বিবি খাদিজা
সে এমন সময়, কন্যা জন্মালে পুঁতে ফেলতে হত মাটিতে।
খাদিজা কিন্তু কারও না কারও কন্যা ছিল
কে কেউ পুঁতে ফেলেনি, সে বরং চুটিয়ে বাণিজ্য করেছে
টাকার থলে ভারি ছিল বলে তার পায়ের কাছে নত হয়েছে পুরুষ,
এমনকি মহাপুরুষও।
থলে ভারি বলে সে বুড়ি হয়েও তুড়ি বাজিয়ে গেল,
পুরুষের বহুগমন বন্ধ হল আপাতত
দিব্যি প্রেমিকের মত খুঁটি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল পুরুষ,
এমন কি মহাপুরুষও।
ধর্মও ধুলোয় গড়ায় কড়ির শব্দ শুনে।
ভালবাসার ভার
ভালবাসা মহানন্দে চেপেছে আমার ঘাড়ে
এত ন্যুজ,
কুঁজো,
আমি ভালবাসার ভারে–
ক্ষয় বাড়ে শরীরের হাড়ে।
ইচ্ছে করে পালকের মত
উড়ি,
ঘুরি ফিরি
অনায়াসে ভাঙি কুড়িতলার সিঁড়ি
ছিঁড়ি
সুতো জড়িয়েছি জীবনে যত।
মন নেই
এ শহরে টাকা ওড়ে, যে পারে সে ধরে
যাদের জোটেনা, যাদের দায় দেনা
তারাও তক্কে তক্কে থাকে লাখপতি হতে
চতুর্কোণ পাল উড়িয়ে ভেসে জনস্রোতে।
সব আছে, ঘর বাড়ি, গোটা দুই গাড়ি,
বারান্দায় ক্যাকটাস, ফুলের বাগান
পরবে উৎসবে বেসুরো বেতাল নাচ গান,
চৌরাশিয়ার বাঁশি, থেকে থেকে অট্টহাসি।
সবই আছে কেবল মন নেই কোথাও
অতলান্তিক পারি দাও, যে রাস্তায় হাঁটো বা যে বাঁকেই দাঁড়াও।
মা কষ্ট পেলে আমাদের কিছু যায় আসত না
আমার একটি মা ছিল
চমৎকার দেখতে একটি মা,
একটি মা আমার ছিল
মা আমাদের খাওয়াত শোয়াত ঘুম পাড়াত,
গায়ে কোনও ধুলো লাগতে দিত, পিঁপড়ে উঠতে না,
মনে কোনও আঁচড় পড়তে দিত না
মাথায় কোনও চোট পেতে না।
অথচ
মাকে লোকেরা কালো পেঁচি বলত,
আমরাও।
বোকা বুদ্ধু বলে গাল দিতাম মা’কে।
মা কষ্ট পেত।
মা কষ্ট পেলে আমাদের কিছু যায় আসত না।
আমাদের কিছুতে কিছু যায় আসত না,
মা জ্বরে ভুগলেও না,
মা জলে পড়লেও না,
মা না খেয়ে শুকিয়ে কাঁটা হয়ে গেলেও না
পরণের শাড়ি ছিঁড়ে ত্যানা হয়ে গেলেও না,
মা’কে মা বলে মনে হত, মানুষ বলে না।
মা মানে সংসারের ঘানি টানে যে
মা মানে সবচেয়ে ভাল রাঁধে যে, বাড়ে যে,
কাপড় চোপড় ধুয়ে রাখে গুছিয়ে রাখে যে
মা মানে হাড় মাংস কালি করে সকাল সন্ধে খাটে যে
যার খেতে নেই, শুতে নেই, ঘুমোতে নেই
যার হাসতে নেই
যাকে কেবল কাঁদলে মানায়
শোকের নদীতে যার নাক অবদি ডুবে থাকা মানায়
মা মানে যার নিজের কোনও জীবন থাকে না।
মা’দের নিজের কোনও জীবন থাকতে নেই!
মা ব্যাথায় চেঁচাতে থাকেলে বলি
ও কিছু না, খামোকা আহ্লাদ!
