- বইয়ের নামঃ ভালোবাসো? ছাই বাসো!
- লেখকের নামঃ তসলিমা নাসরিন
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অতলে অন্তরীণ
তুমি আজকাল আমার বাড়িতে আসছো না আর। বাড়ি আসবে, আর
আততায়ীরা যদি আমাকে হত্যা করে, তোমার ভয়, কোনওদিক দিয়ে
কোনও গুলি ছিটকে তোমার গায়ে কোথাও লেগে যাবে।
মাঝে মাঝে ফোন কর, কেমন আছি টাছি জানতে চাও,
বাড়ি আসার কথা উঠতেই বল কী কী কারণে যেন ভীষণ ব্যস্ততা
তোমার।
তুমি আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। শুধু বন্ধু বলি কী করে, প্রেমিক ছিলে।
কোনও কারণে ব্যস্ততা বাড়তেই পারে তোমার, ভেবে নিজেকে
বুঝিয়েছি,
একা একা অন্তরীণে না হয় কাটালামই কিছু দিন। মানুষ তো
দ্বীপান্তরেও
শখ করে মাঝে মাঝে যায়।যেদিন জানলাম, আমার বাড়ি না আসার
আসল কারণ তোমার কী, ভয়ে আমি কুঁকড়ে পড়ে থাকলাম,
আততায়ীর চেয়েও বেশি ভয় আমি তোমাকে পেলাম।
অরণ্য, আপনি
১.
আপনি আশ্চর্য! কী করে পারেন চলে যেতে, ওভাবে!
আপনি তো জানেন আমি খুব মারত্মক রকম চাই আপনাকে,
এত চাওয়ার পরও দশটা বাজতেই দিব্যি আসি বলে স্বচ্ছন্দে চলে
যান,
কাল দেখা হবে বা ফোনে কথা হবে জাতীয় যাচ্ছেতাই প্রতিশ্রুতি দিয়ে
দিব্যি।
কী দরকার কাল দেখা হয়ে,
কাল কি কিছু অন্যরকম হবে! হবে তো সেই একই,
আকণ্ঠ পান করে আর করিয়ে স্পর্শের জন্য উন্মুখ প্রতিটি রোমকূপের
সামনে
মুলো নাচিয়ে আবারও বলবেন আগামীকালের কথা, যে, দেখা হবে।
এরকমই দিনের পর দিন আপনি পরের দিনের কথা বলতে থাকবেন
আর আমি শুনতে থাকবো, অরণ্য।
প্রতিদিনই পরের দিন আসতে থাকবে আর যেতে থাকবে,
আমরা কথা বলতে থাকবো পৃথিবীর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যা ঘটছে
বা ঘটতে যাচ্ছে তার সব কিছু নিয়ে।
টেবিল চাপড়ে দুচারটে বিপ্লব নামিয়ে আনবেন গরিবদের গলিতে,
যে কোনও দিকেই, মল থেকে মর্গ, বা ময়দান বা মোহনার দিকেও
চাইলে
ছুটতে পারবেন, কিছুতে অনিচ্ছের কিছু নেই।
আপনার চোখের দিকে, যে চোখ থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে চমৎকার প্রেম
নামাতে পারেন, প্রতিদিনই অসহায় তাকিয়ে থাকবো
তৃষ্ণা বাড়াতে বাড়াতে আমাকে আস্ত একটি মরুভুমি বানিয়ে ছাড়বেন।
অত ঢংএর কী দরকার অরণ্য,
উত্থানরহিত হলে সোজা বলে দিন যে উত্থানরহিত!
২.
প্রেমিক প্রেমিক ভাব অথচ প্রেমিক নন আপনি অরণ্য
আমি তো চাই আপনি প্রেমিক হন,
আমি তো চাই আপনি আমার সঙ্গে সারাদিন
আপনি সারারাত।
অমন চাওয়া আপনার গোটা বিশ্বের কোনও কানাগলিতেও নেই,
চোখ কান খোলা রাখা লাল পিঁপড়ের চেয়েও বেশি হিসেবি আপনি,
শীতের সঞ্চয় করেই তুষ্ট নন,
গ্রীস্মে, বর্ষায়, শরতে, হেমন্তে তলে তলে মজুদ রাখেন অঢেল।
ঘোর বসন্তেও সব অদ্ভুতরকম ঠিকঠাক থাকে।
আপনার হিসেবে আমার সব আছে,
কেবল আমি নেই,
আপনার জন্য আমার উপোস করা হৃদয় নেই।
প্রেমিক যদি নাই হন, তবে অত ভাবের দরকার কী,
ঘোষণা দিয়ে অপ্রেমিক হয়ে যান
আমি বাঁচি।
বুনো হাতিগুলোর মতো ক্ষিদে আপনার, আমাকে ফুরিয়ে ফেলে
যদি এতটুকু কষ্ট না হয়, তবে ফেলুন, বাঁচি।
আর তা যদি না হয়, তবে প্রেম দিন, বাঁচি।
নাহ অরণ্য, প্রেম তো ঠুনকো বাতাসা নয় যে চাইলেই সবাই বিলোতে
পারে।
আপনি না পারেন, আমি তো পারি,
আমার দয়ায় না হয় একবার বেঁচেই দেখুন অরণ্য।
৩.
এই যে আমার সবকিছু, আমার গদ্যপদ্য আপনাকে নির্ভাবনায় দিয়ে
দিতে পারছি,
এই আপনিই একদিন সব অস্বীকার করবেন,
বদ পুরুষের আড্ডায় টিটকিরি দিয়ে হাসবেন,
দুচারদিনের শুকনো সঙ্গমের গল্প বেশ রসিয়ে বলবেন।
জানি যে জীবন দিচ্ছি, তারপরও যে কোনওদিনই পিঠে ছুরি বসিয়ে
স্বচ্ছন্দে হেঁটে যাবেন।
কেউ কেউ এমন হয়, খুব মিঠেভাষী, খুব অনুদ্ধত, বিনত,
অথচ মুহূর্তে আততায়ী হয়ে যেতে পারে।
একফোঁটা বিশ্বাস নেই আপনাকে, তারপরও আপনার স্পর্শের জন্য
অপেক্ষা করে আমার রোমকূপ, আপনার চুম্বনের জন্য আমার ত্বক,
আপনার উন্মাদনার জন্য স্তন, নিভৃত যাষনার জন্য যোনি।
অপেক্ষা করে আমার ভিতর বাহির,
অপেক্ষা করে প্রেম।
আগুনের দিকে যাচ্ছি জেনেও যাচ্ছি,
কেউ কেউ এমন হয়, পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, তবু আগুন দেখলে আগুনের
দিকেই
যায়, যেতে চায়।
একদিন হয়তো ভুলেও যাবো অরণ্য কে ছিল, কী ছিল,
শুধু মনে থাকবে দুপুর-রোদের মতো কোনও এক শহরের কারও
জন্য
কোনও এক শীতবসন্ত জুড়ে দুর্দম্য তৃষ্ণা ছিল আমার।
৪.
সুদর্শন কোনও যুবক নন আপনি, অরণ্য
আপনার দিকে ফিরে আমি না তাকাতেও পারতাম।
কোনও নক্ষষন নন, নির্দোষ নির্দ্বিধ নন, আমায় নিমজ্জিত নন,
তারপরও এই যে আপনি সব এলোমেলো করে দিতে পারলেন
আমার,
সে কি আপনি আপনি বলে,
নাকি আমি মনে মনে একলা ছিলাম একশ বছর! তাই!
কিছু একটার প্রয়োজন ছিল আমার, নিয়ে বাঁচার!
নাকি অন্য কিছু!
আপনি হালকা তামাশার লোক,
মাস দু মাস পর আপনাকে ত্যাগ করলেও কিছু যেত আসতো না,
অথচ আপনার জন্য বছর ভর বসে থাকা, সে কি আপনি
নিস্পৃহ নির্জীব বলে! যাকে হিঁচড়ে নামাতে পারি আমার জোয়ারে।
নাকি অন্য কিছু!
নাকি ভালোবাসি!
ভালো কি মানুষ এমন অথর্বকে বাসে!
প্রেম বলে কিছু নেই ভারতবর্ষে, জানি।
এর নাম আপাতত মোহ দিয়ে পরস্পরকে চুম্বন করি চলুন।
আপনি মধ্য চল্লিশের ট্যারাচোখি পুরুষবাদী শঠ, চোখ কান নাক মাথা
বুজে
চুম্বন সারতে চাই। চুম্বনের জাদু যদি শঠতা সরাতে পারে, তবে নয় কেন!
কী জানি মনে নেই কাউকে কখনও আনখচুল বদলে ফেলার
প্রতিজ্ঞা করেছিলাম কী না কোথাও!
হতে পারে, নাও হতে পারে।
তা ছাড়া, কী হয় যদি ভালোবাসি! ভালোও তো বাসতে পারি,
সোনাঝুরি বনে মধ্যরাতের চাঁদ ভাসা আলোয় যদি পাশাপাশি হাঁটি,
হাতের কি কোনও শক্তি থাকে না ছুঁতে পাশের হাত!
৫.
ঢংয়ের রংয়ের লম্ফ ঝম্ফ চলছে চলুক,
যে যাই বলুক,
আপনি জানেন আমি জানি
শোয়াশুয়ি করতে গিয়ে কম হয়নি হয়রানি।
বাড়ির বউকে তুলসি পাতার মন্ত্র দিয়ে বাইরে এসেই শয়তানি
করুন করুন রক্তে আছে, রক্তের চেয়েও বেশি আছে মস্তিষ্কের কোষে
কোষে।
এই ফাগুনে দুদণ্ড কি সময় আছে কথা বলবেন বসে!
মাগনা মদের পিছন পিছন তুফান ছোটা একটুখানি কমিয়ে এনে বসবেন
কি?
লাভ হবে না এমন কথা দুটো চারটে বলার মতো মন আছে কি?
এই বঙ্গে বীরপুরুষের অর্থ হল যে করেই হোক রাখতে পারা দুদশখানা
প্রেমিকা।
আমার কাছে বীরপুরুষের থুরি ওই চামচিকাদের দর উঁচুতে তুলে
ধরেও পাঁচশিকা।
আমার জীবন আমার জীবন
কেউ নেই তা শেয়ার করার।
যেমন ইচ্ছে জীবন যাপন করছি আমি, বন্য হলে বন্য
এসবের তো সবই আপনি জানেন অরণ্য।
চিরকালের একা আমি একাই ছিলাম ভালো,
আপনি এসে ঝড়ের মতো নিবিয়ে দিয়ে আলো,
আরও বেশি একা করলেন, আরও ভয়াবহ। থাক সে কথা,অন্য কথা,
আমার কথা।
আপনি তো আর একলা নন, আপনার আসর সব ঋতুতেই জমকালো।
আপনি এত তুচ্ছ, এত তৃণ, তবু তৃণের দিকে বারেবারেই নুইতে হয়,
হৃদয় ছাড়া মেয়েমানুষের অন্য কিছুই শত্রু নয়।
৬.
