উৎসব
জানলা খুললে মেঘগুলো হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে ঘরে
ডানায় করে আমাকে তুলে নিয়ে যায়–
পায়ের পাতায় চুমু খায় অরণ্যের জলধোয়া ঠোঁট।
নিতে নিতে অনেক দূরে কোনও এক জলের দেশে…
যে জলে মেঘগুলোকে লাগে ধাবমান ঘোড়ার মত…
আমার রঙিন জামা আকাশের এপার ওপার ছেয়ে থাকে রঙধনু হয়ে।
জলের ওপর মেঘের ত্রিপল তুলে উৎসব হবে আজ–
ঘুঙুর পরে নাচবে একশ গাঙচিল।
জলের দরজা খুললে পুরো আকাশ, আকাশের পিঠে চড়া চাঁদ
হুমড়ি খেয়ে পড়ে জলে…
সারারাত জলে ডুবে গোল্লাছুট খেলে অসংসারি চাঁদ।
কারও সঙ্গে সখ্য হয় না আমার, এমনকি চাঁদের সঙ্গেও
যে কিনা বিনা শর্তে আমাকে খেলতে ডেকেছে।
একটি অকবিতা
আমার মা যখন মারা যাচ্ছিলেন, সকালবেলা স্নান করে জামা জুতো পরে ঘরবার হলেন বাবা, চিরকেলে অভ্যেস। বড়দা সকালের নাস্তায় ছ’টি ঘিয়ে ভাঁজা পরাটা নিলেন, সঙ্গে কষানো খাসির মাংস, এ না হলে নাকি জিভে রোচে না তাঁর। ছোড়দা এক মেয়েকে বুকে মুখে হাত বুলিয়ে সাধাসাধি করছিলেন বিছানায় নিতে। সারা গায়ে হলুদ মেখে বসেছিলেন বড়বৌদি, ফর্সা হবেন; গুনগুন করে হিন্দি ছবির গান গাইছিলেন, চাকরবাকরদের বলে দিয়েছেন ইলিশ ভাঁজতে, সঙ্গে ভুনা খিচুড়ি। ভাইয়ের ছেলেগুলো মাঠে ক্রিকেট খেলছিল, ছক্কা মেরে পাড়া ফাটিয়ে হাসছিল। মন ঢেলে সংসার করা বোন আমার স্বামী আর কন্যা নিয়ে বেড়াতে বেরোল শিশুপার্কে। মামারা ইতিউতি তাকিয়ে মা’র বালিশের তলে হাত দিচ্ছিল সোনার চুরি বা পাঁচশ টাকার নোট পেতে। খালি ঘরে টেলিভিশন চলছিল, যেতে আসতে যে কেউ খানিক থেমে দেখে নেয় তিব্বত টুথপেস্ট নয়ত পাকিজা শাড়ির বিজ্ঞাপন। আমি ছাদে বসে সিগারেট ফুকতে ফুকতে নারীবাদ নিয়ে চমৎকার একটি কবিতা লেখার শক্ত শক্ত শব্দ খুঁজছিলাম।
মা মারা গেলেন।
বাবা ঘরে ফিরে জামাকাপড় ছাড়লেন। বড়দা খেয়ে দেয়ে ঢেঁকুর তুললেন। ছোড়দা রতিকর্ম শেষ করে বিছানা ছেড়ে নামলেন। বড়বৌদি স্নান সেরে মাথায় তোয়ালে পেঁচিয়ে ইলিশ ভাঁজা দিয়ে গোগ্রাসে কিছু খিচুড়ি গিলে মুখ মুছলেন। ভাইয়ের ছেলেগুলো ব্যাট বল হাতে নিয়ে মাঠ ছাড়ল। স্বামী কন্যা নিয়ে বোনটি শিশুপার্ক থেকে ফিরল। মামারা হাত গুটিয়ে রাখলেন। আমি ছাদ থেকে নেমে এলাম। ছোটরা মেঝেয় আসন পেতে বসে গেল, টেলিভিশনে নাটক শুরু হয়েছে। বড়দের এক চোখ মায়ের দিকে, আরেক চোখ টেলিভিশনে। মায়ের দিকে তাকানো চোখটি শুকনো, নাটকের বিয়োগান্তক দৃশ্য দেখে অন্য চোখে জল।
একটি মৃত্যু, কয়েকটি জীবন
একটি মৃত্যুকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল কয়েকটি জীবন।
কয়েক মুহূর্ত পর জীবনগুলো চলে গেল
যার যার জীবনের দিকে।
মৃত্যু পড়ে রইল একা, অন্ধকারে
কেঁচো আর কাদায়–
জীবন ওদিকে হিশেব পত্তরে,
বাড়িঘরে,
সংসারে, সঙ্গমে।
কপাল
কারও কারও কপালে প্রেম থাকে,
যেমন ইয়োকো ওনো।
প্রেমিক হয়ত দাঁড়িয়ে আছে পথের বাঁকে,
সেও খুঁজছে ঠিক আমার মত কোনও…
দেখা হচ্ছে না এই যা, হলে জীবন হত অন্যরকম,
ওম শান্তি ওম!
