রেখে এসো কলকাতা শহরে লাশ।
জীবিত নেবে না আমাকে ও শহর।
মরলে নেবে তো? প্রিয় কলকাতা।
১৩.০২.০৮
বইমেলা
সারা বছর বসে থাকি এই মেলাটি আসবে বলে।
এই মেলাটির অলি গলির ভিড়ের মধ্যে
নতুন বইয়ের গন্ধে ঘ্রাণে, ধুলোবালির ধুসর হাওয়ায়,
হারিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখি। এই মেলাটি আসবে বলে
আকাশপারের উতল হাওয়ায় ইচ্ছে মতো ঘুড়ি ওড়াই।
বছর বছর এই মেলাটি আসে বলেই স্যাঁতসেঁতে এক ঘরের কোণেও
খুব গোপনে ভীষণ সুখে, স্বপ্নসহ বেঁচে থাকি।
আমার তো আর পুজো-আচ্চা, ঈদ-বড়োদিন নেই,
আমার একটি মেলাই আছে, প্রাণের মেলা,
এই একটি মেলায় মানুষ দেখি কাছের মানুষ,
সাত-নদী-জল সাঁতরে তবু একটুখানি ছুঁতে আসে।
এই মেলাটিই ধর্মকর্ম, ধূপের কাঠি, ধানদুব্বো।
এই একটি পরব, একটি সুখ-ই, নিজের জন্য তুলে রাখি।
শিল্প-মেলায় আগ্রহ নেই, জুয়োর মাঠ, ব্যবসা পাতি,
সন্ধে হলে উৎসবে নেই, ককটেলে নেই।
এই একটি মেলাই একমাত্র।
এই মেলাটিই শৈশব দেয়, কৈশোর দেয়,
ব্রহ্মপুত্র পাড়ের সেসব এঁটেল মাটির আনন্দ দেয়।
এই মেলাটির সারা গায়ে মাতৃভাষা,
মাথার ওপর স্নেহসিক্ত মায়ের আঁচল।
এই মেলাকেই অন্য অর্থে জীবন বলি।
এটিও তুমি কেড়ে নিলে?
স্বদেশহারা স্বজনহারা
সামান্য এই সর্বহারার সবটুকু সুখ
বুকের ওপর হামলে পড়ে আঁচড়ে কামড়ে
এক থাবাতে ছিনিয়ে নিতে পারলে তুমি ভারতবর্ষ?
দাঁত বসিয়ে কামড় মেরে ছিঁড়েই নিলে যা-ছিল-সব?
হৃদয় বলতে কিছুই কি নেই ভারতবর্ষ?
হৃদয় তবে কোথায় থাকে ভারতবর্ষ?
০১.০৩.০৮
বাঁচা
অথৈ অন্ধকারে, অদ্ভুত অজ্ঞাতবাসে
পড়ে থাকা অসার আমার কাছে কেউ নেই আসে।
চাঁদের দিকে চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকি,
মানুষের কাছে, আশ্চর্য, চাঁদও শিখেছে ফাঁকি।
জীবনে অমাবস্যা ঢেলে দিয়ে পূর্ণিমা পালায়,
পেছনে দৌড়ে দৌড়ে কত ডাকি, আয়, ফিরে আয়।
চাঁদের কী আসে যায়!
মানুষের কাছে দুদণ্ড ইদানীং মানুষই থাকে না,
দূরত্ব খোঁজে আত্মার আত্মীয়, জন্ম জন্ম চেনা।
দক্ষিণ থেকে উতল হাওয়ারা ছুটে ছুটে ছুঁতে আসে,
হাওয়াই ভরসা ছিল অতপর অজ্ঞাতবাসে।
হা কপাল! হাওয়াও উজার করে হাহাকার দিল,
জীবনে যা কিছু ছিল বা না-ছিল, নিল।
আকাশের কাছে কিছুই চাই না, ও আর কী দেবে?
দিলে এক শূন্যতা দেবে!
