স্বদেশ, দ্যাখো, তোমার সমস্ত ভালবাসায় আমার ভালবাসা
একাকার হয়ে মিশে আছে
ক্যামোন নিবিড় অন্তরঙ্গতায়!
৮/৮/৭০
হিমু সিরিজের “দরজার ওপাশে”

হুমায়ূন আহমেদের হিমু সিরিজের দ্বিতীয় উপন্যাস “দরজার ওপাশে” আপলোড করা হয়েছে। এখানে ক্লিক করে দেখুন- দরজার ওপাশে
হেলেনের মতো চুম্বন
আমিতো বলিনি হেলেনের মতো একটি চুম্বন অমর করো আমাকে!
অথচ তুমিই একদা প্রতিবিম্বহীন মেঘমেলায় কুসমগন্ধ রেখে
কি গান শুনিয়েছিলে!
আমার সত্তায় সেই শ্লোক গভীর মমতায় এখনে৷ বেজে ওঠে কিন্নরী!
আমিতো অগ্নির কাছে নতজানু হয়ে বলিনি
—রক্তের অশুদ্ধতা প্রজ্জ্বলিত হোক তোমার বিশ্বাসে
অতলান্ত প্রেমে মুছে যাক সুবর্ণ পদাবলী
প্রত্যাখ্যাত ভালবাসায় ফিরে যেতে বড় ভালবাসি।
সকল সম্ভার থেকে মুক্ত করো দুচোখের সজল সরোবর।
বুঝিনি সানন্দে পুষ্পবীজ নক্ষত্র বাগানে—
প্রেমিক হবো বলে গ্রন্হিতে প্রতিজ্ঞার কোন চিহ্ন নেই আমার–
অথচ তুমিই একদা হেলেনের মতো একটি চুম্বনে
অমর করেছো কিন্নরী!
এ অমরতার জন্যে তুমিই দোষী হে আমার প্রিয়তম সুন্দরী।
২৫/৫/৭৩
যেদিক দিয়া আসিয়াছিলাম
যেদিক দিয়া আসিয়াছিলাম সেই দিক দিয়াই ফিরিয়া চলিলাম। মোড় পর্যন্ত পৌঁছিবার আগেই দেখা গেল সম্মুখের রাস্তা দিয়া একটি যুবতী এক ঝাঁক পাতিহাস তাড়াইয়া লইয়া যাইতেছে।
যুবতী আমাদের দেখিতে পায় নাই। তাহার মাথার কাপড় খোলা, পরনে মোটা তাঁতের লুঙ্গি-ডুরে শাড়ি, দেহে ভরা যৌবন। অন্যমনস্কভাবে যাইতে যাইতে আমাদের দিকে চোখ ফিরাইয়া যুবতী লজ্জায় যেন শিহরিয়া উঠিল। ক্ষিপ্ৰহস্তে মাথার উপর ঘোমটা টানিয়া দিয়া সে তাড়াতাড়ি হাঁসগুলিকে পিছনে ফেলিয়া চলিয়া গেল। কলোনীর পিছন দিকে প্ৰকাণ্ড ইন্দারার পাশে কয়েকটা ঘর রহিয়াছে, সেইখানে অদৃশ্য হইয়া গেল।
নিশানাথ বলিলেন,–’মুস্কিলের বৌ। কলোনীর হাঁস-মুরগীর ইন-চার্জ।’
মনে আবার একটা বিস্ময়ের ধাক্কা লাগিল। এখানে কি প্রভু-ভৃত্য সকলেরই দ্বিতীয় পক্ষ? ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল,–’ওদিকে কোথায় গেল?’
নিশানাথ বলিলেন,–’ওদিকটা আস্তাবল। মুস্কিলও ওখানেই থাকে।’
ব্যোমকেশ বলিল,–’ভদ্রঘরের মেয়ে বলে মনে হয়।’
‘ওদের মধ্যে কে ভদ্র, কে অভদ্র বলা শক্ত। জাতের কড়াকড়ি নেই। কিনা।’
‘কিন্তু পর্দার কড়াকড়ি আছে।’
‘আছে, তবে খুব বেশি নয়। আমাদের দেখে নজর বিবি এখন আর লজ্জা করে না। আপনারা নতুন লোক, তাই বোধহয় লজ্জা পেয়েছে।’
নজর বিবি! নামটা যেন সুনয়নার কাছ ঘেঁষিয়া যায়! চকিতে মাথায় আসিল, যে স্ত্রীলোক খুন করিয়া আত্মগোপন করিতে চায়, মুসলমান অন্তঃপুরের চেয়ে আত্মগোপনের প্রকৃষ্টতর স্থান সে কোথায় পাইবে? আমি রমেনবাবুর দিকে সরিয়া গিয়া চুপিচুপি জিজ্ঞাসা করিলাম,–’কেমন দেখলেন?’
