ইকবাল খাটিয়ার ওপর শুয়ে আকাশের তারা দেখছিলেন অস্বচ্ছ আলোয়। তিনি কিছু লোকের কথাবার্তা শুনতে পেলেন। তাঁরা সব গুরুদুয়ারায় প্রবেশ করে সিড়ি দিয়ে ওপরে উঠছিলেন। তাদের স্বাগত জানাতে তিনি উঠে দাঁড়ালেন।
শুভ রাত, বাবু সাহেব।
আপনাদের প্রতি সালাম, বাবু সাহেব।
তাঁরা করমর্দন করলেন। মিত সিং তাদের সাথে ইকবালের পরিচয় করার প্রয়োজন অনুভব করলেন না। অতিথিদের বসার জায়গা করে দেয়ার জন্য ইকবাল খাটিয়ার গদি এক পাশে সরিয়ে দিলেন। তিনি নিজে মেঝের ওপর বসলেন।
আগে আপনার সাথে দেখা করিনি, এজন্য আমি লজ্জিত, একজন শিখ বললেন। আমাকে দয়া করে মাফ করে দিন। আমি আপনার জন্য কিছু দুধ এনেছি।
সত্যি সাহেব, আমরা খুবই লজ্জিত। আপনি আমাদের অতিথি আর আমরা আপনার কোন সেবাই করলাম না। ঠাণ্ডা হওয়ার আগে দুধ টুকু খেয়ে নিন, অন্য একজন আগভুক বললেন। লোকটা লম্বা, পাতলা এবং মুখে ছোট ছোট দাড়ি।
সত্যি আপনারা দয়ালু… আমি জানি আপনারা পুলিশ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন… আমি দুধ খাই না। সত্যি আমি দুধ খাই না। আমরা শহরবাসীরা …।
সরদার সাহেব ইকবালের ভদ্রজন্যোচিত আপত্তি প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি তার পিতলের মগের ওপর থেকে একটা ময়লা কাপড় সরিয়ে নিয়ে আঙ্গুল দিয়ে দুধ নাড়াতে লাগলেন। একেবারে টাটকা দুধ। ঘন্টটা খানেক আগে আমি মহিষের দুধ দুয়েছি। স্ত্রীকে বলেছি দুধ গরম করে দিতে। কারণ আমি জানি, শিক্ষিত লোকেরা গরম দুধ খায়। এর মধ্যে বেশ চিনি আছে। সব নিচে পড়ে আছে, কথাগুলো বলে তিনি দুধে আর একবার নাড়া দিয়ে দিলেন। দুধের খাঁটিত্ব প্রমাণ করার লক্ষ্যে তিনি দুধের ওপর পড়া জমাট সর আঙ্গুলো করে তুলে আবার দুধের সাথে মিশিয়ে দিলেন।
এই যে ভাইজি, ঠাণ্ডা হওয়ার আগেই খেয়ে নিন।
না না, ধন্যবাদ। ইকবাল আপত্তি জানালেন। তিনি বুঝতে পালেন না, আগডুকদের মনে আঘাত না দিয়ে তিনি কিভাবে না বলবেন। আমি কোনদিন দুধ খাইনি। কিন্তু আপনারা যদি অনুরোধ করেন তাহলে পরে খাব। আমি ঠাণ্ড দুধই পছন্দ করি।
আপনার পছন্দ অনুযায়ী খান ভাইজি, একজন মুসলমান আগন্তুক এ কথা বলে তাঁকে বাঁচালেন। বানতা সিং, এখানেই মগটা রেখে যাও। ভাই মিত সিং কাল সকালে নিয়ে যাবে।
সরদার সাহেব কাপড় দিয়ে মগটার মুখ ঢেকে দিয়ে তা ইকবালের খাটিয়ার নিচে রাখলেন। সবাই কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। সরসহ মগের দুধ নৰ্দমায় ফেলে দেয়ার সুযোগ ইকবালের হলো। এ কথা ভাবতেও ইকবালের ভাল লাগল।
ঠিক আছে বাবুজি, মুসলমান লোকটি শুরু করলেন। আমাদের কিছু বলুন। বিশ্বে কি ঘটছে? পাকিস্তান ও হিন্দুস্থান নিয়েই বা কি হচ্ছে?
