৬/৬/৬৯
বাংলাদেশ
লক্ষ মানুষ বিলিয়ে দিয়ে
তোমায় পেলুম একটি নামে—
স্বাধীনতা
তোমার শরীর রক্তে মাখা –
চোখের জলে সিনান কোরে উঠে এলে রণপায়ে; দীপ্ত চোখে
স্টেন্গান ফেলে দিয়ে বুকের ভেতর জড়িয়ে নিয়ে
চুম দিলাম আদর কোরে
পাড়ার লোকে দেখতে এলো মালা হাতে
ভুলে গেল দুঃখাবলী, কঠিন শোক, অত্যাচারী রাজার কথা—-
এখন আমি তোমায় নিয়ে নেচে বেড়াই প্রাণের সুখে
সামনে আমার দাঁড়িয়ে তুমি হাসতে থাকো ভীষণ জোরে
আমার মেয়ে মাটির ব্যকে পা ঠেকিয়ে
কাঁদতে থাকে কেমন কোরে–
দ্যাখো তুমি
মায়ের প্রেম হারিয়ে এখোন তাকিয়ে আছে বোনের দিকে–
আসবে ফিরে
ভায়ের কথা স্মরণ কোরে শুধায় শুধু এই পিতাকে
“আসবে কখোন যুদ্ধ থেকে–বাংলাদেশে”?
লক্ষ মানুষ হারিয়ে আমি তোমায় পেলুম তোমায় পেলুম
তোমার বুকে মাথা রেখে ঘুমাই আমি পরম সুখে—
তুমি এলে রণপায়ে, দীপ্ত চোখে; স্বাধীনতা!
১/২/৭২
ভালোবাসার বাগান থেকে
ভালবাসার বাগান থেকে একটি গোলাপ তুমি চেয়েছিলে
তোমার গম্বুজের মতোন অলীক খোঁপার জন্যে—
আমি তোমাকে দিতে পারিনি
তুমি তাই চোখের জলে প্রতিশোধ নিলে
মুখ রাখলে শাড়ির কাছে
আমি বারবার তোমাকে ডাকলাম; তুমি সাড়া দিলে না
বরং ভাসালে নিকানো আঙিনা কুয়োতলা
বিজন ধোঁয়ার মতো উড়ে গেল আমাদের দীর্ঘদিনের পরিচয়
বৃদ্ধি করলে বুকের হিংসার নদী
আমি পেছনে ফিরে তাকালাম একবার; দেখি—
নিজস্ব দুঃখের ঘরের দরজা তখন হাট কোরে খোলা!
১৪/৪/৬৯
মধ্যরাতে রূপোলী চাঁদ
(সিলভিয়া ইসলাম-কে)
মধ্যরাতে রূপোলী চাঁদের মতো বিশাল দুঃখ নিয়ে পড়ে আছি
তোমার করতলে হে আমার মাধবী
সবুজ নিসর্গ থেকে উঠে এলে একাকী
মুখে কালো কাপড় জড়িয়ে; ফেলে রেখে ভাবনার ভায়োলীন
আমি এই মধ্যরাতে তোমার সম্পতি কুড়াবো
বিজন প্রেমে উল্লসিত হবোনা আর—
ভেবেছি বহুদিন
আমার সুনীল মাংসে ভয়াবহ ক্ষতের চিহ্নাবলী—
যেন আদিগন্ত চিৎকারে ভেসে যায় নিবিড় যামিনী!
মধ্যরাতে এখনো পড়ে আছি; রাপোলী চাঁদের মতো পড়ে আছি
চতুর্দিকে ছেঁড়া ট্রাউজার উড়ছে শুন্যে নীলিমায়
হয়তোবা আজন্ম দুঃখগুলো এখানেই পাওয়া যাবে–
কিছুমাত্র লুকোবার নেই
আমি আমার দুঃখের কাছে যাবো হে মাধবী
তুমি তোমার করতল উর্দ্ধে তোলো
মধ্যরাতে রূপোলী চাঁদের মতো পড়ে আছি
থাকতে দাও!
