাদে, পদানিতে, দরজা ও জানালায়সবখানে মানুষ। দরজা ও জানালায় দেখা গেল মানুষের মাথা ও হাত। দুই বগির মধ্যে যে জায়গা আছে, সেখানেও যাত্রী দেখা গেল। শেষ বগির পিছনেও দুজন লোককে বসে পা নাড়তে দেখা গেল। ব্রিজ পার হওয়ার পর ট্রেনের গতি বেড়ে গেল। গাড়ি চালক হুইসেল বাজাতে শুরু করল। মানো মাজরা স্ট্রেশন অতিক্রম না করা পর্যন্ত হুইসেল বাজানোর বিরতি ঘটল না। তারা পাকিস্তান থেকে ভারতের সীমানায় এসে পৌঁছেছে। এই স্বস্তির, এই নিশ্চিন্ততার প্রকাশ ঘটল যেন হুইসেল বাজানোর মধ্যে দিয়ে।

ইকবাল নদীতীর দিয়ে এগিয়ে গেলেন ব্রীজের দিকে। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, তিনি ব্রিজের নীচে দিয়ে ডাকবাংলোর দিকে যাবেন। কিন্তু তিনি দেখলেন, ব্রিজের এক প্রান্ত থেকে একজন শিখ সৈন্য তাঁকে নিরীক্ষণ করছে। ইকবাল তাঁর মত পরিবর্তন করে সোজা রেল রাস্তার ওপরে গিয়ে উঠলেন এবং অতঃপর মানো মাজরা স্টেশনের দিকে তার গতিপথ পরিবর্তন করলেন। এতে প্রহরীর সন্দেহ প্রশমিত হলো। ইকবাল কিছুদূর এগিয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে রেল রাস্তার ওপর বসে পড়লেন।

এক্সপ্রেস ট্রেনটি চলে যাওয়ার পর মানো মাজরা যেন বিলম্বিত দিবা নিদ্রা থেকে জেগে উঠল। ছেলেরা পুকুরে বিশ্রামরত মহিষকে লক্ষ্য করে ঢ়িল নিক্ষেপ করে। তাদের বাড়ির পথে নিয়ে গেল। দল বেঁধে মেয়েরা মাঠে গিয়ে জঙ্গলের আড়ালে ছড়িয়ে পড়ল। যে গরুর গাড়িতে রামলালের মৃতদেহ তোলা হয়েছিল, তা গ্রাম ছেড়ে ক্টেশনের পথ ধরল। গরুর গাড়িকে পাহারা দিচ্ছিল পুলিশ। গ্রামের অনেকে ঐ গাড়ির সাথে সাথে অনেকটা পথ এগিয়ে গিয়ে আবার গ্রামে ফিরে এলো।

ইকবাল দাঁড়িয়ে চারদিকে দেখলেন। তিনি রেল স্টেশনের দিকে তাকিয়ে ডাকবাংলো দেখলেন। দেখলেন, বাংলোটি যেন দাঁড়িয়ে আছে পাতাহীন কুল গাছের অদূরে। একই স্থানে দাঁড়িয়ে তিনি ব্রিজ এবং গ্রাম দেখলেন। ফের দেখলেন স্টেশন। সব এলাকাতেই তার চোখে পড়ল। পুরুষ, মেয়ে, শিশু, গরু-ছাগল ও কুকুরের ভিড়। আকাশে দেখা গেল উড়ন্তীয়মান ঘুড়ি। কাকের দল উড়ে চলেছে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। হাজার হাজার চড়ুই পাখি গাছে বসে এদিক-ওদিক দুটাছুটি করছে। ভারতে এমন কোন স্থান নেই যেখানে জীবনস্পন্দন নেই। ইকবাল প্রথম যেদিন বোম্বাই যান, সেদিনকার স্মৃতি তাঁর মনে পড়ল। রাস্তায়, রাস্তার ধারে, রেলওয়ে প্লাটফর্মে হাজার হাজার মানুষের ভিড়, এমন কি রাতেও ফুটপাতগুলো মানুষের ভিড়ে পূর্ণ। সমস্ত দেশটাই যেন মানুষে ভরা একটা কামরার মতো। প্রতি মিনিটে ছজন করে মানুষ বাড়ছে, প্রতি বছরে বাড়ছে ৫০লাখ। সুতরাং কি আশা করা যায়। শিল্প বা কৃষি খাতে সব পরিকল্পনা তাই নিস্ফল হচ্ছে। এই পরিমাণ অর্থ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে ব্যয় করা হচ্ছে না কেন? কিন্তু কামসূত্রের এই দেশে, লিঙ্গ পূজা ও পুত্রের প্রতি ভক্তির এই দেশে তা কি সম্ভব?

ইকবাল যেন দিবাস্বপ্ন দেখছিলেন। রেল লাইনের সমান্তরালভাবে বিছানো ইস্পাতের তারের ঝন ঝন্য শব্দে তাঁর যেন স্বপ্ন ভঙ্গ হলো। ব্রিজের কাছে প্রহরী কক্ষের ওপরে সিগন্যাল ডাউন হলো। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে কাপড়ের ধুলো বাড়লেন। ইতোমধ্যে সূর্য ডুবে গেছে। পাটল বর্ণ আকাশ ধূসর রং ধারণ করেছে। রং ধনুর রং প্রতিভাত হয়েছে আকাশে। সন্ধ্যাতারার পিছনে নতুন চাঁদ স্পষ্ট হয়ে দেখা যাচ্ছে। একটা ট্রেন আসার শব্দ পাওয়া গেল। কিন্তু সেই শব্দকে ছাপিয়ে শোনা গোল মুয়াজ্জিনের আজানের ধ্বনি।

