দুঃখ দেবে সমুদ্র
আমার কাছে দুঃখ আছে রঙ বেরঙের দুঃখ আছে, দুঃখ নেবে দাদা?
ক’কিলো চাই?
ঠকাবো কেন! কী যে বলছ ছাই!
জীবনভর ঠকিয়ে গেছি নিজেকে শুধু, অন্যকে না,
এ খবরটি শহর জুড়ে সবাই জানে, কে না!
তুমি তো দাদা সুখের বিলে ডিঙি ঠেললে, গায়ে মাখলে কাদা,
দুঃখ কেনো, দুঃখ দেবে সমুদ্দুর,
দুঃখ দেবে স্রোতের কাঁধে জীবন রেখে পরান খুলে কাঁদা।
দুঃখপোষা মেয়ে
কান্না রেখে একটুখানি বস
দুঃখ-ঝোলা একেক করে খোল…
দেখাও তোমার গোপন ক্ষতগুলো
একদিনে গভীর কত হল।
ও মেয়ে শুনছ!
বাইরে খানিক মেলে দাও তো এসব
দুঃখ তোমার একদম গেছে ভিজে…
হাওয়ার একটি গুণ চমৎকার
কিছু দুঃখ উড়িয়ে নেয় নিজে।
ও কি গুনছ!
দিন।
দিন তো যাবেই! দুঃখপোষা মেয়ে!
শুকোতে দাও স্যাঁতসেঁতে এ জীবন
রোদের পিঠে, আলোর বিষম বন্যা
হচ্ছে দেখ, নাচছে ঘন বন…
সঙ্গে সুখী হরিণ।
ও মেয়ে হাসো,
নিজের দিকে দু’চোখ দাও, নিজেকে ভালবাসো।
দুঃখবতী মা
মা’র দুঃখগুলোর ওপর গোলাপ-জল ছিটিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল,
যেন দুঃখগুলো সুগন্ধ পেতে পেতে ঘুমিয়ে পড়ে কোথাও
ঘুমটি ঘরের বারান্দায়, কুয়োর পাড়ে কিম্বা কড়ইতলায়।
সন্ধেবেলায় আলতো করে তুলে বাড়ির ছাদে রেখে এলে
দুঃখগুলো দুঃখ ভুলে চাঁদের সঙ্গে খেলত হয়তো বুড়িছোঁয়া খেলা।
দুঃখরা মা’কে ছেড়ে কলতলা অব্দি যায়নি কোনওদিন।
যেন এরা পরম আত্মীয়, খানিকটা আড়াল হলে বিষম একা পড়ে যাবেন মা;
কাদায় পিছলে পড়বেন, বাঘে-ভালুকে খাবে, দুষ্ট জিনেরা গাছের মগডালে
বসিয়ে রাখবে মা’কে-
দুঃখগুলো মা’র সঙ্গে নিভৃতে কী সব কথা বলত…
কে জানে কী সব কথা
মা’কে দুঃখের হাতে সঁপে বাড়ির মানুষগুলো অসম্ভব স্বস্তি পেত।
দুঃখগুলোকে পিঁড়ি দিত বসতে,
লেবুর শরবত দিত, বাটায় পান দিত,
দুঃখগুলোর আঙুলের ডগায় চুন লেগে থাকত…
ওভাবেই পাতা বিছানায় দুঃখগুলো দুপুরের দিকে গড়িয়ে নিয়ে
বিকেলেই আবার আড়মোড়া ভেঙে অজুর পানি চাইত,
জায়নামাজও বিছিয়ে দেওয়া হত ঘরের মধ্যিখানে।
দুঃখগুলো মা’র কাছ থেকে একসুতো সরেনি কোনওদিন।
ইচ্ছে ছিল লোহার সিন্দুকে উই আর
তেলাপোকার সঙ্গে তেলোপোকা আর
নেপথলিনের সঙ্গে ওদের পুরে রাখি।
ইচ্ছে ছিল বেড়াতে নিয়ে গিয়ে ব্রহ্মপুত্রের জলে, কেউ জানবে না,
ভাসিয়ে দেব একদিন
কচুরিপানার মতো, খড়কুটোর মতো, মরা সাপের মতো ভাসতে ভাসতে দুঃখরা
চলে যাবে কুচবিহারের দিকে…
ইচ্ছে ছিল
দুঃখগুলো মা’র সঙ্গে শেষ অব্দি কবর অব্দি গেছে,
তুলে নিয়ে কোথাও পুঁতে রাখব অথবা ছেঁড়া পুঁতির মালার মতো ছুড়ব
রেললাইনে, বাঁশঝাড়ে, পচা পুকুরে। হল কই?
