১৩/৮/৭৪
একদিন কেউ কাউকে চিনবে না
(মেহবুবা শিরীন-কে)
সবই চলে যায় সবই চলে যাবে একদিন
তবু কেউ কারও মুখ দেখবোনা সঠিক
অস্পষ্ট ভালবাসা বরং থেকে যাবে ইতস্ততঃ
আজীবন ইচ্ছেগুলো ভেসে যাবে বাতাসে নীলিমায়
চোখে চোখে চোখ রাখলে কেউ কাউকে চিনবো না
ভুল কোরে পাশাপাশি হেঁটে গেলে কেউ কাউকে দেখবো না –
একদিন শরীরে শরীরে মিশে যাবো
একদিন জীবন সংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবো
একদিন মিছিল থেকে চলে যাবো মরণ ভবনে
একদিন ডেকে ডেকে চলে যাবে অলীক ঠিকানায়
একদিন নির্ভুল নিয়মে দাঁড়াবো মুখোমুখী
একদিন আমি তুমি চলে যাবো কালের আঙিনায়
একদিন তবু কেউ কাউকে চিনবো না!
৭/৩/৭০
একলা হাতে
চাঁদ খসে পড়ল নষ্ট আকাশের বুক থেকে–
তারার মিউজিয়ম দুয়ার খুলে চকচক করে উঠল পুনরায়
আমি এক দাঁড়িয়ে; চাল উড়ে যাওয়া ভাঙা ঘরের মেঝেয়—
একল হাতে
পেছনে নটীর ছবিওলা আয়না
দেখলাম আয়নায় চাঁদের শরীর বিধ্বস্ত
নিসর্গের গাছপালা বেশ্যার মতো অদূরে দাঁড়িয়ে হাতছানি দিচ্ছে
আমায়
আমার শুদ্ধ প্রেম হঠাৎ তোমার হৃদয় থেকে ঝরে গেল।
আমি এখন সেই প্রেম এখানে ওখানে খুঁজি—
দেখি; আমার বুকের মধ্যে বসে কে যেন সেই প্রেমে
একাগ্রচিত্তে
সুন্দর করে আগুন লাগাচ্ছে ভীষণ; দ্রুত–
একলা হাতে!
২৯/২/৭৩
কবিতার এলোমেলো ভেলা
আমার বুকে অনেক ক্ষত
তব আমি বিক্ষত নই—
ভরদুপুরে একলা কত
খুঁজে বেড়াই হৃদয়টা কই!
কোথায় গেল এই বেলাতে—
দিন কেটে যায় অলস কাজে
বুকের মাঝে সন্ধ্যা রাতে
বীণার মতো দুঃখ বাজে
দুঃখ আমার ভালবাসা
তারে নিয়েই বেঁচে থাকা
বাঁচার মাঝে সকল আশা
সকাল দুপুর তারই দেখা!
২
চোখের সবুজ পৃথিবীটা নাচে হঠাৎ
রাত্রে
সুন্দরী এক লুকিয়ে থাকে রঙীন সাত
পাত্রে
অলীক প্রেমিক আরাম খোঁজে অন্ধকার
কক্ষে
কালো রঙের ইচ্ছে গুলো লাফায় তার
বক্ষে!
৩
আমি বলি—
অঞ্জলি
সন্ধ্যে হলো
বাইরে চলো
একলা ঘরে
বুকের ‘পরে
কতটুকু পাবে মোরে!
৪
হায়দার
এই দ্বার
আজ কেন রুদ্ধ?
তরুতলে কাছাকাছি
বসে আছি
গৌতম বুদ্ধ!
দিন নেই রাত নেই বসে শুধু ভাবছি
মমতায় ইশারায় চোখ দিয়ে ডাকছি—
কোথা সেই যুদ্ধ?
দেখলাম হায়দার
যুদ্ধই উদ্ধার
উদ্ধারে হয়ে যাবো সুন্দর শুদ্ধ।
[ কবিতাগুলো ‘৬৯ থেকে ৭৪-এ রচিত ]
কার জন্যে ভালবাসা
(রাশিদুল হাসান ও আনোয়ার পাশাকে)
এ বৈশাখে আমি কার জন্যে ভালবাসা রেখে যাবো?
সম্পূর্ণ ধ্বংসের ভিতর থেকে বিশাল ক্ষত এবং দুঃখ নিয়ে সবেমাত্র
বেরিয়ে এসেছি
আমার পেছনে আসছে বেলোয়ারী ঝড়; ভয়াবহ সোনালী বন্যার হাত ধরে
আমি কার জন্যে ভালবাসা রেখে যাবো?