যখন সুখ দিচ্ছেন আমাকে, অসুখ দিচ্ছেন বুঝিনি।
চুম্বনের জন্য বিযুক্ত করেছি ঠোঁট, গোপনে বিষ দিয়েছেন মুখে, বুঝিনি।
৭.
আপনার ব্যাধি নিয়ে আমি এখন ভেলায় শুয়ে আছি,
ভেসে ভেসে ভেলা ওপারে মৃত্যুর দিকে যাচ্ছে, দেখছেন যাচ্ছে।
যাচ্ছে, তাতে কী! আপনার উৎসবে কোনও জলের ছিটে তো লাগছে
না!
যারা ভালোবাসি, যারা বুঝি না হিসেব নিকেষ, তারা ভেসে যাচ্ছি
ওইপারে,
ওইপারে গলে গলে পড়ছে আগুন।
সূর্যাস্তের সৌন্দর্য মদ্যপান করতে করতে উপভোগ করতে
ভালোবাসেন, করবেন।
আপনার সবই তো বুঝি, শুধু ভালোবাসেননি, বুঝিনি।
অরণ্য, তুই
১.
আমার কাছে এই জীবনের মানে কিন্তু আগাগোড়াই অর্থহীন,
যাপন করার প্রস্তুতি ঠিক নিতে নিতেই ফুরিয়ে যাবে যে-কোনোদিন।
গ্রহটির এই মানবজীবন ব্রহ্মাণ্ডের ইতি-হাসে
এক পলকের চমক ছাড়া আর কিছু নয়।
ওইপারেতে স্বর্গ নরক এ বিশ্বাসে
ধম্মে কম্মে মন দিচ্ছে—কী হয় কী হয়—সারাক্ষণই গুড়গুড়ে সংশয়
—
তাদের কথা বাদই দিই, সত্য কথা পাড়ি
খাপ খুলে আজ বের করিই না শখের তরবারি!
মানুষ তার নিজের বোমায় ধ্বংস হবে আজ নয়তো কাল,
জগত টালমাটাল।
আর তাছাড়া কদিন বাদে সুয্যিমামা গ্যাস ফুরিয়ে মরতে গিয়ে
পৃথিবীকে পেটের ভেতর এক চুমুকে শুষে নিয়ে
দেখিয়ে দেবে খেলা।
সাঙ্গ হবে মেলা
জানার পরও ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিঁড়ে কামড়ে তুচ্ছ কিছু বস্তু পাওয়ার লোভ,
ভীষণ রকম পরস্পরে হিংসেহিংসি ক্ষোভ।
মানুষের—কই যাবে দুর্ভোগ!
তাকত লাগে ভবিষ্যতের আশা ছুঁড়ে করতে কারও মহানন্দে মুহূর্তকে
ভোগ।
ভালোবাসতে শক্তি লাগে, হৃদয় লাগে সবকিছুকেই ভাগ করতে সমান
ভাগে,
কজন পারে আনতে রঙিন ইচ্ছেগুলো বাগে?
ভুলে যাস এক মিনিটের নেই ভরসা,
তোর ওই স্যাঁতস্যাঁতে-সব-স্বপ্ন-পোষা কুয়োর ব্যাঙের দশা
দেখে খুব দুঃখ করি, দিনদিনই তোর বাড়ছে তবু দিনরাত্তির কাদাঘাটা,
অরণ্য তুই কেমন করে এত বছর কামড়ে আছিস দেড়দুকাঠা!
ধুচ্ছাই!
সমুদ্দুরে চল তো যাই!
২.
অরণ্য তুই আমার জন্য একবার মরে দেখ,
দেখ কেমন করে বাঁচাই আমি তোকে।
একবার ভালোবেসে দেখ,
দেখ কী ভয়ঙ্কর সুখে আমি মরি!
৩.
এই বর্ষায় তুই কোথায় কার সঙ্গে কী করছিস অরণ্য?
কার ঘরে আটকা পড়ে আছিস?
কার ওপর অঝোরে ঝরছিস তুই?
তোর উঠোনে বুঝি এবছরও ছুতোর হাঁটুজল?
আমার সঙ্গে যেমন যেমন করিস, তেমন কি অন্য কারও সঙ্গেও?
কে সেই অন্য কেউ?
ভালোবাসে আমার চেয়েও বেশি?
তা যদি হয় তো ভালোই আছিস,
এদিকে এসে সময় নষ্টের কী দরকার।
এদিকে তো আবার জানিস সত্যিকারের হাঁটুজল।
ওখানেও তোরা খিচুড়ি আর ইলিশের উৎসব করিস!
যার কাছে থাকিস
আমার মতোই বোধহয় সে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ইলিশ
কিনতে,
আমার মতোই বোধহয় মগ্ন থাকে তোকে নিয়ে সারাদিন
কী খাবি, কী পরবি, কোথায় বসবি, শুবি, কীসে খুব আনন্দ পাবি !
আর তোর ওই শরীরের প্রতিটা তিলে তিরিশটা করে চুমু। ও-ও হয়?
একটুখানি দূরে সরলে আমার মতোই বুঝি সে কষ্ট পায়?
আমার মতোই বা বলি কেন, নিশ্চয়ই আমার চেয়েও বেশি।
বেশি না হলে আমার আলিঙ্গণ থেকে ছলে-কৌশলে নিজেকে ছাড়িয়ে
তার কাছেই বা যাবি কেন!
অরণ্য সত্যিই কি তুই সুখে আছিস, আগের চেয়েও অনেক?
৪.
যে আমি এক মুহূর্ত প্রেম ছাড়া বাঁচি না,
তাকে তুই সাতদিন হয়ে গেল প্রেম দিচ্ছিস না,
তাকে তুই সাত কোটি বছর প্রেম দিচ্ছিস না অরণ্য।
তার ত্বকে এখন খরা, বুকের মধ্যে আস্ত একটা মরুভূমি,
ভরা বর্ষা তাকে এতটুকু ছুঁতে পাচ্ছে না,
সারারাতের বৃষ্টি তার একটি লোমকূপও ভেজাতে পারে না।
তোর আঙুলে কি জাদু ছিল অরণ্য?
কী করে স্পর্শ মাত্র নদী হয়ে উঠতাম,
কী করে চুমু মাত্র আনখসমুদ্দুর!
তুই নেই।
জগতটা লু হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে হঠাৎ
চুপসে গিয়ে কালো কোনও গর্তে ঢুকে গেছে।
চারদিকটা হঠাৎ খুব অসহ্যরকম ফাঁকা।
তুই নেই, মাঝে মাঝে মনে হয় আমি বোধহয় আর বেঁচে নেই ।
৫.
মনে মনে মুক্তি চাস তো অরণ্য!
সেই মুক্তিই তোর জুটে যাচ্ছে, এক শরীর স্বাধীনতা পাবি,
রঙিন রঙিন ডানা পাবি। আস্ত একটা আকাশ পাবি।
ফাঁকা আছে কিনা জানতে চেয়ে কাকে এসএমএস করছিস,
কাকে দিকশূন্যপুরে নিযে গেলি, কাকে চুমু খেলি, কার সঙ্গে শুয়ে এলি,
এসব নিয়ে এখন আর পাগল হবো না।
তোকে এখন ততটাই ভালোবাসতে চাই যতটা বাসলে
অন্য কোনও রমণীকে তুই চুমু খেলে কোনও যন্ত্রণা হবে না আমার,
একশ সুন্দরীর সঙ্গে সারারাত সঙ্গম সারলেও কিছু যাবে আসবে না,
কারও প্রেমে উন্মাদ হলেও কোথাও কোনও ক্ষরণ হবে না।
আর কী চাই তোর, অরণ্য।
আমি এখন তোকে ততটাই ভালোবাসতে চাই
যতটা বাসলে মুঠো−ফান বাজলেই মনে হবে না এ তুই,
এসএমএসের শব্দ পেয়ে মনে হবে না এ তোর,
দরজায় কেউ এলে তোকে ভেবে দৌড়ে যাবো না।
এখন ততটাই ভালোবাসতে চাই,
যতটা বাসলে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামলে তোকে কাছে পেতে ইচ্ছে হবে
না,
সামনে এসে দাঁড়ালে হাত ছুঁতে হাত যাবে না তোর হাতের দিকে।
যতটা বাসলে চুমু খেতে ঠোঁট বাড়াবো না, যতটা বাসলে ভিজবো না
ভিতরে বাইরে একফোঁটা।
ততটাই তোকে ভালোবাসবো অরণ্য দেখে নিস, যতটা বাসলে
কোনওদিন আর দেখা না হলেও মনে হবে না দেখা হলে ভালো হত।
৬.
কতদিন এভাবে ভালো তোকে বেসেই যাবো, অরণ্য?
আর কতদিনই বা এভাবে ভালো তুই বেসেই যাবি, বল!
একদিন, মানুষ তো কোনও একদিন নিজের মুখোমুখি দাঁড়ায়!
ছিটেফোঁটা মানুষ যদি অবশিষ্ট থাকে ভেতরে কোথাও
খুঁজে তাকে সামনে আনে একদিন।
ধোঁকা দিতে দিতে, ঠকাতে ঠকাতে, মিথ্যে বলতে বলতে
একদিন থামে, সত্য বলে।
মানুষ তো একদিন দুঃখ পায়, একদিন কাঁদে।
তেমন একদিন তো তোর জীবনে কোনওদিন আসে না অরণ্য,
নন্দিনীর কাছেই ফিরিস প্রতি রাতে, মধ্যরাত হলেও ফিরিস।
নন্দিনীর কাছেই তোর নতমুখ, নতচোখ,
ওকেই মনে মনে দেবী মানিস। আসলেই কি মানিস?
আজ আমি, কাল সে যা কিছুই হোক
নন্দিনী যেন ঠিকঠাক থাকে, যেমন আছে
বাচ্চাজ্ঞশশুর মতো হাসিখুশি, যেন কিছু না বোঝে, কোনও কষ্ট যেন
কখনও না পায়
যেন একবারও না ভাবে ছেড়ে গেছিস।
কী করে পারিস যাপন করতে প্রতিদিন তোর
দ্বিচারী ষিনচারী চতুর্চারী জীবন!
কতদিন তোকে হেঁদিপেঁচির মতো ভালোবাসবো বল!
এবার একটু মানুষ হতে দে অরণ্য, তোকে চোখের আড়াল করি।
মানুষ হই, তোকে না ভালোবাসি।
মানুষ হই, তোকে দুঃখ দিই।
অরণ্য, তুমি
১.
চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছো তুমি, অরণ্য,
আমি জগত দেখতে পাচ্ছি না।
অন্ধকার ছুঁড়ে ছুঁড়ে ইন্দ্রিয়গুলো বুজিয়ে দিয়েছো,
কাউকে শুনতে পাচ্ছি না, নিজের আর্তস্বরও নয়।
কেবল তোমাকে শুনছি,
তোমার মিথ্যে,
তোমার ছল-কৌশল,
তোমার ফণা, প্রতারণা।
তুমি আমাকে গ্রাস করছো,
গ্রহণ লেগেছে গায়ে, হৃদয়ে ঢুকে গেছে রক্তচোষা জোঁক,
রোমে রোমে নিশ্চিহ্ন হলাম।
আমার ভিতর বাহিরে এখন যে আছে সে আমি নই, অন্য কেউ।
ইচ্ছে ছিল তোমাকে গড়ে পিটে সভ্য করবো,
অথচ তোমার হাতেই দেখি বাগে আনার চাবুক,
লাগাম এমনই টেনেছো যেন তোমার ঠোঁটজোড়া ছাড়া
কিছুই থাকে না নাগালে,যেন খেলে তোমাকেই চুমু খাই।
দুটো তিনটে ক্যাভেরটা সেবনে এমনই পুরুষ হয়েছো
যেন তোমার উত্থান, এক তোমার উত্থানই মেটাতে পারে আমার রাক্ষুসে
ক্ষিধে।
ওভাবে দাঁড়িয়ে থেকো না অরণ্য,
আমি জগত দেখতে পাই না।
সবকিছু অক্ষত তোমার, সংসারের হিসেব, স্ত্রীপুত্র, সন্ধের মদ।
সবই তো বোঝো, সোনাগাছি রূপাগাছি, নন্দন চন্দন,
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িবাড়ি, অর্থকড়ি, যশখ্যাতি সব বুঝে সারা,
শুধু ভালোবাসা বোঝো না, সে কি আর বুঝেছিলে কোনওদিন!
ইচ্ছে ছিল প্রেমিক হও,
সব উজাড় করে উপুড় করে
ঢেলে দেখি আর যা কিছুই হয়েছো, কবি বা ব্যাবসায়ী, প্রেমিক হওনি।
ও মুরোদ সবার থাকে না। যা তুমি, তাই থাকো,
তোমাকে সভ্য হতে হবে না, মানুষ হতে হবে না, প্রেমিক হতেও না।
শুধু চোখের সামনে থেকে সরো,
পাশে বা পিছনে দাঁড়াও।
আমি যেন অন্তত আমি হই।
২.
আমাকে তুমি পাগল বানিয়ে ছাড়বে অরণ্য।
আরও বিরাট হয়ে বিকট হয়ে চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছো,
চোখ আমার দিন দিন ঘোলা হচ্ছে, ঘোলা হতে হতে অন্ধ।
আমি কি কবন্ধ,
তোমাকে পাথর ছুঁড়ে কেন সরাচ্ছি না!
আমার জীবন-যাপনে কী জানি কী করে ঢুকে পড়ে এখন হল্লা করছো,
যেন আমার সংসার আসলে তোমার সংসার,
আমার ঘর−দার আসবাব তোমার,
বাসনকোসন, ব্যাংকের যাবতীয়, বাগানের ফুল, বইপষন সব তোমার,
সেলারের মদগুলো তোমার, রেশমি কাবাব তোমার, স্নানঘর তোমার,
আমার বিছানা বালিশ তোমার, শরীর তোমার।
এত দাপট দেখাচ্ছে! যেন তোমার আমি খাই পড়ি,
যেন তোমাকে না হলে আমি মরে যাবো,
হৃদপিণ্ড ঝুলে থাকবে, ফুসফুসে শ্যাওলা পড়বে।
দরজা সেঁটে দাঁড়িয়ে আছো,
কোনও আগন্তুককে আমন্ত্রণ জানাবে না,
বেমককা গুঁতো দেবে আমন্ত্রিতর পেটে,
কেবল তোমার অনুমোদিত অতিথিকে আসন দেবে তুমি।
চোখ দুটোয় রক্তজবা, সে জানো?
আমি পালাতে চাইলেই খপ করে ধরে ফেল
যেন আমার জীবন আসলে তোমার,
আমার হৃদয়ও তোমার তিন বা চার ইঞ্চি আধ-অকেজো শিশ্নের জোরে
তোমার।
তোমার বোতল থেকে দৈত্য বেরিয়ে এসেছে,
ছিপি চেপে বেশিদিন রাখতে পারোনি।
বোতল থেকে আসলে তুমিই বেরিয়েছো,
ন্যাংটো গায়ে নোংরা লাগা, শিশ্নে বীর্যের আঠা
কারও যোনি থেকে এই সবে উঠে এসে তড়িঘড়ি প্রেমিক সেজেছো।
আধিপত্য চাও, অরণ্য?
কাউকে সিঁদুর শাঁখা পরিয়ে বশে রাখো,
কাউকে প্রেম দিচ্ছে! দাবি করে বশে,
সারাদিন মনে মনে ধর্ষণ করো যেখানে যে নারীকেই দেখ।
তুমি পুরুষ বলে তোমার ছোঁকছোঁক মাফ!
পুরুষ বলে লাম্পট্য মাফ!
তোমাকে আর যা কিছুই দিতে পারি, আধিপত্য পারি না অরণ্য।
টন টন প্রেম নেবে নাও,
নিযে যা কিছুই করো,
গঙ্গায় ছোড়ো কী কোথাও পুঁতে রাখো সে তোমার খুশি।
যতবার ইচ্ছে করো শুতে,
শুতে পারো পুরোনো বীর্যের আঠা ধুয়ে বা না ধুয়ে
মিথ্যে তোমাকে বলতেই হয় তুমি ভালোবাসো,
মিথ্যে তোমাকে উচ্চারণ করতেই হয় তুমি এক আমাকেই।
এই দাপট এখনও তোমার নেই যে
ভালোবাসার কথা না বলে ঠোঁট ছোঁবে,
বুকের এত পাটা তোমার নেই যে
কেবল শরীরের জন্য বলবে শরীর স্পর্শ করছো।
জানি না জানো কী জানো না যে ভালোবাসতে যেমন পারি,
না বাসতেও ঠিক ততটুকু পারি আমি।
তোমার ওই আধ-অকেজো শিশ্নকে কেজো করার জন্য
এক ফোঁটা প্রেমের প্রয়োজন পড়ে না, অরণ্য।
শোনো, শুনে রাখো, ভালো তোমাকে না বেসেই আমি চুমু খাই,
শরীরের জন্যই স্পর্শ করি তোমার শরীর।
আমি তো আমিই ছিলাম এতকাল,
এখন ইচ্ছে করেই তোমার সঙ্গে তোমার মতো হই, অরণ্য।
বোঝো?
৩.
তোমার কি আর বোঝার মন আছে !
মন যদি কোনওকালে ছিল, তাকে ছড়িয়েছো ছষিনশদিকে,
এত টুকরো টুকরো করেছো যে মন আর মন নেই,
তুমিও এখন আর ঠিক ঠিক চিনতে পারো না কোনওটিকে।
ভাসিয়েছিলে তরুণীর তরে তরী, বাণিজ্য-বাঁধনে ছিলে।
হর্ষে কর্ষেছিলে, বর্ষেছিলে,
খুশি ছিলে,
আহলাদে আরামে ছিলে, ভেবেছিলে ছিলে।
এখন মন খুঁজতে গিয়ে দেখ
তোমার আস্ত শরীরের কোনও আনাচ কানাচে নেই,
টুকরোগুলো যষনতষন, খালে বিলে খাবি খাচ্ছে।
মনকে একষন করো একদিন, একাগ্র করো একদিন,
অরণ্য, সমৃদ্ধ হও,
দেখে দেখে তোমাকে মুগ্ধ যেন হই, মুগ্ধ হতে দাও।
যত বলি, যত যাই বলি যে ভালো না বেসে স্পর্শ করছি তোমাকে,
বিশ্বাসও করতে চাই প্রাণপণে যে শরীরের জন্যই শরীর,
আমাকে শরম দিয়ে, গোহারা হারিয়ে দিয়ে, অভিমানের পুরু প্রলেপ
ভেঙে
বেরিয়ে আসে আমার বীভৎস প্রেম।
এ আমার সঙ্গে আমার লড়াই, তোমার ভূমিকা অতি সামান্য অরণ্য।
মনকে একাগ্র করে সে মন যাকে ইচ্ছে তাকে দিও,
না দিতে চাও তো রেখে দিও।
ভিক্ষে চাইছি না, চাইনি কোনওদিন।
পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে যদি মানুষ না পাও দেবার,
তবেই এদিকে ফিরে চেও, না দিয়ে না পারো যদি, তবেই দিও।
৪.
কথা বলেছি ওই সুদর্শন যুবকের সাথে, তার সাথে,
তাতে তোমার কী অরণ্য?
তুমি কেন চিল্লিয়ে বাড়ি ফাটাচ্ছে!?
বাপ মা তুলে গাল দিচ্ছ, গালে শক্ত শক্ত চড় দিচ্ছা
ভালোবাসা দেখাচ্ছে!?
ছাই ভালোবাসো, মদে চুর হয়ে দুনিয়া উল্টে ফেলবে ভাব,
চুলের মুঠি ধরে আমাকে টানছো, ধাককা দিচ্ছ দেওয়ালে,
কব্জির জোর দেখাচ্ছে!, অথচ কব্জি উল্টে উল্টে কিন্তু
ঠিকই দেখে নিচ্ছ কটা বাজলো
সময় হলেই বাড়ি যাবে,
ওখানে তোমার নন্দিনী ভাত বেড়ে বসে আছে,
ওখানে নন্দিনী এলোমেলো শুয়ে,
আধো ঘুম তার ভাঙাবে আলতো ছুঁয়ে,
চোখের পাতায় চুমু খেয়ে চোখ খোলাবে, দেখাবে তোমাকে,
স্ত্রৈণ তোমাকে, নতমুখ নতজানু কর্তব্যপরায়ণ বিবেকি পুরুষকে।
ওখানে আমি নেই, আমার গল্প নেই, বিন্দুবিসর্গ নেই,
ওখানে হাসি মুখ, ওখানে ডিম দুধ, মাছ মাংস,
ওখানে সন্তান, বংশের দীপ, ওখানে ভবিষ্যৎ,
স্ফটিক-য়চ্ছ জলে খলসে মাছের সাঁতার।
ওখানে স্বজন বন্ধু, প্রতিবেশি,
ফুসফুসে শুদ্ধ হাওয়া,
ওখানে তুমি কত্তা,
আহ, নিটোল নিরাপত্তা।
চার দেওয়ালে আটকে রাখতে চাইছো,
অন্ধকারের আড়ালে,
মুঠোর মধ্যে পুরতে চাইছো সবটা,
আমার দখল চাইছো তুমি,
আমার ইচ্ছে অনিচ্ছে চাইছো,
গতরে অন্তরে স্ট্যাম্প মেরে মালিকানা চাইছো।
চোখ যেন অন্য কোনও যুবকের দিকে না ফেরে,
চোখ তুমি খুবলে আনতে চাইছো দশ নখে,
দাঁতে ছিঁড়তে চাইছো আমার স্তনবৃন্ত যেন কেউ ঠোঁট ছোঁয়াতে না পারে,
জ্বলন্ত শিক ঢুকিয়ে পুড়িয়ে দিতে চাইছো যৌনাঙ্গ,
হৃদয় মোহর করে দিতে চাইছো।
তুমি কি মানুষ অরণ্য?
