ইকবাল কোন আগ্রহ দেখাল না বলে মিত সিং হতাশ হলেন।
আপনি দুনিয়া দেখেছেন, অনেক বই পড়েছেন। কিন্তু শুনে রাখুন, সাপ তার খোলস ছাড়লেও বিষ ছাড়তে পারে না। একথা হাজার টাকার চেয়েও দামী।
এই মূল্যবান কথারও গুণগান করল না ইকবাল। মিত সিং ব্যাখ্যা করে বললেন, জুগ্গা কিছু দিন বেশ সৎভাবেই দিন কাটাচ্ছিল। সে জমি চাষ করত, গৃহপালিত পশু দেখাশোনা করত। গ্রাম থেকে বাইরে যেত না, সরদারের কাছে প্রতিদিন রিপোর্ট করত। কিন্তু কতদিন একটা সাপ না কামড়িয়ে থাকতে পারে? তার রক্তের সাথে পাপ মিশে আছে।
কারও রক্তে যদি পুণ্য মিশে থাকে তাহলে তার চেয়ে বেশি কারও রক্তে পাপ মিশে থাকে না, কিছুটা উত্তেজিত হয়েই বললেন ইকবাল। অনেক মতবাদের মধ্যে এটাও তাঁর একটা মন্ত্ৰ। কেউ কি কখনও জানার চেষ্টা করেছে মানুষ কেন চুরি, ডাকাতি, হত্যা করে? না। তারা তাদের জেলে ঢোকায় আর না হয় ফাঁসিতে ঝোলায়। এটা খুব সহজ কাজ। ফাঁসি কাষ্ঠ বা জেলের সেল যদি মানুষকে খুন বা চুরি থেকে বিরত রাখতে পারত। তাহলে কোন খুন, বা চুরি হত না। এটা হতে পারে না। এ প্রদেশে তারা প্রতিদিন একজন লোককে ফাঁসিতে ঝোলাচ্ছে। কিন্তু প্রতি চব্বিশ ঘণ্টায় দশ জন লোক খুন হচ্ছে। না, ভাইজি, কেউ পাপী হয়ে জন্মায় না। ক্ষুধা, চাহিদা ও অবিচার তাদেরকে পাপী করে তোলে।
এমন নিরস বক্তব্য দেয়ায় ইকবাল নিজেকে অবিবেচক বলেই মনে করল। আলোচনার সময় এ ধরনের বক্তৃতা দেয়ার অভ্যাস তাঁর পরিত্যাগ করাই বাঞ্ছনীয়। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তিনি আগ্রহ প্রকাশ করলেন।
জুগ্গা যেহেতু সবার অতি পরিচিত, সেহেতু আমার মনে হয়, তারা সহজেই তাকে ধরতে পারবে।
জুগ্গা বেশি দূর যেতে পারবে না। এলাকার সবাই তাকে চেনে। সাধারণ লোকের চেয়ে সে বেশ লম্বা। ডেপুটি সাহেব সবস্থিানায় নির্দেশ পাঠিয়েছেন জুগ্গার ওপর কড়া নজর রাখতে।
ডেপুটি সাহেব কে? ইকবাল জিজ্ঞাসা করলেন।
আপনি ডেপুটি সাহেবকে চেনেন না? মিত সিং বিস্ময় প্রকাশ করলেন। তাঁর নাম হুকুম চাঁদ। তিনি এখন আছেন পুলের উত্তর পাশে ডাকবাংলোয়। এখন হুকুম চাঁদই সত্যিকারের বীর। তিনি ছিলেন একজন কনস্টেবল। আর এখন তিনি কোথায়! তিনি সব সময় সাহেবদের খুশি রাখেন এবং তারা তাঁকে একটার পর একটা পদোন্নতি দেন। শেষের জন্য তাঁকে ডেপুটি করে দেন। সত্যি ইকবাল সিংজি, হুকুম চাঁদ একজন বীর এবং তিনি চালোকও বটে। তিনি বন্ধুদের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং তাদের সব কাজ তিনি করিয়ে দেন। তিনি তাঁর বহু আত্মীয়স্বজনকে ভাল চাকরি জুটিয়ে দিয়েছেন। তাঁর মতো লোক এক শ জনে একজন পাওয়া ভার।
তিনি কি আপনার বন্ধু?
বন্ধু? না, না। প্রতিবাদের সুরে বললেন মিত সিং। আমি এই গুরুদুয়ারার একজন সাধারণ ভাই। আর তিনি একজন সম্রাট। তিনি সরকার আর আমরা তাঁর প্ৰজা। তিনি মানো মাজরায় আসলে আপনি তাঁকে দেখতে পাবেন।
আলোচনায় কিছুটা বিরতি ঘটল। ইকবাল তাঁর স্যান্ডেলে পাঢুকিয়ে দাঁড়ালেন। আমার কিছুটা হাঁটা দরকার। কোন দিকে যাওয়া ঠিক বলে আপনি মনে করেন?