ইকবাল অতি সহজে ফিরে আসার পথ খুঁজে পেলেন। পিপুল গাছকে কেন্দ্র করে তিনটি গলিপথ গ্রামে ঢুকেছে। একটা পথ মসজিদ, অন্যটি গুরুদুয়ারা এবং অপরটি গেছে মহাজনের বাড়ির দিকে। রামলালের বাড়ি থেকে তখনও বুকফাটা কান্না শোনা যাচ্ছিল। মসজিদে বারো-তেরো জন লোক দুই লাইনে দাঁড়িয়ে নীরবে নামাজ পড়ছিল। গুরুদুয়ারায় মিত সিং বসেছিলেন একটা ছোট টেবিলের ওপর মসলিন কাপড়ে জড়ানো গ্রন্থের পাশে। তিনি সন্ধ্যার প্রার্থনা করছিলেন। পাঁচ-ছয় জন পুরুষ ও মহিলা অর্ধবৃত্তাকারে বসে তাঁর কথা শুনছিল। তাঁদের মাঝে ছিল একটি জুলানো হারিকেন।

ইকবাল সরাসরি তার কামরায় গিয়ে অন্ধকারের মধ্যে খাটিয়ার ওপর শুয়ে পড়লেন। তিনি চোখ বন্ধ করার আগেই প্রার্থনাকারীরা সমবেতভাবে মন্ত্র পাঠ শুরু করল। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ চলার পর তারা থামল, যেন পুনরায় শুরু করার জন্য। অনুষ্ঠান শেষ হলো সৎ শ্ৰী আকাল বলে এবং ড্রাম পিটিয়ে। পুরুষ ও মহিলারা বেরিয়ে এলো। মিত সিং হারিকেন হাতে করে তাদের জুতো খুঁজতে সাহায্য করলেন। তারা বেশ জোরেই কথা বলছিল। ঐ গোলমালের মধ্যে ইকবাল একটা কথা বুঝতে পারলেন। ঐ কথাটি হলো বাবু। কেউ একজন ইকবালকে দেখে অন্যদের সে কথা বলেছিল। পরে কানে কানে ফিস ফিস কথা হলো, পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল এবং অতঃপর নীরবতা।

ইকবাল চোখ বুজে ঘুমাবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু মিনিটখানেক পরেই মিত সিং লণ্ঠন হাতে কামরার কাছে এলেন।

ইকবাল সিংজি। কিছু না খেয়েই শুয়ে পড়লেন? কিছু সবজি খাবেন? আমার কাছে দই, ঘোল আছে।

ধন্যবাদ ভাইজি। আমার কাছে খাবার আছে।

আমাদের কাছে যা আছে তা গরিব মানুষের খাবার…, মিত সিং বলতে শুরু করলেন। কিন্তু তাঁর কথায় বাধা দিয়ে ইকবাল বললেন, না না, আসল কথা তা নয়। তিনি উঠে বসলেন। বললেন, আসল কথা হলো, আমার কাছে খাবার আছে। এগুলো যদি না খাই তাহলে তা নষ্ট হয়ে যাবে। আমি কিছুটা ক্লান্ত। আমি ঘুমাতে চাই।

তাহলে কিছুটা দুধ খান। সরদার বানতা সিং আপনার জন্য দুধ আনতে গেছেন। আপনি আগেভাগে ঘুমাতে চাচ্ছেন, তাঁকে তাড়াতাড়ি দুধ আনার কথা বলি। ছাদে আমি আপনার জন্য আরও একটা খাটিয়া রেখে দিয়েছি। এত গরমে ঘরের মধ্যে ঘুমানো খুব কষ্ট। মিত সিং ঘরের মধ্যে হারিকোনটা রেখে অন্ধকারের মধ্যে বেরিয়ে গেলেন।

সরদারের সাথে কথা বলার সম্ভাবনা খুব সুখপ্রদ ছিল না। ইকবাল তাঁর বালিশের তলা থেকে ফ্লাক্সটা নিয়ে তার মুখ খুলে এক পেগী হুইস্কি ঢেলে নিলেন। কাগজের প্যাকেট কয়েকটা শুকনো বিস্কুট ছিল। তিনি তাই খেলেন। এরপর তিনি গদি ও বালিশ নিয়ে ছাদে গেলেন। সেখানে তার জন্য একটা খাটিয়া ছিল। গুরুদুয়ারার আঙ্গিনায় মিত সিং শুয়েছিলেন। বাহাত তিনি ঘুমিয়ে আছেন বলেই মনে হলো। কিন্তু তিনি ঘুমান নি। তিনি গুরুদুয়ারা পাহারা দিচ্ছিলেন।

ইকবাল খাটিয়ার ওপর শুয়ে আকাশের তারা দেখছিলেন অস্বচ্ছ আলোয়। তিনি কিছু লোকের কথাবার্তা শুনতে পেলেন। তাঁরা সব গুরুদুয়ারায় প্রবেশ করে সিড়ি দিয়ে ওপরে উঠছিলেন। তাদের স্বাগত জানাতে তিনি উঠে দাঁড়ালেন।

শুভ রাত, বাবু সাহেব।

আপনাদের প্রতি সালাম, বাবু সাহেব।

তাঁরা করমর্দন করলেন। মিত সিং তাদের সাথে ইকবালের পরিচয় করার প্রয়োজন অনুভব করলেন না। অতিথিদের বসার জায়গা করে দেয়ার জন্য ইকবাল খাটিয়ার গদি এক পাশে সরিয়ে দিলেন। তিনি নিজে মেঝের ওপর বসলেন।

আগে আপনার সাথে দেখা করিনি, এজন্য আমি লজ্জিত, একজন শিখ বললেন। আমাকে দয়া করে মাফ করে দিন। আমি আপনার জন্য কিছু দুধ এনেছি।

সত্যি সাহেব, আমরা খুবই লজ্জিত। আপনি আমাদের অতিথি আর আমরা আপনার কোন সেবাই করলাম না। ঠাণ্ডা হওয়ার আগে দুধ টুকু খেয়ে নিন, অন্য একজন আগভুক বললেন। লোকটা লম্বা, পাতলা এবং মুখে ছোট ছোট দাড়ি।

সত্যি আপনারা দয়ালু… আমি জানি আপনারা পুলিশ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন… আমি দুধ খাই না। সত্যি আমি দুধ খাই না। আমরা শহরবাসীরা …।