যে কোনও পুরুষের মতোই পুরুষ তুমি।
দীন, হীন,
যে কোনও পুরুষের মতোই লোভী,
স্বার্থে অন্ধ। অনুদার, কুৎসিত।
নন্দিনীকে শেকল পরিয়েছো, আমাকেও পরাবে পণ করেছো ।
যারই সান্নিধ্যে যাও, যে-ই তোমাকে না-বুঝে না-দেখে ভালোবাসে
তাকেই খামচে কামড়ে পরাতে চাও শেকল।
সারা শরীরে তোমার ঝনঝন আওয়াজ, অরণ্য,
মানুষ পেঁচাতে পেঁচাতে নেশাগ্রস্ত এখন মানুষ পেঁচিয়ে বাঁচো।
দখলি-দারের লোল গড়াচ্ছে তলপেটে পেটে,
মুহূর্মুহু মালিক হবে মাংসের।
দূরারোগ্য দম্ভ-রোগে ভুগছো তিনকাল,
অন্যের স্বাধীনতাই এখন দাওয়াই বটে
তোমার-ঘোলা-জলে গুলে গুলে সারাদিন অপ্রকৃতস্থের মতো তাই খাও।
মেগালোম্যানিয়ার কিলবিলে কীট কুরে খাচ্ছে তোমাকে,
তোমাকে করুণা করি,
তোমার শতচারী শরীরে শতবার থুতু দিই।
কিছু কম ঘৃণা হলে একশ সুদর্শনের সঙ্গে রমণ করে দেখাতাম
স্বাধীনতা কাকে বলে।
বেশি ঘৃণা বলে তোমার তো নয়ই, তোমার জাতেরও স্পর্শ নেব না, না।
গেট লস্ট ইডিয়ট ছাড়া আপাতত আমার মুখে
প্রেমের অন্য কোনও বাক্য অবশিষ্ট নেই।
৫.
দুহাত পেতে ভিক্ষে চাইছো ক্ষমা,
তুমি কি জানো যোগের ঘরে শূন্য করেছো জমা !
বিয়োগের ঘরে কম করে বলি দুকোটি,
মনে আছে কেড়ে নিয়েছিলে সব, ছাড়ো নাই খড়কুটোটি!
তুমি বুঝি আর ছোটখাটো বদমাশ!
চুমু খেতে খেতে পরিয়েছো ফাঁস,
আমারই খেয়ে আমারই পরে আমারই সর্বনাশ।
ক্ষমার প্রশ্ন ওঠে না শুনেই অন্য আঁচলে ঝাঁপ,
দুধ কলা দিয়ে চিরকালই আমি পুষলাম কালসাপ।
৬.
তোমাকে এখন অনেক দূরের মানুষ মনে হয় অরণ্য,
সন্ধেটা কাটাতে তুমি আসো, মামুলি কিছু কথার পুনরাবৃত্তি করো,
চুমু না খেলে কী আবার ভেবে বসি বলে চুমুও দুতিনটে খাও।
সঙ্গমের জন্য গায়ের কাপড়চোপড় এমন করে খোলো
যেন সারাদিন রোদে ভিজে বাড়ি ফিরে পায়ের মোজা খুলছো,
খুলে আমার শরীর নিয়ে যা করো তা নিতান্তই দুপুরবেলার স্নানের
মতো,
স্নান সেরে টেবিলের বাড়া ভাতে হাত ডোবাবার মতো, খেয়ে ঢেঁকুর
তুলে বিছানায় ভাতঘুম দেওয়ার মতো, দিয়ে এলিয়ে কেলিয়ে বিকেলের
বেরিয়ে যাওয়ার মতো।
আমাকে কি বাড়ির বউ পেয়েছো অরণ্য?
আমি কি দীর্ঘ দু যুগ ধরে সংসার করা তোমার অভ্যেসের জিনিস!
ঘন কুয়াশার দিকে বুঝে না বুঝে দৌড়ে যাচ্ছে! তুমি
তোমার সন্ধেবেলার মুখকে প্রতিদিনই খুব নতুন নতুন লাগে,
তোমার মুখের মতো মুখ, অথচ ঠিক তোমার নয়।
তোমাকে স্পর্শ করি, অথচ ঠিক তোমাকে নয়।
ছটফট করা একটি মন বুকে না কোথায় বসে থাকতো,
তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে কোথায় কোন অরণ্যে নিয়ে গেছো, অরণ্য!
তুমি এখন অনেকটা এলেও যা না এলেও তা-এর মতো,
অনর্গল বকো বা অন্যমন বসে থাকো, একই।
শ্যাওলা ফেলে ফেলে চোখদুটো এমন করেছো যে আর পড়তে পারি
না।
তুমি কি চাইছো না পড়ি!
একটু একটু করে মরে যাবে ভেবেছো বলেই কি তুমি মরে যাচ্ছে! !
একটু একটু করে আমাকে মারবে বলেই কি তুমি মরছো, অরণ্য?
৭.
তুমি চলে যাও, পেছন পেছন আমিও যাই
যে আমিটি হাসি খেলি আনন্দ করি,
সাঁতরে সাঁতরে ওইপার যাই,
যে আমিটি হাত পা ছুঁড়ে সকালসন্ধে কাঁদি।
একটা পাথর-মতো কিছু পড়ে থাকে ঘরে,
কুণ্ডুলি পাকিয়ে অন্ধকার পড়ে থাকে,
সারা গায়ে যার স্যাঁতস্যাঁতে শ্বেতি।
একটা আমি পড়ে থাকি বোধবুদ্ধিহীন আমি,
একটা মেয়েমানুষ পড়ে থাকে
সাড়ে ছ হাজার বছর বয়স।
মুঠোর ভেতর আকাশ যে নিয়ে যাও
পেছন ফিরে কি দেখেছো কী থাকে?
তোমার না-থাকা জুড়ে কতটা শ্বাসকষ্ট,
ক জোড়া মৃত্যু থাকে!
রাতে রাতে তুমি কার কাছে যাও অরণ্য!
কে তোমাকে কী আমার চেয়ে বেশি দেয়?
এত টইটম্বুর তুমি, এত কানায় কানায় ভরে রাখি,
কোথাও কি নিজেকে দিতে যাও তাই!
ঢেলে দিয়ে খালি হাতে ফিরবে বলে একদিন, উদাসীন!
তোমার চলে যাওয়ার আস্তিন ধরে হেঁচকা
টেনেও কখনও এক সুতো নাড়াতে পারিনি,
তুমি নড়ো না কেন অরণ্য,
ছলকে পড়লে যদি তোমার এক ফোঁটা কিছু আবার পেয়ে যাই আমি!
আমাকে না দিতে চাও, না দাও,
যাকে দাও, ভালোবেসে দাও।
পারো তো ভালোবাসা শেখো অরণ্য,
স্বরেঅস্বরেআ শিখে নিয়ে দ্রুত যুক্তাক্ষর ধরো।
এইটুকু অন্তত আমার সান্ত্বনা হোক—
যাকে ভালোবাসি, সে কোনও ইট কাঠ নয়, সে মানুষ।
যাকে ভালোবাসি সে নিরেট কোনও স্বপ্ন নয়, সে রক্তমাংস।
ভালোবাসতে সেও কাউকে জানে, আমাকে না হোক।
সুনামি মাথায় করে কারও কাছে যেতে জানে,
কাউকে সে মুঠো খুলে আকাশ দিতে জানে।
সেও নিবিড় করে উষ্ণ হাত রাখে কারও হাতে,
সে হাত আমার নয়, না হোক।
অরণ্য, যাকে জীবন দিচ্ছে!, তাকে ভালোবেসেই দাও।
এভাবেই না হয় তুমি যোগ্য হয়ে ওঠো আমার প্রেমের।
৮.
একদিন আমারও ইচ্ছে করে যাই, অন্য অঙ্গে অঙ্গাঙ্গি জড়াই,
একদিন আমিও আর পেছন না তাকাই।
দেখে নিও অরণ্য, তোমার ওই আদিখ্যেতার
আলিঙ্গণ থেকে হঠাৎই উঠে যাবো, শর্তে ঠাসা দুপুরগুলো দুহাতে ভেঙে
কড়ায় গণ্ডায় বুঝে নেবো প্রণয়ের প্রতিটি প্রহর,
দুআনার বিনিময়ে তখন দুআনাই পাবে।
অন্যকে ফাঁকি দিয়ে একদিন আমার কাছে আসতে অরণ্য,
আমাকে ফাঁকি দিয়ে এখন অন্যের কাছে যাও,
তুমি কিন্তু তুমিই আছো। খেয়াঘাটে ডিঙিনৌকো ঠিকঠিক বাঁধা।
ফাঁকি দিতে জানলে আমি ফাঁকিই দিতাম,
জানি না বলেই দেখিয়ে দেখিয়ে অন্য কারওর হাত ধরে হেঁটে যাবো
যতদূর খুশি, দেখিয়ে দেখিয়ে সমুদ্রে স্নান করবো, দেখিয়ে দেখিয়ে
অনেক কিছু….
কিছু তো কোনওদিনই আমাকে দিলে না অরণ্য,
একটি দিনই না হয় দাও, যে দিনটি পিঠে আঙুল ছোঁয়ালেই
ঘুমের ঘোমটা তুলে খুলবো দুচোখ, শিশিরের মতো
ঝরতে থাকা সোনারং সকাল জুড়ে দেখবো অরণ্য নামে কেউ নেই
ও নামে কোনওদিন কেউ ছিল না কোথাও
বিছানা জুড়ে এলোমেলো শুয়ে আছে নতুন যুবক!
৯.
