তুমুল অগ্নিপ্রপাতের দিনে পাশাপাশি যেতে যেতে
একজন মায়াবী মহিলার কাছে শব্দের তোরণ খুলে দিয়ে
আভুমি নতজানু হয়ে
তাকালে নয়নে সখা তাকালে নীলিমায়
।। দুই।।
এই ভাবেই হোকনা শুরু এই ভাবেই হোকনা শেষ —
জীবনের সজল পল্লব জয় করবার ইচ্ছায় চকিতে উড়াও
কামিনী ডালের পাখিদের, আঙিনার পায়রা, ভোরের পবন,
শ্রাবণের মেঘ মেলা, আমাদের প্রিয়তম সুন্দরীতমারে!
না পারলেও পুনর্বার ভেবে দাখো তুমি; ভেবে দ্যাখো
সরোবরের পদ্মপাতার ফাঁকে অমল জ্যোৎস্নার লকোচুরি
নর্তকী অমরাবতীর সোনালী যৌবন
সুবর্ণ পদাবলীর কোমল হৃদয়
পার্কের বিকেল বেলায় খুনসুটি
চুলের নিবাসে রজনীগন্ধার বসবাস—এইসব দেখা ও পাওয়া
বুঝি সব ব্যথা যাবে
বৃথা যাবে অন্ধকারে দুজনে মুখোমুখী বসিবার?
[কবিতার দুটো লাইন এলিয়ট এবং জীবনানন্দের কাছ থেকে ধার নেয়া]
নিজস্ব মানুষ
তাতে কি, পুনর্বার জলে নেমে শুদ্ধ কর গা
যে গন্ধময় পাপ করেছ ধারণ
না হয় নামলেই এই শীতে
সমস্তই ধুয়ে যাবে জলের তরলতায়-বলে
আমার সুজন মিশে গেল হাওয়ার গভীরে
চারদিকে সকালের নিবিড় কুয়াশা
পাখিও জাগেনি তখন
অন্ধকার কেবল ছায়া-ছায়া
আমি সেই জলের উদরে পা রাখতেই
কনকনে ঠাণ্ডা এক ঘিরে ধরল শরীর
তাড়াতাড়ি উঠে পড়লাম তীরে
তারপর হাঁটতে হাঁটতে আমিও চললাম শহরে
শহরের এক প্রান্তে এসে যখন দাঁড়িয়েছি
দেখলাম, আমার সুজন মিশে গেল মানুষের ভীড়ে
প্রাণপণে ডাকলাম যেন না-শোনার ভানে হাঁটতে থাকলো দ্রুত
আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেটে শেষ টান দিচ্ছি
দেখি, একটি বাস এসে দাঁড়াল আমার কাছে—
আমি তাঁর হাতল ধরে উঠতে চাইলাম—
মানুষগুলো ঠেলে দিল মাটিতে
পুনরায় আমি হাঁটতে লাগলাম
হাঁটতে হাঁটতে একটি রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছি
সবাই নাকে আঙুল চেপে চলে গেল –
আমি বুঝতে চেষ্টা করলাম
মানুষের কিসে এই অনীহা!
মনে পড়ল সুজনের কথা—
“যে গন্ধময় পাপ করেছ ধারণ–
না হয় নামিলেই এই শীতে
সমস্তই ধুয়ে যাবে জলের তরলতায়!”
আমি আবার হাঁটতে হাঁটতে নিজের ঘরে ফিরে এলাম
দরজায় টোকা দিতেই ভেতর থেকে শব্দ এলো
‘কে’?
বললাম
‘খোলো’
খুলে গেল বন্ধ কপাট
ভিতরে ঢুকতেই নির্দ্ধিধায় কাছে এলে বাসন্তী
শরীরে হাত রেখেই বলে উঠলো
‘ঘেমে দেখছি অস্থির হয়ে গেছ”
বাসন্তী তখন জামার বোতাম খুলে, সামনে বসে, মাথায় হাত
বুলাতে বুলাতে
বাতাস দিতে থাকলো—
আমিই সেই বাতাসে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছি
তারপর এক সময় জেগে দেখি
বাসন্তীর মুখখানি পড়ে আছে আমার বুকের উপর।
৩/১০/৭২
নিরপরাধ বৃক্ষমূল
কখনো যাবোনা আর-
যেহেতু তার
হিংস্রতার
কঠিন কুঠার
হানা দেয় অনিবার।
একদা যখন টাকার
ছড়াছড়ি আমার
রাজার
দুলালী এসে ছিঁড়ে দিত গিঁট পাজামার।
এখন গিয়েছে সব; ঘরেতে আঁধার–
বিধাতার
অদৃশ্য খেলার
হাত; মমতা যার
কবিতার
মতো অপার—
বোঝা ভার।
নিরপরাধ বৃক্ষমূল ভেঙেছে সে; যাবো না আর
২/১১/৭২
প্রতিদিন দুঃখ আসে আমার নিবাসে
রাস্তায় গাঢ় দিন হেঁটে যায়। মধ্যরাত
তোমার নিবাসে; সমুদ্র উধাও; দুই হাত
বিজয়িনীর স্বর্ণ মাখা। ভালবাসার নাম
কোথায়? বিভিন্ন সবর আমার মধ্যে। দাম
সব জিনিসের। পলাতক প্রত্যেকে। বাজারে আগুন।
আমি নিঃস্ব। চৌদিকে ঝড়; ঝড়ের খেলায় খুন
হয় ঘরবাড়ি। কোথায় যাবো প্রাক্তন বন্ধুরা?
