তুমি যখন সত্যিকার সঙ্গে থাকো, তখন কিন্তু এত বেশি সঙ্গে থাকো না।
যদি বাসোই
তুমি যদি ভালোই বাসো আমাকে, ভালোই যদি বাসো,
তবে বলছো না কেন যে ভালো বাসো! কেন সব্বাইকে জানিয়ে দিচ্ছ না যে ভালোবাসো!
আমার কানের কাছেই যত তোমার দুঃসাহস!
যদি ভালোবাসো, ওই জুঁইফুলটি কেন জানে না যে ভালোবাসো!
ফুলটির দিকে এত যে চেয়ে রইলাম, আমাকে একবারও তো বললো না যে ভালোবাসো!
এ কীরকম ভালোবাসা গো! কেবল আমার সামনেই নাচো!
এরকম তো দুয়োর বন্ধ করে চুপি চুপি তুমি যে কারও সামনেই নাচতে পারো।
আমি আর বিশ্বাস করছি না, যতই বলো।
আগে আমাকে পাখিরা বলুক, গাছেরা গাছের পাতারা ফুলেরা বলুক,
আকাশ বলুক, মেঘ বৃষ্টি বলুক, রোদ বলুক চাঁদের আলো বলুক, নক্ষত্ররা বলুক,
পাড়া পড়শি বলুক, হাট বাজারের লোক বলুক, পুকুরঘাট বলুক, পুকুরের জল বলুক যে
তুমি ভালোবাসো আমাকে!
শুনতে শুনতে যখন আর তিষ্ঠোতে না পারবো তখন তোমাকে ওই চৌরাস্তায় তুলে একশ
লোককে দেখিয়ে চুমু খাবো, যা হয় হবে।
ভালোবাসা কি গোপন করার জিনিস! দেখিয়ে দেখিয়েই তো
শুনিয়ে শুনিয়েই তো ভালোবাসতে হয়।
ভালোবাসা নিয়ে আমরা জাঁকালো উৎসব করবো, ধেই ধেই নাচবো, নাচাবো,
সুখবর বুঝি আমরা চারদিকে ঢোল বাজিয়ে জানিয়ে দিই না!
জুইঁফুলটি যেদিন বলবে যে তুমি আমাকে ভালোবাসো, সেদিনই কিন্তু তোমাকে বলবো যে
তোমাকেও বাসি, তার আগে একটুও নয়।
যা ইচ্ছে তাই
‘শিউলি মেয়েটি এমন মিষ্টি করে হাসে আবার এমন কঠিন করে তাকায় যে না পারি চোখ সরাতে, না পারি রাখতে।’ অরুণ বোধহয় বলল, নাকি সন্দীপ বলল, দুজনের মধ্যে কেউ একজন বলেছে। এমনও হতে পারে কেউ বলেনি, আমার মন বলেছে। আমাদের জাহাজটি বিদ্যাসাগর সেতুর তল দিয়ে হাওড়া সেতুর তল দিয়ে কোথায় যাচ্ছে কে জানে, যতদূর চোখ যায়, সম্ভবত ততদূর যাচ্ছে, দক্ষিণেশ্বর মন্দির পেরিয়ে যাচ্ছে.. এসবের মধ্যে দেখি চাঁদা তুলে বেড়াচ্ছে শিউলি। গঙ্গার হাওয়া এসে উড়িয়ে দিচ্ছে তার শাড়ি, চুল, কানের দুল। যা ইচ্ছে তাই করার জন্য চাঁদা। বাহ, চমৎকার তো! যা ইচ্ছে তাই করার জন্য! জাহাজের চারপাঁচজন চাঁদা দিয়ে দিল। আমিও পাঁচশ টাকার একটি নোট ছুড়ে দিলাম। কিন্তু চাঁদা কেন? চাঁদার দরকার পড়ছে কেন! শিউলি থেমে ঘেমে কেশে হেসে বলল যে সে আর তার কজন শিল্পী-বন্ধু যা ইচ্ছে তাই করার জন্য একটি সংগঠনই নাকি গড়ে তুলেছে নতুন, এখন যা ইচ্ছে তাই করতে যেহেতু টাকার দরকার হয়, তাই টাকা।
কি রকম যা ইচ্ছে তাই?