সরদার সাহেব ইকবালের ভদ্রজন্যোচিত আপত্তি প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি তার পিতলের মগের ওপর থেকে একটা ময়লা কাপড় সরিয়ে নিয়ে আঙ্গুল দিয়ে দুধ নাড়াতে লাগলেন। একেবারে টাটকা দুধ। ঘন্টটা খানেক আগে আমি মহিষের দুধ দুয়েছি। স্ত্রীকে বলেছি দুধ গরম করে দিতে। কারণ আমি জানি, শিক্ষিত লোকেরা গরম দুধ খায়। এর মধ্যে বেশ চিনি আছে। সব নিচে পড়ে আছে, কথাগুলো বলে তিনি দুধে আর একবার নাড়া দিয়ে দিলেন। দুধের খাঁটিত্ব প্রমাণ করার লক্ষ্যে তিনি দুধের ওপর পড়া জমাট সর আঙ্গুলো করে তুলে আবার দুধের সাথে মিশিয়ে দিলেন।

এই যে ভাইজি, ঠাণ্ডা হওয়ার আগেই খেয়ে নিন।

না না, ধন্যবাদ। ইকবাল আপত্তি জানালেন। তিনি বুঝতে পালেন না, আগডুকদের মনে আঘাত না দিয়ে তিনি কিভাবে না বলবেন। আমি কোনদিন দুধ খাইনি। কিন্তু আপনারা যদি অনুরোধ করেন তাহলে পরে খাব। আমি ঠাণ্ড দুধই পছন্দ করি।

আপনার পছন্দ অনুযায়ী খান ভাইজি, একজন মুসলমান আগন্তুক এ কথা বলে তাঁকে বাঁচালেন। বানতা সিং, এখানেই মগটা রেখে যাও। ভাই মিত সিং কাল সকালে নিয়ে যাবে।

সরদার সাহেব কাপড় দিয়ে মগটার মুখ ঢেকে দিয়ে তা ইকবালের খাটিয়ার নিচে রাখলেন। সবাই কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। সরসহ মগের দুধ নৰ্দমায় ফেলে দেয়ার সুযোগ ইকবালের হলো। এ কথা ভাবতেও ইকবালের ভাল লাগল।

ঠিক আছে বাবুজি, মুসলমান লোকটি শুরু করলেন। আমাদের কিছু বলুন। বিশ্বে কি ঘটছে? পাকিস্তান ও হিন্দুস্থান নিয়েই বা কি হচ্ছে?

আমরা ছোট এই গ্রামে বাস করি, সরদার সাহেব বললেন। বাবুজি, ইংরেজরা কেন চলে গেল আমাদের বলুন।

এ ধরনের ছোট প্রশ্নের উত্তর কিভাবে দিতে হয় ইকবালের তা জানা ছিল না। এসব লোকের কাছে স্বাধীনতা হয়। অন্ধ কিছু আর না হয় কিছুই না। তারা একথা বুঝতেও পারে না যে, এটা তাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা যা সত্যিকার অর্থনৈতিক স্বাধীনতার প্রথম ধাপ।

তারা চলে গেছে, কারণ তাদের চলে যেতে হয়েছে। আমাদের হাজার হাজার ছেলেরা যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। এখন তাদের কাছে অস্ত্ৰও আছে। আপনার কি ভারতীয় নাবিকদের বিদ্রোহের কথা শোনেন নি? এই সৈন্যরা একই কাজ করত। ইংরেজরা এতে ভয় পেয়ে গেল। জাপানীরা যে ভারতীয় জাতীয় সৈন্য বাহিনী গড়ে তোলে তাতে যেসব ভারতীয় যোগ দেয় তাদের একজনকেও ইংরেজরা গুলি করেনি। কারণ তারা চিন্তা করেছিল যে, এর ফলে সমগ্ৰ দেশ তাদের বিরুদ্ধে চলে যাবে।

ইকবালের এই গবেষণাসমৃদ্ধ বক্তব্য কারও বিশেষ ভাল লাগল না।

বাবুজি, আপনি যা বললেন তা হয়ত ঠিক, সরদার সাহেব বললেন। গত বিশ্বযুদ্ধে আমি ছিলাম। মেসোপটেমিয়া ও গ্যালিপোলিতে আমি যুদ্ধ করেছি। ইংরেজ অফিসারদের আমরা পছন্দ করতাম। তারা ভারতীয়দের চেয়ে ভাল।

হ্যাঁ, মিত সিং এ কথার সাথে যোগ করলেন, আমার হাবিলদার ভাই বলে যে, সব সেপাই ভারতীয়দের চেয়ে ইংরেজ অফিসারদের কাছে সুখী ছিল। আমার ভাইয়ের যিনি কর্নেল ছিলেন তাঁর স্ত্রী এখনও লন্ডন থেকে আমার ভাতিজির জন্য উপঢৌকন পাঠায়। আপনি তো জানেন সরদার সাহেব, তার বিয়েতে মেমসাহেব টাকাও পাঠিয়েছিল। ভারতীয় অফিসারদের স্ত্রীরা এমন কিছু করে?

ইকবাল কিছুটা আক্রমণাত্মক ভূমিকা নেয়ার চেষ্টা করলেন।

কেন, আপনারা কি স্বাধীন হতে চান না? সারা জীবন ধরে আপনারা কি অন্যের দাস হিসাবে থাকতে চান?

কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর সরদার সাহেব বললেন, স্বাধীনতা নিশ্চয়ই একটা ভাল জিনিস। কিন্তু এর থেকে আমরা কি পাচ্ছি? আপনাদের মতো যারা শিক্ষিত লোক অর্থাৎ বাবু সাহেব তারা চাকরি পাবেন, যা আগে ইংরেজরা করত। কিন্তু আমরা, আমরা কি বেশি জমি বা বেশি মহিষ পাব?

