- বইয়ের নামঃ কিছুক্ষণ থাকো
- লেখকের নামঃ তসলিমা নাসরিন
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অকাজ
অনেকবার ফোন বাজলো, কেউ ধরলো না
কথা বলতে চাইলাম, কেউ বললো না
সারাদিন কোনও চিঠি নেই, কেউ লিখলো না
কেউ ভাবলো না
মনে করলো না
কেউ জাগালো না
ভালোবাসলো না।
কী জানি, হয়ত এই ফোন করা, কথা বলা, চিঠি লেখা সবকিছুকে এখন বড় অকাজ বলে
মনে হচ্ছে কারও কাছে!
ধীরে ধীরে ভুলে যায় মানুষ, ভুলেই তো যায়, কেউ হয়ত ভুলে যাচ্ছে।
আমার কিন্তু কখনও এসবের কিছুকে অকাজ বলে মনে হবে না,
সকলে ভুলে যাক, আমি ভুলবো না,
ভালো কেউ না বাসুক, নিভৃতে আমিই বাসবো,
এ জগতটিকে, জগতের হৃদয়বান মানুষগুলোকে ভালোবেসে আমি তো অন্যকে নয়,
নিজেকেই ধন্য করি,
এর চেয়ে বড় কাজ আর কী আছে জীবনে?
আমি আছি, দূরে ব হুদূরে, কোথাও, কোনওখানে
এখনও শ্বাস নিচ্ছি, নিঝুম চরাচরে নিজের শ্বাসের শব্দে হঠাৎ হঠাৎ চমকে উঠি,
স্বপ্নটাকে রেখে দিয়েছি খুব যত্ন করে নেপথলিনে মুড়ে
যাবো কলকাতায়
যাবো আবার
দেখা হবে প্রিয় প্রিয় মানুষের সঙ্গে
হাতে হাত রেখে হাঁটা হবে, রাতের কলকাতাকে কোনও কোনও রাতে
ঘুম থেকে তুলে পালিয়ে যাওয়া যাবে,
সারারাত অকাজ করে ভোর হলে আবার অকাজে মন দেব,
সারাদিন অকাজে দিন যাবে,
রাজি?
অভিশাপ
প্রেম আমাকে একেকবারে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে,
আমি আর আমি নেই, আমাকে আমি আর চিনতে পারি না,
আমার শরীরটাকে পারি না, মনটাকে পারি না।
হাঁটাচলাগুলোকে পারি না,
দৃষ্টিগুলোকে পারি না,
কী রকম যেন অদ্ভুত হয়ে যাচ্ছি, বন্ধুদের আড্ডায় যখন হাসা উচিত
আমি হাসছি না, যখন দুঃখ করা উচিত, করছি না।
মনকে কিছুতেই প্রেম থেকে তুলে এনে অন্য কোথাও মুহূর্তের জন্য
স্থির করতে পারি না।
পুরো জগতটিতে এখন অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে,
চাঁদ সুর্যের ঠিক নেই, রাত দিনের ঠিক নেই,
আমার জীবন গেছে, জীবন-যাপন গেছে,
নাশ হয়ে গেছে।
এখন শত্রুর জন্য যদি অভিশাপ দিতে হয় কিছু, আমি আর
বলি না যে তোর কুষ্ঠ হোক,তুই মরে যা, তুই মর।
এখন বড় য়চ্ছন্দে এই বলে অভিশাপ দিয়ে দিই —- তুই প্রেমে পড়।
আমেরিকা
কবে তোমার লজ্জা হবে আমেরিকা?
কবে তোমার চেতন হবে আমেরিকা?
কবে তোমার সন্ত্রাস বন্ধ করবে তুমি আমেরিকা?
কবে তুমি পৃথিবীর মানুষকে বাঁচতে দেবে আমেরিকা?
কবে তুমি মানুষকে মানুষ বলে মনে করবে আমেরিকা?
কবে এই পৃথিবীটাকে টিকে থাকতে দেবে আমেরিকা?
শক্তিমান আমেরিকা, তোমার বোমায় আজ নিহত মানুষ,
তোমার বোমায় আজ ধ্বংস নগরী,
তোমার বোমায় আজ চূর্ণ সভ্যতা,
তোমার বোমায় আজ নষ্ট সম্ভাবনা,
তোমার বোমায় আজ বিলুপ্ত স্বপ্ন।
কবে তোমার হত্যাযজ্ঞের দিকে তাকাবে, কুৎসিত মনের দিকে,
কলঙ্কের দিকে তাকাবে আমেরিকা,
কবে তুমি অনুতপ্ত হবে আমেরিকা?