যুবকেরা শয্যাশঙ্গী হবে, হোক। হৈ হৈ করে মিলনে মিথুনে
বারো বছরের মতো দীর্ঘ এক একটি রাত্তির দেবে
দিক, ভালোবাসা নৈব নৈব চ।
ভালো আমি কাউকে আর বাসছি না অরণ্য।
বাসলেই আমার রাষিনদিন ছিটকে পড়বে মহাশূন্যে
বাসলেই আমি উন্মাদের মতো জপ করবো কেবল তার,
মস্তিষ্কের আর মেদমাংসের আর অস্থিমজ্জার নির্যাস নিংড়ে নিয়ে
নিজেকে নিঃশেষ করে
কেবলই তার পাষেন আমি গড়িয়ে পড়তে থাকবো।
বাসলেই বুকের ভেতর খাঁচা নাকি খোলা উঠোন
সব পুড়তে থাকবে, থাকবেই
যতক্ষণ না শেষবিন্দু রক্ত শুকিয়ে হৃদপিণ্ড অচল হয়।
যাকে ভালোবসি, তাকে, এমনই বদঅভ্যেস, আস্ত একটা জগত করে
ফেলি
জগত ক্রমশ বড় হতে হতে মাটি ফুঁড়ে উলঙ্গ উঠে আসে,
উদ্বাহু উল্লাসে হৈ রৈ করতে করতে
আমাকেই মুঠোয় নিয়ে শেষে চটকায়, পেষে।
ভালোবাসা মানেই আমার মরণ নিশ্চিত,
এ আর তোমার চেয়ে বেশি কে জানে অরণ্য!
১০.
দরজায় শব্দ হচ্ছে না, তবু সারাক্ষণই মনে হচ্ছে হচ্ছে,
আসোনি, তারপরও বিশ্বাস হতে চায় না যে সত্যিই তুমি আসোনি
অরণ্য।
১১.
লোকে করছে করুক, কত আর করবে কানাকানি
কেন ছাড়াছাড়ি, সে তুমি জানো আর আমি জানি।
দুজনে ছিলাম জড়িয়ে ছিলাম যে কদিনই ছিলাম,
ভ্রুক্ষেপ করিনি কিছু, কোনও দুর্নামও।
একটি সত্য মানো—
ভালো যা বাসার আমিই বেসেছি,
তুমি একটুও বাসোনি।
রইছো কোথাও রবি থেকে শনি,
চেনো ও-পাড়ার ডজন কয়েক যোনি।
ভালো আমিই বেসেছি অরণ্য, তুমি কোনওদিনই বাসোনি।
ভ্রমণ তো কিছু কম করছো না,
আমার সাথেই নেই বনিবনা।
ঘোরো অলিগলি, এ পথেই শুধু হয়না তোমার পা ফেলা,
যেদিকে চাও, এ তো সত্যিই, সেদিকেই নেবে কাফেললা।
মানচিষেন তো প্রত্যেকে আছে, আমাকেই তুমি রাখোনি,
অন্য কোথাও পেয়ে গেছ ধন, যক্ষের ধন, হিরে মানিকের খনি!
ভালো-বাসার জন্য তো তুমি আসোনি,
ভালো বাসোনি বাসোনি, বাসোনি!
মিটে গেল। মিটে কি আর কিছু অত সহজেই যায়,
বুকের বাঁপাশ যন্ত্রণা তার দাঁতে নখে ছিড়ে খায়।
অরন্ধন
কৈশোর যেতে না যেতে সংসার শুরু তোমার
ভোর থেকে মধ্যরাত্তির গতর খাটো,
তিনবেলা রাঁধো, পাতে তুলে তুলে খাওয়াও
বাড়ির লোকদের, অতিথিদের,
এমনকী জলও ভরে দাও গ্লাসে।
ভাসো, ভেসে যাও −ঢঁকুরের টকে,
নিজে তুমি সবার শেষে।
যখন খেতে বসো, একা,
সঙ্গ দেয় বড় জোর পাড়ার নেড়িকুকুর।
সবাই বসে থাকুক খাবে বলে,
#কই গো, হল? দাও।
কি রেঁধেছো কী শুনি,
ইলিশ ভাজো, মাংসটা ভালো ভাবে কষাও,
আলু পোস্ত কর, কাসুন্দিটা দিও।
বেগুন ভাজা আছে তো! পটলের −দারমা করার কথা ছিল!
চিংড়ির কিছু করোনি! চিলি চিকেনের খবর কি? #
এসব শুনো না। কান দিও না।
এটোঁ আঁশটে বাসন থেকে দূরে সরে এসো তো,
ও মেয়ে সরে এসো,
আজ থেকে তোমার অরন্ধন শুরু হোক।
আকাশপার
তোমার পারে কি আর আজ থেকে বসে আছি!
ডেকে ডেকে চাঁদ দেখিয়েছো, নক্ষষনগুলোও সব দেখা সারা,
কী লাভ দেখে !
দেখতে তো চাই তোমাকে, তোমার ভেতর বাহির।
ওই চাঁদ সূর্য থেকে, রাশি রাশি তারা থেকে ঢের জরুরি তো তুমি,
তোমার আলোয় পুরো এক ব্রহ্মাণ্ডকেই দেখতে চেয়েছি,
তোমার আলোয় তোমাকে চেয়েছি, আমাকেও।
আমার চাওয়াটির গায়ে অনেকদিন আগুন ধরিয়ে দিয়েছো
চাওয়াটি এখন ডানা-ভাঙা চড়ুইএর মতো আকাশপারে
চাওয়াটির দিকে চাইলে জল চলে আসে চোখে
এ চাওয়াকে কে চায় আর !
আকাশ তুমি নিরুপদ্রপ বাস করো তোমার ব্ল্যাক−হালে,
হৃদয়ে অন্ধকার পুরে বসে থাকো চুপচাপ।
তোমার বাড়িঘর আরও ভগবানে
আরও ভবিষ্যতে, আরও ভুতে ভরে উঠুক,
আকাশ তুমি নিজের সঙ্গে প্রেম করো বাকি জীবন,
আকাশ তুমি একা একা সুখে থাকো বাকি জীবন।
আমি, আমরা সবাই, খুবুব বুড়ো হয়ে যাচ্ছি
খুব বুড়ো হয়ে যাচ্ছি,
চুল পেকে যাচ্ছে, ত্বকে ভাঁজ পড়ছে,
মাঝে মাঝে আয়নার সামনে দাঁড়ালে চমকে উঠি, এ কি সেই আমি!
যে আমাকে আমি দীর্ঘ দিন ধরে চিনি, এ কি সেই!
এখন প্রায় প্রতিদিনই খবর শুনতে হয় এর হা−র্ট অসুখ, ওর কিডনি চলে
যাচ্ছে,
লিভার যায় যায়।
শুনি জরায়ুতে বিদঘুটে কিছু বড় হচ্ছে, স্তনে ক্যানসার,
শুনি প্রো−স্টটে কিছু একটা ধরা পড়েছে, কারও ফুসফুস নষ্ট, হঠাৎ হাত
পা অবশ।
কবছর আগেও শুনেছি বন্ধুদের বাবার বাবা চলে গেলেন,
মার মা।
এরপর কারও বাবা, কারও মা।
হাহাকার করতে করতে চমকে উঠে দেখেছি আমার পাশে যে মা ছিলেন,
আমার নিজের মা,
আমার দিকে সেই কতকাল স্বপ্ন-চোখে তাকিয়েছিলেন,
হাতটি ধরে ছিলেন, আমার ঠাণ্ডা হাতটি,
নেই।
এখন বন্ধুরাও কেউ কেউ চলে যাচ্ছে , তাকালে বড় ফাঁকা দেখি
চারদিক,
যে ছিল, কালও ছিল, হঠাৎ বলা নেই, কওয়া নেই, নেই।
এখন এর ওর মত আমারও শরীরে একের পর এক উপদ্রপ জমছে।
আমাদের যাবার সময় হচ্ছে, আমরা সবাই খুব বুড়ো হয়ে যাচ্ছি —
শুনছো তোমরা?
অসুখগুলো আমাদের ছেড়ে কোথাও যেতে যাইছে না, এত যে তাড়াতে
চাইছি, তারপরও
কি অসভ্যের মত আমাদের টানছে অন্ধকার খাদের দিকে, দেখছো!
এই যে এত বই পত্তর, বেশির ভাগের পাতা এখনো ওল্টানো হয়নি
নাম ঠিকানা লেখা হাজার টুকরো কাগজ, কী হবে এসবের!
এই যে বাড়িগাড়ি, টাকা পয়সা, এই যে হাজারটা স্বপ্ন জড়ো করা আছে,
কী হবে!
জীবন গুছিয়ে নিয়ে বসতে বসতেই শুনি জীবনের একেবারে কিনারে
দাঁড়িয়ে আছি,
একটি কেবল টোকা পড়লেই হল..
শুনছো, আমরা খুব ভয়ংকর রকম, খুব অশ্লীল রকম, খুব জঘন্য রকম
নিঃসঙ্গ হয়ে যাচ্ছি!
সামনে আমাদের আয়না ছাড়া আর কিছু থাকছে না,
ঝকঝকে একটি আয়না, আর নাস্তার টেবিলে লাল নীল বড়ি,
মেপে ভাত, মেপে তরকারি, মেপে নুন চিনি, একশ রকম নিষেধের
কাদায় প্রতিদিন গলা পর্যন্ত ডুবে থাকতে হচ্ছে।
আমরা সবাই এমন বুড়ো হয়ে যাচ্ছি, আমার ভয় করছে খুব,
ভয় করছে বুড়ো হচ্ছি বলে,
কোথাও কোনও অন্ধকারে যে অন্ধকার থেকে কোথাও আর ফিরব না
কোনওদিন,
যেতে ইচ্ছে করছে না,
আমার ভয় হচ্ছে, রাগ হচ্ছে, অভিমান হচ্ছে, মায়া হচ্ছে,
চোখ খুলতে খুলতেই দেখি জীবনের একেবারে কিনারে দাঁড়িয়ে আছি,
একটি কেবল টোকা পড়লেই হল..
এই এতটুকু এক চিমটি জীবনে আমার শখ মেটে না,
এই এতটুকু এক বিন্দু জীবনে আমার তৃষ্ণা মেটে না,
এই এতটুকু এক তিল জীবনে আমার স্বস্তি হয় না,
এই এতটুকু এক কণা জীবনে আমার কিচ্ছু হয় না..