না, মুসলমান লোকটি বললেন, যারা যুদ্ধ করেছে স্বাধীনতা সেই সব শিক্ষিত লোকের জন্য। আগে আমরা ইংরেজদের দাস ছিলাম, এখন আমরা শিক্ষিত পাকিস্তানী বা ভারতীয়দের দাস হবো।

ইকবাল এই ব্যাখ্যায় বিস্মিত হলেন।

আপনারা যা বললেন তা সম্পূর্ণ ঠিক, তিনি তাদের বক্তব্য সাদরে গ্রহণ করে নিলেন। আপনারা যদি স্বাধীনতাকে আপনাদের জন্য সত্যিকারের অর্থবহ করতে চান তাহলে কৃষক ও শ্রমিকশ্রেণীকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করতে হবে। বেনিয়া কংগ্রেস সরকারকে হটাতে হবে। রাজপুরুষ ও জমিদারদের হাত থেকে মুক্ত হতে হবে। তবেই আপনাদের কাছে স্বাধীনতা হবে আপনাদের পছন্দমতো। অনেক জমি, অনেক মহিষ এবং থাকবে না কোন ঋণ।

এ ধরনের কথাই একটা লোক আমাদের বলেছিল, মিত সিং কথার মাঝে বললেন, ঐ লোকটা …কি যেন তার নাম সরদার সাহেব?

কমরেড কি যেন! আপনি কি কমরেড বাবু সাহেব?

না।

খুশি হলাম। কারণ ঐ কমরেড আল্লাহয় বিশ্বাস করেন না। তিনি বলেছিলেন, তাঁর দল ক্ষমতায় এলে তুরুণ তারুণ মন্দিরের চারপাশের পবিত্র পানির নালা কেটে জমিত্রে সেচের ব্যবস্থা করবে এবং তাতে ধান ফলাবে। এতে অনেক উপকার হবে। বলে তিনি বলেন।

এ ধরনের কথা অসার, ইকবাল প্রতিবাদ জানালেন। তিনি মিত সিংকে ঐ কমরেডের নাম স্মরণ করতে বললেন। এ ধরনের লোক সম্পর্কে হেড কোয়ার্টার্সে জানানো দরকার এবং তার যথাযথ শাস্তি হওয়া উচিত বলে ইকবাল জানালেন।

আল্লাহয় যদি আমাদের বিশ্বাস না থাকে তাহলে আমরা তো পশুর মতো, বেশ গভীরভাবে বললেন মুসলমান লোকটি। বিশ্বের সব লোকই ধাৰ্মিক লোককে শ্ৰদ্ধা করে। গান্ধীকে দেখুন। আমি শুনেছি যে, তিনি বেদ ও শাস্ত্রের সাথে সাথে কোরআন শরীফ ও ইনজিল পাঠ করেন। তামাম দুনিয়ার লোকে তাঁর প্রশংসা করে। আমি পত্রিকায় গান্ধীর একটা ছবি দেখেছিলাম, তিনি প্রার্থনা করছেন। ঐ ছবিতে দেখেছিলাম, অনেক সাদা চামড়ার পুরুষ ও মহিলা পা মুড়ে বসেছিল। একজন বিদেশী মহিলার চোখ ছিল বন্ধ। অনেকে বলে, তিনি ছিলেন একজন সন্ত্ৰান্ত লর্ড-এর কন্যা। দেখ ভাই মিত সিং, ইংরেজরাও ধাৰ্মিক লোককে সম্মান দেয়।

নিশ্চয় চাচা। তুমি যা বলেছি তার ষোল আনাই ঠিক, মিত সিং তাঁর পেটে হাত বুলাতে বুলাতে ঐ কথায় সমর্থন জানালেন।

ইকবালের বেশ রাগ হলো। তারা প্রতারকের জাত, ইকবাল বেশ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন। তারা যা বলে তা বিশ্বাস করবেন না।

তিনি বুঝলেন, হিংসার মাত্রা তাঁর ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু সম্ভ্রান্ত লর্ড-এর কন্যা সংবাদপত্রে ছবি প্রকাশের জন্য পা মুড়ে চোখ বন্ধ করে আছেন, আর সেই সন্ত্রান্ত লর্ড যিনি দেখতে সুন্দর ও রাজার হিন্দুস্তানী ভাই, তিনি ভারতকে ভালবাসেন মিশনারীদের মতো—এসব কথা ইকবালের মোটেই ভাল লাগে না।

আমি ওদের দেশে অনেক বছর ছিলাম। মানুষ হিসাবে ওরা ভাল। কিন্তু রাজনীতিতে ওরা বিশ্বের সেরা ঠগবাজ। ওরা সৎ হলে তামাম দুনিয়ায় সাম্রাজ্য বিস্তার করতে পারত না। এ কথা অবশ্য এখানে অপ্রাসঙ্গিক, ইকবাল বললেন, এখন কি ঘটতে যাচ্ছে তাই বলুন।

আমরা জানি কোথায় কি হচ্ছে, সরদার সাহেব বেশ রাগত স্বরেই বললেন। সারা দেশে ধ্বংসের বাতাস বইছে। আমরা যা শুনছি তা শুধু হত্যা আর হত্যা। স্বাধীনতা ভোগ করছে। কেবল চোর, ডাকাত ও হত্যাকারীরা। অতঃপর তিনি শান্তভাবে বললেন, আমরা ব্রিটিশদের অধীনে বেশ ভালই ছিলাম। অন্ততপক্ষে সে সময় নিরাপত্তা ছিল।

কিছুটা অস্বস্তিকর নীরবতা। ট্রেন লাইনের ওপর দাঁড়ানো মালগাড়ির বগি। পুনর্বিন্যাস করতে ইঞ্জিনের শব্দ শোনা গেল। মুসলমান লোকটি আলোচনার বিষয় পরিবর্তন করলেন।

মাল গাড়ি। আজ নিশ্চয়ই দেরিতে পৌঁছেছে। বাবু সাহেব, আপনি ক্লান্ত। আপনার আরাম করার সুযোগ দেয়া আমাদের উচিত। আমাদের দরকার হলে বলবেন, আমরা সব সময় আপনার সেবার জন্য রয়েছি।