আপনার যেদিকে ইচ্ছা সেদিকে যান। সব দিকই উন্মুক্ত। নদীর ধারে যান। দেখবেন ট্রেন আসছে আর যাচ্ছে। রেল রাস্তা পার হয়ে গেলে আপনি ডাকবাংলো দেখতে পাবেন। কিন্তু দেরি করবেন না। এখন সময় ভাল নয়। সন্ধ্যার আগে ঘরে ফেরাই ভাল। তাছাড়া আমি মসজিদের ইমাম বখশ ও সরদারকে বলেছি আপনার কথা। তারা আপনার সাথে দেখা করার জন্য আসতে পারে।
না, আমার দেরি হবে না।
গুরুদুয়ারা থেকে বেরিয়ে পড়লেন ইকবাল। এ সময় কারও কোন কর্মব্যস্ততা তার নজরে পড়ল না। বাহ্যত পুলিশ তদন্ত কাজ শেষ করেছে।
পিপুল গাছের নিচে ছয়জন কনস্টেবল খাটিয়ার ওপর অলসভাবে শুয়ে-বসে আছে। রামলালের ঘরের দরজা খোলা। ঐ ঘরের আঙ্গিনায় কিছু গ্রামবাসী তখনও বসে ছিল। একজন মহিলা কাঁদছিলেন। হৃদয়ফাটা চিৎকার। তাঁর সাথে কান্নায় যোগ দিলেন আরও কয়েকজন মহিলা। বাইরে বেশ গরম। বাতাস নেই। সূর্যের প্রখর রশ্মি ঘরের মাটির দেয়ালে এসে যেন আছড়ে পড়ছিল।
ইকবাল গুরুদুয়ারার মাটির দেয়ালের ওপর দেয়া চালের নিচ দিয়ে হাঁটছিলেন। পথটিতে মলমূত্রের ছাপ স্পষ্টভাবে বিদ্যমান। পুরুষ লোকেরা এ পথটিকে তাদের প্রস্রাবের স্থান হিসাবে ব্যবহার করে। একটা মেয়ে কুকুর পাশ ফিরে শুয়েছিল। তার আটটি ছোট বাচ্চা উী:উ: শব্দে দুধ খাচ্ছিল।
গলি পথটি হঠাৎ শেষ হয়ে গেল গ্রামের প্রান্তসীমায় এসে। সামনেই একটা ছোট পুকুর, পানি কম, কাদা বেশি। ঐ পুকুরে দেখা গেল কাদা পানির মধ্যে মহিষ শুয়ে আছে। শুধু মুখটা পানির ওপরে।
ছোট পুকুরটার পাশ দিয়ে একটা পায়ে হাঁটা পথ। গম খেতের মধ্য দিয়ে ঐ পথটা মিশে গেছে নদীর কিনারায়। পায়ে হাঁটা পথের পাশ দিয়ে আছে একটা দীর্ঘ নালা, সেটাও শেষ হয়েছে নদীর কিনারায়। ঐ নালায় এখন পানি নেই, শুকনো। নালার পাশ দিয়ে ইকবাল সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। পা ফেললেন অতি সাবধানে। পথের শেষ প্রান্তে অর্থাৎ নদীর তীরে এসেই তিনি দেখলেন লাহোর থেকে আসা এক্সপ্রেস ট্রেনটি ব্রিজ পার হচ্ছে। ইস্পাতের তৈরি ব্রিজ কিভাবে ট্রেনটি অতিক্রম করছে তা তিনি আপলক নেত্ৰে তাকিয়ে দেখলেন। অন্যান্য ট্রেনের মতো এ ট্রেনটিতেও ছিল যাত্রী ঠাসা। ট্রেনের ছাদে, পদানিতে, দরজা ও জানালায়সবখানে মানুষ। দরজা ও জানালায় দেখা গেল মানুষের মাথা ও হাত। দুই বগির মধ্যে যে জায়গা আছে, সেখানেও যাত্রী দেখা গেল। শেষ বগির পিছনেও দুজন লোককে বসে পা নাড়তে দেখা গেল। ব্রিজ পার হওয়ার পর ট্রেনের গতি বেড়ে গেল। গাড়ি চালক হুইসেল বাজাতে শুরু করল। মানো মাজরা স্ট্রেশন অতিক্রম না করা পর্যন্ত হুইসেল বাজানোর বিরতি ঘটল না। তারা পাকিস্তান থেকে ভারতের সীমানায় এসে পৌঁছেছে। এই স্বস্তির, এই নিশ্চিন্ততার প্রকাশ ঘটল যেন হুইসেল বাজানোর মধ্যে দিয়ে।