কোনও কবিকে কি কখনও গৃহবন্দি করেছিলো কেউ?
কোনও কবিকে কি কখনও গৃহবন্দি করা হয়েছিলো কখনও?
কবি নিয়ে রাজনীতি অনেক হয়েছে হয়তো,
কবি নিয়ে ইট পাটকেলও হয়েছে,
আগুন হয়েছে,
কবিকে কেউ গৃহবন্দি করেনি, কোনও দেশ।
এই ভারতবর্ষ, এই সভ্যতা, এই একবিংশ শতাব্দি, কবিকে গ্রহণ করেছিলো,
মুহূর্তে বর্জনও করেছে এর বালখিল্য ধর্ম, এর নিষ্ঠুর রাজনীতি।
কোনও অপরাধ করেনি কবি, কবি আজ গৃহবন্দি।
কবি এখন আকাশনা দেখে দেখে জানে না আকাশ কেমন দেখতে,
মানুষ না দেখে দেখে জানে না মানুষ কেমন,
কবির সামনে এক জগত অন্ধকার ফেলে চলে গেছে তারা,
তারা আর এ পথ মাড়াবে না বলে গেছে।
আজ একশ পঞ্চান্ন দিন কবি গৃহবন্দি,
একশ পঞ্চান্ন দিন কবি জানেনা
হৃদয় আছে এমন কেউ পৃথিবীতে আর বাস করে কি না,
একশ পঞ্চান্ন দিন কবি জানে না, কবি বেঁচে আছে কি নেই।
কার কাছে সে তার দিনগুলো ফেরত চাইবে,
অন্ধকার সামনে নিয়ে বসে কবি ভাবে,
কে তার জীবনে দেবে রোদ্র ফিরিয়ে,
কে তাকে নিভৃতে জীবনের মন্ত্র দেবে কোনও একদিন।
অন্তত সান্ত্বনা দিতে কবিকে তো বলুক মানুষ,
এর আগে গৃহবন্দি ছিল যারা, অধিকাংশই কবি ছিল–
নিঃসঙ্গতা থেকে মনে মনেও কিছুটা মুক্তি পাক সে। ১৯.০১.০৮
খুব উঁচু মানুষ
খুব উঁচু মানুষ
(শিবনারায়ণ রায়কে শ্রদ্ধাঞ্জলি)
একটি মানুষ ছিলেন আমার পাশে,
আমার যে কোনও দুঃসময়ে তিনি পাশে ছিলেন,
পৃথিবীর যে প্রান্তেই ছিলাম, ছিলেন,
নির্ভীক লড়াকু মানুষটি প্রশাসন আমার পাশে নেই,
প্রতিষ্ঠান পাশে নেই পরোয়া করেননি, তিনি ছিলেন।
এত উঁচু মানুষ ছিলেন তিনি, তার নাগাল পাওয়া,
তার বিদগ্ধ চোখদুটোয় তাকানো সহজ ছিল না কারও।
এই সেদিনও, আমার এই ঘোর দুঃসহ বাসে,
টুকরো টুকরো হয়ে আমার আর
আমার স্বপ্নগুলোর ভেঙে পড়ায়
এতটুকু কাতর না হয়ে বলেছিলেন,
লেখো, যেখানে যেভাবেই থাকো,
যে দেশেই, যে পরিস্থিতিতেই, লিখে যাও,
তোমার জীবন হলো তোমার কলম।
শিথিল হয়ে আসা হাতের কলম আমি আবার শক্ত মুঠোয় ধরেছি,
মানুষটি ছিলেন পাশে, আগুনের মতো ছিলেন।
গোটা পৃথিবীও যখন আমাকে ত্যাগ করে সরে যায়,
তখনও জানি, একজনও যদি কেউ সঙ্গে থাকেন, তিনি তিনি।
উঁচু মানুষেরা হারিয়ে যাচ্ছেন একা একা।
নির্ভীক নিঃস্বার্থর সংখ্যা ক্রমে ক্রমে কমে কমে শূন্য হচ্ছে,
এই ভীতু আর স্বার্থান্ধ আর ক্ষুদ্রদের পৃথিবীতে বড় একা হয়ে যাচ্ছি,
তাদের চিৎকারে, দাপটে বধির হচ্ছি,
তাদের রক্তচক্ষু দেখে দেখে যোবা।
উঁচু মানুষটি নেই,
শীতার্ত অন্ধকার গ্রাস করে নিচ্ছে আমার নিঃসঙ্গ জগত।