বলল, যে যার ছেলেবন্ধু মেয়েবন্ধু সঙ্গে নিয়ে কোনও ঘর ভাড়া করব। পান করব, হল্লা করব। ফূর্তি করব, আনন্দ করব!
তারপর?
তারপর যে যার ঘরে ফিরে যাব। সব আনন্দর কথা ভুলে যাব।
আমি আঁতকে উঠি শুনে। তড়িঘড়ি জানতে চাই, ভুলে যাবে কেন? ভোলার প্রশ্ন ওঠে কেন!
ভোলার প্রয়োজন কেন?
যা লজ্জা করবে না বুঝি?
যা ইচ্ছে তাই করলে বুঝি লজ্জা হয়!
শিউলির চোখ কাঁপে। ঠোঁট কাঁপে। চেপে ধরলে চুপচুপ করে বলে, সবারই তো ঘর সংসার
আছে, অশান্তি হবে যে!
আমি তো যা ইচ্ছে তাই করতে চাই। কিন্তু কিছু করলে তো তা ভুলতে চাই না!
শুনে শিউলি ঈর্ষা ঈর্ষা দৃষ্টি ছুড়ে বলে, তোমার তো আর স্বামী সংসার নেই!
শিউলির হাত টেনে কাছে এনে তাকে ঘিরে কয়েক পাক নেচে বলি, এই যে দেখ যা ইচ্ছে তাই করছি, এর কথা ভুলবো কেন!
জাহাজের রেলিংএ গা এলিয়ে দিয়ে গঙ্গার ঘ্রাণ নিতে নিতে চোখ বুজে বলি, এই যে দেখ যা ইচ্ছে তা। গলায় পেঁচিয়ে থাকা ওড়নাটাকে হাওয়ায় ছুড়ে দিয়ে বলি, এই যে দেখ যা ইচ্ছে তা। জাহাজের ছাদে উঠে গলা ছেড়ে ভাটিয়ালি একটি গান গেয়ে শিউলিকে বলি, দেখলে তো যা ইচ্ছে তা করছি কেমন! শিউলি এদিক ওদিক তাকায়। সিঁড়ির কাছে যায়, আবার যায় না। ছাদে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করি, এগুলোকে বুঝি গোনোনি? মাথা নাড়ে মেয়ে। গোনেনি।
এরপর ও তো মুর্ছা যায় দেখে যখন গঙ্গায় ঝাঁপ দিলাম। দিব্যি ঘণ্টাখানিক সাত রকম সাঁতার কেটে যখন উঠে এলাম জাহাজে, এক -জাহাজ লোক হাঁ করে তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করল, কী করলে এসব? আমি বললাম, যা ইচ্ছে তাই।
শিউলিকে এবার হাতে নাতে ধরি, গুনেছিলে? বলি সাঁতারটা গুনেছিলে।
বড় একটা শ্বাস ফেলে ঠোঁট উল্টে সুন্দরী বলে, না।
তবে কী গুনেছো?
