নারী এবং কবিতা
যতটুকু দুঃখ নিয়ে একজন মানুষ নারী হয়ে ওঠে,
ততটুকু দুঃখ নিয়ে সে নারী কবি ওয়ে ওঠে।
একটি শব্দ তৈরি হতে যায় একটি দীর্ঘ যন্ত্রণার বছর,
আর, একটি কবিতা নেয় পুরো এক জীবন।
নারী যেদিন কবি হয়, সেদিন সে পুরো এক নারী
সেদিন সে কষ্টের জঠর থেকে শব্দ প্রসব করার মত পরিণত
সেদিন সে যোগ্য শব্দকে নকশিকাঁথায় ঢাকার।
কবিতার জন্ম দিতে গেলে নারী হতে হয় আগে
যন্ত্রণা ছাড়া যে শব্দ জন্মায়–ধসে পড়ে স্পর্শমাত্র
আর নারীর চেয়ে যন্ত্রণার নাড়িনক্ষত্র কেই বা জানে বেশি!
নির্মলেন্দু গুণ
মুখ চুন করে বসে আছেন নির্মলেন্দু গুণ,
এলে ফাগুন,
ইচ্ছে তার করেন দুএকটি খুন
লোকে বলে এ গুণের দোষ, আমি বলি গুণ।
গুণ তো দেখছেন, দেশটিকে কুড়ে খাচ্ছে ঘুণ।
ন্যাড়া দশবার বেলতলা যায়
প্রথম টপকে গেলে নিষেধের বেড়া
বারবার টপকায়,
একবার কেন, বেলতলা দশবার যায় ন্যাড়া।
ন্যাড়ার মাথায় বেল তো বেল, আকাশ ভাঙুক ক্ষতি নেই!
যে পথে ইচ্ছে, অলিগলি ঘুরে সে পথেই যাবে ন্যাড়া,
ন্যাড়া কি তোমার ভেড়া!
ন্যাড়ার ঘাড়ের দুটো রগ বড় ত্যাড়া।
পুরুষের কথা বলি
পুরুষের গল্প বলা চাট্টিখানি কথা নয়।
তারাই এ যুগের ঈশ্বর কি না!
ইঁদুরের লেজ ঝুলে থাকে পুরুষের দু’উরুর মাঝখানে…
তা নিয়েই কেশর ফুলিয়ে এদের বনফাটা গর্জন!
যেন লেজের তেজ ঝরাতে চমৎকার দক্ষ একেকজন।
লেজখানা মাঝে মাঝে খুঁসে ওঠে তা ঠিক,
ফুঁসে ওঠা লেজ বেড়ালের মুখের মত যৌনাঙ্গ
দেখে মুহূর্তে চুপসে যায়, পৌরুষ-ক্ষত থেকে শাদা পুঁজ ঝরে পড়ে টুপটুপ,
খসে যায় বেলুন
(ওয়াক থুঃ!)
আহা… সঙ্গমের স ও যদি জানত পুরুষ!
প্রায়শ্চিত্য
একটি অসুখ চাইছি আমি, ঠিক সেই অসুখটি–
সেই বৃহদন্ত্রের অসুখ, হামাগুড়ি দিয়ে যকৃতে পৌঁছবে,
যকৃত থেকে হেঁটে হেঁটে হাড়ে, হাড় থেকে দৌড়ে ধরবে ফুসফুস
ফুসফুস পেরিয়ে রক্তনদী সাঁতরে মস্তিস্ক।
ভুল কাঁটাছেড়া, ভুল ওষুধ, ভুল রক্তের চালান
অসুখের পেশিতে শক্তির যোগান দেবে, কুরুক্ষেত্রে বাড়তি সৈন্য, রণতরী।
সেরকম পড়ে থাকব বিষণ্ণ বিছানায় একা, যেরকম ছিলে তুমি
যেরকম আস্ত কঙ্কাল, যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া হাড়ের কঙ্কাল
মাংস খসে পড়ছে, রক্ত ঝরে যাচ্ছে
ধসে পড়ছে স্নায়ুর ঘরবারান্দা
ঠিক সেরকম হোক আমারও,
আমারও যেন চোখের তারা জম্মের মত অচল হয়
যেন তীব্র শ্বাসকষ্ট হয়, ফুসফস
ফুলে ঢোল হয়ে থাকে জলে, নিঃশ্বাসের হাওয়া পেতে যেন কাতরাই,
যেন হাত পা ছুঁড়ি,
যেন না পাই।
যেন কারও স্পর্শ পেতে আকুল হই,
যেন কাতরাই, হাত বাড়াই,
যেন না পাই।
ফেরা
মা একদিন ফিরে আসবেন বলে
মা’র ঘটিবাটি, দু’জোড়া চটি
বিছানার চাদর, লেপ কাঁথা,
ডালের ঘুটনি, হাতা
ক’টি কাপড়, ক’টি চুরি দুল
চিরুনিখানি, ওতে আটকা চুল
ফুল ফলের ছবি, মা’র আঁকা
যেখানে যা কিছু ছিল, তেমন করেই রাখা।
মা ফিরে আসবেন
ফিরে কলতলায় পায়ের কাদা ধুতে ধুতে বলবেন
খুব দূরে এক অরণ্যে গিয়েছিলাম।
তোরা সব ভাল ছিলি তো!