ও আমার যথেষ্ট আছে, ও নিয়েই আছি,
ও নিয়েই ভারতবর্ষের অজ্ঞাতবাসে বাঁচি।
২৫.০২.০৮
বাঁচো
সত্য বললে কিছু লোক আছে খুব রাগ করে,
এখন থেকে আর সত্য বোলো না তসলিমা।
গ্যালিলিওর যুগ নয় এই যুগ, কিন্তু
এই একবিংশ শতাব্দিতেও
সত্য বললে একঘরে করে সমাজ,
দেশছাড়া করে দেশ।
গৃহবন্দি করে রাষ্ট্র,
রাষ্ট্র শাস্তি দেয়,
সত্য বোলো না।
তার চেয়ে মিথ্যে বলো,
বলো যে পৃথিবীর চারদিকে সূর্য ঘোরে,
বলো যে সূর্যের যেমন নিজের আলো আছে, চাঁদেরও আছে,
বলো যে পাহাড়গুলো পৃথিবীর গায়ে পেরেকের মতো পুঁতে দেওয়া,
বলো যে পুরুষের পাঁজরের হাড় থেকে নারীকে বানানো,
বলো যে নারীর ঘাড়ের কী যেন একটা হাড় খুব বাঁকা।
বলো যে শেষ-বিচারের দিনে মানুষেরা সব কবর থেকে,
ছাই থেকে, নষ্ট হাড়গোড় থেকে টাটকা যুবক যুবতী হয়ে
আচমকা জেগে উঠবে, স্বর্গবা নরকে অনন্তকালের জন্য জীবন কাটাতে যাবে।
তুমি মিথ্যে বলো তসলিমা।
বলো যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অগুনতি গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্ররাজি মিথ্যে,
মাধ্যাকর্ষণ শক্তি মিথ্যে, মানুষ চাঁদে গিয়েছিলো, মিথ্যে।
মিথ্যে বললে তুমি নির্বাসন থেকে মুক্তি পাবে,
তুমি দেশ পাবে, প্রচুর বন্ধু পাবে,
হাত পায়ের শেকল খুলে দেওয়া হবে, তুমি আলো দেখবে, আকাশ দেখবে।
একা একা অন্ধকারে হাঁমুখো মৃত্যুর মুখে ছুঁড়ে দেবে না তোমাকে কেউ।
তুমি সত্য বলো না তসলিমা, বাঁচো।
২৫.০১.০৮
বাঙালি
আমার মতো বাঙালিকেও
ভারতবর্ষ বাংলাদেশি বলে।
বাংলাদেশি বস্ত্র হয়, অস্ত্র হয়,
বাঙালি আবার বাংলাদেশি হয় কী করে?
বাঙালি কি একাত্তরে জন্মেছে ওই দেশে?
নাকি হাজার বছর লালন করছে জাতিসত্তা
হাজার বছর বইছে রক্তে সংস্কৃতি।
বাংলাদেশ আজ নাম পাল্টে ভুতুমপেঁচা হলে?
বাঙালি কি ভুতুমপেঁচি হবে?
পূর্ববঙ্গের নাম বদলে পূর্ব পাকিস্তান,
সে নামটিও বদলে গিয়ে বাংলাদেশ হল,
দেশ পাল্টায়, নাম পাল্টায়,
ধর্মকর্ম অনেক সময় ভীষণরকম পাল্টে যায়,
পলিটিক্স তো পাল্টে ফেলে
এক তুড়িতে অনেক কিছু।
ঐতিহ্য কি পাল্টে যায়?
অস্তিত্ব কি অস্ত যায় দেশের নামের শেষে?
নাম পাল্টে বাংলাদেশ বাঙাল হলেই শুধু
বাঙালিকে সঠিক নামে ডাকবে নির্বোধেরা।
২৯.০২.০৮
ভয়
বন্দুক হাতে সেনারা ঘুরছে, চারদিকে,
মাঝখানে নিরস্ত্র আমি।
সেনারা কেউ আমাকে চেনে না, নিরস্ত্র নারীর দিকে
মাঝে মাঝে অদ্ভুত চোখে তাকায়।
কেউ জানে না এখানে হঠাৎ কী কারণে আমি!
ময়লা শরীর, মলিন কাপড়চোপড়, মনমরা উড়ুককু চুল,
গায়ে পায়ে শেকল নেই আমার, কিন্তু কোথাও না কোথাও আছে,
টের পায় ওরা, চাইলেও দু পা এগোতে পারবো না টের পায়।
ওদের চোখের তারায় বীভৎস এক টের পাওয়া দেখি।
বন্দুকগুলো, জানে ওরা, ভয় দেখাতে,
বেয়নেটগুলো, বুটজুতোগুলো ভয় দেখাতে।
ভয় না পেলে ওরা আঘাত পাবে খুব,
কাউকে আঘাত দেওয়ার অধিকার আমার আইনত নেই।
ওরা যদি ওপরতলায় খবর পাঠিয়ে বলে, এর তো দেখি ডর ভয় নেই।
শেকল ভাঙতে চাইছে প্রাণপণে!
ওপরতলা আমাকে নির্ঘাত ফাঁসি দেবে। ফাঁসির দিনক্ষণ ঠিক হলে,
খেতে দেবে মাছের ঝোল, ইলিশচিংড়ি ইত্যাদি।
যদি বলি, খাবো না!
ফাঁসির মঞ্চে উঠে যদি একটাও দীর্ঘশ্বাসনা ফেলি?
গলায় দড়ি পরাবার পরও যদি ভয় না পাওয়ার দুঃসাহস আমার হয়?
০৪.০১.০৮