নিরুপায় মায়েরা সেই ভিড়ের মধ্যেই অবুঝ শিশুর মুখে স্তন দিলে তাদের কান্না থেমে যায়। কিন্তু ক্টেশন ছাড়ার পর বহুক্ষণ ধরে সেই চিৎকারের রেশ থাকে। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে বার বার। কারণ পঞ্চাশ জন যাত্রীর এই কামরায় উঠেছিল। প্রায় দুশ জন যাত্রী। কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে। সাথে তো বিছানাপত্র ছিলই। দরজার পাদানিতে দাঁড়িয়ে ছিল প্রায় ডজন দুই যাত্রী। হ্যান্ডেল ধরে তারা দাঁড়িয়ে ছিল। ছাদের ওপর ছিল বহু লোক। গরম ও বিকট গন্ধ ছিল অসহনীয়। ঝগড়া করার জন্য তাদের মেজাজ যেন তৈরিই ছিল। কয়েক মিনিট পরপরই যাত্রীদের মধ্যে কথা কাটাকাটি এবং উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়। কারণ অতি সামান্য। কেউ হয়ত অন্যের জায়গা সামান্য একটু দখল করে নিয়েছে অথবা টয়লেটে যাওয়ার সময় কারও পায়ে পাড়া লেগেছে। দুজনের কথা কাটাকাটিতে অন্যেরা দুই পক্ষ নিয়ে যোগ দিয়েছে। আবার শেষে অনেকে বিরোধ মিটিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। সব মিলিয়ে একটা অসহনীয় পরিবেশ। এর মধ্যে ইকবাল স্বল্প আলোয় কিছু পড়ার চেষ্টা করছিলেন। বাঘের চারপাশে পতঙ্গ উড়ছিল। তিনি একটা প্যারা পড়া শেষ না করতেই পাশ থেকে একজন বলে উঠলেন:
আপনি পড়ছেন?
হা, আমি পড়ছি।
আপনি কি পড়ছেন?
একটা বই।
এ উত্তরে তিনি সন্তুষ্ট হলেন না। ইকবালের হাত থেকে বইখানা নিয়ে তিনি বইয়ের পাতা উল্টে-পাল্টে দেখলেন।
ইংরেজী?
হ্যাঁ, ইংরেজী।
আপনি নিশ্চয়ই শিক্ষিত লোক।
ইকবাল এ কথার জবাব দিলেন না।
বইখানার হাত বদল হলো। কামরার অনেক যাত্রীই তা পরখ করে দেখলেন। তাদের ধারণা হলো, তিনি শিক্ষিত, ফলে অন্য শ্রেণীর লোক। তিনি বাবু শ্রেণীর লোক।
আপনার নাম কি?
আমার নাম ইকবাল।
স্ত্ৰষ্টা আপনার ইকবাল (সুনাম) বৃদ্ধি করুক।
লোকটা মুসলমান বলে সবাই ধরে নিল। ভাল হলেই ভাল। যাত্রীদের প্রায় সবাই ছিল মুসলমান। তারা যাচ্ছিল পাকিস্তানে।
আপনার বাড়ী কোথায় বাবু সাহেব?
আমার পর্ণকুঠির ঝিলাম জেলায়। ইকবাল বললেন অতি সহজভাবে। তাঁর উত্তরে সবাই নিশ্চিত হলেন যে, লোকটি মুসলমান। কারণ বিলাম জেলা পাকিস্তানে।
ফলে অন্য যাত্রীরাও ইকবালকে নানা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে তুলল। ইকবালকে তাদের বলতে হলো: সে কি করে, তাঁর আয়ের উৎস কি, সমাজে তাঁর মর্যাদা কতটুকু, কোথায় সে লেখাপড়া শিখেছে, সে বিয়ে করেনি কেন, এ যাবত সে কি কি রোগে আক্রান্ত হয়েছে। তারা তাদের পারিবারিক সমস্যা ও অসুখের কথা তুলে ইকবালের পরামর্শ চাইল। যৌন শক্তিহ্রাস পেলে ইংরেজ লোকেরা যা করে এমন কোন ওষুধ বা আয়ুৰ্বেদীয় ওষুধ ইকবাল কি জানে? ইত্যাকার প্রশ্নে জর্জরিত ইকবালকে পড়া বা ঘুমানোর চেষ্টা থেকে বিরত থাকতে হলো। সারা রাত এবং পরদিন সকাল পর্যন্ত তারা এ ধরনের আলোচনা চালিয়ে গেল। ইকবাল এই সফরকে দুঃসহ বলে বর্ণনা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি জানেন ভারতে মানুষের সহোর সীমা কত বিস্তৃত। তাই তিনি সফরের বর্ণনা দেয়াকে অর্থহীন বলে মনে করলেন। মানো মাজরা স্টেশনে তিনি ট্রেন থেকে নেমে পরিতৃপ্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন। তিনি সেবন করলেন নির্মল বায়ু। অপেক্ষা করতে লাগলেন একটা দীর্ঘ নিদ্রার।
কিন্তু ঘুম ইকবালের চোখে এলো না। কামরায় বাতাস চলাচলের কোন ব্যবস্থা ছিল না। ছাতা-পড়া মাটির দুৰ্গন্ধ। কামরার এক কোণায় এক স্তুপ ময়লা পুরাতন কাপড়। হয়ত ধোয়ার জন্য রাখা আছে। তার চারপাশে মাছি ভন্ ভিন্ন করছে। ইকবাল তাঁর মুখের ওপর একটা রুমাল ছড়িয়ে দিলেন। তাঁর শ্বাস নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। এমন পরিবেশেও তিনি নিদ্রায় ঢলে পড়লেন। কিন্তু মিত সিং-এর দার্শনিক কথায় তার সে নিদ্ৰা ভেঙ্গে গেল।
নিজ গ্রামের লোকের বাড়িতে ডাকাতি করা আর মায়ের জিনিস চুরি করা একই ব্যাপার। ইকবাল সিংজি এটা হলো কলিযুগ, অন্ধকার যুগ। প্রতিবেশীর বাড়িতে ডাকাতি করার কথা। আপনি কখনও শুনেছেন? এখন দুনিয়ায় নৈতিকতা বলতে আর কিছু নেই।
ইকবাল তাঁর মুখ থেকে রুমালটা সরিয়ে নিলেন।
কি ঘটেছে?