তারা সবাই উঠে পড়লেন। ইকবাল তাদের সাথে করমর্দন করলেন। তাঁর ব্যবহারে রাগের কোন বহিঃপ্রকাশ দেখা গেল না। সরদার সাহেব ও মুসলমান লোকটিকে মিত সিং আঙ্গিনা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। তারপর তিনি সেখানেই রাখা চারপাই-এ শুয়ে পড়লেন।

ইকবাল আবার শুয়ে আকাশের তারা দেখতে লাগলেন। শান্ত রজনীতে ইঞ্জিনের আর্ত চিৎকারে তাঁর মনে হলো তিনি বড় একা এবং হতাশাগ্ৰস্ত। ভারতের মতো বিশাল দেশে এবং অগণিত মানুষের মাঝে তাঁর মতো ক্ষুদ্র এক ব্যক্তি কতটুকুই বা করতে পারেন? তিনি কি হত্যা বন্ধ করতে পারবেন? হিন্দু, মুসলমান, শিখ, কংগ্রেস কর্মী, লীগ কামী, আকালী বা কমিউনিস্ট দল-সবাই এ কাজে জড়িত। বুর্জেীয়া বিপ্লব প্রোলেতারিয়েত বিপ্লবে রূপান্তরিত হবে এমন কথা বলা আত্মতুষ্টিরই নামান্তর। ঐ অবস্থা এখন আসেনি। হিন্দুস্তান বা পাকিস্তানের সাধারণ লোক এখনও রাজনৈতিক স্বাধীনতার ব্যাপারে উদাসীন। ভিন্নধৰ্মী লোককে খুন করে তার জমি আত্মসাৎ করাকে তারা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা মনে করে। সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে খুন করে সম্পত্তি আহরণের প্রবণতাকে দূর করে ধনিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে ঐ সংগ্রাম পরিচালনা করা যেতে পারে। এটাই সাধারণ শ্রেণীর লোকের সংগ্রামের সহজ পথ। তাঁর দলীয় নেতারা এ কথাটা বুঝতে পারেন না।

দলীয় নেতারা মানো মাজরায় অন্য কাউকে পাঠাক, ইকবাল সেটাই চেয়েছিলেন। নীতি নির্ধারণ এবং মানুষের মন থেকে বাজে চিন্তা দূর করার কাজে তিনি কিছু কাজ করতে পারতেন। তাঁর যোগ্যতার অভাব আছে, তিনি সংকল্পবদ্ধও নন। তিনি কোনদিন জেলে যাননি। প্রয়োজনীয় ‘উৎসর্গের’ কোনটিই তিনি করেননি। ফলে কেউ তাঁর কথা শোনেনি। কোন কারণে বন্দিত্ব গ্রহণের পর তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু করা উচিত ছিল। এখনও অবশ্য সময় আছে। দিল্লী ফিরে যাওয়ার পর প্রথম সুযোগেই তিনি সে কাজ করবেন। ততদিনে হত্যাযজ্ঞ শেষ হয়ে যাবে এবং তখন তার জন্য তা নিরাপদও হবে।

মাল ট্রেন স্টেশন ছেড়ে দিয়েছে। ব্রিজের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় গুড় গুড় শব্দ শোনা গেল। জেলখানায় এক শান্তিময় জীবনের স্বপ্ন দেখতে দেখতে ইকবাল ঘুমিয়ে পড়লেন।

 উত্তরখণ্ড – কার্তিক মাসের সকালবেলা

একদিন কার্তিক মাসের সকালবেলা ব্যোমকেশ ও আমি আমাদের হ্যারিসন রোডের বাসায় ডিম্ব সহযোগে চা-পান শেষ করিয়া খবরের কাগজ লইয়া বসিয়াছিলাম। সত্যবতী বাড়ির ভিতর গৃহকর্মে নিযুক্ত ছিল। পুঁটিরাম বাজারে গিয়াছিল।

ব্যোমকেশের বিবাহের পর আমি অন্য বাসা লইবার প্রস্তাব করিয়াছিলাম; কারণ নবদম্পতির জীবন নির্বিঘ্ন করা বন্ধুর কাজ। কিন্তু ব্যোমকেশ ও সত্যবতী আমাকে যাইতে দেয় নাই। সেই অবধি এই চার বছর আমরা একসঙ্গে বাস করিতেছি। ব্যোমকেশকে পাইয়া আমার ভ্রাতার অভাব দূর হইয়াছিল; সত্যবতীকে পাইয়াছি একাধারে ভগিনী ও ভ্রাতৃবধূরূপে। উপরন্তু সম্প্রতি ভ্রাতুষ্পপুত্র লাভের সম্ভাবনা আসন্ন হইয়াছে। আশাতীত সুখ ও শান্তির মধ্যে জীবনের দিনগুলা কাটিয়া যাইতেছে।

ভাগ করিয়া খবরের কাগজ পাঠ চলিতেছিল। সামনের পাতা আমি লইয়াছিলাম‌, ব্যোমকেশ। লইয়াছিল ভিতরের পাতা। সংবাদপত্রের সদরে মোটা অক্ষরে যেসব খবর ছাপা হয়‌, তাহার প্রতি ব্যোমকেশের আসক্তি নাই‌, সদরের চেয়ে অলিগলিতেই তাহার মনের যাতায়াত বেশি।

হঠাৎ কাগজ হইতে মুখ তুলিয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ঈশানচন্দ্র মজুমদারের নাম জানো?’

