এ ধরনের কথাই একটা লোক আমাদের বলেছিল, মিত সিং কথার মাঝে বললেন, ঐ লোকটা …কি যেন তার নাম সরদার সাহেব?
কমরেড কি যেন! আপনি কি কমরেড বাবু সাহেব?
না।
খুশি হলাম। কারণ ঐ কমরেড আল্লাহয় বিশ্বাস করেন না। তিনি বলেছিলেন, তাঁর দল ক্ষমতায় এলে তুরুণ তারুণ মন্দিরের চারপাশের পবিত্র পানির নালা কেটে জমিত্রে সেচের ব্যবস্থা করবে এবং তাতে ধান ফলাবে। এতে অনেক উপকার হবে। বলে তিনি বলেন।
এ ধরনের কথা অসার, ইকবাল প্রতিবাদ জানালেন। তিনি মিত সিংকে ঐ কমরেডের নাম স্মরণ করতে বললেন। এ ধরনের লোক সম্পর্কে হেড কোয়ার্টার্সে জানানো দরকার এবং তার যথাযথ শাস্তি হওয়া উচিত বলে ইকবাল জানালেন।
আল্লাহয় যদি আমাদের বিশ্বাস না থাকে তাহলে আমরা তো পশুর মতো, বেশ গভীরভাবে বললেন মুসলমান লোকটি। বিশ্বের সব লোকই ধাৰ্মিক লোককে শ্ৰদ্ধা করে। গান্ধীকে দেখুন। আমি শুনেছি যে, তিনি বেদ ও শাস্ত্রের সাথে সাথে কোরআন শরীফ ও ইনজিল পাঠ করেন। তামাম দুনিয়ার লোকে তাঁর প্রশংসা করে। আমি পত্রিকায় গান্ধীর একটা ছবি দেখেছিলাম, তিনি প্রার্থনা করছেন। ঐ ছবিতে দেখেছিলাম, অনেক সাদা চামড়ার পুরুষ ও মহিলা পা মুড়ে বসেছিল। একজন বিদেশী মহিলার চোখ ছিল বন্ধ। অনেকে বলে, তিনি ছিলেন একজন সন্ত্ৰান্ত লর্ড-এর কন্যা। দেখ ভাই মিত সিং, ইংরেজরাও ধাৰ্মিক লোককে সম্মান দেয়।
নিশ্চয় চাচা। তুমি যা বলেছি তার ষোল আনাই ঠিক, মিত সিং তাঁর পেটে হাত বুলাতে বুলাতে ঐ কথায় সমর্থন জানালেন।
ইকবালের বেশ রাগ হলো। তারা প্রতারকের জাত, ইকবাল বেশ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন। তারা যা বলে তা বিশ্বাস করবেন না।
তিনি বুঝলেন, হিংসার মাত্রা তাঁর ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু সম্ভ্রান্ত লর্ড-এর কন্যা সংবাদপত্রে ছবি প্রকাশের জন্য পা মুড়ে চোখ বন্ধ করে আছেন, আর সেই সন্ত্রান্ত লর্ড যিনি দেখতে সুন্দর ও রাজার হিন্দুস্তানী ভাই, তিনি ভারতকে ভালবাসেন মিশনারীদের মতো—এসব কথা ইকবালের মোটেই ভাল লাগে না।
আমি ওদের দেশে অনেক বছর ছিলাম। মানুষ হিসাবে ওরা ভাল। কিন্তু রাজনীতিতে ওরা বিশ্বের সেরা ঠগবাজ। ওরা সৎ হলে তামাম দুনিয়ায় সাম্রাজ্য বিস্তার করতে পারত না। এ কথা অবশ্য এখানে অপ্রাসঙ্গিক, ইকবাল বললেন, এখন কি ঘটতে যাচ্ছে তাই বলুন।
আমরা জানি কোথায় কি হচ্ছে, সরদার সাহেব বেশ রাগত স্বরেই বললেন। সারা দেশে ধ্বংসের বাতাস বইছে। আমরা যা শুনছি তা শুধু হত্যা আর হত্যা। স্বাধীনতা ভোগ করছে। কেবল চোর, ডাকাত ও হত্যাকারীরা। অতঃপর তিনি শান্তভাবে বললেন, আমরা ব্রিটিশদের অধীনে বেশ ভালই ছিলাম। অন্ততপক্ষে সে সময় নিরাপত্তা ছিল।
কিছুটা অস্বস্তিকর নীরবতা। ট্রেন লাইনের ওপর দাঁড়ানো মালগাড়ির বগি। পুনর্বিন্যাস করতে ইঞ্জিনের শব্দ শোনা গেল। মুসলমান লোকটি আলোচনার বিষয় পরিবর্তন করলেন।