একবিন্দু মা
অনেকে আমার মা হতে চেয়েছে,অনেকে বাবা
অনেকে মামা কাকা খালা ফুপু
অনেকে সেসব বন্ধু, যাদের হারিয়েছি।
চেষ্টা চরিত্তির করে অনেকে বাবা হয়েছে অনেকটাই
কষ্টে সৃষ্টে মামা কাকা খালা ফুপু।
অনেকে বন্ধু হয়েছে নিমেষেই, কায়ক্লেশে নয়।
মা হতে অনেকে চেষ্টা করেছিল, মা হতে সেই অনেকের পর আরও
অনেকে চেষ্টা করেছিল
সেই আরও অনেকের পর আরও অনেকে। দিনের পর দিন অকথ্য
পরিশ্রম
করেছিল মা হতে তবু কেউ মা হতে পারেনি
ছিটেফোটা মা কেউ হতে পারেনি
এক ফোঁটা মা কেউ হতে পারেনি।
এক বিন্দু মা হতে পারেনি।
কলকাতা
আমাকে শহর থেকে তাড়িয়ে তুমি ভালো আছো তো! ভুলে আছো তো!
কুয়োর ব্যাঙ
আমার কাছে এই জীবনের মানে কিন্তু আগাগোড়াই অর্থহীন,
যাপন করার প্রস্তুতি ঠিক নিতে নিতেই ফুরিয়ে যাবে যে-কোনোদিন।
গ্রহটির এই মানবজীবন ব্রহ্মাণ্ডের ইতি-হাসে
এক পলকের চমক ছাড়া আর কিছু নয়।
ওইপারেতে স্বর্গ নরক এ বিশ্বাসে
ধম্মে কম্মে মন দিচ্ছে কী হয় কী হয় সারাক্ষণই গুড়গুড়ে সংশয়—
তাদের কথা বাদই দিই, সত্য কথা পাড়ি
খাপ খুলে আজ বের করিই না শখের তরবারি!
মানুষ তার নিজের বোমায় ধ্বংস হবে আজ নয়তো কাল,
জগত টালমাটাল।
আর তাছাড়া কদিন বাদে সুয্যিমামা গ্যাস ফুরিয়ে মরতে গিয়ে
পৃথিবীকে পেটের ভেতর এক চুমুকে শুষে নিয়ে
দেখিয়ে দেবে খেলা
সাঙ্গ হবে মেলা
জানার পরও ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিঁড়ে কামড়ে তুচ্ছ কিছু বস্তু পাওয়ার লোভ,
ভীষণ রকম পরস্পরে হিংসেহিংসি ক্ষোভ।
মানুষের ক-ই যাবে দুর্ভোগ!
তাকত লাগে ভবিষ্যতের আশা ছুঁড়ে মহানন্দে করে যেতে মুহূর্তকে
ভোগ।
ভালোবাসতে শক্তি লাগে, হৃদয় লাগে সবকিছুকেই ভাগ করতে সমান
ভাগে,
কজন পারে আনতে রঙিন ইচ্ছেগুলো বাগে?
ভুলে যাই এক মিনিটের নেই ভরসা,
আমাদের স্যাঁতস্যাঁতে-সব-স্বপ্ন-পোষা কুয়োর ব্যাঙের দশা।
ধুচ্ছাই
সমুদ্দুরে ঠাঁই পেতে চাই।
খালি মন মন মন, তোর শরীর নাই?
শোনো, ওরকম luv u luv u luv u luv u এসএমএস পাঠাবে না তো আর। একটু পর পর লভড়ড় য় লভড়ড় য়. সত্যিকার মিস করলে চার কিলোমিটার ছুটে এসে চুমু খেতে খেতে বলতে ভালোবাসি। ভালোবাসি। ভালোবাসি। বাঙালি পুরুষের মতো এত আলসে জাত জগতে নেই। এমনিতে আলসে, তার ওপর মুঠো−ফান এসে আরও আলসে বানিয়ে দিয়েছে। রাত জেগে কুড়ি বাইশ পাতার প্রেমের চিঠি লেখার দিন তো আর নেই, ইমেইল ভালো করে ব্যবহার করার আগেই শুরু হয়েছে মুঠো−ফানের মোচ্ছব। আলসেরা এখন অল্পতে, যাকে বলে শর্টকাটে প্রেম সারার সুবিধে পেয়েছে । কেন বাবু, loveove লেখা যায় না? একটা অক্ষর বেশি টিপলে কি সময় নষ্ট হয় খুব? আর অত ইংরেজিতেই বা কেন, bhalobashi শব্দটি কি খারাপ শোনায়? নাকি অত বড় শব্দ লিখলে আঙুলে ব্যথা হয়?
সবটা আলো গিলে নিয়ে রাতগুলো ভুত হয়ে বসে থাকে, আর রাজ্যির সব অকাজের ব্যস্ততা কাটলে যখন করার কিছু নেই, বলার কিছু ভাবার কিছু নেই, তখন তোমার মনে পড়ে আমাকে। হুলস্থূল ডাকাডাকি। আমিও মাইরি, ছুটে যাই আমার বংশীবাদকের কাছে। বংশীবাদক কি বোঝে কেন যাই? বোঝে যে আমি ইচ্ছে করলেই বলতে পারতাম কারও ডাকে আমার কিচ্ছু যায় আসে না, কিন্তু বলি না? আধঘন্টা হাবিজাবি কথা বলে ব্যস, তোমার চুমু খাওয়া শুরু হয়ে যায়। চুমু তো নয়, আস্ত আস্ত কামড়। আর বুকে যেদিন প্রথম হাত দিলে, মনে হচ্ছিল বাঘের থাবা বুঝি। এরপর ধমক খেয়ে দাঁত নখ গুটিয়ে মানুষ হলে, পালকের মতো আঙুল ছোঁয়ালে বুকে। সারা শরীর কী ভীষণ কাঁপে তোমার স্পর্শে তুমি কি টের পাও? টের নিশ্চয়ই পাও, তারপরও কী করে পারো আমাকে অমন করে ভিজিয়ে ভাসিয়ে, আমাকে পাগল করে অবশ করে, ঠোঁটে বা চোখে গুড নাইট কিস খেয়ে টা টা বলতে? এত যে বলো মন মন, তোমার কি শুধু মনই আছে, শরীর নেই? তুমি বাঙালি না হলে তোমার ওই টা টা বলার মুখে দীর্ঘ একটি দম বন্ধ করা চুমু খেয়ে টেনে তোমাকে বিছানায় নিতাম। কাপড় চোপড় ছিঁড়ে ছুঁড়ে তোমার সঙ্গে সারারাত আমি সাত-আকাশে উড়তাম। হ্যাঁ তুমি বাঙালি না হলে তাই করতাম। বাঙালিকে বিশ্বাস নেই বাবা, এত ধকল সইতে না পেরে হয়তো মুহূর্মুহূ মুর্চ্ছা যাবে।
তোমার সংকোচটা কোথায় বলো তো! দুজনই অ্যাডাল্ট, দুজনই একা। এরকম তো নয় যে কোনও এক্সট্রা মেরিটাল রিলেশান হচ্ছে। হিপোক্রেসি আমি হেইট করি। তুমি কি বোঝো উত্থানরহিতের মতো তোমার আচরণ আমাকে মাঝে মাঝে ষেন²জি করে তোলে? তারপরও দিনের পর দিন তুমি ও-ই করছো, রসের এসএমএস পাঠিয়ে যাচ্ছে!, সেজেগুজে আমার বাড়িতেও আসছো, এসে কিন্তু আদ্যিকালের বদ্যি বুড়োর মতো বসে থাকছো, কেবল যাবার সময় হলে তোমার ভেতরের যুবক জেগে ওঠে, হঠাৎ তোমার চুমুর তেষ্টা পায়। আমাকে যে রাতে রাতে ভীষণভাবে জাগিয়ে যাও, এরপর যে স্বমৈথুনের আশ্রয় নিয়ে বাঁচতে হয় আমাকে। বোঝো? কম তো করছো না সিটি সেন্টার, নলবন, রেস্তোরাঁ, রেড ওয়াইন, হাত ধরা, হাঁটা, চুমু খাওয়া, স্তন ছোঁওয়া ..। আগুন জ্বালাচ্ছে! ঠিকই, জ্বালিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে যাচ্ছো। তুমি কি কোনও প্রেমিক আদৌ?
আঠারো বছর বয়সে না হয় আমার মন থেমে আছে। তখনও প্রেমিকের স্পর্শে যেমন পুলক লাগতো, এখনও ঠিক তেমন। আসলে সত্যি কথা বলতে কী, পুলকের পরিমাণ আগের চেয়ে বরং বেশি।কিন্তু গোপনে গোপনে বয়স তো বাড়ছে, তোমারও, আমারও। মানুষ বাঁচে কদ্দিন বলো তো! আর ক কোটি বছর অপেক্ষা করতে হবে তোমাকে সম্পূর্ণ করে পেতে? এভাবে সময়গুলো ইডিয়টের মতো ফুরোচ্ছে! কেন? আমাদের শরীর যদি পরস্পরকে না চাইতো, তাহলে কথা ছিল, কিন্তু চায় তো! তারপরও ঘোড়সওয়ারের মতো লাগাম যেন তোমাকে টেনে ধরতেই হবে ! এই অসভ্যতাগুলো ছাড়ো তো তুমি। ভাল্লাগে না। আবার ঢং করে বলছো ধীরে বও উতল হাওয়া। এত ধীরে বইব কী করে, ভেতরে তো বান ডাকছে, ঝড় নামছে!
আমার মুশকিল কি জানো, আর কোনও পুরুষকে আমি এখন স্পর্শ করার কথা কল্পনাও করতে পারি না। কাউকে চুমু খাবো ! কারও সঙ্গে শোবো! না, অসম্ভব। তোমায় আচ্ছত হয়ে আছি, আমাকে কি মানায় ওসব? তুমিময় জগত আমার। এ জগতে কার সাধ্য আছে ঢোকে? বেসিকেলি আমি স্ট্রিক্টলি মনোগ্যামাস, এ সমাজের জন্য একটু বেমানান।
এই পাথর, শোনো, এখন থেকে bhalobashi লিখবে। luv বাদ দাও। খুব তো বলছি ভালোবাসি লিখতে! কেন? তুমি কি সত্যিই আমাকে ভালোবাসো!
বাসো? ছাই বাসো।
গুডবাই স্কাই
তোমাকে চাই
শুনছো, তোমাকে
দুচ্ছাই, শুনছো না? তোমাকে চাই।
গল্প তো আমার পুরোটাই ছিল বাকি।
তোমার শুনেই বা কী!
তুমি তো প্রেম জানো না
এখনও জানো না কোন জল মিঠে, কোনটি নোনা।
হারেমের মেয়েগুলোকে এক এক রাতে
হাতের নাগালে নিয়ে বসে থাকো, পেষো,
আমাকেও রাতে রাতে এসএমএস লেখো, এসো।
ফড়িং ধরতে চাও, ধরে যাও,
কে করেছে না?
ধোরো না সাধুর বাহানা।
তুমি আকাশ বটে, মাথার ওপরে পাথরের মতো,
এরকম আকাশ উড়িয়ে দিয়েছি কত!
