ভয়ংকর
বরং বাঘ টাঘ নিয়ে বলো,
কৃষ্ণসার হরিণ নিয়ে কথা বলো।
মানুষের কথা বলো না,
মানুষ খুব ভয়ংকর।
বাঘকে খোঁচাবে তো রক্ষে নেই।
হরিণের গায়ে হাত তুলেছো কী মরেছে।
মানুষকে খোঁচালে চলে,
বোমা মেরে উড়িয়ে দিলেও ঠিক আছে।
যে মানুষ যুক্তি দেখায়, তর্ক করে,
ভাবে,
ভাবনাটা ছড়ায়,
তারা মানুষ তো নয়, আগুন।
আগুন যে করেই হোক নেভাতে হয়।
যে মানুষগুলো জন্তুর মতো,
ভাবনা নেই,
বেশ আছে,
খায় দায় ঘুমোয়,
যেভাবে অন্যরা চলে, সেভাবে চলে।
ওদের বাঁচিয়ে রাখো।
জন্তুরা খায় দায় ঘুমোয়,
আর জঙ্গলের শোভা বর্ধন করে।
এই চিন্তাশক্তিহীন লোকগুলোও
লোকালয় শোভিত
করে আছে বহুঁকাল।
এরাই থাকুক বেঁচে। দুধে ভাতে।
চিন্তকদের কথা ছাড়ো,
কৌশলে বন্দি করো ওদের,
পারলে মেরে ফেলো।
ওদের কথা নয়,
বরং অন্য কথা বলো।
হরিণ টরিণ।
২.৩.০৮
ভারতবর্ষ
ভারতবর্ষ
(সুমিত চক্রবর্তী শ্রদ্ধাভাজনেষু)
ভারতবর্ষ শুধু ভারতবর্ষ নয়, আমার জন্মের আগে থেকেই
ভারতবর্ষ আমার ইতিহাস।
বিরোধ আর বিদ্বেষের ছুরিতে দ্বিখণ্ডিত হওয়া, ভয়াবহ ভাঙন বুকে নিয়ে
উর্ধ্বশ্বাস ছোটা অনিশ্চিত সম্ভাবনার দিকে আমার ইতিহাস।
রক্তাক্ত হওয়া ইতিহাস, মৃত্যু ইতিহাস।
এই ভারতবর্ষ আমাকে ভাষা দিয়েছে,
আমাকে সমৃদ্ধ করেছে সংস্কৃতিতে
শক্তিময়ী করেছে স্বপ্নে।
এই ভারতবর্ষ এখন ইচ্ছে করলেই কেড়ে নিতে পারে
সব ইতিহাস, আমার জীবন থেকে আমার অস্বিত্ব,
আমার স্বপ্ন থেকে আমার স্বদেশ।
নিঃশেষ করতে চাইছে বলে আমি আজ নিঃস্ব হব কেন?
ভারতবর্ষ তো জন্ম দিয়েছে মহাত্মাদের।
আজ তারা হাত রাখছেন আমার ক্লান্ত কাঁধে,
এই অসহায়, এই অনাথ, এই অনাকাঙ্খিত কাঁধে।
দেশের চেয়েও দীর্ঘ এই হাত, দেশকাল ছাপিয়ে এই হাত আমাকে
জাগতিক সব নিষ্ঠুরতা থেকে বড় মমতায় নিরাপত্তা দেয়।
মদনজিৎ সিং, মহাশ্বেতা দেবী, মুকুন্দ দুবে—তাঁদেরই আমি
দেশ বলে আজ ডাকি,
তাঁদের হৃদয়ই আজ আমার সত্যিকার স্বদেশ।
০৫.০২.০৮
ভারতবর্ষের উপহার
হৃদয়ে ভারতবর্ষ ছিল,
তা সয়নি ভারতবর্ষের,
সয়নি বলে শাস্তি দিল আমাকে,
শাস্তি হৃদরোগ।
চোখে ভারতবর্ষের স্বপ্ন ছিল আমার,
তা সয়নি ভারতবর্ষের,
সয়নি বলে শাস্তি দিল আমাকে,
শাস্তি অন্ধত্ব।
আমি যেন হৃদয়ে রোগ ছাড়া আর কিছু লালন করতে না পারি,
চোখে যেন অন্ধত্ব ছাড়া আমার আর না থাকে কিছু।
এত বড় শাস্তি আজ অবধি কেউ আমাকে দেয়নি,
পৃথিবীর সমস্ত ধর্মান্ধ মৌলবাদী মিলেও
যত ক্ষতি আমার ভারতবর্ষ করেছে গত সাড়ে সাত মাসে,
তার এক তিলও করতে পারেনি দীর্ঘ দুযুগ ধরে।
বাংলাদেশ আমাকে দেশ ছাড়া করেছে,
কষ্ট পেয়েছি খুব, দেশ দেশ করে কেঁদেছি,
সেই দেশও আমাকে এত তিল তিল করে হত্যা করেনি,
সেই নিষ্ঠুর দেশও আমাকে মৃত্যুর মতো কঠিন শাস্তি দেয়নি।
ভারতবর্ষকে ভালোবাসার শাস্তি