চিন্তা করিয়া বলিলাম‌, ‘নামটা চেনা-চেনা মনে হচ্ছে। কে তিনি?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন। বহরমপুরে আমি কিছুদিন তাঁর ছাত্র। ছিলাম। ভদ্রলোক মারা গেছেন।’

বলিলাম‌, ‘তা তুমি যখন তাঁর ছাত্র‌, তখন তাঁর মরবার বয়স হয়েছিল বলতে হবে।’

‘তা হয়তো হয়েছিল। কিন্তু তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। সর্পঘাতে মারা গেছেন।’

‘ও।’

‘গত বছর আমরা যেখানে স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করতে গিয়েছিলাম, তিনি এবছর সেখানে গিয়েছিলেন। সেখানেই মৃত্যু হয়েছে।’

সাওঁতাল পরগণার সেই পাহাড়-ঘেরা শহরটি! সেখানে কয় হগুপ্ত বড় আনন্দে ছিলাম‌, যাহাদের স্মৃতি ঝাপসা হইয়া আসিতেছিল‌, তাহাদের কথা মনে পড়িয়া গেল। মহীধর বাবু্‌, পুরুন্দর পাণ্ডে‌, ডাক্তার ঘটক‌, রজনী—

বহিদ্বারের কড়া নড়িয়া উঠিল। দ্বার খুলিয়া দেখিলাম‌, ডাকপিওন। একখানা খামের চিঠি‌, ব্যোমকেশের নামে। আমাদের চিঠিপত্র বড় একটা আসে না। ব্যোমকেশকে চিঠি দিয়া উৎসুকভাবে তাহার পানে চাহিয়া রহিলাম।

চিঠি পড়িয়া সে সহাস্যে মুখ তুলিল‌, বলিল‌, ‘কার চিঠি বল দেখি?’

বলিলাম‌, ‘তা কি করে জানব? আমার তো রেডিও-চক্ষু নেই।’

‘ডি. এস. পি‌, পুরন্দর পাণ্ডের চিঠি।’

সবিস্ময়ে বলিলাম‌, ‘বল কি! এইমাত্র যে তাঁর কথা ভাবছিলাম।’

ব্যোমকেশ ঘাড় নাড়িয়া বলিল‌, ‘আমিও। শুধু তাই নয়‌, অধ্যাপক মজুমদারের প্রসঙ্গও আছে।’

‘আশ্চর্য!’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘এরকম আশ্চর্য ব্যাপার মাঝে মাঝে ঘটে। অনেকদিন যার কথা ভাবিনি তাকে হঠাৎ মনে পড়ে গেল‌, তারপর সে সশরীরে এসে হাজির হল।–পণ্ডিতেরা বলেন‌, ‘কইনসিডেন্স-সমাপতন। কিন্তু এর রহস্য আরও গভীর। কোথাও একটা যোগসূত্র আছে‌, আমরা দেখতে পাই না–’

‘সে যাক। পাণ্ডে লিখেছেন কি?’

‘পড়ে দ্যাখো।’

চিঠি পড়িলাম। পাণ্ডে যাহা লিখিয়াছেন তাহার সারমর্ম এই :-

সম্প্রতি এখানে একটি রহস্যময় ব্যাপার ঘটিয়াছে। শহর হইতে কিছু দূরে পাহাড়ের উপর এক সমৃদ্ধ পরিবার বাস করেন; গৃহস্বামীর এক বৃদ্ধ বন্ধু ঈশান মজুমদার বায়ু পরিবর্তনের জন্য আসিয়াছিলেন। তিনি হঠাৎ মারা গিয়াছেন। মৃত্যুর কারণ সর্পাঘাত বলিয়াই প্রকাশ‌, কিন্তু এ বিষয়ে শব-ব্যবচ্ছেদক ডাক্তার এবং পুলিসের মনে সন্দেহ হইয়াছে। … ব্যোমকেশবাবু রহস্য ভালবাসেন; তার উপর এখন শীতকাল‌, এখানকার জলবায়ু অতি মনোরম। তিনি যদি সবান্ধবে আসিয়া কিছু দিনের জন্য দীনের গরীবখানায় আতিথ্য গ্রহণ করেন‌, তাহা হইলে রথ-দেখা কলা-বেচা দুই-ই হইবে।

চিঠি পড়া শেষ হইলে ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘কি বল?’

বলিলাম‌, মন্দ কি। এখানে তোমার কাজকর্মও তো কিছু দেখছি না। কিন্তু সত্যবতী—’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ওকে এ অবস্থায় কোথাও নিয়ে যাওয়া চলে না—’

‘তা বটে। কিন্তু ও যদি যেতে চায়? কিম্বা যদি তোমাকে না ছাড়তে চায়? এ সময় মেয়েদের মন বড় অবুঝ হয়ে পড়ে‌, কখন কি চায় বোঝা যায় না–ভিতর দিকে পায়ের শব্দ শুনিয়া থামিয়া গেলাম।

সত্যবতী প্রবেশ করিল। অবস্থাবশে তাহার মুখখানি শুকাইয়া গিয়াছে‌, দেহাকৃতি ডিম-ভরা কৈ মাছের মত। সে আসিয়া একটা চেয়ারে থপ্‌ করিয়া বসিয়া পড়িল। আমরা নীরব রহিলাম। সত্যবতী তখন ক্লান্তিভরে বলিল‌, ‘আমাকে দাদার কাছে পাঠিয়ে দাও। এখানে আর ভাল লাগছে না।’

ব্যোমকেশের সহিত আমার চোখে চোখে বাত বিনিময় হইয়া গেল। সে বলিল‌, ‘ভাল লাগছে না! ভাল লাগছে না কেন?