৪/৪/৭২
মনের রংধনু ক্যানভাসে
মনের রংধনু ক্যানভাসে
সৈয়দ গোলাম দস্তগীর
সিম্ফনি বিশ্বের সব কলার মা সম্ভবত সংগীত। এই মাধ্যমের অঙ্গসমূহের তুলনা শিল্পের যেকোনো মাধ্যমে পাওয়া সম্ভব। অভিব্যক্তি, ভূমিবিন্যাস, দৃশ্য বর্ণনা, আকার এবং এদের বস্তুক-নির্বস্তুক অবস্থান শিল্পের যেকোনো মাধ্যমে দেখা যায়। তাই সংগীতবিহীন কোনো শিল্পের কল্পনা বেশ কঠিন।
আর শিল্পী নিজে যদি হন সংগীতের মানুষ, তাহলে তো কথাই নেই। শিল্পী সুমনা হক একাধারে সংগীতশিল্পী এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত চিত্রকর। দীর্ঘ নয় বছর পর প্রদর্শনী করছেন ৬৭টি বাছাই করা চিত্রকর্ম নিয়ে; যার সবগুলোই তেলরঙে করা। কারণ কৌশলে প্রথার বাইরে এসে এমনভাবে উপকরণ ব্যবহার করেছেন, যাতে উপকরণ ও করণ কৌশলের বিবেচনায় তার এক প্রকার নিজস্ব স্বাক্ষর তৈরি হয়েছে। সুমনার এ রচনাসমূহকে দেখলে একপ্রকার ব্যক্তিগত কাব্যের সামনাসামনি হই আমরা। শিল্পীর একান্ত নিজস্ব ভালো লাগা, সুখ, দুঃখ অথবা খেলার ছলে দাগ কেটে যাওয়া বা কোনো কিছু আঁকা এসব চেতন-অবচেতন প্রয়াসের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এক দৃশ্যকাব্য। যার হয়তো নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তিগত অর্থ আছে অথবা নেই। তবে প্রত্যেক স্বতন্ত্র ব্যক্তির কাছে তা ভিন্ন। কাজ হিসেবে এরা দৃষ্টিনন্দন। তার প্রয়াসের সরল একটি লক্ষ্য হলো এমন কিছু উপস্থাপন করা, যা চোখকে আরাম দেয়। আর এ রকম কাজ স্বভাবতই ঘরের শোভা বাড়াতে বা দৃষ্টিকে পুলকিত করতে পারঙ্গম।
কাজগুলোতে আবেগ আছে, আছে ভূমিবিন্যাসের সেই কারুকাজ, যা সংগীতের শব্দ, নৈঃশব্দ্য এবং শব্দ থেকে নৈঃশব্দ্যের যাত্রাপথের মধ্যবর্তী স্বরের মধ্যে ঘটে থাকে এবং এ বিষয়টিকে বস্তু ও শূন্যতা পরিপ্রেক্ষিত দিয়ে বিচার করলে যেমন ফল পায় তেমন। তবে নিবিষ্ট মনে পরপর তাঁর কাজগুলো দেখতে থাকলে মাঝেমধ্যে ঈষৎ সংশয় জাগতে পারে দর্শকদের এবং সংশয়টা ভাষাগত। দৃশ্য ভাষার নির্মাণে একটু যেন অস্থিরই তিনি মনে হয়। বিশুদ্ধ বিমূর্ত রীতির ছবির পরই কখনো কখনো সম্পূর্ণ চেনা অবয়ব বা অপরিচিত আকার বা চেনা অবয়বের আদলে আবার নির্মাণ—এভাবে লাফিয়ে চলেছে। আবার বিমূর্ত ছবিগুলো যখন চেনা নামের ব্রাকেটে আবদ্ধ হয় এবং সে নামগুলো যদি পরিচিত কোনো বস্তুর কথা বিবৃত করে, তখন সংশয়টা আরও বেড়ে যায়। এ প্রসঙ্গে রংধনু শিরোনামের কাজগুলোর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। রংধনুর বর্ণচ্ছটা এবং পরিচিত আকৃতি থেকে এরা স্বতন্ত্র। যদিও এর মধ্যে তার রংগুলো উপস্থিত, তথাপি এরা পরিচিত আকারে বা অবয়বে বর্তমান নয়। এ রকম উপস্থাপনা দোষণীয় নয়; বরং একটি সফল প্রকাশরীতি। তথাপি বিপত্তি শুরু হয় তখন, যখন পাশাপাশি একই শিল্পীর অপর একটি কাজ সরাসরি চেনা বস্তুকে তার চেনা অবয়বেই প্রকাশ করে।
তার পরও যে কথাটা বলতে হয় তা হলো, তার সব কটি কাজ মিলিয়ে একটা ঐক্যতান আছে। যেগুলো একসঙ্গে দেখলে আমরা হয়তো সুমনার কাজ বলে আংশিকভাবে হলেও চিহ্নিত করতে পারব।
প্রথমে ভেবেছিলাম যেহেতু দীর্ঘ নয় বছরের কাজের সমাবেশ এই প্রদর্শনী, তাই সময় পরিক্রমায় শিল্পী নিরন্তর একটি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। বাস্তবে রচনাগুলোর তারিখ দেখতে গিয়ে আমরা দেখি, ২০১১ সালের রচনা বিমূর্ত মূর্ছনা-১, যা পুরোপুরি নিবস্তুক। আবার একই বছরের রচিত ‘ডিজায়ার’ শিরোনামের চিত্রটিতে আমরা দেখি ফুল-পাখি এবং কিছু লাইনের সমাহারে রচিত। একইভাবে ২০১১ সালের রচিত নেচার অ্যান্ড লাভ-১ বা ফিশের মতো কাজের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে মিডনাইট মিস্ট্রি। এসব বৈপরীত্য ছাপিয়ে বহু কাজ আছে যারা আলাদাভাবে দর্শকদের আনন্দ দেয়। তাদের কেউ কেউ একক চিত্র হিসেবে বেশ মন কাড়ে। এদের একটি সিম্ফোনি-৩ মজবুত জ্যামিতিক গঠনে স্নিগ্ধ কিন্তু উচ্ছল বর্ণবিন্যাসে বেশ ভালো লাগে কাজটি। এ ছাড়া আরও কয়েকটি কাজের কথা উল্লেখ না করলেই নয়; যারা রচনা নৈপুণ্যে নান্দনিকভাবে দৃষ্টি কেড়েছে। যেমন—বিমূর্ত মূর্ছনা-৩, অ্যাবসট্র্যাক্ট-৪, সম্পর্ক-২, স্বাধীনতা, এনব্লোজড, নস্টালজিয়া প্রভৃতি। সবশেষে যে বিষয়টি উল্লেখ করা প্রয়োজন তা হলো তার উপাদান ব্যবহারে ও করণ কৌশলগত দক্ষতা। যেখানে বুনটের চমৎকারিত্বে সৃষ্টি করেছেন ভিন্ন মায়াজাল। আর বর্ণ প্রয়োগে পরিমিত এবং ঝুঁকি না নেওয়ার প্রবণতা তার ছবিকে আকর্ষণের কেন্দ্রে নিয়ে যায়।