১২/৭/৭২
জেব্রা ক্রসিং-এ
এই চাঁদ খসে পড়ল জেরা
ক্রসিং-এ। তাঁর শরীরে আলোর
যে বন্যা; কে যেন মাড়িয়ে
গেল নিমিশে। জ্যোৎস্নার ব্লাউজ ব্রা
রক্তে ভেজা। ছুরির তীক্ষ্মতা যেন মোর
বুকের উপর তখনো দাঁড়িয়ে।
কোন্ ঈশ্বর এই জ্যোৎস্নময়ী
চাঁদের স্তনে আঘাত করেছিল? — জানিনা!
তবু মনে হলো বেশ্যার অপরাধ
কতটুকু? ঈশ্বরতো সবারই জয়ী।
মুদ্রার কাছে শুধু বেশ্য পরাজিতা বৈশ্যাকে ঘরে রাখতে পারিনা
বলেই ঘর থেকে বের কোরে দেয়া–কি স্বাদ
আমি তো বুঝিনা। সেই চাঁদের কলঙ্ক আমি জানি। যেমন সবাই বেশ্যার
কলঙ্ক জেনেও তাঁর কাছে বারবার
যাওয়া আসা; দু’পায়ের গোপন ফাঁদের নিবিড়ে ধরা দেয়া। কি আশার
কথা তুমি শোনাবে এখানে?—জানা আছে আমার!
পড়ে থাকা চাঁদের রাউজ ব্রা
সব কুড়িয়ে যখন ঘরে ফিরছি; দেখি
ভীষণ রক্তে ভিজে গেছে জেব্রা
ক্রসিং। মনে মনে বলি, “তাহলে ঈশ্বরই মেকী!”
২৮/৫/৭৩
তুমি আমার কবিতা পড়োনা
আমি কখনো প্রেমিক ছিলুম না
প্রেম কি বুঝতে চাইতুম না—তুমি শেখালে
আমি হয়ে উঠলুম প্রেমিক
সকল বাঁধা বিপত্তি অমান্য কোরে তোমার কাছে যাই
অনিচ্ছায় বলি “কি সন্দের তোমার চুল চিবুক চোখের ইশারা
শরীরের রঙ
চন্দ্রের সাথে তোমাকে তুলনা করা ভুল হবে!
এমনি হাসি কখনো দেখিনি;–ঠিক যেন মুক্তো ঝরে—
আমি আসলে ঠিকই তোমাকে আবিস্কার করেছি
তোমাকে দেখলেই কবিতার কথা মনে পড়ে যায়
তুমি যেন সাক্ষাৎ কবিতা হয়ে ওঠো
কবিতার সমস্ত উপমা তোমাতেই
আমি তাই কবি হয়ে গেছি!
তোমার জন্যেই আমি আজ কবিতা লিখি–
মিথ্যে বলতে বলতে কবিরা যেমন সৎ হয়ে যায়
সবকিছুই ইচ্ছাকৃত ভুল কোরে চিৎকার কোরে ওঠে এইটেই ঠিক
আমিও তেমনি অলীকে আশ্রয় নিয়ে বলি
“তুমিই আমার জীবন যেন নদীর জলধারা আমাতে স্বয়ং
যৌবনের প্রাচুর্যে আমি এক গ্রীসীয় রাজা–হৃদয়ে আমার
খেলছো সর্বদা!
আমি তোমাকে পাবার জন্যে মিথ্যে উপমা দিয়ে কবিতা লিখি
কবিতার বদৌলতে আমি কবি হয়ে গেলাম—
কিন্তু তুমি আমার কবিতা পড়োনা!
২/৪/৭৩
তুমিই আমার প্রেমিকা
তুমিই আমার প্রেমিকা। যেহেতু
তুমিই আমাকে প্রথম ভালবাসা শেখালে
কি কোরে ভালবাসতে হয়।
একদিন দেখলাম; একজন বিদেশী যুবা
তোমাকে ক্যামোন জোর করে টেনে নিচ্ছে—-
তুমি নিরুপায়!
হয়তো তোমার বিশ্বাস ছিল
তোমার ভালবাসার প্রতিদানে
আমি তোমাকে উদ্ধার করবো। আমি তাই করেছি
আমি তোমার জন্যে মুক্তিযুদ্ধে গেছি
মর্টার ধরেছি, দাঁত দিয়ে গ্রেনেডের ক্লিপ ছিঁড়েছি—
দ্যাখো, তার সঠিক ফলাফল পাওয়া গেছে
একটি চরম যুদ্ধে।
অতএব এসো, এখন জ্বলজ্বলে দিনের আলোয় পুনমিলন হোক্
আমাদের–
যেহেতু আমি তোমার আশৈশব প্রেমিক—
তোমার ভালবাসা আমার শরীরে!