আমরা ছোট এই গ্রামে বাস করি, সরদার সাহেব বললেন। বাবুজি, ইংরেজরা কেন চলে গেল আমাদের বলুন।
এ ধরনের ছোট প্রশ্নের উত্তর কিভাবে দিতে হয় ইকবালের তা জানা ছিল না। এসব লোকের কাছে স্বাধীনতা হয়। অন্ধ কিছু আর না হয় কিছুই না। তারা একথা বুঝতেও পারে না যে, এটা তাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা যা সত্যিকার অর্থনৈতিক স্বাধীনতার প্রথম ধাপ।
তারা চলে গেছে, কারণ তাদের চলে যেতে হয়েছে। আমাদের হাজার হাজার ছেলেরা যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। এখন তাদের কাছে অস্ত্ৰও আছে। আপনার কি ভারতীয় নাবিকদের বিদ্রোহের কথা শোনেন নি? এই সৈন্যরা একই কাজ করত। ইংরেজরা এতে ভয় পেয়ে গেল। জাপানীরা যে ভারতীয় জাতীয় সৈন্য বাহিনী গড়ে তোলে তাতে যেসব ভারতীয় যোগ দেয় তাদের একজনকেও ইংরেজরা গুলি করেনি। কারণ তারা চিন্তা করেছিল যে, এর ফলে সমগ্ৰ দেশ তাদের বিরুদ্ধে চলে যাবে।
ইকবালের এই গবেষণাসমৃদ্ধ বক্তব্য কারও বিশেষ ভাল লাগল না।
বাবুজি, আপনি যা বললেন তা হয়ত ঠিক, সরদার সাহেব বললেন। গত বিশ্বযুদ্ধে আমি ছিলাম। মেসোপটেমিয়া ও গ্যালিপোলিতে আমি যুদ্ধ করেছি। ইংরেজ অফিসারদের আমরা পছন্দ করতাম। তারা ভারতীয়দের চেয়ে ভাল।
হ্যাঁ, মিত সিং এ কথার সাথে যোগ করলেন, আমার হাবিলদার ভাই বলে যে, সব সেপাই ভারতীয়দের চেয়ে ইংরেজ অফিসারদের কাছে সুখী ছিল। আমার ভাইয়ের যিনি কর্নেল ছিলেন তাঁর স্ত্রী এখনও লন্ডন থেকে আমার ভাতিজির জন্য উপঢৌকন পাঠায়। আপনি তো জানেন সরদার সাহেব, তার বিয়েতে মেমসাহেব টাকাও পাঠিয়েছিল। ভারতীয় অফিসারদের স্ত্রীরা এমন কিছু করে?
ইকবাল কিছুটা আক্রমণাত্মক ভূমিকা নেয়ার চেষ্টা করলেন।
কেন, আপনারা কি স্বাধীন হতে চান না? সারা জীবন ধরে আপনারা কি অন্যের দাস হিসাবে থাকতে চান?
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর সরদার সাহেব বললেন, স্বাধীনতা নিশ্চয়ই একটা ভাল জিনিস। কিন্তু এর থেকে আমরা কি পাচ্ছি? আপনাদের মতো যারা শিক্ষিত লোক অর্থাৎ বাবু সাহেব তারা চাকরি পাবেন, যা আগে ইংরেজরা করত। কিন্তু আমরা, আমরা কি বেশি জমি বা বেশি মহিষ পাব?
না, মুসলমান লোকটি বললেন, যারা যুদ্ধ করেছে স্বাধীনতা সেই সব শিক্ষিত লোকের জন্য। আগে আমরা ইংরেজদের দাস ছিলাম, এখন আমরা শিক্ষিত পাকিস্তানী বা ভারতীয়দের দাস হবো।
ইকবাল এই ব্যাখ্যায় বিস্মিত হলেন।
আপনারা যা বললেন তা সম্পূর্ণ ঠিক, তিনি তাদের বক্তব্য সাদরে গ্রহণ করে নিলেন। আপনারা যদি স্বাধীনতাকে আপনাদের জন্য সত্যিকারের অর্থবহ করতে চান তাহলে কৃষক ও শ্রমিকশ্রেণীকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করতে হবে। বেনিয়া কংগ্রেস সরকারকে হটাতে হবে। রাজপুরুষ ও জমিদারদের হাত থেকে মুক্ত হতে হবে। তবেই আপনাদের কাছে স্বাধীনতা হবে আপনাদের পছন্দমতো। অনেক জমি, অনেক মহিষ এবং থাকবে না কোন ঋণ।