ব্যোমকেশের বিবাহের পর আমি অন্য বাসা লইবার প্রস্তাব করিয়াছিলাম; কারণ নবদম্পতির জীবন নির্বিঘ্ন করা বন্ধুর কাজ। কিন্তু ব্যোমকেশ ও সত্যবতী আমাকে যাইতে দেয় নাই। সেই অবধি এই চার বছর আমরা একসঙ্গে বাস করিতেছি। ব্যোমকেশকে পাইয়া আমার ভ্রাতার অভাব দূর হইয়াছিল; সত্যবতীকে পাইয়াছি একাধারে ভগিনী ও ভ্রাতৃবধূরূপে। উপরন্তু সম্প্রতি ভ্রাতুষ্পপুত্র লাভের সম্ভাবনা আসন্ন হইয়াছে। আশাতীত সুখ ও শান্তির মধ্যে জীবনের দিনগুলা কাটিয়া যাইতেছে।
ভাগ করিয়া খবরের কাগজ পাঠ চলিতেছিল। সামনের পাতা আমি লইয়াছিলাম, ব্যোমকেশ। লইয়াছিল ভিতরের পাতা। সংবাদপত্রের সদরে মোটা অক্ষরে যেসব খবর ছাপা হয়, তাহার প্রতি ব্যোমকেশের আসক্তি নাই, সদরের চেয়ে অলিগলিতেই তাহার মনের যাতায়াত বেশি।
হঠাৎ কাগজ হইতে মুখ তুলিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘ঈশানচন্দ্র মজুমদারের নাম জানো?’
চিন্তা করিয়া বলিলাম, ‘নামটা চেনা-চেনা মনে হচ্ছে। কে তিনি?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন। বহরমপুরে আমি কিছুদিন তাঁর ছাত্র। ছিলাম। ভদ্রলোক মারা গেছেন।’
বলিলাম, ‘তা তুমি যখন তাঁর ছাত্র, তখন তাঁর মরবার বয়স হয়েছিল বলতে হবে।’
‘তা হয়তো হয়েছিল। কিন্তু তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। সর্পঘাতে মারা গেছেন।’
‘ও।’
‘গত বছর আমরা যেখানে স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করতে গিয়েছিলাম, তিনি এবছর সেখানে গিয়েছিলেন। সেখানেই মৃত্যু হয়েছে।’
সাওঁতাল পরগণার সেই পাহাড়-ঘেরা শহরটি! সেখানে কয় হগুপ্ত বড় আনন্দে ছিলাম, যাহাদের স্মৃতি ঝাপসা হইয়া আসিতেছিল, তাহাদের কথা মনে পড়িয়া গেল। মহীধর বাবু্, পুরুন্দর পাণ্ডে, ডাক্তার ঘটক, রজনী—
বহিদ্বারের কড়া নড়িয়া উঠিল। দ্বার খুলিয়া দেখিলাম, ডাকপিওন। একখানা খামের চিঠি, ব্যোমকেশের নামে। আমাদের চিঠিপত্র বড় একটা আসে না। ব্যোমকেশকে চিঠি দিয়া উৎসুকভাবে তাহার পানে চাহিয়া রহিলাম।
চিঠি পড়িয়া সে সহাস্যে মুখ তুলিল, বলিল, ‘কার চিঠি বল দেখি?’
বলিলাম, ‘তা কি করে জানব? আমার তো রেডিও-চক্ষু নেই।’
‘ডি. এস. পি, পুরন্দর পাণ্ডের চিঠি।’
সবিস্ময়ে বলিলাম, ‘বল কি! এইমাত্র যে তাঁর কথা ভাবছিলাম।’
ব্যোমকেশ ঘাড় নাড়িয়া বলিল, ‘আমিও। শুধু তাই নয়, অধ্যাপক মজুমদারের প্রসঙ্গও আছে।’
‘আশ্চর্য!’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘এরকম আশ্চর্য ব্যাপার মাঝে মাঝে ঘটে। অনেকদিন যার কথা ভাবিনি তাকে হঠাৎ মনে পড়ে গেল, তারপর সে সশরীরে এসে হাজির হল।–পণ্ডিতেরা বলেন, ‘কইনসিডেন্স-সমাপতন। কিন্তু এর রহস্য আরও গভীর। কোথাও একটা যোগসূত্র আছে, আমরা দেখতে পাই না–’
‘সে যাক। পাণ্ডে লিখেছেন কি?’