মা ঘুমিয়ে আছেন, মা’র শিথানের কাছে মা’র দুঃখগুলো আছে,
নিশুত রাতেও জেগে আছে একা একা।
দুইঞ্চি অহং
বড় স্বস্তি বোধ করি সমকামি পুরুষ বন্ধুদের আড্ডায়
ওদের সঙ্গে লুটোপুটি হুটোপুটি, নাচ গান,
মাতাল হওয়া, ন্যাংটো হয়ে গড়িয়ে পড়া মেঝেয়…
যেমন ইচ্ছে বেসামাল হতে পারি
যেমন ইচ্ছেনষ্ট ভ্রষ্ট।
ঘুমোতে পারি ওদের কোলে, কাখে, বিছানায়–
স্নান শেষে দাঁড়াতে পারি অনিন্দ্য আফ্রোদিতি
বুনো ষাঁড়ের মত তেড়ে আসে না ওরা
যেমন আসে অসমকামি পুরুষ, দু’ইঞ্চি অহং উঁচিয়ে–
যদিও অপটু সাঁতারুগুলো জলে খাবি খেতে খেতে ডোবে।
দেশ বলতে এখন
দেশ এখন আমার কাছে আস্ত একটি শ্মশান,
শ্মশানে দাঁড়িয়ে প্রতিরাতে একটি কুকুর কাঁদে,
আর এক কোণে নেশাগ্রস্ত পড়ে থাকে চিতা জ্বালানোর কজন লোক।
দেশ এখন আমার কাছে আর শস্যের সবুজ ক্ষেত নয়,
স্রোতস্বিনী নদী নয়, রোদে ঝিলমিল দীঘি নয়,
ঘাসনয়, ঘাসফুল নয় …
দেশ ছিল মা’র ধনেখালি শাড়ির আঁচল
যে আঁচলে ঘাম মুছে, চোখের জল মুছে দাঁড়িয়ে থাকতেন মা, দরজায়।
দেশ ছিল মা’র গভীর কালো চোখ,
যে চোখ ডানা মেলে উড়ে যেত রোদ্দুরে, রাত্তিরে
যেখানেই ভাসি, ডুবি, পাড় পাই–খুঁজত আমাকে।
দেশ ছিল মা’র এলো চুলের হাতখোঁপা,
ভেঙে পড়ত, হেলে পড়ত, রাজ্যির শরম ঢাকত আমার।
দেশছিল মা’র হাতে সর্ষের তেলে মাখা মুড়ি
মেঘলা দিনে ভাজা ইলিশ, ভুনো খিচুড়ি
দেশছিল মা’র হাতের ছ’জোড়া রঙিন চুরি।
দেশ ছিল বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে মা মা বলে ডাকার আনন্দ।
কনকনে শীতে মা’র কাঁথার তলে গুটিসুটি শুয়ে পড়া,
ভোরবেলায় শিউলি ছাওয়া মাঠে বসে ঝাল পিঠে খাওয়া…
অন্ধকারে মুড়ে,
দূরে,
নৈশব্দের তলে মাটি খুঁড়ে
দেশটিকে পুরে,
পালিয়েছে কারা যেন,
দেশবলে কেউ নেই এখন, কিছু নেই আমার।
খাঁ খাঁ একটি শ্মশান সামনে, একটি কুকুর, আর কজন নেশাগ্রস্ত লোক।
ধোঁয়া
ধোঁয়ায় উড়ছে ঘর, কবিতার হারানো অক্ষর,
উড়ছে আমার শিশুকাল আর ধুসর যৌবন
যা ছিল লুকোনো ঝাঁড়ে জঙ্গলে যক্ষের ধন,
উড়ছে নেশায় বুদ হয়ে থেকে বেহায়া ঈশ্বর।
দেয়ালে টাঙানো মা’র হাসিমুখ
ভেতরে লুকিয়ে হামুখো অসুখ,
হতচ্ছাড়া আমি বেঁচে আছি বেদনায়–
ঈশ্বরের লেজ ধরে ঝুলছি ধোঁয়ায়।
নারী
ওক গাছ তো নয়, আস্ত এক শিশ্ন–
মেঘেরা তার বীর্য, শিশ্ন থেকে বীর্য উড়ে গেছে–
হুম ঠ্যালা সামলা কৃষ্ণ
বীর্য যখন বৃষ্টি হয়ে ঝরে, উতল হাওয়া বয়
নারীগুলোন গর্ভবতী হয়।
ও কি পাহাড়-জোড়া! নাকি নিতম্ব!
নারী ওতে জন্ম দিতে গেছে
ঘাস অথবা জল, জল অথবা ভেড়া…
ডিঙিয়ে গেছে সাধসাধ্যের বেড়া!
শিশ্ন উখিতই থাকে, ঝড়ে পড়লে গুঁড়িসুদ্ধ ধপাস।
মাটি থাকে স্থবির শুয়ে, নারী ফলায় যা ফলানোর–
সারাদিনের ঘানি
টানার পর শস্য এবং প্রাণী।