ইকবাল নদীতীর দিয়ে এগিয়ে গেলেন ব্রীজের দিকে। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, তিনি ব্রিজের নীচে দিয়ে ডাকবাংলোর দিকে যাবেন। কিন্তু তিনি দেখলেন, ব্রিজের এক প্রান্ত থেকে একজন শিখ সৈন্য তাঁকে নিরীক্ষণ করছে। ইকবাল তাঁর মত পরিবর্তন করে সোজা রেল রাস্তার ওপরে গিয়ে উঠলেন এবং অতঃপর মানো মাজরা স্টেশনের দিকে তার গতিপথ পরিবর্তন করলেন। এতে প্রহরীর সন্দেহ প্রশমিত হলো। ইকবাল কিছুদূর এগিয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে রেল রাস্তার ওপর বসে পড়লেন।
এক্সপ্রেস ট্রেনটি চলে যাওয়ার পর মানো মাজরা যেন বিলম্বিত দিবা নিদ্রা থেকে জেগে উঠল। ছেলেরা পুকুরে বিশ্রামরত মহিষকে লক্ষ্য করে ঢ়িল নিক্ষেপ করে। তাদের বাড়ির পথে নিয়ে গেল। দল বেঁধে মেয়েরা মাঠে গিয়ে জঙ্গলের আড়ালে ছড়িয়ে পড়ল। যে গরুর গাড়িতে রামলালের মৃতদেহ তোলা হয়েছিল, তা গ্রাম ছেড়ে ক্টেশনের পথ ধরল। গরুর গাড়িকে পাহারা দিচ্ছিল পুলিশ। গ্রামের অনেকে ঐ গাড়ির সাথে সাথে অনেকটা পথ এগিয়ে গিয়ে আবার গ্রামে ফিরে এলো।
ইকবাল দাঁড়িয়ে চারদিকে দেখলেন। তিনি রেল স্টেশনের দিকে তাকিয়ে ডাকবাংলো দেখলেন। দেখলেন, বাংলোটি যেন দাঁড়িয়ে আছে পাতাহীন কুল গাছের অদূরে। একই স্থানে দাঁড়িয়ে তিনি ব্রিজ এবং গ্রাম দেখলেন। ফের দেখলেন স্টেশন। সব এলাকাতেই তার চোখে পড়ল। পুরুষ, মেয়ে, শিশু, গরু-ছাগল ও কুকুরের ভিড়। আকাশে দেখা গেল উড়ন্তীয়মান ঘুড়ি। কাকের দল উড়ে চলেছে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। হাজার হাজার চড়ুই পাখি গাছে বসে এদিক-ওদিক দুটাছুটি করছে। ভারতে এমন কোন স্থান নেই যেখানে জীবনস্পন্দন নেই। ইকবাল প্রথম যেদিন বোম্বাই যান, সেদিনকার স্মৃতি তাঁর মনে পড়ল। রাস্তায়, রাস্তার ধারে, রেলওয়ে প্লাটফর্মে হাজার হাজার মানুষের ভিড়, এমন কি রাতেও ফুটপাতগুলো মানুষের ভিড়ে পূর্ণ। সমস্ত দেশটাই যেন মানুষে ভরা একটা কামরার মতো। প্রতি মিনিটে ছজন করে মানুষ বাড়ছে, প্রতি বছরে বাড়ছে ৫০লাখ। সুতরাং কি আশা করা যায়। শিল্প বা কৃষি খাতে সব পরিকল্পনা তাই নিস্ফল হচ্ছে। এই পরিমাণ অর্থ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে ব্যয় করা হচ্ছে না কেন? কিন্তু কামসূত্রের এই দেশে, লিঙ্গ পূজা ও পুত্রের প্রতি ভক্তির এই দেশে তা কি সম্ভব?