কানে কানে বলে, পরপুরুষের সঙ্গে চুমু টুমু….। আড়ালে। কেউ যেন না দেখে। না বোঝে।
শুনে তুমুল হেসে উঠি। অরুণ কাছেই ছিল, বলি, ও অরুণ, তোমাকে খুব চুমু খেতে ইচ্ছে হচ্ছে যে।
মুহূর্তে লাল হয়ে গেল সে লজ্জায়। নিমরাজি ছেলেটির হাত স্পর্শ করতেই ছেলে রাজি।
জাহাজের সবগুলো লোক দেখলো দু বাহুতে আলিঙ্গণ করে চুমু খেলাম অরুণকে।
শিউলি কিন্তু বলেই চলছে, ছি ছি! তোমার লজ্জা নেই একেবারে। চুমু খেয়ে শিউলিকে কোনওদিন তো ভুলে যেতে চাইবো না এই চুমটির কথা বলে যেই না রেলিংএ গা এলিয়ে হাওয়ার সঙ্গে নাচছি, আমার দেওয়া সেই পাঁচশ টাকা আমাকে ফেরত দিয়ে শিউলি সরে গেল। অন্যদিকে চাঁদা তুলতে গেল।
যেও না
যেও না। আমাকে ছেড়ে তুমি এক পাও কোথাও আর যেও না।
গিয়েছো জানি, এখন উঠে এসো। যেখানে শুয়ে আছো, যেখানে তোমাকে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে
সেখান থেকে লক্ষ্মী মেয়ের মত উঠে এসো।
থাকো আমার কাছে, যেও না। কোথাও আর কোনওদিন যেও না।
কেউ নিতে চাইলেও যেও না।
রঙিন রঙিন লোভ দেখিয়ে কত কেউ বলবে, এসো। সোজা বলে দেবে যাবো না।
সারাক্ষণ আমার হাতদুটো ধরে রাখো,
সারাক্ষণ শরীর স্পর্শ করে রাখো,
কাছে থাকো, চোখের সামনে থাকো,
নিঃশ্বাসের সঙ্গে থাকো,
মিশে থাকো।
আর কোনওদিন কেউ ডাকলেও যেও না।
কেউ ভয় দেখালেও না।
হেঁচকা টানলেও না।
ছিঁড়ে ফেললেও না।
যেও না।
আমি যেখানে থাকি, সেখানে থাকো, সারাক্ষণ থাকো।
আবার যাপন করো জীবন,
যেরকম চেয়েছিলে সেরকম জীবন তুমি যাপন করো আবার।
হাত ধরো, এই হাত থেকে কাঁড়ি কাঁড়ি সুখ তুলে নাও।
আমাকে বুকে রাখো, আমাকে ছুঁয়ে থাকো, যেও না।
তোমাকে ভালোবাসবো আমি, যেও না।
তোমাকে খুব খুব ভালোবাসবো, যেও না।
কোনওদিন আর কষ্ট দেব না, যেও না।
চোখের আড়াল করবো না কোনওদিন, তুমি যেও না।
তুমি উঠে এসো, যেখানে ওরা তোমাকে শুইয়ে দিয়েছে, সেখানে আর তুমি শুয়ে থেকো না,
তুমি এসো, আমি অপেক্ষা করছি, তুমি এসো।
তোমার মুখের ওপর চেপে দেওয়া মাটি সরিয়ে তুমি উঠে এসো,
একবার উঠে এসো, একবার শুধু।
আমি আর কোনওদিন কোথাও তোমাকে একা একা যেতে দেব না।
কথা দিচ্ছি, দেব না।
তুমি উঠে এসো।
তোমাকে ভালোবাসবো, উঠে এসো।
যেহেতু তুমি, যেহেতু তোমার
তোমার কপালের ভাঁজগুলোকেও আমি লক্ষ করছি যে আমি ভালোবাসি,
ভালোবাসি কারণ ওগুলো তোমার ভাঁজ,
তোমার গালের কাটা দাগটাকেও বাসি, যেহেতু দাগটা তোমার
আমার দিকে ছুঁড়ে দেওয়া তোমার বিরক্ত দৃষ্টিটাকেও ভালোবাসছি,
যেহেতু দৃষ্টিটা তোমারই।
তোমার বিতিকিচ্ছিজ্ঞর টালমাটাল জীবনকেও পলকহীন দেখি, তোমার বলেই দেখি।