হাঁটুজল ভাঙতে অভ্যস্ত; বাসে বাদুড় হই; যারা
ভেঁঙচি কাটে; রক্ত তাদের ভিন্নমুখী। এখানে বাঁচার
অর্থ কি? সঠিক সংজ্ঞাটা দিতে পারেন থিবির রাজার
স্ত্রী। এখনো বালক; উপলদ্ধি যদিও প্রখর নয়—
লোকে বলে। তব, আমি অন্ধকার করিনা ব্যবসা। সময়
উর্ধ্বমুখী। পত্র আজ ছিন্ন; ছেলে মেয়ে উপোস যায়।
মাঝে মাঝে ভরসা পাই; হকার হাঁকে রাস্তায়
দৈনিকের হেডলাইন। ঘরে শুয়ে দেখি রোজ
আকাশে নক্ষত্র; ডালপালাহীন তরুরাজি। খোঁজ
নেই আমার হপ্তাখানেক। যুদ্ধ চলে পেটের নিবাসে।
দিন সব বাঘের মতো। রাত্রি; দুঃখ নিয়ে আসে
ঈশ্বর প্রচন্ড ক্ষমতাবান জানি; তব, আমাদের এই পাপ
হয়না কেন স্খলন? এসবের মালিক কে? কে করেন মাফ?
বুঝি দরিদ্র? মধ্যরাতে সজাগ হয় চিন্তা; দুঃখ হানা দেয় আমার নিবাসে
বস্ত্রহীন ছেলে মেয়ে; দ্রব্যমুল্যের বৃদ্ধির খবর আসে
আমার কাছে; তাহলে কিসের স্বাধীন?
মৃত্যু অনিবার্য; এমনিই কাছে আমাদের দিন।
২৭/৪/৭২
প্রেম
প্রেম দ্যাখো বয়স মানেনা কোনদিন
ছোটবড় তালার মতো সব বয়সের কপাটে ঝুলে পড়ে হঠাৎ
প্রেম, সবুজ নিসর্গ থেকে পলাতক কয়েদীর মতোন নিঃশবেদ বেরিয়ে
আসে দ্রুত
ঠাঁই নেয় বিভিন্ন লোকালয়ে; খেলা করে সকাল বিকাল
তোলপাড়ে ভেঙে যায় নীলিমার আজীবন আশীর্বাদ-গড়ে তোলে
সুখ-দুঃখ
পড়ে থাকে বয়স্কদের দারুণ চোখ
প্রেম, সেতো বয়স মানে নি কোনদিন-বুঝি তাই
তীক্ষ্ম চকচকে সোনার ছুরি এনে বসিয়ে দেয় সকল প্রহরে
মেতে ওঠে ভয়াবহ বন্যার জলের মতো বাদশাহী হৃদয়ে–এবং
ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় পারিবারিক স্নেহ-মমতা
অথচ শুধু, বেঁচে থাকে পরস্পর হৃদয়ের সদর দৃশ্যাবলী!
।২।
প্রেম, একটা ক্ষুধার্ত হিংস্র বাঘ : নিমেষে গ্রাস করে দীর্ঘকায় শরীর
প্রচন্ড থাবায় কখনো আবার ছিঁড়ে নেয় লালিত মাংস–ছিঁটিয়ে দেয়
বিষাক্ত লবণ
জ্বলতে থাকে আজীবন!
প্রেম; য্যানো গোলাপ-নীলিমা-নিসর্গ-নক্ষত্রে মোড়া আদুরে পুতুল—
নির্জনে থাকেনা পড়ে; অথচ একবার উপযুক্ত হৃদয়ে ঠাঁই পেলে কেউই
রুখতে পারেনা সহজে এবং
সৃষ্টি করে রিশাল বাগান
যা কখনো ফেলে রেখে কোথাও যাওয়া যায় না; শুধু ঈশ্বরের মতো
ক্ষমতা সম্পন্ন হয়ে যায় মুহূর্তে!