খাসনি বুঝি! আহা, মুখটা কেন শুকনো লাগছে এত!
বাঘ ভালুকের গল্প শোনাতে শোনাতে মা আমাদের খাওয়াবেন রাতে
অনেকদিন পর মাও খাবেন মাছের ঝোল মেখে ভাতে,
খেয়ে, নেপথলিনের গন্ধঅলা লালপাড় শাড়ি পরে একটি তবক দেওয়া পান
হেসে, আগের মত গাইবেন সেই চাঁদের দেশের গান।
একদিন ফিরে আসবেন মা
ফিরে আসবেন বলে আমি ঘর ছেড়ে দু’পা কোথাও বেরোই না
জানালায় এসে বসে দু’একটি পাখি,
ওরাও জানে মা ফিরবেন, বিকেলের দুঃখী হাওয়াও,
আকাশের সবকটা নক্ষত্র জানে, আমি জানি।
বয়স
একটি করে দিন যায় আর বয়স বাড়ে
একটি করে রাত আসে আর বয়স বাড়ে।
গ্রীষ্ম গিয়ে বর্ষা আসে, বয়স বাড়ে
শীতের শেষে বসন্তের ফুল ফোটে আর বয়স বাড়ে।
অসুখ যায় অসুখ সারে
কোনও এক মাঝদুপুরে অলক্ষে অসুখ বাঁধে হাড়ে।
হাড়ের ভেতর বয়স বাড়ে
ধা ধা করে বয়স বাড়ে,
আর নিশুত রাতে বুকের কোঠায় কে যেন খুব দরজাখানা বিষম জোরে নাড়ে,
হুড়মুড়িয়ে দস্যু ঢুকে নিঃশ্বাসের বাতাসটুকু কাড়ে।
বস্তিতে ভগবান এসেছেন
রেললাইনের ওপর বসে আছেন কে! ও কি!
ভগবান নাকি?
ও ভগবান, দেখছেন কী!
ওদের নেভা চুলো! শুকনো সানকি!
মাছি বসে বুড়োদের দুর্গন্ধ ঘাএ
যুবতীরা ভেজা কাপড় শুকোয় গায়ে
বেশরম যুবতীরা, যার তার বিছানায় শোয়! আস্ত খানকি!
দেখুন এক চালার তলে ঘুমোয় কজন!
শরীরের তলে চাপা পড়ে মরছে ওদের মন…
কপাল কুঁচকে ভাবছেন কি?
নরকের নীল নকশা আঁকছেন?
হঠাৎ উঠছেন যে! ও কি ভগবান!
নাকে রুমাল চেপে বড় যে পালাচ্ছেন।
বালক বালিকারা
এরা কি দুবেলা খেতে পায়!
ইশকুলে যায়! এই বালক বালিকারা!
এরা নেড়ি কুকুরের আধখাওয়া হাড় কেড়ে খায়
এরা জমে যাওয়া শীতের রাত্তিরে ধুলোকাদায় ঘুমায়
এরা জন্মায়, এই বালক বালিকারা।
যদি বা জন্মায়
বছর বছর মরে খরায় বন্যায়
কেউ কেউ বাঁচে অপেক্ষায়–এই বালক বালিকারা
এদের জীবন ঘোরে উল্টো চাকায়।
মাঝে মাঝে সন্ধায়
বাবুদের বাড়ির সীমানায়
এরা সুখের দুখের গান গায়
দু’আনা চারআনা চায়।
বাবুরা যায়,
এদের ভাগ্যকে দোষ দিয়ে সিঁড়ি ভেঙে ওপরতলায়।