২৬.০২.০৮
গুডবাই ইন্ডিয়া
একটা কথা আমার মুখ থেকে শুনবে বলে সবাই বসে আছে।
একটা বাক্য শুনবে বলে বসে আছে,
দুটো শব্দ শুনবে বলে,
দুটো মাত্র শব্দ।
আতঙ্কে,
ভয়ে,
বিবর্ণ হয়ে,
কাঠ হয়ে,
যেন বলে ফেলি একদিন, গুডবাই ইন্ডিয়া।
দিন যাচ্ছে,
সপ্তাহ শেষ হচ্ছে,
মাস পেরোচ্ছে, মাসের পর মাস।
আমার মুখের দিকে কয়েকশ রক্তচক্ষু
কয়েকশ বছর আগে বন্ধ হয়ে থাকা পুরোনো ঘড়ির কাঁটার মতো স্থির,
ডানে বামে ওপরে নিচে সর্বত্র
বাদুরের কানের মতো উৎসুক কান,
জগতের সবচেয়ে মধুর শব্দদ্বয় শুনবে বলে,
গুডবাই ইন্ডিয়া।
আমি এখনও উচ্চারণ করছি না শব্দদুটো,
এখনও বিশ্বাস করছি সত্যে।
সততায়।
বিশ্বাস করছি সৌন্দর্যে।
শিল্পে।
সহমর্মিতায়।
যেদিন আমাকে উচ্চারণ করতে হবে শব্দদুটো,
যদি আমাকে করতেই হয়–
দুচারটে ঘৃণাই যেদিন উথলে উঠে সুনামি ঘটাবে,
যদি ঘটায়ই–
মনুষ্যত্ব পায়ে পিষে ধর্মান্ধতার নিশান
ওড়াবে মানুষ শহর নগর জুড়ে যেদিন–
যেদিন আমারই রক্তের ওপর আমি লাশ হয়ে ভেসে থাকবো,
ঠুকরে খাবে একপাল শকুন আমার ফুসফুস–
যেদিন আমাকে উচ্চারণ করতেই হবে শব্দদুটো,
সেদিন যেন গভীর রাত্তির হয়,
আমাকে যেন দেখতে না হয় দেশটির মুখ,
দেখতে না হয় দুপুরের শান্ত পুকুর,
আমগাছতলা, উঠোনের রোদ্দুর,
যেন ভুলে যাই দেশটির সঙ্গে কখনও আমার
কোনও আত্মীয়তা ছিল।
আমি এখনও উচ্চারণকরছি না শব্দদুটো,
এখনও প্রাণপণে পাথর করে রেখেছি জিভ।
আমি উচ্চারণ করতে চাইছি না
এখনও চাইছি ভালোবাসার জয় হোক।
০৪.০৩.০৮
ঘাস
তার চেয়ে ঘাস হয়ে যাই চল,
তাকে বলেছিলাম, সেবলেছিল চল।
বলেছিল, তুমি আগে হও, আমি পরে।
বলেছিল, তোমার ডগায় ছোট চুমু খেয়ে তারপর আমি।
ঘাস হলাম, সে হল না। আমাকে পায়ে মাড়িয়ে অন্য কোথাও চলে গেল।
কোথায় কার কাছে কে জানে! ঘাসের কি সাধ্য আছে খোঁজ নেয়!
কোনও একদিন বছর গেলে শুনি
কোথাও সে বৃক্ষ হতে চেয়ে চেয়ে হয়েছেও,
আমি ঘাস, ঘাসই রয়ে গেছি, ফুল ফোঁটাই, দিনভর আকাশ দেখি, বাঁচি।
এদিকে দুটো লোক ঘুরঘুর করছে, বৃক্ষ হবে, বৃক্ষ হবে?
সেবুঝি পাঠালো বৃক্ষ হতে? একলা লাগছে তাহলে এতদিনে?
লোক দুটো চাওয়াচাওয়ি করে। বলে, কার কথা বলো?
নাম বলি। জীবনে শোনেনি নাম।
তবে কেন বৃক্ষ হতে বলছো আমাকে?
হেসে বললো, দেখতে রূপসী হবে, ফলবতী হবে।
দূর দূর করে তাড়াই তাদের। আমার ঘাসই ভালো।
ঘাস হলে দুঃখ রাখার জায়গা অত থাকে না,
ঘাস হলে কার সাধ্য আছে গায়ে চড়ে চড়ে
আচড়ে কামড়ে রক্তাক্ত করে।