এক জীবনে সব হয় না কন্যা,
শরীর জুড়োয় তো, মন না।
কলকাতা
কলকাতা তেমনই আছে,
ভিখিরির ভিড় আর ধুলো
ফুটপাতে টিমটিমে চুলো,
কড়ায়ে গরম হয় তেল–
গন্ধে, বন্ধে
সন্ধেবেলা বসে নন্দনে আঁতেল।
কলকাতায় কী নেই!
মহারাণী ভিক্টোরিয়া থেকে নোংরা গঙ্গা
দুটোকে মাথায় তুলে হারায় সঙঙ্গা।
বারো মাসে তের পুজো, পাগলের কুম্ভমেলা,
চোখে ঠুলি পরে অলক্ষুণে ধর্ম ধর্ম খেলা।
কলকাতা ঠিক সেই,
যেমন বেয়াড়া ছিল, নেশায় হারিয়ে খেই
ভুল ঠিকানায় বাড়ি ফেরে মাতাল কবিরা
অনায়াসে ছুঁড়ে দিয়ে মনি মুক্তা হীরা
কেউ কেউ বেছে নেয় আটপৌরে জীবনের কাঁসা
কলকাতা এমন শহর, যে শহরে প্রাণ খুলে যায় হাসা
কলকাতা এমনও শহর, যাকে অনায়াসে যায় ভালবাসা।
গ্রামটির মত
তুমি সেই গ্রামটির মত দেখতে
যে গ্রামের আকাশে আর সূর্য ওঠে না, জমে থাকে
গাদা গাদা কাকতাড়ুয়া মেঘ, চাঁদও লুকিয়ে রাখে পোড়ামুখ।
গাছগুলো বুড়ি বেশ্যার মত ন্যাংটো
কোনও ফুল ফোঁটে না কোথাও
এমনকি বসন্ত এলে একটি গন্ধহীন গাঁদাও না।
ঘরবাড়ি পাথরের মত পড়ে থাকে স্যাঁতসেঁতে ক্ষেতের কিনারে
পাথরগুলো পাহাড়ের চারপাশ ঘিরে
পাহাড়গুলো নদীর দুদিকে
একটি পাখিও ডাকে না কোথাও কেবল রাত কুঁড়ে খোঁড়া হাওয়ার
কাঁধে ভর রেখে এক তক্ষক ছাড়া
গাভীগুলো জল-চোখে মরা বেড়ালের দিকে,
মানুষের জলহীন চোখ, ভীত
গ্রামটি দেখতে ঠিক তোমার মত, তোমার চোখের মত
যে চোখে তাকালে কী নেই কী নেই করে ওঠে বুকের ভেতর।
চুনোখুঁটির জীবন
নদী থেকে ভেসে ভেসে কোথাকার খালে এসে
অন্ধকারে, সাপখোপের গা ঘেঁসে, ফেঁসে
জড়ালো জালে।
যন্ত্রের জালে
হালে
বা কলি কালে
এমনই দুর্গতি কপালে
এমনই সংসার লুটোপুটির,
জাল থেকে আলগোছে শরীর সরানো যায়
যদি, মন সরে না চুনোটির।
জন্মদিন
মৃত্যুর দিকে আরেক পা এগিয়ে যাওয়া হল, মৃত্যুর দিকে আরেকটি বছর
স্বপ্নের জন্য আরেকটি ঘর তৈরি হল,
আরেকটি বারান্দা।
মৃত্যুর কাছে যাবে বলে জলস্থল বাড়ে জীবনের,
ঘটিবাটি বাড়ে
মমতার দড়িদড়া দৈর্ঘে প্রস্থে বাড়ে
পাওয়ার সুখের চেয়ে হারাবার অসুখ পেতে ভালবাসে মানুষ।
ভালবেসে ফুল দিও আমাকে যে কোনও দিন,
জন্মদিনে নয়।
ওদিন ফুলের গন্ধ পেলে নিজেকে মনে হয় নিজেরই আস্ত একটি কবর।