- বইয়ের নামঃ জন্মই আমার আজন্ম পাপ
- লেখকের নামঃ দাউদ হায়দার
- প্রকাশনাঃ জয়তী
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অতন্দ্রিলা; তুই আমার কাছে থাক
(অতন্দ্রিলা, তুমি ঘমোওনি জানি/অমিয় চক্ৰব্রতী)
অতন্দ্রিলা; তুই এলি কেন, বরং চলে যা
দুঃখের নদীতে দ্যাখ গিয়ে পড়ে আছে আমার দুঃখপূর্ণ ভেলা
আমাকে আজ ঘুমোতে দে তুই
স্বচ্ছ আকাশে যন্ত্রণার ঝাপসা মায়া বাঁধলো কেনো ঘর
তুই জিজ্ঞেস কর বাতাস সাক্ষী হবে বকে রাধ কঠিন সাহস
তোর শরীরে আজ দেখি নিসর্গের আদি শোভা
আশ্চর্য হাওয়ায় তুই চুলগুলি উড়িয়ে এলি এতক্ষণ
হঠাৎ আনন্দ তোর বেজে ওঠে গুপ্ত সরোবরে
করোটি বিহীন শীতল অন্ধকার আসছে ওই
আলোটা জ্বালা
নিজস্ব সংসারে আমি ফিরে যাবো
তুই আজ যা অতন্দ্রিলা
তোর ছায়া ভীষণ ভয় লাগে; তবু তোর চোখ দুটো আমার চোখে
মারবেলের মতো জ্বলজ্বল করে
তোর হাঁটার শব্দে আমার ব্যাকুলতা বাড়ে—
বাসন্তী কাপড়ে তুই এসেছিস তব আমার চোখে ঘন্ত্রণা
আমার দুঃখের ভাগী হ’ এইবেলা
আমি কিছু স্বচ্ছ দেখি পৃথিবী তোকে
জননীর মতো হাতটা রাখ কপালে
দুঃখ আর দুশ্চিন্তায় মাথাটা ক্যামোন গরম দ্যাখ
জানালাটা বন্ধ কর সেই সাথে
অতীন্দ্রলা; তুই আজ আমার কাছে থাক
২৩/৯/৭০
অন্তর্গত উজ্জ্বল বিষাদ
(কবিরুল ইসলাম-কে)
যায় যায় সবই যায় নদীর কোঁকড়ানো ঢেউ ভাঙতে ভাঙতে যায়
হালকা হাওয়া নাচতে নাচতে যায় রমণীর নক্সী আঁচল উড়তে উড়তে যায়
পুরুষের দল হাঁটতে হাঁটতে যায় বহমান জনতার হাটে যায়; যায় যায়
যায় যায় সবই যায় খড়কুটো কবিতার শরীর ভেসে যায়
যায় যায় সবই যায় আমি এক পড়ে থাকি শুকনো শান্ত নদীর জলে পড়ে থাকি
অর্ধ-ডুবন্ত অৰ্ধ-জাগা পাশ ভাঙা খালি নৌকার মতো পড়ে থাকি
স্মৃতিরা ভীড় করে আসে আর সব যায় লালনীল নিশান উড়িয়ে যায়
মাছে শামুকের শুয়ে থাকে আমার পাঁজরায় আর সব যায়
আমি এক আর সব যায়; যায় ভালবাসার সরল হাত ধরে চলে যায়
নিপুণ সিম্ফনি বাজাতে বাজাতে যায়
উজ্জ্বল আলোর মেলায় যায় অন্তর্গত কান্নার ধ্বনি রেখে যায়
যায় যায় সবই যায়!
অলৌকিক বিকেল
কোঁকড়ানো চুলের মতো নদীর ঢেউ দেখে
তুমি বললে
সবুজ নিসর্গের দিকে তাকিয়ে দ্যাখো
একজন কামুক ক্যামোন উড়াচ্ছে কার
বেনারসী অঁচল।
আমার সুনীল মাংসে বাতাস খেলছে প্রবল
খোঁপার গোলাপ এই বিকেলে পড়ে যাবে অনায়াসে
হাত রাখো
বুকের নিবিড় গম্বুজে
ঢেউ তুলি শরীরে।
আমি বললুম—
তারপর স্নান করবো কোঁকড়ানো চুলের মতো
নদীর ঢেউ-এর জলে।
৪/৫/৭২
আন্দোলন; বারবার ফিরে আসে বাংলাদেশে যুদ্ধের বেশে
বাংলাদেশ কি আসলেই শোকের দুঃখের না যুদ্ধের?