সত্যবতী উত্তাপহীন স্বরে বলিল‌, ‘তোমাদের আর সহ্য হচ্ছে না। দেখছি আর রাগ হচ্ছে।’

ইহা নিশ্চয় এই সময়ের একটা লক্ষণ‌, নচেৎ আমাদের দেখিয়া রাগ হইবার কোনও কারণ নাই। ব্যোমকেশ একটা ব্যথিত নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল‌, ‘যাও তাহলে‌, আটকাব না। অজিত তোমাকে সুকুমারের ওখানে পৌঁছে দিয়ে আসুক।–আর আমরাও না হয় এই ফাঁকে কোথাও ঘুরে আসি।’

 

টেলিগ্রাম পাইয়া পুরুন্দর পাণ্ডে মহাশয় স্টেশনে উপস্থিত ছিলেন‌, আমাদের নামাইয়া লাইলেন। তাঁহার বাসায় পৌঁছিয়া অপব্যাপ্ত খাদ্যদ্রব্য নিঃশেষ করিতে করিতে পরিচিত ব্যক্তিদের খোঁজখবর লইলাম। সকলেই পূর্ববৎ আছেন। কেবল মালতী দেবী আর ইহলোকে নাই; প্রোফেসর সোম বাড়ি বিক্রি করিয়া চলিয়া গিয়াছেন।

অতঃপর কাজের কথা আরম্ভ হইল। পুরন্দর পাণ্ডে অধ্যাপক ঈশানচন্দ্র মজুমদারের মৃত্যুর হাল বয়ান করিলেন। সেই সঙ্গে রামকিশোরের পারিবারিক সংস্থাও অনেকখানি জানা গেল।

অধ্যাপক মজুমদারের মৃত্যুর ব্বিরণ এইরূপ —তিনি মাসখানেক দুর্গে অবস্থান করিতেছিলেন‌, শরীর বেশ সারিয়াছিল। কয়েকদিন আগে তিনি রাত্রির আহার সম্পন্ন করিয়া অভ্যাসমত দুর্গের প্রাঙ্গণে পায়চারি করিলেন; সে সময় মাস্টার রমাপতি তাঁহার সঙ্গে ছিল। আন্দাজ সাড়ে নয়টার সময় রমাপতি বাড়িতে ফিরিয়া গেল; অধ্যাপক মহাশয় একাকী রহিলেন। তারপর রাত্রিকালে দুৰ্গে কি ঘটিল কেহ জানে না। পরদিন প্ৰাতঃকালেই রমাপতি আবার দুর্গে গেল। গিয়া দেখিল‌, অধ্যাপক মহাশয় তাঁহার শয়নঘরের দ্বারের কাছে মরিয়া পড়িয়া আছেন। তাঁহার পায়ের গোড়ালিতে সর্পাঘাতের চিহ্ন‌, মাথার পিছন দিকে ঘাড়ের কাছে একটা কালশিরার দাগ এবং ডান হাতের মুঠির মধ্যে একটি বাদশাহী আমলের চকচকে মোহর।

সপাঘাতের চিহ্ন প্ৰথমে কাহারও চোখে পড়ে নাই। রামকিশোর সন্দেহ করিলেন‌, রাত্রে কোনও দুৰ্বত্ত আসিয়া ঈশানবাবুকে মারিয়া গিয়াছে; মস্তকের আঘাত-চিহ্ন এই অনুমান সমর্থন করিল। তিনি পুলিসে খবর পাঠাইলেন।

কিন্তু পুলিস আসিয়া পৌঁছবার পূর্বেই সর্পদংশনের দাগ আবিষ্কৃত হইল। তখন আর উপায় নাই। পুলিস আসিয়া শব-ব্যবচ্ছেদের জন্য লাস চালান দিল।

শব-ব্যবচ্ছেদের ফলে মৃতের রক্তে সাপের বিষ পাওয়া গিয়াছে‌, গোখুরা সাপের বিষ। সুতরাং সপঘিাতাই যে মৃত্যুর কারণ তাঁহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু তবু পুরন্দর পাণ্ডে নিঃসংশয় হইতে পারেন নাই। তাঁহার বিশ্বাস ইহার মধ্যে একটা কারচুপি আছে।

সব শুনিয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘সাপের বিষে মৃত্যু হয়েছে একথা যখন অস্বীকার করা যায় না‌, তখন সন্দেহ কিসের?’

পাণ্ডে বলিলেন‌, ‘সন্দেহের অনেকগুলো ছোট কারণ আছে। কোনোটাই স্বতন্ত্রভাবে খুব জোরালো নয় বটে‌, কিন্তু সবগুলো মিলিয়ে একটা কিছু পাওয়া যায়। প্রথমত দেখুন‌, ঈশানবাবু মারা গেছেন সর্পাঘাতে। তবে তাঁর মাথায় চোট লাগল কি করে?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘এমন হতে পারে‌, সাপে কামড়াবার পর তিনি ভয় পেয়ে পড়ে যান‌, মাথায় চোট লেগে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। তারপর অজ্ঞান অবস্থাতেই তাঁর মৃত্যু হয়। সম্ভব নয় কি?’

‘অসম্ভব নয়। কিন্তু আরও কথা আছে। সাপ এল কোথেকে? আমি তন্নতন্ন করে খোঁজ করিয়েছি‌, কোথাও বিষাক্ত সাপের চিহ্ন মাত্র পাওয়া যায়নি।’

‘কিন্তু আপনি যে বললেন‌, দু’বছর আগে রামকিশোরবাবুর মেয়েও সর্পাঘাতে মারা গিয়েছিল।’

‘তাকে সাপে কামড়েছিল জঙ্গলে। সেখানে সাপ থাকতেও পারে। কিন্তু দুর্গে সাপ উঠল কি করে? পাহাড়ের গা বেয়ে ওঠা অসম্ভব। সিঁড়ি বেয়ে উঠতেও পারে‌, কিন্তু ওঠবার কোনও কারণ নেই। দুর্গে ইঁদুর‌, ব্যাং কিছু নেই‌, তবে কিসের লোভে সাপ সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠবে?

‘তাহলে–?’

‘তবে যদি কেউ সাপ নিয়ে গিয়ে দুর্গে ছেড়ে দিয়ে থাকে‌, তাহলে হতে পারে।’

ব্যোমকেশ চিন্তা করিতে করিতে বলিল‌, ‘হুঁ, আর কিছু?’

পাণ্ডে বলিলেন‌, ‘আর‌, ভেবে দেখুন‌, অধ্যাপক মহাশয়ের মুঠির মধ্যে একটি স্বর্ণমুদ্রা ছিল। সেটি এল কোথেকে?’

‘হয়তো তাঁর নিজের জিনিস।’

‘অধ্যাপক মহাশয়ের আর্থিক অবস্থার যে পরিচয় সংগ্রহ করেছি‌, তাতে তিনি মোহর হাতে নিয়ে সর্বদা ঘুরে বেড়াতেন বলে মনে হয় না।’

‘তবে–কি অনুমান করেন?’