নিজের জীবন দিয়ে পেতে হল।
এই জীবন থেকে নিবে গেল সমস্ত আলো,
প্রাণরস শুকিয়ে জীবন এখন বাতিল খড়কুটো,
এখন কাঁধের ওপর ভীষণ শকুনের মতো বসে আছে মৃত্যু,
এখন চোখের সামনে দাঁত কপাটি মেলে বীভৎস মৃত্যু,
ভারতবর্ষকে ভালোবাসার সর্বোচ্চ উপহার।
চেয়েছিলাম মানুষের অন্ধত্ব দূর করতে,
চেয়েছিলাম মানুষের মোহর করা হৃদয় থেকে
বৈষম্যের, হিংসের, অন্ধকারের আর অসুস্থতার
শেকড় উপড়ে ফেলে ভালোবাসা রোপন করতে।
আমার চাওয়ার শাস্তি আমাকে দিয়েছে প্রিয় ভারতবর্ষ।
এত বড় মৃত্যু পৃথিবীর শক্তি হয়নি আমাকে দেয়,
গোটা পৃথিবীর চেয়েও বেশি শক্তিমান একা ভারতবর্ষ।
এই শক্তিকে নতমস্তকে পুজো করো তোমরা,
এই ক্ষমতাকে আশীর্বাদ করো দীর্ঘজীবী হতে।
আমি পরাজিত হলে যত জয় ধর্মান্ধের হবে,
তার চেয়ে বেশি হবে ভারতবর্ষের।
আমার আজ মৃত্যু হলে যত জয় ধর্মান্ধের হবে,
তার চেয়ে বেশি হবে ভারতবর্ষের।
আজ জয়ধ্বনি করো ভারতবর্ষ,
আজ সময় হয়েছে জয়ধ্বনি করার,
এক অনাথ অসহায় লেখককে,
এক মানবিক মানুষকে
এক উচ্ছল উজ্জ্বল জীবনকে
মৃত্যু উপহার দিয়ে সাড়ে সাত মাসের লড়াইয়ে
তুমি ভয়ংকরভাবে জিতে গেছো ভারতবর্ষ,
তোমাকে অভিবাদন।
১৬.০৩.২০০৮
মাটি
যার দিয়ে অভ্যেস, হাত পেতে কিছু নিতে গেলে আঙুলগুলো
গুটিয়ে আনে সে,
যার নিয়ে অভ্যেস, আঙুল ছড়ানোই থাকে তার, আঙুলের মাথায়
এক একটা হিরের মুকুট পরবে বলে, মনে মনে প্রার্থণা করে সে পাঁচশ আঙুল।
তুমি যখন ভালোবাসা দেবে বলছো আমাকে,
মুহূর্তে তোমার মুখখানাকে মনে হলো কোনওদিন দেখিনি এর আগে,
চারদিক কেমন, এমনকী কণ্ঠস্বরও বড় অচেনা ঠেকলো, কোনও অদ্ভুত গ্রহে
আমাকে ছুঁড়ে দিল, সহস্র আলোকবর্ষ দূরে ছুঁড়ে দিল কেউ।
গাছের পাতাগুলো বাড়িঘরের মতো, বাড়িঘরগুলো শুকনো নদীর মতো,
সাপের মতো মাথার আকাশ, চাঁদ সূর্য কিছু নেই,
রক্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে কোত্থেকে কেউ জানে না।
আমাকে কিছু দেবে শুনে ভয়ে নিজের ভেতরে সেঁধিয়ে
কুন্ডুলি পাকিয়ে বসে আছি।
সমুদ্র সাঁতার কাটা আমি কুয়ো খুঁজছি লুকোতে
পেয়ে অভ্যেস নেই আমার, আমাকে দিও না কিছু।
তার চেয়ে চাও, কী চাই বলো,
জীবন উপুড় করে দেব।
পাওয়ার কথা ভুলেও তুলোনা। না পাওয়ার জন্যই জন্মায় কেউ কেউ।
পেয়ে সবার অভ্যেস থাকে না। ব্রহ্মাণ্ডভ্রমণ করা আমাকেও কী রকম
কেঁচো করে নুন ছিটিয়ে গর্তে পাঠিয়ে দিচ্ছ,
অর্ধেক আকাশ দেবে বলেছো, এ সওয়া যায়, ভালোবাসা দেবে
কখনও বোলো না, ও নিয়ে মিথ্যেচার করে মানুষ মেরো না।
ঝুড়ি ঝুড়ি ভালোবাসা নিচ্ছ নাও,
তোমার কাছে কিছু তো চাইনি,
তুমি তো পুরুষ শত হলেও, ভালোবাসা কী করে দেবে শুনি!
সবার হৃদয়ে তো ও জিনিসের বীজ নেই। মাটি তো উর্বর নয় সবার।
সেপ্টেম্বর ২০০৭