১৫/২/৭২
তৃতীয় বিশ্বের শিশুদের
তৃতীয় বিশ্বের শিশুদের । নবারুণ ভট্টাচার্য
অন্ধকারে জন্ম তোর
দেখেও যাবি অন্ধকার
অন্ধকারে মৃত্যু হবে
অন্ধকারে জন্ম যার।
অনন্তকাল থাকবে ক্ষুধা
দারিদ্র ও মৃত্যু শাপ
মশাল হাতে নাচবে প্রেত
বন্যা, খরা, দুর্বিপাক।
অনাথ শিশু, চক্ষু বসা
চলছে চলবে গুরুর দশা
চলছে চলবে গুরুর দশা
মরণ, মারণ—চলবে তাই।
জুলবে কুমির, বাঘের চোখ
আমিষ গাছের বিষম ফল
লতাবে সাপ কাটায় কাটায়
পচা নদীর বদ্ধ জল।
অন্ধকারে জন্ম তোর
দেখেও যাবি অন্ধকার
অন্ধকারে মৃত্যু হবে
অন্ধকারে জন্ম যার।
তোমার ছায়া
তোমার ছায়া ঘিরে রাখে
সকাল থেকে সন্ধ্যাবেলা
যখন কিনা কাজের ফাঁকে মনে পড়ে
ছায়ায় তখন তোমাকে দেখি
ইচ্ছে করে শুধাই কিছু
এখন কেমন চলছে তবে
আমার মতোন সঙ্গীহীন বুঝি
এখন আমি যেমন আছি!
তোমার ছায়া ধরতে গেলেই
দাঁড়ায় সে যে অনেক দূরে
বলতে গেলে মুখটা তুমি ফিরিয়ে রাখো
হয়না বলা তখন কিছু
পার্কে কিংবা নদীর ঘাটে
বাড়ায় শুধু ব্যাকুলতা
হাতের মুঠোয় ফুলটা তাই
লুকিয়ে থাকে অনেক আগেই
কেমন করে দুঃখটাকে
থামাই বলে এখন তবে!
তোমার ছায়া ভাল লাগে
যখন কিনা একলা ঘরে
তোমায় নিয়ে থাকি মেতে
কিংবা যখন তাকাই আমি সুদূর পানে।
তোমার ছায়া ভাল লাগে সকাল থেকে সন্ধ্যেবেলা।
১৭/৭/৬৯
নগ্নতাই আমার সৌন্দৰ্য
পুনর্বার ফিরে যাবো মধ্যরজনীতে আমি ও আমার সকল সুন্দরতম শত্রু
ফিরে যাবো সেই রমণীর কাছে; যার নিবাসে নিরপরাধ প্রেম
লুকিয়ে থাকে
সগৌরবে তুলে ধরে বাহু
ভাবনার একান্ত নক্সী ভায়োলীন
সিম্ফনির মতো বাজতে থাকে একলা বাতাসে–
আমরা তাকে ডেকে এনে
জ্যোৎস্নাহীন জ্যোৎস্নায় হত্যা করবো
খুলে নেব সমস্ত ভূষণ প্রেমের মাদুলী
শুধু রক্ষা করবো তাঁর একমাত্র প্রিয় গাঁথা!
পুনর্বার ফিরে যাবো; ফিরে যাবে সুশোভনাকে সঙ্গে নিয়েই
ফিরে যাবো
ফেলে যাবো রজনীগন্ধার বনে শাড়ি ব্লাউজ ও গোপন অন্তর্বাস
নতজানু হয়ে অবলোকন করব হৃদয়; হৃদয়ের সমস্ত ভালবাসা
সৌন্দয় এবং নগ্নতা
তোমরা সবাই চলে গেলে; চলে গেলে হে আমার সুন্দর শত্রুরা
আমি সুশোভনাকে তুলে নিয়ে ফুলের মতে সাজিয়ে রাখবো–
সাজাবো আমার গোলাপ-টেবিলে!
৮/১/৭৩
না পারলেও পুনর্বার ভেবে দ্যাখো তুমি
না পারলেও পুনর্বার ভেবে দ্যাখো তুমি
ইন্দ্রিয়ের কাছে জেনে নাও কি কোরে পূনর্মিলন হবে আমাদের–বলে
সে নিজেই মধ্যাহ্নের খরতাপে ছুঁড়ে দিল প্রিয় রমণীর মতো একটি
গোলাপ ও সিগ্রেট
অশ্রু নির্মিত সরোবরে
আরেকটি পদ্মের ঠিক হৃদয়ের মাঝখানে