‘কিছুই অনুমান করতে পারছি না; তাতেই তো সন্দেহ আরও বেড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এটা মামুলি সর্পাঘাত নয়‌, এর মধ্যে রহস্য আছে।’

কিয়ৎকাল নীরব থাকিয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ঈশানবাবুর আত্মীয় পরিজন কেউ নেই?’

পাণ্ডে বলিলেন‌, ‘এক বিবাহিতা মেয়ে আছে। জামাই নেপালে ডাক্তারি করে। খবর পেলাম‌, মেয়ে-জামাইয়ের সঙ্গে অধ্যাপক মহাশয়ের সদ্ভাব ছিল না।’

ব্যোমকেশ নীরবে বসিয়া ভাবিতে লাগিল। পাঁচ মিনিট কাটিবার পর পাণ্ডে আবার কহিলেন‌,’ যেসব কথা শুনলেন সেগুলোকে ঠিক প্রমাণ বলা চলে না তা মানি‌, কিন্তু অবহেলা করাও যায় না। তা ছাড়া‌, আর একটা কথা আছে। রামকিশোরবাবুর বংশটা ভাল নয়।’

ব্যোমকেশ চকিত হইয়া বলিল‌, ‘সে কি রকম?’

পাণ্ডে বলিলেন‌, ‘বংশের একটা মানুষও সহজ নয়‌, স্বাভাবিক নয়। রামকিশোরবাবুকে আপাতদৃষ্টিতে ভােলমানুষ বলে মনে হয়‌, কিন্তু সেটা পোষ-মানা বাঘের নিরীহতা; সহজাত নয়‌, মেকি। তাঁর অতীত জীবনে বোধ হয় কোনও গুপ্তরহস্য আছে‌, নৈলে যৌবন পার না হতেই তিনি এই জঙ্গলে অজ্ঞাতবাস শুরু করলেন কেন তা বোঝা যায় না। তারপর‌, বড় ছেলে বংশীধর একটি আস্ত কাঠগোঁয়ার; সে যেভাবে জমিদারী শাসন করে‌, তাতে মনে হয় সে চেঙ্গিস খাঁর ভায়রাভাই। শুনেছি জমিদারীতে দু’একটা খুন-জখমও করেছে‌, কিন্তু সাক্ষী-সার্বুদ নেই—’

ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘বয়স কত বংশীধরের? বিয়ে হয়েছে?’

‘বয়স ছাব্বিশ-সাতাশ। বিয়ে হয়েছিল‌, কিন্তু দু’মাস যেতে না যেতেই বৌয়ের অপঘাত মৃত্যু হয়। দেখা যাচ্ছে‌, এ বংশে মাঝে মাঝে অপঘাত মৃত্যু লেগেই আছে।’

‘এরও কি সর্পাঘাত?’

‘না। দুপুর রাত্রে ওপর থেকে খাদে লাফিয়ে পড়েছিল কিম্বা কেউ ঠেলে ফেলে দিয়েছিল।’

‘চমৎকার বংশটি তো! তারপর বলুন।’

‘মেজ ছেলে মুরলীধর আর একটি গুণধর। ট্যারা এবং কুঁজো; বাপ বিয়ে দেননি। বোপকে লুকিয়ে লোচ্চামি করে। একটা মজা দেখেছি‌, দুই ছেলেই বোপকে যমের মতন ভয় করে। বাপ যদি গো-বেচারি ভালমানুষ হতেন‌, তাহলে ছেলেরা তাঁকে অত বেশি ভয় করত না।’

‘হুঁ–তারপর?’

‘মুরলীধরের পরে এক মেয়ে ছিল‌, হরিপ্রিয়া। সে সর্পাঘাতে মারা গেছে। তার চরিত্র সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানি না। তবে জামাইটি সহজ মানুষ।’

‘জামাই!’

পাণ্ডে জামাই মণিলালের কথা বলিলেন। তারপর গদাধর ও তুলসীর পরিচয় দিয়া ব্বিরণ শেষ করিলেন‌, ‘গদাধরটা ন্যালা-ক্যাবলা; তার যেটুকু বুদ্ধি সেটুকু দুষ্ট্র-বুদ্ধি। আর তুলসী-তুলসী মেয়েটা যে কী তা আমি বুঝে উঠতে পারিনি। নিবোধ নয়‌, ন্যাকাবোকা নয়‌, ইচড়ে পাকাও নয়; তবু যেন কেমন একরকম।’

ব্যোমকেশ ধীরে-সুস্থে একটি সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করিয়া বলিল‌, ‘আপনি যেভাবে চরিত্রগুলিকে সমীক্ষণ করেছেন‌, তাতে মনে হয় আপনার বিশ্বাস। এদের মধ্যে কেউ পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে ঈশানবাবুর মৃত্যুর জন্য দায়ী।’

পাণ্ডে একটু হাসিয়া বলিলেন‌, ‘আমার সন্দেহ তাই‌, কিন্তু সন্দেহটা এখনও বিশ্বাসের পযায়ে পৌঁছয়নি। বৃদ্ধ অধ্যাপককে মেরে কার কি ইষ্টসিদ্ধি হল সেটা বুঝতে পারছি না। যা হোক‌, আপনার মন্তব্য এখন মুলতুবি থাক। আজ বিকেলবেলা দুর্গে যাওয়া যাবে; সেখানে সরেজমিন তেজবিজ করে আপনার যা মনে হয় বলবেন।’

পাণ্ডে অফিসের কাজ দেখিতে চলিয়া গেলেন। ব্যোমকেশ আমাকে জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘কি মনে হল?’

বলিলাম‌, ‘সবই যেন ধোঁয়া-ধোঁয়া।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ধোঁয়া যখন দেখা যাচ্ছে‌, তখন আগুন আছে। শাস্ত্ৰে বলে‌, পর্বতো বহ্নিমান ধূমাৎ।’

Exit mobile version