মাল গাড়ি। আজ নিশ্চয়ই দেরিতে পৌঁছেছে। বাবু সাহেব, আপনি ক্লান্ত। আপনার আরাম করার সুযোগ দেয়া আমাদের উচিত। আমাদের দরকার হলে বলবেন, আমরা সব সময় আপনার সেবার জন্য রয়েছি।
তারা সবাই উঠে পড়লেন। ইকবাল তাদের সাথে করমর্দন করলেন। তাঁর ব্যবহারে রাগের কোন বহিঃপ্রকাশ দেখা গেল না। সরদার সাহেব ও মুসলমান লোকটিকে মিত সিং আঙ্গিনা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। তারপর তিনি সেখানেই রাখা চারপাই-এ শুয়ে পড়লেন।
ইকবাল আবার শুয়ে আকাশের তারা দেখতে লাগলেন। শান্ত রজনীতে ইঞ্জিনের আর্ত চিৎকারে তাঁর মনে হলো তিনি বড় একা এবং হতাশাগ্ৰস্ত। ভারতের মতো বিশাল দেশে এবং অগণিত মানুষের মাঝে তাঁর মতো ক্ষুদ্র এক ব্যক্তি কতটুকুই বা করতে পারেন? তিনি কি হত্যা বন্ধ করতে পারবেন? হিন্দু, মুসলমান, শিখ, কংগ্রেস কর্মী, লীগ কামী, আকালী বা কমিউনিস্ট দল-সবাই এ কাজে জড়িত। বুর্জেীয়া বিপ্লব প্রোলেতারিয়েত বিপ্লবে রূপান্তরিত হবে এমন কথা বলা আত্মতুষ্টিরই নামান্তর। ঐ অবস্থা এখন আসেনি। হিন্দুস্তান বা পাকিস্তানের সাধারণ লোক এখনও রাজনৈতিক স্বাধীনতার ব্যাপারে উদাসীন। ভিন্নধৰ্মী লোককে খুন করে তার জমি আত্মসাৎ করাকে তারা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা মনে করে। সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে খুন করে সম্পত্তি আহরণের প্রবণতাকে দূর করে ধনিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে ঐ সংগ্রাম পরিচালনা করা যেতে পারে। এটাই সাধারণ শ্রেণীর লোকের সংগ্রামের সহজ পথ। তাঁর দলীয় নেতারা এ কথাটা বুঝতে পারেন না।
দলীয় নেতারা মানো মাজরায় অন্য কাউকে পাঠাক, ইকবাল সেটাই চেয়েছিলেন। নীতি নির্ধারণ এবং মানুষের মন থেকে বাজে চিন্তা দূর করার কাজে তিনি কিছু কাজ করতে পারতেন। তাঁর যোগ্যতার অভাব আছে, তিনি সংকল্পবদ্ধও নন। তিনি কোনদিন জেলে যাননি। প্রয়োজনীয় ‘উৎসর্গের’ কোনটিই তিনি করেননি। ফলে কেউ তাঁর কথা শোনেনি। কোন কারণে বন্দিত্ব গ্রহণের পর তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু করা উচিত ছিল। এখনও অবশ্য সময় আছে। দিল্লী ফিরে যাওয়ার পর প্রথম সুযোগেই তিনি সে কাজ করবেন। ততদিনে হত্যাযজ্ঞ শেষ হয়ে যাবে এবং তখন তার জন্য তা নিরাপদও হবে।
মাল ট্রেন স্টেশন ছেড়ে দিয়েছে। ব্রিজের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় গুড় গুড় শব্দ শোনা গেল। জেলখানায় এক শান্তিময় জীবনের স্বপ্ন দেখতে দেখতে ইকবাল ঘুমিয়ে পড়লেন।
উত্তরখণ্ড – কার্তিক মাসের সকালবেলা
একদিন কার্তিক মাসের সকালবেলা ব্যোমকেশ ও আমি আমাদের হ্যারিসন রোডের বাসায় ডিম্ব সহযোগে চা-পান শেষ করিয়া খবরের কাগজ লইয়া বসিয়াছিলাম। সত্যবতী বাড়ির ভিতর গৃহকর্মে নিযুক্ত ছিল। পুঁটিরাম বাজারে গিয়াছিল।