আজ সমর্পণের শরীরটি উঠে দাঁড়াই,
আকাশ পেরিয়ে উদাস হাওয়া যাই
শেষ চুমু ছুঁড়ে দুর্ভাগাকে বলি, হাই, গুডবাই,
গুডবাই মাই স্কাই।
ঘাস
তার চেয়ে ঘাস হয়ে যাই চল,
তাকে বলেছিলাম, সে বলেছিল চল।
বলেছিল, তুমি আগে হও, আমি পরে।
বলেছিল, তোমার ডগায় ছোট চুমু খেয়ে তারপর আমি।
ঘাস হলাম, সে হল না। আমাকে পায়ে মাড়িয়ে অন্য কোথাও চলে গেল।
কোথায় কার কাছে কে জানে! ঘাসের কি সাধ্য আছে খোঁজ নেয়!
কোনও একদিন বছর গেলে শুনি
কোথাও সে বৃক্ষ হতে চেয়ে চেয়ে হয়েছেও,
আমি ঘাস, ঘাসই রয়ে গেছি, ফুল ফোটাই, দিনভর আকাশ দেখি, বাঁচি।
এদিকে দুটো লোক ঘুরঘুর করছে, বৃক্ষ হবে, বৃক্ষ হবে?
সে বুঝি পাঠালো বৃক্ষ হতে? একলা লাগছে তাহলে এতদিনে?
লোক দুটো চাওয়াচাওয়ি করে। বলে, কার কথা বলো?
নাম বলি। জীবনে শোনেনি নাম।
তবে কেন বৃক্ষ হতে বলছো আমাকে?
হেসে বললো, দেখতে রূপসী হবে, ফলবতী হবে।
দূর দূর করে তাড়াই তাদের। আমার ঘাসই ভালো।
ঘাস হলে দুঃখ রাখার জায়গা অত থাকে না,
ঘাস হলে কার সাধ্য আছে গায়ে চড়ে চড়ে
আচড়ে কামড়ে রক্তাক্ত করে।
আমি আমার মতো বৃষ্টি বাদলায় বাঁচি,
ঘামাচি গরমে বাঁচি।
আমার মতো রাতভর চাঁদ দেখে দেখে, চাঁদ থেকে
চুয়ে পড়া সুখ দেখে দেখে বাঁচি।
ভুল করেও কাউকে বলি না ঘাস হতে আর,
ভুল করে নিজেও কখনও বৃক্ষ হই না।
চাওয়াগুলো
পাহাড়গুলো জড়ো করলে যে পাহাড় হবে,
সাগরগুলো মিশিয়ে দিলে যে সাগর হবে –সেরকম কিছু ইচ্ছে করে।
শেষ হতে না চাওয়া আকাশের মতো কিছু।
তোমাকে ছুঁলেই তুমি ফুরিয়ে যাও,
মনের তো নয়ই , যে আঙুলে ছুঁই, সেটিরও কিছু মেটেনা।
তিয়াশ মেটাবো বলে যার তার কাছে যাই, সে কি আজ থেকে!
মেটেনি কোনওদিন।
আমাকে জড়ো করে করে যে আমি হই, তাকে পুড়িয়ে ছাই করে
তুমি বিখ্যাত হলে।
এক দুই করে করে অনেকগুলো বছর
তোমাকে জড়ো করে করে তোমাকে পাইনি,
স্পর্শের আগেই ভেঙে গেছ, চুম্বনের ঢের আগেই গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে
জানি না তোমার কোন ঈশ্বরের দিকে উর্ধ্বশ্বাসে উড়েছো।
তোমাকে চাওয়া তো শুধু তোমাকেই চাওয়া নয়।
চাওয়াগুলো পাওয়ার আড়ালে ঘাঁপটি মেরে থাকে
পাতার আড়ালের পোকার মতো।
চাওয়াগুলো চিবিয়ে খায় আমাকে, চাওয়াগুলোকে গিলে ফেলি আমি
ভয়ে।
ঝরাপাতা
ঝরাপাতাদের জড়ো করে পুড়িয়ে দেব ভেবেছি অনেকবার,
রাত হলেও যত রাতই হোক, আগুন হাতে নিই।
ওদের তাকিয়ে থাকা দেখলে গা শিরশির করে।
ঝরে গেলে কিছুর আর দায় থাকে না
যেমন খুশি ওড়ে, ঘরে বারান্দায় হৈ হৈ করে খেলে,
জানালায় গোত্তা খাচ্ছে, গায়ে লুটোপুটি, হাসছে,
কানে কানে বার বার বলে, ঝরে যাও, ঝরো, ঝরে যাও।
মন বলে কিছু নেই ওদের। তারপরও কী হয় কে জানে, আগুন নিভিয়ে
দিই।
পাতাগুলো পোড়াতে পারি না, কোনও কোনও দিন হঠাৎ কাঁদে বলে
পারি না,
গুমড়ে গুমড়ে কারও পায়ের তলায় কাঁদে।
কান্নার শব্দ দিগন্ত অবধি ছড়ানো শত শতাব্দির মরুময় নৈঃশব্দ
ভেঙে ভেঙে জলতরঙ্গের মতো উঠে আসে..
কেউ হেঁটে আসে, আমার একলা জীবনে কেউ আসে।
সে না হয় দুদণ্ড দেখতে এল, তবু তো এল।
সে না হয় কাছেই কোথাও গিয়েছিলো, তাই এল, তবু তো এল।
ঝরাপাতারা তাকে নিয়ে নিয়ে আসে, যতক্ষণ নিয়ে আসে,
ততক্ষণ জানি আসছে, ততক্ষণ নিজেকে বলি কাছেই কোথাও নয়, পথ
ভুল করে নয়,
আসলে আমার কাছেই, বছরভর ঘুরে, ঠিকানা যোগাড় করে, খুঁজে
খুঁজে
আমার কাছেই আসছে কেউ, ভালোবেসে।
ওই অতটা ক্ষণই, ওই অতটা কুয়াশাই
আমার হাত পা খুলে খুলে , খুলি খুলে, বুক খুলে গুঁজে দিতে থাকে প্রাণ।
বাড়ির চারদিক পাহাড় হয়ে আছে ঝরাপাতার,
পোড়াতে পারি না।
ডুবে যেতে থাকি ঝরাপাতায়, পোড়াতে পারি না।
দ্যুতি
(আন্দ্রিয়া ডোরকিন্সকে)
সূর্য কি কখনও কাউকে জিজ্ঞেস করে,
আমি কি যোগ্য, আমি কি যথেষ্ট?
করে না, সে বরং আলো ছড়িয়ে যায়।
সূর্য কি কখনও কাউকে জিজ্ঞেস করে,
চাঁদ কী ভাবছে আমাকে নিয়ে?
আজ কি মঙ্গল কিছু বলেছে আমার কথা!
না, সে আলো ছড়িয়ে যায়।
সূর্য কি কখনও কাউকে জিজ্ঞেস করে,
ব্রহ্মাণ্ডের অন্য সূর্য়গুলোর মতো কি আমার আকার?
না, সে আলো ছড়ায়।
তুমিও কোনওদিন কিছু জানতে চেওনা মেয়ে,
তোমার অহংকারের আলো যখন
তোমার মুখে এসে পড়বে,
মুখটি দেখো আয়নায় দাঁড়িয়ে,
ওই উজ্জ্বল, ঝলমলে মুখটি তোমার মুখ,
মুখটিতে ভালোবেসে চুমু খাবো আমি।
প্রথম দিন
বছরের প্রথম দিনটি যে কোনও দিনের মতোই দিন,
যে কোনও দিনের মতোই এর সূর্যচাঁদ,
এর আকাশ আর মাটি, এর সমুদ্র ঝাউবন,
ধুলোবালি, গৃহস্থালি,
যে কোনও দিনের মতো উদাসিন এই দিন।
মধ্যরাতে মদ্যপান আর আকাশ লাল করা হুল্লোড়,
ঝেঁটিয়ে জীর্ণ পুরোনোকে ঘরবার, অমনি সে ভ্যাঁ,
উঠোন ভিজিয়ে হিসি।
নতুনের কোলে কাঁখে আহলাদী বুড়োর মতো বাপ বাপ বলে ঝাঁপ।
কেউ কেউ বাণিজ্য ব্যস্ততায় বুঁদ।
কেউ আবার হতচকিত, জানে না আজ কী দিন, কোন দিন,
ঢোঁড়াসাপের মতো চোখের সামনে পুরো দিন পার হয়ে গেলেও
অনেকে জানবে না আজ প্রথম দিন বছরের।
সাল তারিখের খবর কজন জানে?
সখিনা বিবি জানে? ফুলমণি দাসী?
পাখি কি জানে? পাতা জানে আজ নিউইয়ার? ফুল জানে?
নিউইয়ার বোঝো?
পোষা বেড়ালটি এত যে সভ্য ভব্য, বললো বোঝে না।
কে বোঝে তবে, আমি!
আঙুলের ফাঁক গলে শৈশব থেকে দিনগুলো ঝরে যাচ্ছে টের পাচ্ছি,
বুঝতে না দিয়ে মাসগুলো ঝরছে, নির্লজ্জের মতো বছর,
মাঝে মাঝে দিনের শেষে একা অন্ধকারে থমকে দাঁড়িয়ে ভাবি,
মৃত্যুর দিকে কি যাচ্ছি না একটি বছর করে প্রতিবছর?
এক জীবন শূন্যতার দিকে প্রতিবছর?
নেই নেই হাহাকারের দিকে প্রতিবছর?
বছর যায় আর টুপ করে এক একটি আশঙ্কা এক টুকরো খড়ের মতো
বুকের মধ্যে ঢুকে যায়, সময় নেই। নেই ।
ইচ্ছে করে, কার না করে, ঝুঁটি ধরে সময়কে বসিয়ে দিই বারান্দায়,
শুইয়ে দিই, সুড়সুড়ি দিয়ে ঘুম ভাঙাই, বেড়াতে যাই পুকুরপাড়,
দুধকলা দিয়ে পুষি, ভুলিয়ে ভালিয়ে মুঠোর ভেতর নিয়ে নিই,
ইচ্ছে করে শেকল দিয়ে বাঁধি। আর যেন কোনওদিন কখনও
সে না যায় আমাকে ছেড়ে, কোথাও এক পা-ও ।
এসব ইচ্ছের কথা, কবে আর কখন পুরন হয়েছে!
ইচ্ছেরা ইচ্ছেই থেকে যায় হাজার বছর।
এখনও কখনও তারিখ লিখতে গেলে ভুল করি,
অন্যমনে সাল লিখে ফেলি ছিয়াশি বা ছিয়াত্তর
তবে কি অবচেতনে মন পড়ে থাকে পুরোনোতে! কেবল শরীর
এগোয়!