রমেনবাবু দ্বিধাভরে মাথা চুলকাইয়া বলিলেন,–’উই, নেত্যকালী নয়–কিন্তু–কিছু বলা যায় না—‘
বুঝিলাম, রমেনবাবু নেত্যকালীর মেক-আপ করিবার অসামান্য ক্ষমতার কথা ভাবিতেছেন। কিন্তু মুস্কিল মিঞার বৌ দিবারাত্ৰ মেক-আপ করিয়া থাকে ইহাই বা কি করিয়া সম্ভব?
ইতিমধ্যে আমরা আর একটি বাড়ির সম্মুখীন হইতেছিলাম। ভোজনালয় যে রাস্তার উপর তাহার পিছনে সমান্তরাল একটি রাস্তা গিয়াছে, এই রাস্তার মাঝামাঝি স্থানে একটি কুঠি। ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল,–’এখানে কে থাকে?’
নিশানাথ বলিলেন,–’এখানে থাকেন প্রফেসার নেপাল গুপ্ত আর তাঁর মেয়ে মুকুল।’
ব্যোমকেশ বলিল,–’নেপাল গুপ্ত-নামটা চেনা-চেনা ঠেকছে। বছর তিন-চার আগে এর নাম ‘কাগজে দেখেছি মনে হচ্ছে।’
নিশানাথ বলিলেন,–’অসম্ভব নয়। নেপালবাবু এক কলেজে কেমিস্ট্রির অধ্যাপক ছিলেন। তিনি রাত্রে গিয়ে ল্যাবরেটরিতে কাজ করতেন। একদিন ল্যাবরেটরিতে বিরাট বিস্ফোরণ হল, নেপালবাবু গুরুতর আহত হলেন। কর্তৃপক্ষ সন্দেহ করলেন নেপালীবাবু লুকিয়ে লুকিয়ে বোমা তৈরি করছিলেন। চাকরি তো গেলই, পুলিসের নজরবন্দী হয়ে রইলেন। যুদ্ধের পর পুলিসের শুভদৃষ্টি থেকে মুক্তি পেলেন বটে। কিন্তু চাকরি আর জুটল না। বিস্ফোরণের ফলে তাঁর চেহারা এবং চরিত্র দুই-ই দাগী হয়ে গিয়েছে।’
‘সত্যিই কি উনি বোমা তৈরি করছিলেন? উনি নিজে কি বলেন?’
নিশানাথ মুখ টিপিয়া হাসিলেন, —’উনি বলেন গাছের সার তৈরি করছিলেন।’
আমরা হাসিয়া উঠিলাম। নিশানাথ বলিয়া চলিলেন,–’এখানে এসেও সার তৈরি করা ছাড়েননি। বাড়িতে ল্যাবরেটরি করেছেন, অর্থাৎ গ্যাস-সিলিন্ডার, বুনসেন বানার, টেস্ট-টিউব, রেটর্ট ইত্যাদি যোগাড় করেছেন। একবার খানিকটা সার তৈরি করে আমাকে দিলেন, বললেন, পেঁপে গাছের গোড়ায় দিলে ইয়া ইয়া পেঁপে। ফলবে। আমার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু উনি শুনলেন না—‘
‘শেষ পর্যন্ত কি হল?’
‘পেঁপে গাছগুলি সব মরে গেল।’
নেপালবাবুর কুঠিতে প্ৰবেশ করিলাম। বাহিরের ঘরে তক্তপোশের উপর একটি অর্ধ উলঙ্গ বৃদ্ধ থাবা গাড়িয়া বসিয়া আছেন, তাঁহার সম্মুখে দাবার ছক। ছকের উপর কয়েকটি ঘুটি সাজানো রহিয়াছে, বৃদ্ধ একাগ্র দৃষ্টিতে সেইদিকে চাহিয়া আছেন। সেই যে ইংরেজি খবরের কাগজে দাবা খেলার ধাঁধা বাহির হয়, সাদা ঘুটি প্রথমে চাল দিবে এবং তিন চালে মাত করিবে, বোধহয় সেই জাতীয় ধাঁধার সমাধান করিতেছেন। আমরা দ্বারের বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইলাম; কিন্তু তিনি জানিতে পারিলেন না।