কবে তুমি সত্য বলবে আমেরিকা?
কবে তুমি মানুষ হবে আমেরিকা?
কবে তুমি কাঁদবে আমেরিকা?
কবে তুমি ক্ষমা চাইবে আমেরিকা?
আমরা তোমার দিকে ঘৃণা ছুঁড়ে দিচ্ছি আমেরিকা,
আমরা ঘৃণা ছুঁড়তে থাকবো ততদিন, যতদিন না তোমার মারণাস্ত্র ধ্বংস করে তুমি হাঁটু
গেড়ে বসো, ঘৃণা ছুঁড়তেই থাকবো যতদিন না তুমি প্রায়শ্চিত্য করো, আমরা ঘৃণা ছুঁড়বো,
আমাদের সন্তান ছুঁড়বে, সন্তানের সন্তান ছুঁড়বে, এই ঘৃণা থেকে তুমি পরিষনাণ পাবে না
আমেরিকা।
তোমার কত সহস্র আদিবাসীকে তুমি খুন করেছো,
কত খুন করেছো এল সালভাদরে,
খুন করেছো নিকারাগুয়ায়,
করেছো চিলিতে, কিউবায়,
করেছো পানামায়, ইন্দোনেশিয়ায়, কোরিয়ায়,
খুন করেছো ফিলিপিনে,
করেছো ইরানে, ইরাকে, লিবিয়ায়, মিশরে, প্যালেস্তাইনে,
ভিয়েতনামে,
সুদানে, আফগানিস্তানে
— মৃত্যুগুলো হিসেব করো,
আমেরিকা তুমি হিসেব করো, নিজেকে ঘৃণা করো তুমি আমেরিকা।
নিজেকে তুমি, এখনও সময় আছে, ঘৃণা করো।
এখনও তুমি তোমার মুখখানা লুকোও দু হাতে,
এখনও তুমি পালাও কোনও ঝাড় জঙ্গলে,
তুমি গ্লানিতে কুঁকড়ে থাকো,
কুঁচকে থাকো, তুমি আত্মহত্যা করো।
থামো,
একটু দাঁড়াও।
আমেরিকা তুমি তো গণতন্ত্র, তুমি তো স্বাধীনতা!
তুমি তো জেফারসনের আমেরিকা,
লিংকনের আমেরিকা,
তুমি মার্টিন লুথার কিংএর আমেরিকা,
তুমি রুখে ওঠো,
রুখে ওঠো একবার, শেষবার, মানবতার জন্য।
আরও প্রেম দিও
আরও প্রেম দিও আমাকে, এত অল্প প্রেমে আমার হয় না, আমি পারি না।
আরও প্রেম দিও, বেশি বেশি প্রেম দিও
যেন আমি রেখে কুলিয়ে উঠতে না পারি,
যেন চোখ ভরে,
হৃদয়ের সবকটি ঘর যেন ভরে যায়
যেন শরীর ভরে, এই তৃষ্ণার্ত শরীর।
প্রেম দিতে দিতে আমাকে অন্ধ করে দাও,
বধির করে দাও, আমি যেন শুধু তোমাকেই দেখি,
কোনও ঘৃণা, কোনও রক্তপাত যেন আমাকে দেখতে না হয়,
আমি যেন আকাশপার থেকে ভেসে আসা তোমার শুভ্র শব্দগুলো শুনি,
কোনও বোমারু বিমানের কর্কশতা, কারও আর্তনাদ, চিৎকার আমার কানে যেন না
পৌঁছোয়।
দীর্ঘকাল অসুখ আর মৃত্যুর কথা শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত
দীর্ঘকাল প্রেমহীনতার সঙ্গে পথ চলে আমি ক্লান্ত,
আমাকে শুশ্রুষা দাও, স্নান করিয়ে দাও তোমার শুদ্ধতম জলে।
যদি ভালো না বাসো, তবে বোলো না কিন্তু যে ভালোবাসো না,
মিথ্যে করে হলেও বোলো যে ভালোবাসো,
মিথ্যে করে হলেও প্রেম দিও,
আমি তো সত্যি সত্যি জানবো যে প্রেম দিচ্ছ,
আমি তো কাঁটাকে গোলাপ ভেবে হাতে নেব,
আমি তো টেরই পাবো না আমার আঙুল কেটে গেলে কাঁটায়,
রক্ত শুষে নেবে আঙুল থেকে, এদিকে ভাববো বুঝি চুমৃ খাচ্ছে!।