‘পড়ে দ্যাখো।’
চিঠি পড়িলাম। পাণ্ডে যাহা লিখিয়াছেন তাহার সারমর্ম এই :-
সম্প্রতি এখানে একটি রহস্যময় ব্যাপার ঘটিয়াছে। শহর হইতে কিছু দূরে পাহাড়ের উপর এক সমৃদ্ধ পরিবার বাস করেন; গৃহস্বামীর এক বৃদ্ধ বন্ধু ঈশান মজুমদার বায়ু পরিবর্তনের জন্য আসিয়াছিলেন। তিনি হঠাৎ মারা গিয়াছেন। মৃত্যুর কারণ সর্পাঘাত বলিয়াই প্রকাশ, কিন্তু এ বিষয়ে শব-ব্যবচ্ছেদক ডাক্তার এবং পুলিসের মনে সন্দেহ হইয়াছে। … ব্যোমকেশবাবু রহস্য ভালবাসেন; তার উপর এখন শীতকাল, এখানকার জলবায়ু অতি মনোরম। তিনি যদি সবান্ধবে আসিয়া কিছু দিনের জন্য দীনের গরীবখানায় আতিথ্য গ্রহণ করেন, তাহা হইলে রথ-দেখা কলা-বেচা দুই-ই হইবে।
চিঠি পড়া শেষ হইলে ব্যোমকেশ বলিল, ‘কি বল?’
বলিলাম, মন্দ কি। এখানে তোমার কাজকর্মও তো কিছু দেখছি না। কিন্তু সত্যবতী—’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘ওকে এ অবস্থায় কোথাও নিয়ে যাওয়া চলে না—’
‘তা বটে। কিন্তু ও যদি যেতে চায়? কিম্বা যদি তোমাকে না ছাড়তে চায়? এ সময় মেয়েদের মন বড় অবুঝ হয়ে পড়ে, কখন কি চায় বোঝা যায় না–ভিতর দিকে পায়ের শব্দ শুনিয়া থামিয়া গেলাম।
সত্যবতী প্রবেশ করিল। অবস্থাবশে তাহার মুখখানি শুকাইয়া গিয়াছে, দেহাকৃতি ডিম-ভরা কৈ মাছের মত। সে আসিয়া একটা চেয়ারে থপ্ করিয়া বসিয়া পড়িল। আমরা নীরব রহিলাম। সত্যবতী তখন ক্লান্তিভরে বলিল, ‘আমাকে দাদার কাছে পাঠিয়ে দাও। এখানে আর ভাল লাগছে না।’
ব্যোমকেশের সহিত আমার চোখে চোখে বাত বিনিময় হইয়া গেল। সে বলিল, ‘ভাল লাগছে না! ভাল লাগছে না কেন?
সত্যবতী উত্তাপহীন স্বরে বলিল, ‘তোমাদের আর সহ্য হচ্ছে না। দেখছি আর রাগ হচ্ছে।’
ইহা নিশ্চয় এই সময়ের একটা লক্ষণ, নচেৎ আমাদের দেখিয়া রাগ হইবার কোনও কারণ নাই। ব্যোমকেশ একটা ব্যথিত নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, ‘যাও তাহলে, আটকাব না। অজিত তোমাকে সুকুমারের ওখানে পৌঁছে দিয়ে আসুক।–আর আমরাও না হয় এই ফাঁকে কোথাও ঘুরে আসি।’
টেলিগ্রাম পাইয়া পুরুন্দর পাণ্ডে মহাশয় স্টেশনে উপস্থিত ছিলেন, আমাদের নামাইয়া লাইলেন। তাঁহার বাসায় পৌঁছিয়া অপব্যাপ্ত খাদ্যদ্রব্য নিঃশেষ করিতে করিতে পরিচিত ব্যক্তিদের খোঁজখবর লইলাম। সকলেই পূর্ববৎ আছেন। কেবল মালতী দেবী আর ইহলোকে নাই; প্রোফেসর সোম বাড়ি বিক্রি করিয়া চলিয়া গিয়াছেন।
অতঃপর কাজের কথা আরম্ভ হইল। পুরন্দর পাণ্ডে অধ্যাপক ঈশানচন্দ্র মজুমদারের মৃত্যুর হাল বয়ান করিলেন। সেই সঙ্গে রামকিশোরের পারিবারিক সংস্থাও অনেকখানি জানা গেল।