মরে গেলে মাকে পুঁতে রাখে মাটির তলায়,
ভাবি যে বিষম এক কর্তব্য পালন হল
মা নেই।
আমাদের এতেও কিছু যায় আসে না।
মৃত্যু যদি আছেই
মৃত্যু যদি আছেই,
যদি বসেই আছে কোথাও ঝোঁপঝাড়ে ওত পেতে,
দরজার আড়ালে, ছাদে, অন্ধকার গলিতে, চৌরাস্তায়
আসবেই যদি কাছে
তবে আজই কেন নয়!
সন্ধায় যখন বারান্দায় দাঁড়াব একা
কেউ খুঁজবে না,
কেউ ডাকবে না ভেতর ঘর থেকে,
কেউ আসবেনা রাখতে একটি হাত কাঁধে
কেউ বলবে না ‘কী চমৎকার চাঁদ উঠেছে দেখ।‘
যদি মৃত্যুর হাতে দিতেই হয় যা আছে সব,
তবে আজ নয় কেন?
আজ সে আসুক,
আজই শেষ হোক শূন্যতার সঙ্গে আমার বেহিশেবি সংসার।
যদি
কাউকে বাঁচতে দেখলে অসম্ভব রাগ হয় আমার।
পৃথিবীর সব গাছ যদি মরে কাঠ হয়ে যেত
পাহাড়গুলো ধসে পড়ত বাড়িঘরের ওপর,
নদী সমুদ্র শুকিয়ে চর হয়ে যেত, সেই চরে
পশুপাখি মানুষ এক বিষম অসুখে কাতরে কাতরে মরে যেত!
কদাকার পিন্ডটি যদি মহাকাশে ছিঁড়ে পড়ত হঠাৎ,
সূর্যের দু’হাত কাছে গিয়ে ঝলসে যেত, ছাই হয়ে যেত!
এরকম স্বপ্ন নিয়ে আজকাল আমি বেঁচে থাকি
আর এই বেঁচে থাকার জন্য প্রতিদিন বিবমিষা, প্রতিদিন ঘৃণা…
যদি যেতে চাও
যদি যেতে চাও, এভাবেই যেও–
ঠিক যেভাবে গেছ
ঠিক যেভাবে, আলগোছে, টের না পাই
দরজা আধখোলা রেখে
ফিরে আসবে ভেবে যেন কোনওদিন খিল না দিই।
যেও, যেতেই যদি হয়–দু চারটে কাপড় ভুল করে
আলনায় ফেলে–এভাবেই
স্নানঘরে রেখে যেও তোয়ালে
এক জোড়া চপ্পল–এভাবেই।
দমকা বাতাসও কড়া নাড়ে সময় সময়
কোনও কোনও রাতে এরকমও ভেবে নেব, বুঝি ফিরেছিলে
বেঘোরে ঘুমিয়েছিলাম বলে চলে গেছ।
রাতে
যখন ঘুমিয়ে যায় পৃথিবীর মানুষ,
চাঁদ থেকে নিঃশব্দে নেমে আকাশ-বারান্দায় সে দাঁড়ায়
কিছুক্ষণ উদাসিন হাঁটে
তারপর কী ভেবে মেঘের পাখা পরে নেমে আসে
নিচে, জামা খুলে স্নান করে কাছের পুকুরে
স্নান শেষে ভেজা চুল ভেজাই থাকে,
পাড়ে বসে মিহি গলায় কাকে যেন ডাকে, কে জানে কাকে!
তারপর
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বুড়ো শিমুলের ডালে ফাঁসিতে ঝোলে সে।
গা থেকে অচেনা ফুলের ঘ্রাণ ভেসে
কিছু কষ্টকাতর মানুষকে রাতভর জাগিয়ে রাখে…
আমিও জেগে থাকি।
রাস্তার ছেলে আর কবি
এ গল্প আগেই করেছি, ওই যে ছোটবেলায় একদিন নদীর ধারে হাঁটছিলাম
আর ধা করে উড়ে এসে এক রাস্তার ছেলে আমার স্তন টিপে
দৌড়ে পালিয়ে গেল, অপমানে নীল হয়ে বাড়ি ফিরে সারারাত কেঁদেছিলাম!
এ গল্প এখনও করিনি যে বড় হয়ে, কবিতা লিখতে শুরু করে
কবিদের আড্ডায় যেই না বসি,
হাতির মত কবিরা স্তন টিপে দিয়ে চলে যায়।
পরদিন দেখা হলে বলে কাল খুব মদ পড়েছিল পেটে
মদের দোহাই দিয়ে কবিরা বাঁচে,
কবিতার দোহাই দিয়েও পার পায় বটে।