আমার চৌদিকে একদা যে শিল্পসম্মত মানুষগুলো ঘুরতো সর্বদা
ঝলমলে আলোয় হাসি খুশি মুখ রাখতো পরম বিশ্বাসে
হাওয়ায় ফলে তোলা রুমাল উড়িয়ে চলে যেতো দূরে শহরে
গল্প করতো নিসর্গের সবুজ পার্কে; ডাকতো গভীর স্নেহে–
তাদের আমি আজ আর কাউকে দেখিনা
আমি কার জন্যে ভালবাসা রেখে যাবো?
ছিন্নমসুল পাখীর মতো অবিরাম ঘুরছি; নগ্ন পা রাখছি ক্লান্ত
মাটির শরীরে
সবদিকে দুর্ভিক্ষের দারুণ কন্ঠস্বর, দয়ারে অনাথ বালিকার কান্না—
আমি তার মধ্যে হেঁটে যাই; হেঁটে যাই গোপন ভালবাসা বুকে নিয়ে
আমি কার জন্যে এই গোপন ভালবাসা রেখে যাবো—আমার ভালবাসা?
২/১/৭২
খেলা
তবু দৃশ্যের কিছু, দৃশ্য থেকে যায় অবশেষে
টর্নেডো বন্যা মহামারী কিংবা ভয়াবহ যুদ্ধের শেষে
ধ্বংসের দারুণ ছবি খেলা করে হৃদয়ে চোখে
আকাশের সুনীল গম্বুজে প্রান্তরে নদীতে কল্পলোকে
শোক দুঃখ এবং কান্নার অবশিষ্ট অংশ
জমা হয় আমাদের পরিচিতি রাস্তা ঘাটে
লোকালয় বিধ্বস্ত হয়; পড়ে থাকে ঘরের ঝুল কবাট মাঠে–
উড়ে যায় সুদূরে কাকচিল চড়ুই হংস!
বিষাদ যন্ত্রণা ভালবাসা যাই বলো না কেন ধ’রে রাখে কিছু দৃশ্য
সময়ের ক্যামেরা
আদিগন্ত সবজ চিৎকারে ভাসে আমাদের শান্তির নীল ভেলা
বাতাসে জ্বলেনা মোমবাতি; অন্ধকারে জেগে থাকে বস্তি গ্রাম পাড়া—
এই সবই দেখা যায় বড় বেশী; প্রেম দুঃখের খেলা!
২৮/৭/৬৯
চলে এলুম
(চলে এলাম, তোমায় ছেড়ে চলে এলুম–
মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়)
চলে এলুম, তোমায় ছেড়ে চলে এলুম
রইলো পড়ে ছেঁড়া মাদুর, ভাঙ্গা সানকী
জীর্ণ কাঁথা মলিন বালিশ
মুলিবাঁশের ছিদ্রবেড়া, পচাঁ ডোবা
মাটির ঝাঁকি, পুরানো কোদাল
ফেলে রেখে চলে এলাম
চলে এলুম, তোমায় ছেড়ে চলে এলুম
দুঃখপূর্ণ মুখটি তোমার উঠলো ভেসে চোখের মধ্যে
ঘন্ট করা কচুর শাকে আমায় তুমি খেতে দিলে
মাটির ব্যকে পা ঠেকিয়ে অন্ন দিলুম মুখের ভেতর
হাতের খেলায় বিদায় নিলো ঘাসের যত মাছিগুলো
পাশে দেখলুম বুড়ো কুকুর শুয়ে আছে খালি পেটে
মাথার উপর কড়া রোদ্দুর কাকের শরীর
এবং তোমার
চোখের জলে ভিজে যাওয়া শাড়িটাকে
মনে ছিল, আসার বেলায় বলবো কিছু
খুচরো পয়সা দিয়ে যাবো
মুন্সী বাড়ি কাজের জন্যে বলেও যাবো
দিয়ে যাবো গামছাটাকে শাড়ি কোরে পরবে তুমি
কিন্তু আমার হয়নি বলা অত কিছু—
তবু আমায় আসতে হলো, আসতে হলো তোমায় ছেড়ে
গ্রামটা আমার ভেসে গেছে
চৈত্র এলে পুড়েও যাবে
কাজের জন্যে দুয়ার দুয়ার ঘুরেও কোন ফল হবেনা
এখন দেখি শহর আমায় রাখে কিনা!