কি ঘটেছে? একই কথার পুনরাবৃত্তি করে মিত সিং বিস্ময়ের ভান করে বললেন, কি হয়নি। তাই বলুন! জুগ্গার জন্য পুলিশ এসেছে। জুগ্গা হলো দশ নম্বর বদমায়েশা। (পুলিশের খাতায় লিপিবদ্ধ অসৎ লোকদের তালিকার নম্বর মোতাবেক)। কিন্তু জুগ্গা পালিয়েছে, ফেরার। কিন্তু জুগ্গার ঘরের আঙ্গিনায় লুঠ করা এক জোড়া চুড়ি পাওয়া গেছে। সুতরাং এ কাজ কে করেছে তা আমরা বুঝতে পেরেছি। এবারই প্রথম সে হত্যা করল না। হত্যার নেশা তার রক্তের সাথে মিশে আছে। তার পিতা ও পিতামহ ডাকাত ছিল এবং খুন করার জন্য তাদের ফাঁসি হয়। কিন্তু তারা নিজের গ্রামের কারও বাড়িতে কোনদিন ডাকাতি করেনি। সত্যি কথা বলতে কি, তারা বাড়িতে থাকলে মানো মাজরায় কোন ডাকাত আসতে সাহস করত না। জুগ্গাত্ সিং তার পরিবারকেই অসম্মান করল।
ইকবাল উঠে বসে দু’হাত দিয়ে চোখ রূপড়াতে লাগলেন। তুরি ইউরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে এমন অনেক কিছুই ধরা পড়ে যা তাঁর দেশীয় ভাইদের কাছে কিছুই নয়। তাদের নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে মাঝে মাঝে হতবাক করে দেয়। পাঞ্জাবীদের নীতিবোধ আরও বেশি বিভ্রান্তিকর। তাদের কাছে সত্য, সম্মান, অর্থনৈতিক সাধুতা—এসবই ভাল। কিন্তু এর মূল্য বন্ধুর কাছে বন্ধুর উপকারী এবং নিজ গ্রামবাসীর চেয়ে কম। বন্ধুর জন্য তুমি আদালতে মিথ্যা বলতে পার বা কাউকে ঠকাতে পোর। এজন্য তোমাকে কেউ দোষ দেবে না। একইভাবে তুমি যদি পুলিশ বা ম্যাজিস্ট্রেটকে অগ্রাহ্য করতে পোর, ধর্মকে অস্বীকার করতে পোর, অথচ বন্ধুর প্রতি অবিচল থাক, তাহলে লোকে তোমাকে বীরের মর্যাদা দেবে। গ্রামীণ সমাজের চিত্ৰ এটাই। এখানে গ্রামের সবাই সবার আস্ত্রীয় কিনা এবং সবাই সবার প্রতি অনুগত কিনা সেটাই বিবেচ্য বিষয়। জুগ্গা হত্যা করেছে, এটা কিছু ধর্মগুরু মিত সিং-এর কাছে বড় কিছু নয়। তার কাছে বিবেচ্য বিষয় হলো, জুগ্গা নিজ গ্রামের এক লোকের রক্তে নিজের হাত রঞ্জিত করেছে। জুল্পী যদি এমন অপরাধ পাশের গ্রামে করত তাহলে হয়ত মিত সিং তার পক্ষ সমর্থন করে এবং পবিত্র গ্রন্থের নামে শপথ করে বলতেন খুন হওয়ার সময় জুগ্গা গুরুদুয়ারায় প্রার্থনারত ছিল! মিত সিং-এর মতো লোকের সাথে কথা বলতে ইকবালের ক্লান্তিবোধ হয়। তারা কিছু বুঝতে পারে না। ইকবাল শেষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, তিনি ঐ ধরনের লোকের সমপর্যায়ের নন।