পাক ধরে চুলে বা চামড়ায়, হাড়ে বা ঘাড়ে বছর বছর!
আর মন খেলে নিরালাদের বাড়ির মাঠে এখনও হাডুডু, এখনও
গোল্লাছুট!
মন কেবল পেছনে নয়, সামনে আলোর গতিতে যেতে পারে,
যত দূরে ইচ্ছে যায়, তত দূরে। মনের গায়ে শেকড় নেই, শেকল নেই,
শ্যাওলা নেই।
পেছনে আনন্দ, পেছনে শৈশব, সামনে কিছুই না, কিছুই না,
একটি শীর্ণ জীর্ণ নদী, আর তার পাড়ে অনেকগুলো বছর কাঁথা মুড়ে
জবুথবু বসে আছে, ঝিমোচ্ছে, গায়ে পায়ে জং।
মন এখন আকাশ চায়।
নতুন বছর মনকে ছুঁতে পারে না, শরীরকে ছোঁয়,
পেটে গুঁতো মেরে বলে যায় ডাকো বা না ডাকো
দেখা হবে নদীর পাড়ে। দেখা হবে কাঁথা আর জবুথবু জীর্ণতার পাড়ে।
দেখা তো হবেই। শরীরের শক্তি নেই না দেখা দেবার।
মন চেনে না নদীর পাড়। মন এখন আকাশপাড়ে।
নিউইয়ার বোঝো? মনকে প্রশ্ন করি,
মুখ মুছে বলে দেয়, বোঝে না।
মনের নাকি দায় নেই বোঝার, মন শুধু আকাশ বোঝে,
বছর বোঝে না, বয়স বোঝে না।
শরীরকে বলি, ও শরীর বুঝিস নিউইয়ার?
বুঝি না মানে? বলে খেঁকিয়ে ওঠে, তোদের নিউইয়ার হাড়ের ভেতর
ঢুকে বুঝিয়ে দেয় ও কী জিনিস।
মজ্জায় গিয়ে মরণ কামড় দেয়,
ও তো রক্তের ভেতর বালতি বালতি বরফ ঢেলে বলে যায়, সময় নেই।
বুঝি না মানে? প্রতিবছর ভয়ে ভয়ে রাত গুনি, এই বুঝি এলো!
না এলে কী হত নিউইয়ার? ও শরীর? দিন তো পেরোতোই,
যেভাবে পেরোয়!
শরীর কথা বলে না। সময় নেই তার,
সে এখন প্যারিস যাবে।
পোষা বেড়ালটি বারান্দার রোদে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকে,
মন তার পাশে বসে ঝিমোয়। মনের ঠ্যাং ধরে টান দেয় শরীর,
যাবি চল। যাবি চল? মন যাবে না কোথাও।
যেই না কান ধরে হেঁচকা টান, অমনি সে ভ্যাঁ,
বারান্দা ভিজিয়ে হিসি।
বাড়িঘর ছেড়ে বেড়াল ছেড়ে বুনো কলকাতা ছেড়ে
মন যাবে না কোথাও।
না যাক। শরীর চলে যায় একা একা, পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে।
শরীরের পেট কয়েক দশক ধরে নতুন বছরেরা
গুঁতো মেরে মেরে ডাবিয়ে দিয়েছে, খানিকটা কাবু সে, যদিও বাবু সে।
নিউইয়ার বোঝে না শরীর, প্রেম বোঝে।
মন তুই সীমনা বুঝিস? এ দেশ ও দেশ?
না। বুঝি না।
হিংসে বুঝিস? যুদ্ধ?
বুঝি না।
মরে যাওয়া বুঝিস?
না।
তবে বুঝিস কী?
ভালোবাসা বুঝি।
সাদা একটি চন্দ্রমল্লিাকার গালে চুমু খেয়ে মন বলে, ভালোবাসি চল।
পাখিগুলো পাতাগুলো ফুলগুলো মনে মনে মনকে বলে,
আজ থেকে ভালোবাসি চল।
শরীরও যদি এমন বলতো, সময় ফুরোচ্ছে তাতে হয়েছে কী!
ভালোবাসি চল।
সময় তো তত ফুরোয়নি যত ফুরোলে নদীর পাড়ে কাঁথা মুড়ে বসতে হয়!
ও শরীর, সময় তো তত ফুরোয়নি, যত ফুরোলে গায়ে পায়ে জং ধরে।
ভালোবাসবি কি?
দীর্ঘ একটি শ্বাস ফেলে শরীরকে বলতেই হবে, বাসবো।
এ জিনিসটি সে জানে বেশ,
তার ঠোঁট জানে, আঙুলগুলো জানে, প্রতি কণা ত্বক জানে,
সবকটি রোমকূপ জানে, চোখ জানে।
যে কোনও দিনই যে কোনও দিনের মতো,
দিন দিনের মতো থাকে,
মানুষই দুঃখ সুখ গড়ে, মানুষের হাতে যুদ্ধ,
মানুষই খুন করে মানুষ,
মানুষই কলজে খায় রক্ত খায় মানুষের
এই মানুষই আবার নতজানু হয় মানুষের কাছে,
মানুষই মানুষ ভালোবাসে।
দিন দিনের মতো পড়ে থাকে,
মানুষই দিনকে উজ্জ্বলতা দেয়,এই মানুষই আবার দিনকে দিনের
আলোয় ধর্ষণ করে।
দিন দিনের মতো থাকে, রাত রাতের মতো।
নক্ষষন নক্ষষেনর মতো, বেড়াল বেড়ালের মতো।
সময় নেই, তাতে কী!
সময় তো মহাবিশ্বেরও নেই, কোনও একদিন চুপসে যাবে।
সহস্র কোটি গ্রহ নক্ষষন নিয়ে নিজেই নিজের উদরে,
অনন্ত বলে কিছু নেই, অতল বলে নেই।
অন্তর বলে কিছু এখনও আছে, অন্তরতর বলে কিছু।
চন্দ্রমল্লিকার গালে চুমু খেয়ে না হয় বলিই
আনবিক পারমাণবিক ছেড়ে মানবিক হই চল,
এ বছর মন দিয়ে ভালোবাসি চল।
কেবল মুখের কথায় বছরের ছাই হবে, বছর শুনেছে এমন বহুবার,
এবার ভালোবেসেই দেখাতে হবে ভালোবাসি।
কাকে ভালোবাসবো? না কোনও ধর্ষককে নয়,
কোনও শোষককে নয়, অবিবেচক অত্যাচারীকে নয়,
কোনও লোভীকে নয়, পুরুষকে নয়। মানুষকে বাসি চল।
সখিনা বিবিকে চল। ফুলমণি দাসীকে চল।
ফণা
মেয়ে তুমি আগুন জ্বালাও,
মেয়ে তুমি ফণা তোলো, ফোঁসো,
মেয়ে তুমি পোড়াও চারদিক,
মেয়ে তুমি নাচো, হাসো।
মেয়ে তুমি বাঁচো।
তোমাকে তো ভয় পায় ওরা
ওরা তোমাকে ভয় পায় খুব
ভীষণ ভয় ওরা পায়।
তোমার বিষ নামিয়ে নেয় ফণা তুলবে ভয়ে।
মেয়ে তোমার বিষ রাখো,
বিষ জমিয়ে রাখো,
প্রতিদিন একটু একটু করে বিষ জমাও।
আর কিছু যদি না পারো,
হাট করে খুলতে না পারো বন্ধ জানালা, সাঁটা দরজা
যদি ছিঁড়তে না পারো গায়ে পায়ের শেকল,
ভুলেও যেন ভুলে যেও না তুমি ফণা তুলতে পারো,
ভুলো না বিষদাঁতে কাটতে পারো
তোমার পিঠে কথায় কিছু কি হয়েছে কোনওকালে?
যা কিছুই হয় বা হয়েছে, ফনা তুলেই।
বিয়ে
বিয়ে আর দিন পাঁচেক বাদে,
বলি ও মেয়ে তুমি পড়েছো ফাঁদে,
চারদিকের লোক জানে পড়েছিলে প্রেমে।
আসলে এ তোমার মরণ বরণ। গানগুলি যাবে থেমে!
জীবনের ছবিটি টাঙিয়ে রাখবে দেয়ালের কোনও ফ্রেমে !
নতুন জীবন! কে বলেছে নতুন?
এ তোমার মা দিদিমার চেখে দেখা নুন
নিজে তুমি খাওনি বলে খাবে।
যখন পস্তাবে
ফ্রেমের জীবন থেকে মুঠো মুঠো স্বপ্ন পেড়ে
মাঝরাত্তিরে বেহুঁশের মতো গোগ্রাসে খাবে।
দেখে গায়ের জোরে যে তোমার স্বপ্ন নেবে কেড়ে
সে তোমার স্বামী, যাকে ভালোবেসে ঝাঁপিয়ে পড়েছো খাদে,
যেহেতু সবাই পা দেয়, জেনে বুঝেই পা দিয়েছো ফাঁদে।
ভালোবাসা মানুষুকে খুব একা করে দেয়
ভালোবাসার কথা তাকে ছিল না, কিন্তু না বেসে আবার উপায়ও ছিল না।
আমাকে সে বাসেনি, কিন্তু ভেবে নিতাম বাসে,
তার অঙ্গভঙ্গির ভুল অনুবাদ করতাম, ইচ্ছে করেই করতাম কি না কে
জানে।
আসলে, বাসে ভাবলে সুখ হত খুব। নিজেকে সুখ দিতেই কি না কে
জানে।
ভালোবাসেনি বলে হেসে খেলে খেয়েছে ঘুরেছে,
লুটেপুটে কোনও একদিন চলেও গেছে নিঃশব্দে
বাসেনি বলে তার চলে যাওয়ায় তার কোনও দুঃখ নেই।
একা তো বরাবরই ছিলাম, তবু এত একা আমার কখনও লাগেনি।
তার সঙ্গটুকু, তার ওই মিথ্যেটুকুই
আমাকে সত্যিকার গ্রাস করে ফেলেছিল বলে একা লাগে।
কতবার ভাবি ভুলে যাবো, তারপরও দরজায়
শব্দ হলেই মনে হয় সে এলো। কোথাও কারও পায়ের আওয়াজ পেলে
চমকে উঠি।
কতবার ভাবি বাসবো না, তারপরও ভুলভাল মানুষকে ভালোবেসে
নিজের সর্বনাশ করি।
যাকে বিদেয় দেব, সে যদি নিজেই
বিদেয় হয়, সে যদি পেছন না ফেরে, কষ্ট হতে থাকে।
কষ্টের কারণগুলো আমি আজও ঠিক বুঝতে পারি না।
মাটি