এদিকে আবার হঠাৎ কোরে কানের মধ্যে ঢুকেও পড়ে
“দাঁড়াও তুমি—
বাংলাদেশে যুদ্ধ আসে এমনি কোরেই
পরক্ষণেই জিতে যাবে অনায়াসে
আমরা জানি; তুমিও জানো!”
৮/১০/৭১
আমরা যেন খাঁচায় পোষা পাখী
আমরা যেন খাঁচায় পোষা পাখী
যা বলো তাই শুনি তোমার কথা
দ্বিরুক্তি নেই, হাতে বাধছো রাখী
বুকের মাঝে শুধু অনল ব্যথা
আকাশে আজ ঘন মেঘের খেলা
বাতাসে ওই হাহাকারের সুর
ক্ষুধা পেটেই খাঁচায় কাটে বেলা
চালের আড়ত বুঝি অনেক দূর!
একি খেলা খেলা খেলছো মহাজন—
খাঁচা থেকে উধাও হলে আমি
পেয়েই যাবো গভীর ঘন বন
তখন কি আর তোমার ডাকে থামি !
২৩/৮/৭৩
আমাদের সফলতা, মৃত্যু
আবার চিৎকার শোনা গেল, শূন্যমার্গে চাঁদ হাওয়ার রাত হাসপাতালের
করিডোর নার্স স্যালাইন ছুরি
–তার মধ্যে আমি
উৎকন্ঠায় ইতঃস্তত ঘুরছি
তীক্ষ্ম আলোর ফোয়ারাগুলো আমার চোখের সামনে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধের
অবসানের মতো স্বপ্ন হয়ে দুলছিল
ব্যথা অস্থির স্ত্রী নতুন সময়ের কোলাহল পৃথিবীর উন্মত্ততা
সন্তানের জন্ম—অর্থাৎ,
প্রবল আনন্দ ঘিরে ধরল আমাকে
—ভোর পাঁচটায়
আমি বিশাল আকাংক্ষা নিয়ে ক্লান্তি কপালের ঘাম
সব মুছে ফেললাম—
ছিঁড়ে গেছে ঘুম, মসজিদের মিনার থেকে মুয়াজ্জিনের গাঢ় বেদনার
মতে সঙ্গীত সমস্ত নিস্তব্ধতার ছুটি দিল—
রক্তের ভেতর থেকে, দ্বৈত প্রশ্রয়ে যাহার জন্ম হলো আজি—
নিবিড় পিপাসার মতো ঘ্রাণ এসে
নাকের উপর রয়ে গেল
তারপর;–তারপর
সন্দেহ চিন্তা ঘন অন্ধকার, সভ্যতরে বিপুল গ্রন্থিতে দেখলাম
সমস্ত আয়োজন স্বপ্ন ও প্রতীক্ষা সাধনা ও সৌরভ
করতলে এক বিষাদের দীঘ ছায়া ঘিরিতেছে তখন।
কান্নায় বুক ভেঙে আসে, নবজাতকের ওষুধ খাদ্য সব বাজার থেকে উধাও
আমাদের রক্তের সফলতা প্রশ্রয় আনন্দ ও প্রার্থনার সাথে
একটি জন্ম-মৃত্যুর ঘন্টাধ্বনি শোনা গেল!
এখন পৃথিবীর সব নগর বন্দরে এক বিমৰ্ষ আঁধার এসে বাঁধিতেছে ঘর
হায় বাঁধিতেছে ঘর!
১৮/১০/৭৪
আমার পিতাকে
মুমূর্ষু পিতার সংসারে আমি এক নির্বোধ বালক
যেন। আমাকে দিয়ে কিছুই হবেনা কোন কালেই; জানেন
তিনিই শুধু। যার কোলে-পিঠে মানুষ আজীবন; তিনি এই পৃথিবী-লোক
ছেড়ে এখন কোথায় যে ছিটকে পড়ে আছেন
তা বলতেও পারিনা সহসা ৷ অথচ বাড়িতে তাকে
নিয়ে আমাদের ভাবনার অন্ত নেই। এদিকে গতায়ু হবেন
যিনি আজকাল কিংবা মাসাধিকাল পরে; আপাততঃ তাকে
নিয়ে কেউ-ই ঘামায় না মাথা। বুড়োটে শরীর তার
ভীষণ উত্তেজিত হাতের তুড়িতে একদা নিমেষে উধাও হতো সব। তিনি
আজ বিছানায় একা একা শায়ে ভাবেন আল্লার
আরশ। মুমূর্ষু পিতার সংসারে আমিই বড় ছেলে। সব দায়িত্ব আমাকে
কাঁধে তুলে দিয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরে পালাতে চান যিনি
তাকেই বাঁচাতে চাই আপ্রাণ চেষ্টায়; আমার পিতাকে।
৮/৯/৭০
আমার ভালবাসা
বিষ্ণু দে; শ্রদ্ধাস্পদেষু)
আমার উজ্জ্বল ভালবাসায় অবশেষে আপনাকেই জড়িয়েছি।
চৈতন্যের নির্জন প্রকোষ্ঠে যখন নিহত মানুষের ঘণ্টাধ্বনি বাজে –
পুনর্বার ফিরে যাই আপনার কবিতায়। কি পেয়েছি
বলতে চান? গোল চাঁদের স্নিগ্ধতায় বৃক্ষের সজীবতায় নক্ষত্রের নিপুণ
কারুকাজে
আমার ব্যাকুল যৌবন বাধা পড়েছে; য্যানো মধ্যরাতে রাজার দুলালী তার
সমস্ত অন্তর্বাস খুলে দেয়–দাঁড়ায় শস্যহীন দগ্ধপ্রান্তরে!