ইকবাল যেন দিবাস্বপ্ন দেখছিলেন। রেল লাইনের সমান্তরালভাবে বিছানো ইস্পাতের তারের ঝন ঝন্য শব্দে তাঁর যেন স্বপ্ন ভঙ্গ হলো। ব্রিজের কাছে প্রহরী কক্ষের ওপরে সিগন্যাল ডাউন হলো। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে কাপড়ের ধুলো বাড়লেন। ইতোমধ্যে সূর্য ডুবে গেছে। পাটল বর্ণ আকাশ ধূসর রং ধারণ করেছে। রং ধনুর রং প্রতিভাত হয়েছে আকাশে। সন্ধ্যাতারার পিছনে নতুন চাঁদ স্পষ্ট হয়ে দেখা যাচ্ছে। একটা ট্রেন আসার শব্দ পাওয়া গেল। কিন্তু সেই শব্দকে ছাপিয়ে শোনা গোল মুয়াজ্জিনের আজানের ধ্বনি।
ইকবাল অতি সহজে ফিরে আসার পথ খুঁজে পেলেন। পিপুল গাছকে কেন্দ্র করে তিনটি গলিপথ গ্রামে ঢুকেছে। একটা পথ মসজিদ, অন্যটি গুরুদুয়ারা এবং অপরটি গেছে মহাজনের বাড়ির দিকে। রামলালের বাড়ি থেকে তখনও বুকফাটা কান্না শোনা যাচ্ছিল। মসজিদে বারো-তেরো জন লোক দুই লাইনে দাঁড়িয়ে নীরবে নামাজ পড়ছিল। গুরুদুয়ারায় মিত সিং বসেছিলেন একটা ছোট টেবিলের ওপর মসলিন কাপড়ে জড়ানো গ্রন্থের পাশে। তিনি সন্ধ্যার প্রার্থনা করছিলেন। পাঁচ-ছয় জন পুরুষ ও মহিলা অর্ধবৃত্তাকারে বসে তাঁর কথা শুনছিল। তাঁদের মাঝে ছিল একটি জুলানো হারিকেন।
ইকবাল সরাসরি তার কামরায় গিয়ে অন্ধকারের মধ্যে খাটিয়ার ওপর শুয়ে পড়লেন। তিনি চোখ বন্ধ করার আগেই প্রার্থনাকারীরা সমবেতভাবে মন্ত্র পাঠ শুরু করল। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ চলার পর তারা থামল, যেন পুনরায় শুরু করার জন্য। অনুষ্ঠান শেষ হলো সৎ শ্ৰী আকাল বলে এবং ড্রাম পিটিয়ে। পুরুষ ও মহিলারা বেরিয়ে এলো। মিত সিং হারিকেন হাতে করে তাদের জুতো খুঁজতে সাহায্য করলেন। তারা বেশ জোরেই কথা বলছিল। ঐ গোলমালের মধ্যে ইকবাল একটা কথা বুঝতে পারলেন। ঐ কথাটি হলো বাবু। কেউ একজন ইকবালকে দেখে অন্যদের সে কথা বলেছিল। পরে কানে কানে ফিস ফিস কথা হলো, পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল এবং অতঃপর নীরবতা।
ইকবাল চোখ বুজে ঘুমাবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু মিনিটখানেক পরেই মিত সিং লণ্ঠন হাতে কামরার কাছে এলেন।
ইকবাল সিংজি। কিছু না খেয়েই শুয়ে পড়লেন? কিছু সবজি খাবেন? আমার কাছে দই, ঘোল আছে।
ধন্যবাদ ভাইজি। আমার কাছে খাবার আছে।
আমাদের কাছে যা আছে তা গরিব মানুষের খাবার…, মিত সিং বলতে শুরু করলেন। কিন্তু তাঁর কথায় বাধা দিয়ে ইকবাল বললেন, না না, আসল কথা তা নয়। তিনি উঠে বসলেন। বললেন, আসল কথা হলো, আমার কাছে খাবার আছে। এগুলো যদি না খাই তাহলে তা নষ্ট হয়ে যাবে। আমি কিছুটা ক্লান্ত। আমি ঘুমাতে চাই।
তাহলে কিছুটা দুধ খান। সরদার বানতা সিং আপনার জন্য দুধ আনতে গেছেন। আপনি আগেভাগে ঘুমাতে চাচ্ছেন, তাঁকে তাড়াতাড়ি দুধ আনার কথা বলি। ছাদে আমি আপনার জন্য আরও একটা খাটিয়া রেখে দিয়েছি। এত গরমে ঘরের মধ্যে ঘুমানো খুব কষ্ট। মিত সিং ঘরের মধ্যে হারিকোনটা রেখে অন্ধকারের মধ্যে বেরিয়ে গেলেন।
সরদারের সাথে কথা বলার সম্ভাবনা খুব সুখপ্রদ ছিল না। ইকবাল তাঁর বালিশের তলা থেকে ফ্লাক্সটা নিয়ে তার মুখ খুলে এক পেগী হুইস্কি ঢেলে নিলেন। কাগজের প্যাকেট কয়েকটা শুকনো বিস্কুট ছিল। তিনি তাই খেলেন। এরপর তিনি গদি ও বালিশ নিয়ে ছাদে গেলেন। সেখানে তার জন্য একটা খাটিয়া ছিল। গুরুদুয়ারার আঙ্গিনায় মিত সিং শুয়েছিলেন। বাহাত তিনি ঘুমিয়ে আছেন বলেই মনে হলো। কিন্তু তিনি ঘুমান নি। তিনি গুরুদুয়ারা পাহারা দিচ্ছিলেন।