তাহলে আমার মা কোথায়
কোথায় বর্ষিয়ান পিতা
আমার মেয়ে
গর্ভিণী স্ত্রী
ভিটে ঘর-বাড়ি
বলতে পারেন বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ?
হাঁ আমি জানি, আপনার পারবেন
পারবেন ভেজা-ভেজা কন্ঠে
চোখে জড়িয়ে রুমাল একজন যথার্থ প্রেমিকের মতো
মাটিতে পা ঠেকিয়ে
ঠায় রোদ্দুরে কিংবা প্রবল বর্ষণে
হাঁ, আপনারা পারবেন : পারবেন…
আমার মা; সেই মা
যে আমাকে না খেয়ে কোলে পিঠে মানুষ করেছেন
চোখের আড়াল হলেই তন্নতন্ন কোরে খুঁজেছেন
রোদ বৃষ্টিতে আঁচলে ঢেকেছেন
গেয়েছেন ঘুম পাড়ানিয়া
পরম আদরে চুমু দিয়েছেন সকাল বিকাল
পাঠিয়েছেন হাত পা ধুইয়ে
আঁচড়িয়ে চুল
আয়নায় দেখিয়ে মুখ
খেলার সাথীদের কাছে
সেই মা; যে আমার আবদারে বিরক্ত হয়নি কখনো
বরং কপালে মাথায় আশীর্বাদের হাত রেখে বুঝিয়েছেন ময়নার মতোন
সেই মা এখন কোথায়
যিনি রাত্রিকালে ঘুমিয়ে পড়ার আগে দেখে যেতেন পুনরায়?
পিতা, সেই বর্ষিয়ান পিতা?
যে আমাকে কাঁধে নিয়ে ঘুরতেন এমেলা ওমেলায়
কিনে দিতেন টিনের বাঁশি কাঠের ঘোড়া লাটাই সুতো
রঙীন ঘুড়ি
আমার ইচ্ছেমতো পোষাক-আশাক!
বোঝাতেন খেলাচ্ছলে সংসারের ঝামেলা
বিশাল জমিজমার টুকরো টুকরো নথিপত্র
চাইতেন একটা লাল টুকটুকে বৌ-মা
যে তাকে যখন তখন
জায়নামাজ তসবী আর পানের বাসন এগিয়ে দেবে
সহজেই ডাকবে ছেলের চেয়েও গভীর ভালবাসায়
সেই পিতা, যিনি আমাকে নিয়ে স্বপ্নে দেখতেন বিভিন্ন প্রহরে!
তিনি এখন কোথায়?
কোথাইবা আমার সেই পাঁচ বছরের মেয়ে?
যে গলা জড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকত
হঠাৎ কোরে ধরতে গেলে দৌড়ে যেত
ভেঁঙচি কাটত হেসে খেলে
দোলায় চেপে হারিয়ে যেত সাতসমুদ্দুর তেরনদী
অফিস গেলে বায়না ধরতো পতুল আনতে
বিয়ে দিতো যখন তখন ছেলে মেয়ের
বাইরে থেকে ফিরে এলেই হাত রাখত পকেট মাঝে
লজেঞ্চুষের থলি পেলেই চুমু দিতো ঠোঁটের উপর
মাদুর পেতে খেতে গেলেই ঠাঁই নিতে সে মধ্যিখানে
সেই মেয়েটি কোথায় গেল?
কোথায় গেল গর্ভিণী সেই স্ত্রী বা?
এক পা হাঁটতে গেলেই পেটের ব্যাথায় পড়ে যেত
খাটের উপর শুয়ে থাকত অতিকষ্টে
ঘর গোছাতে মন বসেনা
বাটনা বাটে পাড়ার লোকে
চেয়ে থাকত একটি সময়
কেমন করে জন্ম নেবে একটি ছেলে—
বাংলাদেশে!
সবতো আমার চলেই গেলো
কোথায় থাকি এখন আমি
ঘর-বাড়ি তো পুড়েই গেছে
পোড়া ভিটেয় গাছ হয়েছে হাজার রকম
হাঁটতে গেলেও ভয় লাগে যে
পায়ে বাধে মেয়ের শরীর পিতার হাত মায়ের চুল
ছিদ্র করা গর্ভিণী এক স্ত্রীর বুক