কুয়াশার পাংশুপটে যে বালক মিশে গেছে; তাকে আমার
কুশল বলিনি কখনো। নষ্ট মৃত্তিকার সোণামণি; যার শরীরে
বারুদের প্রবল ঘ্ৰাণ পাওয়া যাবে; তাকেও ভালবাসা আশীর্বাদ
দেইনি। সম্পন্ন প্রেমিকের মতো সকল অস্থিরতা পলাতক। ভীষণ আঁধারে
নীলাভ বাহু, নেচেছে দিনরাত। কোথাও পারিনি যেতে। সম্রাটের নিখাদ
আত্মহত্যা অর্থাৎ আমাকে দিয়েছে প্রাণ। সন্ন্যাসীর মতো ঘরে বসে তারে
আমি খুঁজি; খুঁজি এখানে ওখানে; মানুষের সরলতা শান্তি প্রেম
মমতা অপার বিশ্বাসে
পাওয়া যাবে? আমিতো সঠিক পেয়েছি আমার আত্মীয়ের হৃদয়ে!
বিশাল বিষাদ নেই; য্যানো এক মহান প্রেমিক আমাদের আশেপাশে
ঘুরছেন অলৌকিক ক্রাচে-নিজস্ব ভঙ্গিতে। বিষণ্ণ প্রাঙ্গণ এখন হয়ে
যাচ্ছে সবুজ শ্যামল–শ্যামলতায় ঢাকছে গৃহাঙ্গন; হলদে তজনী খেলে
বুকের নিভাঁজ অঙ্গনে। আমার লোকালয় বহুদূরে; শহরতলীর শেষ
প্রান্তে। তব, আমি বৃষ্টির মতোন সঙ্গীহীন চলে আসি; ফেলে
আসি বিধ্বস্ত জনপদ। হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়; এইতো বেশ
চলেছেন আজীবন সঙ্গী আমার! মাঝে মাঝে বড় বেশী খেয়ালী;
বুঝি তাই
টেনে নেই বূকের গভীরে। আমার ভালবাসা
শুধুমাত্র স্মৃতি সত্তায় নয়; সমগ্র নিবিড়তায়। এখন যেখানেই যাই
সঙ্গে যায় মহান প্রেমিক–তাকে বলি “তুমিই আমার জীবন; তুমিই
আমার আশা”
২৫/৩/৭২
আমার স্ত্রীর প্রতি
রাগে আমার সর্বাঙ্গ জ্বলে নরকের আগুনের মতো
অথচ স্ত্রী আমার ভয় করে না বরং হেসেই কুটি কুটি
রাগে আমার শরীর কাঁপে কাঁপে পৃথিবী : ইচ্ছে হয় যতো
খুশী শাসিয়ে পাঠাঁই অনন্ত; চুলের ঝুটি
ধোরে। রাগে আমার কান্না আসে। চোখে দেখি শর্ষের ফুল—
যেন পা মাটিতেই চায়না পড়তে; মাথার সমস্ত চুল
যদি শূন্যেও ছুঁড়ে মারি; তবু আমার পড়েনা বিষণ্ণ
রাগ। সংসারে ছড়িয়ে বিষাদ কোন ফলই হয়না কখনো—
সে যতই দেইনা কেন মহাজনের প্রচন্ড হাঁক; জানি আদিকাল থেকে
যখনি মিছিলে সংগ্রামের ঢেউ; ঠিক তখনি আমি আদিগন্ত
সবুজ মাঠে লাউডস্পিকারে ফাটিয়ে গল ফিরেছি ঘরে;–সময় মতো!